চক্রব্যূহ

শ্মশানের পশ্চিম অংশটা ঢালু এবং নদীগামী। অসংখ্য গাছগাছালিতে ছাওয়া অন্ধকার ঘন বন। মড়া পোড়াতে হঠাৎ কাঠে টান পড়লে দু একটা গাছ কেটে চিতা সাজানো হয়। গাছের ফলমূলের কোন দাবীদার নেই। বেশিটা পাখিতে খায়, নষ্ট করে। বাকিটা শ্মশানপালক পেড়ে নেয়। নিজে রাখে। বিলি করে। কখনও তালসুপুরি হরিতকি বিক্রি করে দেয়।

 

নিচে শ্মশান ছুঁয়ে বয়ে গেছে নদী মধুমতি। সেখানে খেজুরগাছ বাঁধানো নতুন ঘাট দেখা যাচ্ছে। প্রতি বছর বর্ষায় বৃষ্টি বাদল বন্যায় এসব ঘাট ভেসে যায় কিংবা রোদে জ্বলেপুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে পচে ভেঙে পড়ে।

 

ইচ্ছে করলে এ অঞ্চলের হিন্দু ব্যবসায়ীরা নদীর কূল জুড়ে দশ কুড়িটা শান বাঁধানো বিশাল ঘাট বানাতে পারে। তাদের রোজকার যাপিত জীবনে, জন্ম-মৃত্যু এবং ধর্মীয় সংস্কৃতির  সাথে নদি এবং বহতা জলের সম্পর্ক অনেক গভীর এবং নিবিড় । তাছাড়া মধুমতির জল পবিত্র ও পূণ্যময়। এক সময় বাংলাদেশে মা গঙ্গার প্রবাহিতা প্রধান ধারাকন্যা ছিল স্রোতস্বিনী গৌরী ও মধুমতি।

 

কিন্তু কী হবে এসব ঘাট বানিয়ে! কাদের জন্যেই বা বানাবে! এদেশ থেকে হিন্দুরা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ! এখনও যে কয় ঘর টিকে আছে তারাও খুঁটি গেঁড়ে রেখেছে ভারতের এখানে সেখানে। গোরুখোর মোছলমানদের সাথে আর কতদিন একসাথে থাকা যায় !

 

সত্যি বলতে কি এদেশে থাকতে দয়ালের মনও মানে না।

 

আনন্দফুর্তিতে পূজোপাঠ করা যায় না। মন খুলে হরিনাম সংকীর্তন করা যায় না। উৎসব আনন্দযজ্ঞে ভজন কীর্তনের আসর বসানো যায় না। বৈষ্ণবদের আখড়া ভেঙে গেছে। পূজাপার্বণে মেলা হয় না। হলেও যাত্রাপালা বন্ধ। বাঙালি বলে গর্ব করে অথচ পয়লা বৈশাখ, পয়লা ফাল্গুন ছাড়া অন্য কোন মাসের আদর কদর পালন সংস্কৃতির বালাই নেই এদের মধ্যে। তাছাড়া আজকাল পূজার সময় প্রতিমা ভাঙা যেন মোছলমানদের সওয়াবের কাজ হয়ে গেছে। আর আছে জবরদখল। কোনদিন হয়ত এই শ্মশান দখল হয়ে যাবে। যেমন গুজরাটে হিন্দুদের মন্দির হয়ে গেছিল বাবরি মসজিদ!

 

দেশ জুড়ে আছে শুধু ওয়াজ আর  ওয়াজ। এই হুজুর তো সেই হুজুর ! বাইট্টা, কাউঠা, বাচ্চা, লুইচ্চা হুজুরে ভরে গেছে। গ্রামের মাঠে দশ বারোটা মাইক বসিয়ে সারা বছর ওয়াজ হয়। সব হুজুরের এক চোপা, নারী তুই অন্দর যা!

রাগের চোটে মুখ বেঁকে যায় দয়ালের। সে কী শুধু শুধু হিন্দুরাষ্ট্র চায়!

