টোকন ঠাকুর, মুক্তি চাই না

টোকন ঠাকুর ।। সূত্র : বিডিনিউজ২৪ ডট কম

মুচলেকা দিয়ে মুক্তি পেয়েছেন কবি টোকন ঠাকুর। তাঁকে ঘিরে এই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন কবি, গল্পকার, অনুবাদক মুম রহমান। প্রতিক্রিয়াটি আগামীর ইতিহাসের জন্য রেখে দেয়া হলো মুদ্রিত আকারে।

 

টোকন ঠাকুরকে অভিনন্দন জেলে যাওয়ার জন্য। আমরাও আনন্দিত কেননা এ দেশে আইনের প্রয়োগ হয়। আরো আনন্দিত এই ভেবে যে আমাদের কালের একজন কবি কারাগারে যাবেন এবং সুনিশ্চিতভাবেই আমরা নতুন কিছু কবিতা পাবো।

 

কবিকে জেলে নেয়া, কারাগারে দেয়া এ তো কোন নতুন ঘটনা নয়। অজস্র উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। এ ব্যাপারে সবচেয়ে এগিয়ে বিট প্রজন্মের কবিরা। এ প্রজন্মের অন্যতম সেরা কবি, মার্কিন আধুনিক কবিতার কারিগর এলান গিন্সবার্গ মনে হয় খুব জেলবান্ধব ছিলেন। জেলে যাওয়া তার জন্য কোনো ব্যাপারই ছিলো না। প্রথম জেলে গেছেন চুরি করে। চুরির দায় স্বীকারও করেছেন। এমনকি জেলখানা থেকে তাকে মানসিক নিরাময় কেন্দ্রেও পাঠানো হয়েছে। এই গিন্সবার্গই আবার পারমাণবিক বোমা বিরোধী সমাবেশ, যুদ্ধ বিরোধী মিছিল থেকে গ্রেফতার হয়েছেন একাধিকবার। স্বদেশের চৌদ্দ শিকে মনে হয় তার মন ভরেনি। তিনি কিউবা গিয়ে জেল খেটেছেন তার আচরণবিধির জন্য। কে হায় গিন্সবার্গকে আচরণ শেখায়! ইতালিতে গিয়ে কী কী নিষিদ্ধ শব্দ বলেছেন তিনি, তাই সেখানেও জেলে বন্দী। কিন্তু কে হায় গিন্সবার্গকে শব্দ খেলায় জব্দ করতে পারে!

 

গিন্সবার্গের বন্ধু, সহচর কবি ও কথা সাহিত্যিক জ্যাক ক্যারুয়াক মনে হয় আরেক কাঠি উঁচা ছিলেন। তিনি ছোটখাটো ব্যাপারে জেল খাটেনি। বরং খুনির সাহায্যকারী, লাশ গুমের সহয়তাকারী হিসাবে জেল খেটেছেন। বিট প্রজন্মের কনিষ্ঠতম কবিদের একজন — গ্রেগরি কর্সো টোস্টার চুরি করেছিলেন, জেল খেটেছেন। কাপড়ের দোকানে চুরি করেছিলেন, জেল খেটেছেন। ছোটখাটো চুরির বদৌলতে কর্সো মহাশয় বিবিধ মেয়াদে দুই তিন বছর জেল খেটেছেন।

 

আমার অন্যতম প্রিয় দুই মার্কিন কবি চার্লস বুকোস্কি ও রিচার্ড ব্রাউটিগান। এই দুইজনের বহু কবিতা আমি অনুবাদ করেছি এবং তাদের কবিতা নিয়ে আমি দুটো আলাদা বই করেছি। মাশাল্লা তারা দুজনই জেল খেটেছেন। বুকোস্কি তো বরাবরই বেয়াড়া, মাতাল, নারীঘেঁষা, ঠোঁট-কাঁটা, নিজের কথাবার্তা,  চালচলন, লেখালেখি দিয়ে বরাবরই পুলিশকে ব্যস্ত রেখেছেন।  আর ব্রাউটিগান সোজা জানালা থেকে পুলিশের মাথায় ইট মেরেছিলেন। এটা কোনো প্রতিবাদ বা ইয়ার্কি নয়। ব্রাউটিগান জেলে যাওয়ার জন্যই পুলিশকে ইট মেরেছিলেন যাতে জেলে যেতে পারেন। কারণ জেলখানায় গেলে থাকা-খাওয়ার চিন্তা নেই।

