ওরে বাবা! কী কঠিন একটা শিরোনাম! একেতো থিয়েটার-টিয়েটার নিয়ে তাও আবার এত প্যাঁচানো কথা! কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি অনেক চেষ্টা করেও এর চেয়ে সহজ করে লিখতে পারলাম না! আমার মাথায় এই প্রশ্নটা ঘুরছে বহু দিন ধরে। নানাভাবে নানা সময়ে এই প্রশ্ন মাথায় উকুনের মতো কুটকুট করে! সেই আলাপটাই আসলে পাড়তে চাই! কিন্তু এখানে সেই আলাপে আপনার কীই-বা আসে যায়! কী দায় আমারও সেই আলাপের বিস্তারে? নাহ! কারোই কোনো দায় নাই, কিছুই আসে যায় না তাতে। ওই অনেকটা আমাদের থিয়েটার-টিয়েটার করার মতো আর কি!
তবে আমার মতো যাদের মাথায় সেই উকুনটা খুব ছোট সাইজের হলেও কুটকুটায় তাঁরা আসেন ঘন হয়ে বসি; তারপর শিরোনামটাতে আরেকবার চোখ বুলাই। হ্যা, ‘কে চায়’ আর ‘কী চায়’ এই মূল প্রশ্ন ছাড়াও ছোট একটু ফারাক আছে প্রশ্ন দুইটার মধ্যে। ‘এই সময়ে’ আর ‘এই সময়ের’! ঠিক তাই, এই সময়ে থিয়েটার — তার মানে, এই যে এরকম একটা সময়- যখন ‘আকাশ সংস্কৃতি’ও একটা পুরোনো টার্ম হয়ে গেছে, যখন হাতের মুঠোতেই বন্দি আছে দুনিয়ার ভাল-মন্দ সব বিনোদন তখন কে চায় এই সময়ে থিয়েটার করতে? কে চায় এই সময়ে থিয়েটার দেখতে? কেন চায়? আর যদি সেই প্রশ্নের কোনো সুরাহা করা যায় তবে মোকাবিলা করতে হবে সেই থিয়েটার কেমন হবে? কী চায় এই সময়ের সেই থিয়েটার?
অর্থাৎ এই ‘এই সময়ের’ হিসাবটা পরিস্কার হওয়া জরুরি মনে করি। কারণ কেমন এক স্থবির চর্চার মধ্যে পড়ে আছে আমাদের থিয়েটার। পুরা দুনিয়াতেই থিয়েটার এই রকম প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করে এগিয়ে এসেছে, এগিয়ে যাচ্ছে! তাই এই সময়টাকেও মোকাবিলা করে এগিয়ে যাবে সেটা বিশ্বাস করা যেতেই পারে। তবে কেবল বিশ্বাস নিয়ে স্থির থাকাটা তো প্রকৃত বিশ্বাসীর কাজ না। স্থবিরতাকে অতিক্রম করার চেষ্টাতেই তো অস্থির হয়ে ওঠে স্থির বিশ্বাসীর মন।
থিয়েটার শিল্প চর্চার একটা মাধ্যম। যা হয়ত অনেক কিছু দিতে পারে সমাজকে, যা হতে পারে ব্যক্তি ও সমাজের পরিবর্তনের নিয়ামক, তবে সবার আগে সে বিনোদনটাই তৈরি করে। আর সেই বিনোদেনর জন্য এখন তো উপকরণ আর মাধ্যমের অভাব নেই সত্যি বলতে! গান, নাচ, সিনেমা, কৌতুক, কবিতা, সাহিত্য, ওয়াজ, রান্না-বান্না, মোটিভশনাল স্পিচ, অশ্লীল ভিডিও কী নেই হাতের মুঠোর চেরাগে! সবই তো আছে! যে যেটা চায় এক আঙুলের ইশারায় হাজির করে নানান চেহারার দৈত্য! সেখানে থিয়েটার কী এমন দেয় একজন বিনোদন প্রত্যাশী বা শিল্পরসিককে? তেমন কিছুই দেয় না মনে হয় ইদানিং! মনে হয় কিছুই হয় না থিয়েটার দিয়ে!