 

হাতমুখ ধুতে নদীতে চলে আসে। এ নদীর আত্মা মরে গেছে। ভাটার সময় স্খলিত বসনের মত জল নেমে গেলে স্তনবৃন্তের মত জেগে উঠে ডুবোচরের মাথা। ওপারের তীর এপারে সরে এসেছে। তাতে ওপারের শন-শটি, হোগলা ঝোপের সাথে কোথাও আকন্দ আর শেয়ালকাঁটার জঙ্গল একেবারে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এরপর শুরু হয়েছে চষা ক্ষেতের বিস্তার। ক্ষেতের আইলে ধইঞ্চাগাছের সীমানা। যদ্দূর চোখ যায় কেবল বাদাম আলুর ক্ষেত আর ক্ষেত।

 

হঠাৎ চমকে উঠে দয়াল। নদীর জল লালরঙে রেঙে যাচ্ছে। আকাশ দেখে তাজ্জব হয়ে যায়। কী আশ্চর্য! আগুন হয়ে ফুটছে আকাশ। গ্যালন গ্যালন পেট্রল ঢালা আগুনেমেঘ ঢেকে ফেলেছে আকাশের পশ্চিম দিক। লেলিহান শিখার মত পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে জ্বলন্ত ঢেউ। মেঘ পুড়ে নীলাভ ভস্মচ্ছটা পাগলপারা ছুটে যাচ্ছে। কখনও বা মোচড় খেয়ে ধমধমিয়ে ফুলে উঠছে। কয়েক টুকরো হলুদমেঘ কাঁপতে কাঁপতে ঝাঁপিয়ে পড়ল জ্বলন্ত লালমেঘদলের অগ্নি-গহ্বরে। মুহূর্মুহূ বদলে যাচ্ছে নদীর রঙ। বিস্ফারিত আবেগে ফুলেফেঁপে উন্মুখ হয়ে উঠেছে জলরাশি। রক্তাক্ত আকাশের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছে এতদিন পরে গতি পাওয়া রুদ্ধ বদ্ধ নিস্তেজ জলস্তম্ভ। সে জলস্তম্ভের গায়ে ভেসে উঠছে আগুনমেঘের অপরূপ রূপকচ্ছটা। সে ছটায় কল্পতরু হয়ে উঠেছে ওপারের বৃক্ষরাজি। চষাক্ষেতের চৌকো অধিকারে ভেসে উঠছে ভয়তাড়িত কাকদের উদ্বিগ্ন উড়ালের অলৌকিক ছায়াপাত।

ওপারে জ্বলছে কী ? চিতা নাকি ! এত আগুন কেন !

 

মুখ মুছে বিস্ময় কাটাতে মাথা ঝাঁকিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। একটু আগে যে পথ বেয়ে ঘাটে এসেছিল সে পথটা, যেন কোন যুদ্ধশেষের অপ্রাকৃত নীরব নির্জন প্রান্তরেখা। গাছগুলো স্থির, পাখিরা নির্বাক। রোদ্দুর ঘষে গেছে। লতাপাতা পাখিদল অচঞ্চল নিশ্চুপ।

 

আশফাক আর রফিক এরকম আকাশ দেখলে মাছ ধরা বন্ধ করে দিত। ওরা  বলত, ওদের নবীজির আদরের দুই নাতি হাসান হোসেনের রক্ত ভেসে উঠেছে আকাশে। কারাবালার প্রান্তরে এজিদের সেনাপতি সিমারের হাতে —

 

চুদিরভাই। সারা দুনিয়াডা মোছলমানে ভরি গেছে। এহন আকাশডারও দখল নিতি চাতিছে শালারা। মনে মনে ধুমায় গালি দিয়ে ভিজে লুঙ্গি ছেড়ে বিড়ি ধরিয়ে ওদের পাল্টি দিত দয়াল, জানিস ত বাড়া। কুরুক্ষেত্তের যুদ্ধি যারা মরি গেছে এগুলান হতিসে তাগের রক্ত। শুনিস নাই ভীম অজ্জুন যুদিষ্টিরগের নাম! বিশ্বেস না হলি টেলিভিশনে দেখি নিস ।

 

ঘাট থেকে ফিরে দয়াল পেট চেপে বসে পড়ে । ক্ষুধার আগুনে ধিকাচ্ছে ওর আহত শরীর। তিনদিন ভাত ছাড়া।