 

টোকন ঠাকুর হয়তো খাওয়ার চিন্তাতেই তাঁর সংগ্রহের পুরনো বইগুলো বিক্রি করতে চেয়েছেন। হয়তো সে ব্রাউটিগানের মতো অতো সাহসী নয়। কিন্তু তার থাকা-খাওয়ার একটা ব্যবস্থা হলো। কর্পোরেট পত্রিকা, গণমাধ্যমগুলো গরীব, অন্তত চিন্তায়, রাষ্ট্র তো কঠোর, কবি-শিল্পীর আবেগ দিয়ে তো তারা চলে না। তবু ভাবতে ইচ্ছা করে যে দেশে কবিতা লিখলে প্রকাশক দূর দূর করে, সম্পাদক, কাগজঅলা, টিভি, রেডিওঅলারা এড়িয়ে চলে, কবিতা লিখে টাকা চাইলে অমুককণ্ঠ, তমুককালের পত্রিকার বাাজেট নাই হয়ে যায়, সে দেশে না হয় কবির জন্য কারাগারে একটা কম্বল আর তিনবেলা খাবার থাকুক। সপ্তাহে কি মাসে একটা ফিস্ট থাকুক। কবি মন ভরে পোলাও মাংস খাক একদিন। আর ফিরে আসুক আরেকটা নতুন পাণ্ডুলিপি নিয়ে।

 

ইথারিজ নাইট ডাকাতির দায়ে আট বছর জেল খেটেছিলেন।  ১৯৬৮ সালে জেল থেকে বের হয়েই তিনি প্রকাশ করেন তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ কারাগার থেকে কবিতা (poetry from prison)।  এই বই দিয়েই তাকে আমরা অন্যতম আফ্রো-আমেরিকান কবি হিসাবে চিনি। এরপর তিনি লিখেছিলেন কারাগার থেকে কৃষ্ণকন্ঠ (Black voice from prison)। আমি বিশ্বাস করি, ইথারিজের চেয়েও ভালো কবিতা লেখে টোকন ঠাকুর। তার স্বভাবসুলভ পাগলামি, রসিকতা আমাকে মুগ্ধ করে। সেই আন্তনগর এক্সপ্রেস থেকে টোকনের কবিতার মুগ্ধ পাঠক আমি। সেটা জানানোর সুযোগ হয়ে গেলো। আরো অনেকেরই সুযোগ হবে টোকনের সম্পর্কে ও তার কার্জক্রম সস্পর্কে জানা ও জানানোর। এটা ভালো হলো। টোকন অনেক বেশি। মনোযোগের দাবীদার। সেটা হয়তো এবার সে পাবে।

 

অনেকে অবশ্য ব্যাপারটা খুব সম্মানের চোখে দেখবে না। না দেখলে নাই। রবিনস ক্রুসোর অমর লেখক ড্যানিয়েল ডিফো ৭০০ পাউন্ড দেনার দায়ে জেল খেটেছেন। ব্রিটিশ সাহিত্যের শুরুর দিককার গুরুত্বপূর্ণ নারী কবি আফ্রা বেন টাকা শোধ দিতে পারেননি জেল খেটেছেন। কবি গরিব হলে রাষ্ট্রের তো কোন দোষ নেই, সমাজের কোন দায় নেই কবির ভরণ-পোষণের।  তবে কবি দায়মুক্ত নন। 

 

সব সময় যে খুব ন্যায় সঙ্গতভাবেই মানুষ শাস্তি পায় তাও নয়। পেরুর কবি সিজার ভালেহো ১১২ দিন জেল খেটেছেন লুটতরাজের মিথ্যা অভিযোগে। ই ই কামিংস গুপ্তচর বৃত্তির অভিযোগে জেল খেটেছেন। বামপন্থী পত্রিকায় কাজ করা এবং কমিউনিস্ট হওয়ার অভিযোগে তুরস্কের নাজিম হিকমত জেল খেটেছেন। তার মা জেল খানার বাইরে অনশন করেছেন। জা পল সার্ত্র,  পিকাসোরা প্রতিবাদ করে রাস্তায় নেমেছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে। লোরকাকে জেল ভরেও তার কণ্ঠ থামানো যায়নি। রাষ্ট্রীয় গুন্ডারা শেষে তাঁকে হত্যা করেছে। ল্যুভ মিউজিয়াম থেকে মিশরীয় মূর্তি আর বিশ্বখ্যাত মোনালিসা চুরির সন্দেহে কবি গিয়োম এপোলেনিয়ারকে জেল খাটতে হয়েছে।