হ্যাঁ, সত্যিই কিছুই হয় না মনে হয় থিয়েটার দিয়ে, কারণ তেমন কিছুই তো হয় না আসলে আমাদের থিয়েটারে। যা হয় তার বেশির ভাগই চর্বিতচর্বণ, হয়তো তাই কারোই কিছু যায়-আসেও না! আমার তেমনই মনে হয় সব কিছু দেখে-আর কিছু কিছু বুঝে। সব বুঝে ফেলেছি এমনটা বলা যাবে না, রিস্ক আছে তাতে! তবে, এটাকে কিন্তু ‘দেখিয়া শুনিয়া খেপিয়া গিয়াছি’ ধরনের আবেগ অনুভূতিতে ফেলা যাবে না। বরং ‘কনফিউজড’ ক্যাটাগরিতে রাখা যায়। কনফিউশনের কথাটা বলার আগে ‘থিয়েটারে তেমন কিছুই হয় না’ আর ‘কিছুই যায় আসে না’ কেন বলছি — তার তো একটু সাফাই গাইতে হয়! এই দেশে একদল লোক জীবন-যৌবন ক্ষয় করে যখন প্রতি সন্ধ্যায় প্রতিষ্ঠিতি-অপ্রতিষ্ঠিত, চেনা-অচেনা, সদরে-অন্দরে নানা জায়গায় হাতে গোনা কিছু দর্শকের সামনে নাটক করে ফাটিয়ে দিচ্ছে তখন সেসব জায়গারই কোলে বসে অগুনতি দর্শক দিব্যি খেলিয়ে-কেলিয়ে সময় কাটিয়ে দিচ্ছে! ওসব নাটক-ফাটকে কার কী যায় আসে? কিছুই না! সত্যিই যদি কিছু হতো ওই নাটকের নামে তবে হয়তো কিছু যেত আসতো মানুষের! আমরা কি তবে ‘এই সময়টা’কে আনতে পারছি না থিয়েটারে? এই সময়ের দর্শক বা শিল্পরসিকদের মনের মতো কনটেন্ট, স্টাইল, ফর্মের যোগান দিতে পারছি না? শিল্পের যে-বিকাশের চাহিদা তার বিপরীতে আমরা কি চিন্তায় ও কর্মে স্থবির? বৈশ্বিক ও দেশীয় সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিবর্তনকে পাশ কাটিয়ে মেতে আছি শিল্প-শিল্প খেলায়? এসব প্রশ্নের মোকাবিলা হওয়াটা জরুরি মনে হয়!
আবার, মনে কনফিউশন তৈরি হয় এই ভেবে যে, এই ‘তেমন কিছুই হয় না’ আর ‘কিছুই যায় আসে না’-এর সময়ে কেন তবে কিছু লোক থিয়েটার নিয়ে মেতে আছে, কেন মাতিয়ে রাখার চেষ্টা করে? কেন কিছু লোক এই আমলে হাতের মুঠোয় ধরা যন্ত্রে ইউটিউব, ফেসবুক, টিকটক, লাইকির মতো নানা খেলা ছেড়ে থিয়েটারের পথে হাঁটে? মজাটা কোথায় আর মাজেজাটা কী?