দ্বিজুদাদুর সমাধিতে এসে আশ্রয় নিয়েছে পাঁচ মে। রাত্তিরে। বেশ কায়দার সমাধি। একজন মানুষ জীবনভর এখানে থাকতে পারে। চাল ডাল সাথে থাকলে বাইরে না গেলেও চলে! শ্মশানে ত আগুনের অভাব নাই! যদিও এদেশে হিন্দুর সংখ্যা কম তাই মরার রেটও কম। রেগুলার মাত্র একটা দুটো লাশ আসে। চিতার আগুনে বিড়ি ধরিয়ে খাওয়ার অন্যরকমের টেস্ট আছে। ধনীলোকদের ঘি চন্দন আর গরিবদের কেরোসিন পোড়া গন্ধে বিড়ি সিগ্রেটের ঘ্রাণ পালটে অন্যরকমের হয়ে যায়।

 

সত্যি ত ভুল হয়ে গেছে। কিছু চাল ডাল আলু — কিন্তু তখন ত জান বাঁচানো ফরজ ছিল! রাতারাতি গা ঢাকা না দিলে ছাতু হয়ে যেত দয়াল। সাজানো কড়ি যে এমন উলটে যাবে কে পেরেছিল ভাবতে !  তাছাড়া ও ভালই জানত বাংলাদেশে ওর ভাতের অভাব হবে না।

 

যদিও বছর দশেক আগে এক কেস খেয়েছিল। সে কারণে এদেশে এলেও পালিয়ে থাকে। তবে অই কেস এখন হালকা হয়ে গেছে। যে দিয়েছিল সেই দাপুটে নেতা দুর্নীতির দায়ে বিদেশে পালিয়ে গেছে। ধম্মের কল মাঝে মধ্যে ফুড়ুৎফাড়ুৎ লড়েচড়ে!

 

দশ বছর আগে দুর্গাপূজোর সময় নেতার খাতিরযত্ন হয়নি বলে সাগরেদদের পাঠিয়ে মণ্ডপ ভাঙচুর করে মুতে গেছিল! অশ্লীল গালিগালাজের সাথে মেয়েদের গায়ে হাত দিয়ে মালুর আলু বলে জ্বালাচ্ছিল শালারা।

 

দয়ালের আর সহ্য হয়নি। রাগের মাথায় ধুনুচি নাচার হাঁড়ি ভেঙে একজনের নাড়িভুঁড়ি বের করে দিয়েছিল। মরলে মরব আগে দ্যাখ শুয়োরের বাচ্চারা কেমন লাগে।

 

কেস হবে তাতো জানতই। হিন্দু পাড়া ভাঙচুর লুটতরাজ করে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতেও পারে। কিন্তু ঘটনা ত ঘটে গেছে। পালাতে হবে। হাতে ছিল একরাত। এক ঘণ্টার ভেতর শহর ছেড়ে সীমান্তের পথে বেরিয়ে পড়েছিল। বন্ধু পলাশ বাগেরহাট পেরিয়ে খুলনা পর্যন্ত দিয়ে গেছিল। কিন্তু ও বুদ্ধি করে চেনা সীমান্ত ছেড়ে অন্যপথ ধরেছিল। পরদিন দুপুরে  ভারতের মাটিতে পা দিয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিল, যতদিন বাঁচবে মোছলমানদের নিকেশ করাই হবে ওর কাজ।

 

দয়াল পরে জেনেছে অই ঘটনার পর প্রায় কুড়িজন হিন্দুছাত্র ভারতে এসে এখানকার ইশকুলে ভর্তি হয়েছিল। হিন্দু পরিবারের কেউ তাদের উঠতি কিশোর তরুণ ছেলেদের বাংলাদেশে রাখতে নিরাপদ বোধ করেনি। কিন্তু দয়াল ত পড়াশুনা ছেড়েছে সেই কবে। বয়েসও ওদের চেয়ে অনেক বড়। মধ্যপাড়ার বাজারে নিজের ধরা মাছ বিক্রি করত বাবা জ্যাঠা কাকাদের সাথে। এদেশে এসেও তাই শুরু করেছিল।

 

তারপর ইচ্ছে করেই ঢুকে গেছিল রাজনীতির চক্রে। সারাক্ষণ বাংলাদেশের ক্যাংলা শুনতে কাঁহাতক ভাল লাগে! দিনরাত ভয়। কে জানে কখন গলাধাক্কা দিয়ে পার করে দেয় বাংলাদেশে! শুনেছে, পত্রপত্রিকা, টিভিতে দেখেছেও কি এক ক্যাম্প বানিয়েছে। পুলিশ পাঠিয়ে বাংলাদেশের ক্যাংলাদের সেই খোঁয়াড়ে ভরার জন্যে।

