চন্দ্রাবতী। রূপকথার চন্দ্রালোকিত কোনো রাজকন্যা নন, বরং রক্তমাংসের একজন কবি- একই সাথে যিনি নিজে রচনা করেছেন, আবার হয়েছেন অন্য কবির কাব্যের কেন্দ্র। বাংলা সাহিত্যের বর্ণাঢ্য মধ্যযুগে রামায়ণের অনুবাদক, অসংখ্য পালাগানের রচয়িতা চন্দ্রাবতী সেই যুগের সাথে বিসদৃশভাবে একজন নারী, একজন স্বতন্ত্র অনুবাদক। বিসদৃশ এই কারণে যে, একে তো মধ্যযুগে তিনি ছাড়া আর কোনো নারী কবিকে পাওয়া যায় না, আর দুইয়ে, নারীর চোখ দিয়েই তিনি দেখেছেন রামায়ণকে যার ফল হিসেবে অনুবাদ কাব্যটি হয়ে উঠেছে একজন নারীর জীবনগাঁথা। এই বৈসাদৃশ্য পিতৃতন্ত্রের চোখে কবির গুণাগুণকে যতটা না প্রকাশ করেছে তার চেয়ে বেশি সাদৃশ্য দানের আকাঙ্ক্ষায় চন্দ্রাবতীকে পিতৃপরিচয়ে মুড়িয়ে অপর এক কবির ছায়াতলস্পর্শী করার দিকেই অধিক মনোযোগী করেছে।
কবি চন্দ্রাবতীর ব্যক্তিজীবন নিয়ে মধ্যযুগের কবি নয়ানচাঁদ ঘোষ কাব্য রচনা করলেও খোদ মধ্যযুগ থেকে এই কিছুকাল আগ পর্যন্তও তাঁর অনূদিত রামায়ণ নিয়ে পঠন-পাঠন বা সমালোচনার ক্ষেত্রটি ছিল অত্যন্ত সীমিত। সেই সীমিত পরিসরকে যিনি দূরদর্শী গবেষক-দৃষ্টি দিয়ে সম্প্রসারিত আসরে তুলে নিয়ে আসলেন তিনি কবি ও গবেষক হিমেল বরকত। চন্দ্রাবতীর রামায়ণ ও প্রাসঙ্গিক পাঠ গ্রন্থটির সম্পাদনা করেছেন তিনি। এই গ্রন্থের মূলপাঠে চন্দ্রাবতীর রামায়ণ এবং সংযোজনের সাথে প্রাসঙ্গিক পাঠ হিসেবে যুক্ত হয়েছে এগারো জন ভিন্ন ভিন্ন লেখকের লেখা।
মূলত কবি চন্দ্রাবতীকে পাঠ করা, চন্দ্রাবতীর কাব্য পাঠ করা এবং পুরুষকেন্দ্রিক সমাজের প্রান্তে থাকা একজন নারী কবিকে কেন্দ্রে নিয়ে আসার দৃষ্টি উন্মোচন করে দেয়ার ভাবনা থেকে হিমেল বরকত এই গ্রন্থটি সম্পাদনা করবার কাজটিতে হাত দেন। ‘‘চন্দ্রাবতীর কাব্যের মূল্যায়নের চেয়ে গুরুত্ব পেয়েছে তাঁর প্রেম-প্রত্যাখ্যাত কুমারী করুণ জীবনের আখ্যান। এভাবে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চন্দ্রাবতীর নাম উচ্চারিত হলেও, তাঁর সাহিত্যকীর্তি প্রায়-অনালোচিত ও উপেক্ষিত। বর্তমান সংকলন এই অভাব পূরণের দায় থেকেই সম্পাদিত।’’ — সম্পাদক হিমেল বরকতের এই ভাষ্য থেকে সংকলনের উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট হয়েছে বটে কিন্তু তাঁর যে দূরদর্শী চিন্তা এই উদ্দেশ্যের মূলে প্রোথিত, তা আরো গভীরে গিয়ে চলমান সমাজের কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হচ্ছে, চন্দ্রাবতীর জীবন-আখ্যান নিয়ে কবি নয়ানচাঁদ ঘোষ-রচিত চন্দ্রাবতী কাব্যের বিষয়বস্তু হলো কবির পিতৃপরিচয়, বাল্যকাল, প্রত্যাখ্যাত প্রেমের মৃত্যুমুখী অবসান এবং তাঁর রচনা-পরিচিতি। দীর্ঘদিন