স্বপ্নবাজেরা বাজ পাখির মতো বাজখাই গলায় আমাকে বলবেন, ‘ওরা স্বপ্ন নিয়ে বিশুদ্ধ শিল্প সাধনার পথে ধেয়ে আসছে’ আর কিছু নিন্দুকেরা কানে দিবে, ‘কিছুই না আসলে, তারা হইবার ধান্দায় আছে’ — এমন সব কথা বলে! যার কথাই বিশ্বাস করি না কেন! সেটাই যে মজা বা মাজেজা সেটা তো স্বীকার করতেই হবে। শিল্পচর্চার বা অভিনেতা, লেখক, গায়ক, ডিজাইনার হবার স্বপ্ন নিয়েই আমরা সবাই শুরু করেছি থিয়েটার। সেই সাথে এক সময় কম বেশি সবারই তারকাখ্যাতি, অর্থ ও নেতৃত্বের ধান্দা যুক্ত হয়েছে হয়তো। তাতে কেউ সফল কেউ ব্যর্থ! সেই ধান্দায় তেমন খারাপ কিছুই আমার চোখে পড়ে না অন্তত! শিল্পী মাত্রই তো লোকের সমাদর চায়। কিন্তু শিল্পীকে তো সততার সমাদরও করতে হয়, তা না হলে যে থিয়েটার তার অনেক কিছুই কেড়ে নিবে, বিনিময়ে দিবে না কিছুই! আর শিল্পের প্রতি সততা ছাড়া কিছু অর্জিত হয়েছে মনে হলে সেটা আসলে শিল্পের না তথাকথিত শিল্পীর দায়! তবে একটা যৌথ শিল্পপ্রয়াস হিসেবে থিয়েটার অনেক বেশি ত্যাগ দাবি করে। ব্যক্তির শ্রম, নিষ্ঠা, মেধা ও সময়ের যোগ দাবি করে সে। ফলে থিয়েটারের শিল্পীর ত্যাগের বিনিময়ে হয়তো তেমন কিছুই জমা হয় না ঝুলিতে, শুধু শিল্পচর্চা বা তার ভোগের আনন্দ ছাড়া। কিন্তু সেইটুকুতেই তার ‘পোষায়’ এমন মনোভাবই মূল শক্তি!
আর এই শিল্পের দায় মেটানোর জন্য যে প্রয়াস তাতে সময়টাকে সৎভাবে বিশ্লেষণের দাবি রাখে। প্রতিটি শিল্পই তো সময়ের দাবিকে মেনে প্রকাশিত হয়, বিকশিত হয়! আমি কিন্তু এই কথায় শুধু রাজনৈতিক থিয়েটার করা বা সমাজ সচেতন, শ্রেণিসংগ্রামী থিয়েটার চর্চার কথা বলছি না। স্লোগানসর্বস্ব কোনো শিল্প বা থিয়েটার জন্ম দেয়ার দাবি করছি না। ‘এই সময়’ এর দাকি অনুযায়ী কনটেন্ট বা বিষয় ও ফর্ম বা ভঙ্গির রূপায়ণ নিয়ে ভাবছি। সেখানে ক্ল্যাসিক বা সমকালের ইস্যু যেকোনো কিছুই অবলম্বিত হতে পারে। হতে পারে তা দেশি বা বিদেশি, হতে পারে ক্ল্যাসিক প্লে বা একেবারে সাম্প্রতিক ঘটনার ময়নাতদন্ত! হতে পারে সে আয়োজন চার দেয়ালে আবদ্ধ দর্শকদের সামনে বা পথে-মাঠে আপাত অনাগ্রহী জনতার নিমিত্তে! আর সেসব সম্ভব যদি শিল্প সৃষ্টির উদ্যোগটা ঠিকঠাক তাড়না থেকে হয়, কেবল অভ্যাসের দায় থেকে করার জন্য করা না হয়! আমরা খুব সহজভাবে সময়টাকে একটু ভাবি, বিগত দশ-বিশ বছরে সময় আমাদের কী কী পরিবর্তনের মুখোমুখি করেছে সেসব সালতামামি করি, তাহলে দেখবো যাপিত জীবনে যাবতীয় পরিবর্তনের বা অভ্যাসের সাথে সাথে আমাদের চিন্তায় ও মননেও পরিবর্বতন হয়ে গেছে! সেসব পরিবর্তন প্রভাব শিল্পের অনেক মাধ্যমে বা সাহিত্যের নানা শাখায় প্রকাশ হতে থাকলেও থিয়েটারে তা যথেষ্ট বেগবান কিনা সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষ।
এইসব প্রশ্নগুলোই তোলার চেষ্টা করছি শুধু! যার মোকাবিলা হতে হবে যৌথভাবে। কারণ থিয়েটার তো একটা যৌথ শিল্পপ্রয়াস! আর ঠিকঠাক প্রয়াসেই আরো বেশি বেগবান হবে থিয়েটারের বিকাশ ও শিল্পীর প্রকাশ। সেই আশায় আসে ঘন হয়ে বসি সকলে… দম নেই, দম দেই…