 

গামছার ব্যান্ডেজ সরিয়ে ডান পাশের পেট দেখে দয়াল। অনেকখানি চিরে গেছে। থেকে থেকে রক্ত বেরুচ্ছে। মাটি চেঁচে পার হতে গিয়ে অকামটা ঘটে গেছে। কে জানত মাটির ভেতর সেঁধিয়ে আছে তারকাঁটা। ওষুধ না দিয়ে এভাবে থাকলে নির্ঘাত মরে যাবে। শ্মশানের শিয়াল কুকুর চিল শকুন ছিঁড়ে খাবে ওর শরীর। তাছাড়া শ্মশানের পশ্চিম দিকে নরম মাটির নিচে আছে লাশখেকো কাছিমের দল। অনেক মাংস পাওয়া যায় বলে এরা দল বেঁধে মোছলমানদের গোরস্তানেও থাকে। অনেক সময় শ্মশানে আধপোড়া লাশের টুকরো, হাড়গোঁড় পড়ে থাকে। শিশুদের লাশ পুঁতে দেওয়া হয়। শালারা ভোম ভোম করে লাশ খায় আর মানুষিক গলায় চেঁচিয়ে ভয়ার্ত করে তোলে শ্মশানের পরিবেশ। এভাবে মরার চেয়ে রিস্ক ওকে নিতেই হবে ! বাঁচতে হবে। অনেক কাজ। মরলে ত চলবে না।

 

বাংলাদেশের সিম মোবাইলে ভরে এসএমএস করে, পলুরে স্তেপানরে নিয়ি তাড়াতাড়ি আয়। খিদেয় মরি যাতিছি রে ভাডি।

 

এখন কী আসতে পারবে পলাশ! একে করোনা তায় রমজান মাস। ঘণ্টা দুয়েক পরেই ইফতার। আজকাল কাঠমোল্লা হুজুরদের সাথে চলে ফিরে। স্বপ্ন দেখে ইসলামি রাষ্ট্র বানানোর। এই পলাশই প্রথমে দয়াল এরপর ওদের পুরো পাড়াটাকে ভারতের সুন্দরবন অঞ্চলে পালাতে সাহায্য করেছিল।

জানতে পেরে সেই নেতা পুলিশ লেলিয়ে দিয়ে দুই দুটো বছর খুব ঝামেলা করেছিল পলাশকে।

বাল্যবন্ধুর জন্যে ওর কি সেই মন এখনও আছে !

এবার দয়াল হাসে খুচখুচ, তোরা ত রাজাকারই। দেশডারে পাকিস্তান বানাতি চাতিছিস। বাঙালি বুঝনদার আছে বুঝলি।

দ্বিজদাদুর সমাধি ছুঁয়ে উঠে গেছে একটা ঝাপালো বেলগাছ। সেদিকে তাকিয়ে শীত লাগতে শুরু করে দয়ালের। জ্বর আসবে নাকি! কিসের জ্বর? তবে কি!

 

ইচ্ছে করে গলা খেঁকিয়ে কাশি দেয়। হাতের নাগালের বুনোগাছপালা ছিঁড়ে গন্ধ শোঁকে। আমরুলপাতা চিবিয়ে খায়। নাহ স্বাদগন্ধ সব পাচ্ছে।

 

পশ্চিমবঙ্গের ইলেকশনে যেভাবে দাপিয়ে বেড়িয়েছে তাতে যে কোন সময় করোনা হয়ে যেতে পারে। ক্ষুধাতৃষ্ণা ব্যথা আর দুশ্চিন্তায় দয়াল কিছুতেই ঝিমিয়ে পড়তে চায় না। ওর চোখে ভাসে হিন্দুরাষ্ট্র ভারত প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। বিরুদ্ধবাদীদের ঘরবাড়িতে জাল ফেলার মত কাঁচা পেট্রল ছিটিয়ে আগুন দেওয়ার ছন্‌ছনাছন্‌ শিহরণ।

 

আগুন আগুন। কারা যেন ওর নাম ধরে গালি দেয়। তারপরেই নির্দেশ আসে, পালা। পালিয়ে যা। খেলা হবে। হবেই।

 

দয়াল পালাচ্ছে। আগুন তাপ ঝাঁঝালো গন্ধ, চিৎকার, কান্না, ধাওয়া পেরিয়ে ছুটছে—আবার সেই ঘৃণার দেশে! কার যেন কাঁদন ছুটে আসে, আমাগের দ্যাশে রাখে আয় — রাখে আয় — কে কাঁদে? ঠাকমা? ও দেশে গিয়ে দিনরাত খালি কানত। শালার বুড়ি মরি যায়িও দ্যাশ ফলাতিছে! দ্যাশ কি আর তোর আছে রে ঠাকমা!