পর্যন্ত পিতার পরিচয় (মনসামঙ্গল-এর কবি দ্বিজ বংশীদাস) আর করুণ প্রেমের আখ্যান দিয়েই চন্দ্রাবতী ইতিহাসে কেবল নামেমাত্র উচ্চারিত ছিল। লোকসাহিত্য-সংগ্রাহক চন্দ্রকুমার দে, দীনেশচন্দ্র সেন এবং ক্ষিতীশচন্দ্র মৌলিকের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় মলুয়া, দস্যু কেনারামের পালা এবং চন্দ্রাবতীর রামায়ণ সংগ্রহীত এবং সংকলিত হয় পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকায়। গবেষক হিমেল বরকত দীনেশচন্দ্র সেনের সম্পাদিত এবং ক্ষিতীশচন্দ্র মৌলিকের সংযোজিত কাব্যগুলি নিয়ে রচিত দুষ্প্রাপ্র গ্রন্থগুলি থেকে চন্দ্রাবতীর রামায়ণ-এর মূলপাঠ অংশটি সহজসাধ্য এবং শিক্ষার্থীবান্ধব করে সংকলন করেছেন, যাতে বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারী কবির রচনা এবং সেটা নিয়ে পঠন-পাঠন আরো সুদূরপ্রসারী ও সহজলভ্য হতে পারে।
প্রান্তস্বর ব্রাত্য ভাবনা গ্রন্থের ‘কবি চন্দ্রাবতী: অবহেলায়, উপেক্ষায়’ প্রবন্ধটিতে বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন ও মধ্যযুগে সাহিত্যিক হিসেবে নারীর অবস্থান নিয়ে হিমেল বরকত বলেছেন, ‘‘পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ও পুরুষতন্ত্রের প্রবল আধিপত্যের কারণে সারা বিশ্বের মতো বাংলা অঞ্চলেও নারীর অবস্থান ক্ষমতাকেন্দ্রের বহির্মহলে, প্রান্তিক সীমানায়। প্রাচীন ও মধ্যযুগে নারীর এই নির্বাসিত পরিস্থিতি ছিল আরো করুণতর।” প্রাচীন যুগের বহুল প্রচলিত খনার বচনের কথা আমরা জানি। কিন্তু কথিত আছে, তাঁর জিভ কেটে নেয়া হয়েছিলো। পুরুষশাসিত সমাজের এমন নগ্ন উদাহরণকে এর বেশি উপরে তুলে ধরবার প্রয়োজন নেই। আর মধ্যযুগ জুড়ে একদিকে চলেছে দেব-দেবীর আরাধনা, অন্যদিকে মঙ্গলকাব্যগুলোতে, রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যানগুলোতে জনপ্রিয় হয়েছে নারীর বারমাস্যা, নারীর কোমল-সুললিত রূপের বর্ণনা- আর এসবই দেখা হয়েছে পুরুষের চোখ দিয়ে। কিন্তু কবি চন্দ্রাবতী রামায়ণের অনুবাদ করতে গিয়ে রামনামের জপ না করে সীতাকে সর্বেসর্বা করলেন, সীতার উপর্যুপরি মন্দ্যভাগ্যকে গ্রহণ করে দুঃখভোগের চিত্রকে তুলে ধরলেন।
তা, কেনো এই দুঃখভোগ? কারণ, পুরুষশাসিত সমাজের একপাক্ষিক দৃষ্টিকোণ, নারীর প্রতি সমাজের সহমর্মিতার অভাব। রামায়ণে রাবণবধের মধ্য দিয়ে রামকে দেবতার আসনে আসীন করা হয়েছে, অথচ সেই রাম কেবল একজন পুরুষের দৃষ্টি দিয়ে বিচার করেছে সীতার সতীত্বকে, সমাজকে খুশী করতে বিসর্জন দিয়েছে স্ত্রীকে, যেই স্ত্রী সঙ্গী হয়েছে তার সবথেকে দুঃসময়ে। চন্দ্রাবতী কখনো-কখনো রামের কঠোর সমালোচনাও করেছেন- ‘চন্দ্রাবতী কহে, রাম গো তোমার বুদ্ধি হইল নাশ।’
