নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা ।। উপন্যাস ।। লেখক : সন্মাত্রানন্দ
অদ্ভুত ঘোর তৈরি করা এক উপন্যাস, শেষ বাক্যটি না পড়ে শেষ করা পর্যন্ত পাঠক জানতে পারবে না শেষ কোথায়। এই ঘোর থেকে কেন বের হলো, সে বিষয়ে পাঠক যন্ত্রণা-দগ্ধ হওয়াও অসম্ভব কিছু নয়।
‘অতীশ দীপংকরের জীবনের উপর রচিত বাংলাভাষার প্রথম প্রামাণ্য উপন্যাস।’ চন্দ্রবংশীয় রাজকুমার চন্দ্রগর্ভ বাল্যকালেই মুক্তির সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন। ঠিক যেমন করে হারমান হেস রচিত ‘সিদ্ধার্থ’উপন্যাসের সিদ্ধার্থ বেরিয়ে পড়েছিল। রাজকীয় আরাম আয়েশ চন্দ্রগর্ভের জ্ঞানের প্রতি আকর্ষণকে দমিয়ে রাখতে পারে নি। ভারতবর্ষের সকল মহামহোপাধ্যয়ের কাছে শিক্ষা গ্রহণ শেষেও তাঁর তৃপ্তি হয় নি। যাত্রা করেন সুমাত্রার উদ্দেশ্যে — সুবর্ণদ্বীপ বলে যা পরিচিত ছিল।
সেখানে গুরু ধর্মকীর্তির কাছে তাঁর শিক্ষাজীবন শেষ করে ফিরে আসেন ভারতবর্ষে। ভারতবর্ষে তার প্রসারের শিখর-মুহুর্তে তিব্বতের উদ্দেশ্যে গমন — মোটা দাগে এটা হতে পারে উপন্যাসটির আখ্যানভাগ বা পটভূমি। কিন্তু উপন্যাসটি ঠিক এখানেই সীমাবদ্ধ থাকে নি।
অতীশ দীপংকরের জীবনের উপর রচিত উপন্যাস হলেও উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্র জীবন্ত হয়ে উঠেছে লেখকের বর্ণনার গুণে। বাস্তবতা ও কল্পনার বেড়াজাল যেমন ভেঙে গেছে তেমনি অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ এক হয়ে গেছে কোন এক ছেদবিন্দুতে। তিব্বতি পর্যটক চাগ লোচাবা, কুলবধূ স্বয়ংবিদা, বাংলাদেশের কৃষক অনঙ্গ দাস, অমিতায়ুধ, কল্পিত লেখক শাওন এবং স্বয়ং ‘নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা উপন্যাসের লেখক সন্মাত্রানন্দ জড়িয়ে গেছেন চন্দ্রগর্ভের অতীশ দীপংকর হয়ে ওঠার যাত্রায়।
পৃথিবী ঘুরে চলছে তিব্বতীয় জপযন্ত্রের মতো ‘ওঁ তারে তুত্তারে তুরে স্বাহা’ — সময় আবর্তিত হচ্ছে, মানুষ জন্মজন্মান্তর ব্যাপী নিজেকে অন্বেষণ করে চলছে।
’’যখন বৃক্ষরাজির ভিতর দিয়ে বহে যাবে সমুষ্ণ বাতাস
নদীর উপর ছায়া ফেলবে গোধূলিকালীন মেঘ
পুষ্পরেণু ভেসে আসবে বাতাসে
…কেবল তখনই আমি তোমার কাছে আসব…’’- এই কথা বলে হাজার বছর আগে এক নারী ডুব দিল মৃত্যুর নিঃসীম অন্ধকারে। একই কথা স্বয়ংবিদার মুখে, একই ভাব জাহ্নবীর গানে। যার অর্থ খুঁজে ফিরে অতীশ, চাগ লোচাবা, অমিতায়ুধ। এই গাথার অর্থ সময়ভেদে ভিন্ন হলেও, এই-ই জীবন। যার অন্বেষণ করে চলছি আমরা প্রত্যেকেই। সেই অর্থে প্রত্যেকেই আমরা দীপংকর। প্রত্যেকেই একা। আর এই অন্বেষণ- যে দ্রষ্টার দেখার শেষ হয় না, একাকিত্ব তারও।
গাথাটির মতোই আরেক রহস্য চন্দন কাঠের বাক্সটি। তালপাতার পুঁথিতে লেখা, ‘‘শৈলোপরি রূপমেকং দৃষ্টং ময়া। অন্যং রূপদ্বয়ং সূতিকাগৃহং নিকষা উপলব্ধব্যম্। বজ্র- যো- গি- ন্যাং তয়োঃ সদ্ভাবঃ ইতি”— ‘‘পাহাড়ের ওপর একটি রূপ আমি দেখেছি। বাকি দুটি রূপ সূতিকাগৃহের কাছে পাওয়া যাবে। বজ্রযোগিনী গ্রামে সেই রূপ দুটি আছে।”কারো কাছে রূপ মানে মূর্তি, কারো কাছে দর্শন। কোন রূপের কথা বলতে চেয়েছেন অতীশ দীপংকর? নারীকণ্ঠে উচ্চারিত গাথার অর্থ অন্বেষণ করতে করতে অতীশ এই রূপের আবিষ্কারক সেই সাথে আবিষ্কার করেন নিজেকেও। ‘‘আমি শুধু স্নেহবুভুক্ষু অপার এক সত্তা। শুধু সকাতর এক মাতৃহৃদয়। যে-মাতৃহৃদয় যুগে যুগে তার কনিষ্ঠা কন্যা ধরিত্রীর সন্তপ্ত বক্ষের উপর আকাশের বারিবিন্দুর মতন ঝ’রে পড়ে… অপেক্ষা যার শেষ হয় না, বারবার পেয়েও বারবার যে হারায়… আবার ফিরে পাবার জন্য অন্য কোনও আকাশে নীলনীরদরূপে দেখা দেয়, বরিষধারার মতোই বারবার ফিরে ফিরে আসে… আমি সেই আবর্তমান উচ্ছ্বসিত কারুণ্যব্যাকুলতা…।’’ আর এভাবেই অতীশ মানুষ হয়ে ওঠেন, হয়ে ওঠেন এক অন্বেষণের নাম।
শুধু নাম দেখে সংগ্রহ করা এ বইটি আবারও পড়ায় ক্লান্তি তৈরি হয় না। এ ঘোরে ডুবে থাকতে থাকতে নিজেকেও যেন অতীত-বর্তমান- ভবিষ্যতের চক্রে খুঁজে পাওয়া যায়, খুঁজে পাওয়া যায় সৃষ্টির উৎসমূলে।
একাগ্র বইপড়ুর লেখায়ও একাগ্রতা জাগানোর মতন স্রোত আছে।
🙂 কৃতজ্ঞতা
আরে বাহ্, এই ত খুজছিলাম আমি। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে..
বইটার ভেতর রয়েছে ক্ষতিহীন মাদকতা। নেশায় ভুলিয়ে রাখে। কাহিনির গ্রন্থি বহুদূর বিস্তৃত, তবে একদমই ছন্নছাড়া নয়। শক্ত হাতে লাগাম ধরে রেখেছেন কাহিনিকার।তিন কাল এক কালে এসে ঠেকেছ।তবু পাঠক সময়ের গ্রন্থি থেকে কদাপি বিচ্যুত হন না। ইতিহাস ও কল্পনার এক পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি ‘নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা।
উল্লেখ্য, তাহমিনা আপুর রিভিউ পড়েও ভালো লাগলো।