দয়া, এ দয়াল, শালা জাউলার পো তুই কোহানে ?

 

শ্মশান মশান হাতের তালুর মত চেনা পলাশের। কতবার মড়া পোড়াতে জুতে গেছে শবমিছিলে। বল হরি, হরি বোল — তখন কীসের হিন্দু মুসলমান! বন্ধুদের জন্যে জান কুরবান। অস্ফুট আওয়াজ শুনে দয়ালকে খুঁজে পায়, এ কী রে! তুই কী মরতি আসিছিস ইখানে!

চুপ কর শালা — ভাত আনিছিস, ভাত ? দে, তাড়াতাড়ি দে। দিয়ে সরে যা—দূরে গিয়ে বসগে—যা যা–

খাবার শেষে হাতমুখ না ধুয়ে শুয়ে পড়ে দয়াল। পড়েই থাকে। পলাশ সিগারেট ছুঁড়ে দেয়, কেস কি ইবার? খুন?

নাহ, পেট্রলবোমা। তাও শালা জিততে পারলাম না।

খ্যাচখ্যাচ করে হাসে পলাশ, সিট কিন্তু আগেরচে বেশি পাইছিস।

জেতাটাই আসল রে!

তা ঠিক। আমাগের দ্যাখ। এখনও একাত্তরের রাজাকার কয়ি ঘেন্না করে বাংলাদেশ।

এবার দয়াল হাসে খুচখুচ, তোরা ত রাজাকারই। দেশডারে পাকিস্তান বানাতি চাতিছিস। বাঙালি বুঝনদার আছে বুঝলি।

 

সমাধির চাতালে শুয়ে পড়ে পলাশ, আর তোরা? তোগের বাঙালিরাও এবার বুঝনদার হয়িছে বুজেছিস। আচ্ছা দয়াল তুই কি জানিস জিন্না আর তোর নেতা একদেশের মানুষ। শালারা কেউ বাঙালি না!

কিডা কয়িছে ইডা? এস্তেপান?

হুম। আমিও জানছি। গুগলে দেখছি। ভাবতিছি ওরা যখন বাঙালি না, তয় ক্যান আমরা ওগের কথায় নাচি? জীবন দিয়ে দেই?

তোর কি হয়িছে পলু ? গভীর উৎকণ্ঠার সাথে জানতে চায় দয়াল।

 

ওর বুদ্ধি খুলতিছে — ক্রিং করে বেল বাজায় স্তেপান। ভয় তরাসে পিপিই পরা স্তেপানকে চিনতে না পেরে উঠে বসতে চায় দয়াল। হাত তুলে ওকে শুয়ে থাকতে বলে। ততোক্ষণে ধড়াম ধড়াম বুক কেঁপে গেছে। মুখ খারাপ করতে গিয়ে থেমে যায়। পলাশ একবার দেখে ‘আজান পড়লি  ডাকি দিস’ বলে নিশ্চিন্তে শুয়ে থাকে।

ওষুধের বাক্সটা মাটিতে রেখে স্তেপান ছড়ানো ইঁট টেনে বসে পড়ে, তোর মুখচোখ ত ভালো ঠেকতিছে না । জ্বর কাশি —

দয়াল বিস্তারিত বলতে মুখ খুলতেই কি ভেবে  থামিয়ে দেয় স্তেপান, আমি পলিটিক্সের ডাক্তার না। দেখি গামছা সরা—আর এই নে মাস্ক। হ, দুডেই পর।

 

পলাশের আনা ইফতার খেতে খেতে দয়ালকে হাসপাতালে নেওয়ার কথা আলোচনা করে ওরা। চৌদ্দ দিনের না হলেও দশদিনের কোয়ারেন্টাইনে থাকা দরকার। দয়াল আপত্তি করে, মরি গেলিও যাবো নানে। কি চাস তোরা, পুলিশ আসুক আর বান্ধে নিয়ে যাক আমারে!