 

আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের আইন কানুন খুব কড়া।  আইনের প্রতি আমার পূর্ণ শ্রদ্ধা। আমি তাই টোকনের মুক্তি চাই বলবো না। বিচার চাই, মুক্তি চাই এ সব বলতে হবে কেন? অপরাধী বিচার পাবে, নিরপরাধ মুক্তি পাবে এটাই স্বাভাবিক। টোকনের অন্যায়কে হালাল করার জন্য এটাও বলবো না যে, তাহলে অমুকে যে একি কাজ করলো তার সাজা হলো না কেন? আমি এ প্রশ্ন করবো না যে, এক অপরাধে দুই রকম আচরণ কেন? আমি বলবো না, টোকনের চেয়েও বড় অপরাধী কেন প্রকাশ্যে মাস্তি করে বেড়াচ্ছে? এ সব বলা আমার মানায় না।

 

আমি কে এ সব বলার? রাষ্ট্র, আইন আছে এ সব দেখার জন্য। এ দেশের বড় বড় ব্যক্তি আছেন এ সব প্রশ্ন তোলার জন্য। টোকন বড় কবি। টোকন বড় চলচ্চিত্রকার হতে চেয়েছিলো। টোকনের স্বপ্ন দেখার সাহস আছে। তাকে সালাম। রাষ্ট্র কিংবা আইন কিংবা সবার বিচারেও টোকন যদি চোর হয়, বাটপার হয়, খুনি হয়, ডাকাত হয় আমার তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। কারণ টোকন ঠাকুর আমার কাছে বড় কবি। যাঁদের নাম এ লেখায় নিয়েছি টোকন ঠাকুর মহাকালের পাঠশালা তাদের বন্ধুস্থানীয়। প্রিয় টোকন, ‘কারাগারে কবি ঠাকুরের কাছ থেকে আরো একটি দুর্ধর্ষ কাজ চাই। ফিরে এসেই ছাপতে দিয়ো। আর সিনেমা? দেখো, ওটা এবার হবেই। তোমাকে বন্দী করে তোমার সিনেমা মুক্তির পথ প্রসারিত হলো।

 

ভালোবাসা কবি ও চলচ্চিত্রকার টোকন ঠাকুরকে।

 

4 মন্তব্যসমূহ

  1. ইনফর্মেটিভ এন্ড মোটিভেশনাল একটি লেখা।

  2. চমৎকার তথ্যবহুল লেখা! যিনি লিখলেন এবং তার সৌজন্যে লিখলেন উভয়কেই শুভাশিস জানাই।

  3. বাহ! সুন্দর লেখা।
    কবিকে নিয়ে আরেক কবির এরকম প্রশস্তিমূলক লেখা এদেশে বিরল।সমসাময়িককালেতো আরও। শিল্প-সাহিত্যের ভুবনে সহমর্মিতা ও সহযোগিতার বিশাল এক ক্ষেত্র তৈরি হোক–এই প্রত্যাশা করতেই পারি। ধন্যবাদ মুম ভাই। শুভকামনা সহজিয়ার তরে।

  4. মুমদা! আপনার কথকতার এই বহুচারিতা এই রাষ্ট্রে আমাদের তুচ্ছতাকেও মহিমময় করে তোলে। আমরা যারা ক্ষুদ্র প্রতিভা ও বহুবিদ প্রতিকূল আবহাওয়ায় বাংলা ভাষায় কবিতা-চর্চা করি, তাদের জন্যে এ এক পরম পাওয়া! এ ফান নয়, স্তোত্র নয়, লেখাটি পড়ে আপনার জন্যে এ আমার সামান্য অর্ঘ্যাঞ্জলি। ভালো থাকবেন।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here