নারী কবি হিসেবেই কেবল স্বতন্ত্র নন চন্দ্রাবতী, তিনি স্বতন্ত্র নিজ কবিত্বগুণে। উনিশ শতকের আধুনিকতার দিকবিচার করা হয়েছে যেসব বৈশিষ্ট্য দিয়ে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে দেবতার মঙ্গলগান থেকে সরে এসে মানবিকতার জয়ধ্বনি উচ্চারণ। হিমেল বরকত একে বলেছেন, ‘কেন্দ্র-প্রান্তের সম্পর্ক-বদল’। আধুনিক যুগে এ বদল ঘটেছে ১৮৬১ সালে মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্যের মধ্য দিয়ে। ‘কবি চন্দ্রাবতী: অবহেলায়, উপেক্ষায়’ প্রবন্ধে হিমেল বরকত বলছেন, “অথচ, মধুসূদনের সাড়া-জাগানো এই বিদ্রোহী প্রকাশের প্রায় আড়াইশ বছর আগেই চন্দ্রাবতী ভেঙে দিয়েছেন রামায়ণের রাম-কেন্দ্রিকতার স্তম্ভ। সীতাকে কেন্দ্রে বসিয়ে তিনি নির্মাণ করেছেন রামায়ণের নারীবাদী পাঠ। কিন্তু দুর্ভাগ্য, পুরুষতন্ত্রে আচ্ছন্ন বাংলা সাহিত্যে ‘নারী কবি’ বলেই হয়তো এই কৃতিত্বের শিরোপা মেলেনি চন্দ্রাবতীর।”
চোখে আঙুল দিয়ে এই বৈষম্যকে তুলে ধরার লক্ষ্যেই শুধু নয়, একজন শক্তিশালী কবিকে বৈষম্যের দেয়ালের ওপার থেকে এনে পাঠক-সমালোচক সমাজের মুখোমুখি করবার দায়ভার থেকে হিমেল বরকত চন্দ্রাবতীর রামায়ণের সম্পাদনার কাজটি করেছেন। চন্দ্রাবতীর লেখা কয়েক পংক্তিতে সীতার দুঃখের ভেতর সেই আবহমান নারীর দুঃখকে দেখতে পাই- ‘না জানি কে পিতা-মাতা গো, কে গর্ভসোদর ভাই।̸ সোতের শেওলা আমি গো,ঘাটে ঘাটে ভাইস্যা বেড়াই।।’ একজন নারী কবির কাজকে বিলুপ্তির অতলান্ত থেকে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার সোচ্চার প্রচেষ্টাটি করেছিলেন হিমেল বরকত। এবং তাতে তিনি সফলও হয়েছেন বলে চন্দ্রাবতীর রামায়ণ ও প্রাসঙ্গিক পাঠ গ্রন্থটির সম্পাদকের ভূমিকা অংশে উল্লেখ করেছেন। এই প্রাপ্তি বাংলা সাহিত্যের।
হিমেল বরকত একজন কবি, একজন প্রাবন্ধিক, সাথে গবেষণাধর্মী মনন তাঁর, সেই সাথে যুক্ত হয়েছে মানুষকে মানে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে শুধু মানুষ হিসেবে দেখতে পারার অসাধারণত্ব। তিনি আমাদের শিক্ষক। শিক্ষার্থী হিসেবে মাত্র যে একটি কোর্সে তাঁকে পেয়েছি, সেখানে একমাত্র নারী শিক্ষার্থী হিসেবে নিজেকে কখনো উপেক্ষিত, অবহেলিত মনে হয় নি। বরং সমান তালে এগিয়ে চলার শিক্ষাটা খুব নিভৃতে তিনি শিখিয়ে গেছেন। এরকম ভাবনা ভাবার মানুষটি গত ২২ নভেম্বরে চলে গেছেন ওপারে। কিন্তু রয়ে গেছে তাঁর সেই চিন্তাগুলো, অসংখ্য কাজের মধ্যে মানবিকতা, অসাম্প্রদায়িকতা আর জীবনবোধের যে বীজ তিনি রুয়ে দিয়ে গেলেন, তা একদিন মহীরুহে পরিণত হবেই হবে।