তালি আমার সাথি চল।

না, আমি এহানেই থাকপো। খাবারদাবার ওষুধ রাখি যা। দেখিছিস এডাও কোরেন্টাইনের কেমন ফাস্টকেলাস জায়গা। দুডে বোতলও দিস। ওয়া খালি করোনা হয় না তা জানিস !

কিন্তু জ্বর আসলি কি করবিনি ? কাটা জায়গার রক্ত পচি গন্ধ ছড়াতিছে। ইনফেকশন হয়ে গেলি —

যা শালা তাইলে তুই কিসের ডাক্তার। কড়া ওষুধ দে — এখনই ভাল হয়ি যাবানি। কাজ আছে বুঝিছিস—মেলা কাজ।

 

দু বন্ধু কিছুতেই দয়ালের সাথে পারে না। ঠিক হয় আরও একদিন দেখে ওকে নিয়ে আসবে হাসপাতাল। এ শহরে কেউ চিনতে পারলেও শয়তানি করবে না। নিত্যদিন এমন কতজন বাংলাদেশ ভারত করছে। ইন্ডিয়ায় করোনা ভয়ংকর হতে অনেকেই চলে এসেছে বাংলাদেশে। তাছাড়া কত জন ত সারা বছর আসা যাওয়ার ভেতরে থাকে। এ অঞ্চলে এসব ওপেন সিক্রেট ব্যাপার স্যাপার। ওসব বিজিবি বিএসএফ পাহারা ফাহারা, কাঁটাতার-ফার সব নস্যি। হাতের মুঠোর মত ছোট্ট বাংলাদেশের তিনদিকে বিশাল রাষ্ট্র ভারত। পাহারায় আর কত কুলায়! যত পাহারা তত ফাঁকফোকর।

 

সবকিছু গুছিয়ে দিয়ে ওরা বেরিয়ে আসে শ্মশান ছেড়ে। টর্চ জ্বেলে ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে দয়াল। অন্ধকারে আধখানা ঢেকে গেছে পলাশ। দুবার হাত নেড়েছে। বলে গেছে সেহরি খেয়েই মাঝরাতে চলে আসবে। ততক্ষণ বেঁচে থাকিস শুয়োর। স্তেপানকে মানুষ বলে মনে হচ্ছে না। কারা যেন একবার ওদের ঘরবাড়িতে আগুন দিয়েছিল। ওদের বসার ঘরে নটরাজের মূর্তি। দেওয়ালে সুরা চার কুলের ক্যালিওগ্রাফি আর একজন ভীষণ টাকপড়া লোকের ছবি। স্তেপানের মা পোলাপানদের গান শেখায়।

একবার খুব ধরেছিল স্তেপানের আব্বা, দয়াল তবলাটা শিখে নে। স্তেপান না থাকলে —

 

সাইকেলের ঘুরন্ত চাকার সাথে একটি শুকনো পাতা মাটি থেকে উঠে এসে আবার ঝরে পড়ে। এবার অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে ওরা। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। এদিক সেদিক টর্চ ফেলে। কঙ্কালের মত দেখা যাচ্ছে গাছের ডালগুলোকে। সমাধির চারপাশে আলো ফেলে দয়াল। বেলগাছটা যেন অনেকখানি ঝুঁকে এসেছে সমাধির দিকে। লকলক করছে পাতা। কিঁচকিঁচ করে ছুটছে ইঁদুর। সমাধি ঘিরে এত গাছ ছিল না ত! গাছরা কি হাঁটতে পারে! কেমন পাতা টানার শব্দ হচ্ছে। ঝাঁঝালো গন্ধ আসছে। মাটি আর সবুজের কাঁচা গন্ধ।

 

গত দুইরাত এরকম ত লাগেনি কখনও ! তবে কি মানুষ এসেছিল বলে রাতের শ্মশান জেগে উঠছে! দয়ালের ঘুম ছুটে যায়। ইচ্ছে করে ওদের পেছনে ছুটে যেতে।

কিন্তু ও যায় না।

সমাধির পাশে শুকনো কাঠপাতার স্তুপে আগুন ধরিয়ে দেয়।

মড়াহীন চিতা। জ্বলুক।

 

৩০.০৫.২০২১। ঢাকা

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here