তারুণ্য বলতে আমি বুঝি নতুনের আগ্রহ, নতুনের আগমন। জীবনের যে সময়টায় নতুন কিছু করার, জানার, আবিষ্কার করার আগ্রহ থাকে, ঝুঁকি নেয়ার প্রবণতা থাকে, সাহস থাকে সেটাই তারুণ্য। এই সময়টা একই সঙ্গে আনন্দের এবং হতাশার।
তারুণ্যে আনন্দ সর্বাপেক্ষা উপভোগ্য। তারুণ্যে সবচেয়ে বেশি কাজ করা যায়, সবচেয়ে বেশি ভাবা যায় পরিবার, দেশ, বিশ্বকে নিয়ে। এই সময়টায় পরের ওপর নির্ভরশীল থেকেও তরুণরা নিজেরা কিছু করতে চায়। নিজের মেধাকে কাজে লাগাতে চায়।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের প্রজন্ম সবচেয়ে বেশি সময় ব্যয় করে থাকে প্রযুক্তিতে (ইন্টারনেট ব্রাউজিং করে, টিভি সিরিজ দেখে, খেলা দেখে, বিভিন্ন প্রোডাক্টিভ কাজ করে)। এরপরে আসে বই পড়া, ভ্রমণ, আড্ডা দেয়া প্রভৃতি। বই পড়াটাও ইদানিং প্রযুক্তির অন্তর্গত। এতে হয়তো আগের মত বইয়ের গন্ধ শুঁকে পড়ার আনন্দটা পাওয়া যায়না। তবে যেকোন বই সহজলভ্য হওয়ায় সময় ও অর্থ দুইই সাশ্রয় হয়।
বর্তমানে তরুণদের মধ্যে ভ্রমণের প্রবণতা দেখা যায় খুব। বন্ধুদের সঙ্গে, পরিবারের সাথে আড্ডা দেয়াটাও অনেকের অবসর কাটানোর মাধ্যম। অনেক তরুণ এখন সময় কাটায় রক্তদান, ত্রাণ বিতরণ, পরিচ্ছন্নতা অভিযান, পথশিশুদের পড়ানো প্রভৃতি স্বেচ্ছাসেবী কাজের মাধ্যমে। অনেকের মধ্যে চাকরির বাজারে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় সামিল না হয়ে, নিজে কিছু করার তাগিদে (অনলাইনে এবং অফলাইনে) উদ্যোক্তা হওয়ার প্রবণতাও দেখা যায়।
বাংলাদেশে সব ক্ষেত্রে তরুণদের অংশগ্রহণ চোখে পড়লেও রাজনীতিতে তরুণদের অনীহা লক্ষ্য করা যায়। এর অন্যতম কারণ রাজনীতিতে মেধার অভাব, অপরাজনীতি। যে রাজনীতিতে এলে লক্ষ্যচ্যুতি ঘটে, চিন্তার বিকৃতি ঘটে সে রাজনীতিতে তারুণ্য গা ভাসাতে চায়না। যে রাজনীতি মেধার জোরে না চলে কব্জির জোরে চলে, যেখানে জোরজবরদস্তি করে আনা হয় সেখানে তরুণরা আসতে চায়না। আমাদের আকাঙ্ক্ষিত সুস্থ, সুন্দর প্রগতিশীল রাজনীতি চর্চার মাধ্যমে নেতৃত্বদান, টিমওয়ার্ক, সঠিক দিক নির্দেশনা, সঠিক প্রতিবাদের ভাষা প্রভৃতি শেখার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে রাজনীতি বলতে আমরা বুঝি মারামারি, কাটাকাটি, চাঁদাবাজি, ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি এসব। হ্যাঁ কিছু ব্যাতিক্রম হয়তো আছে কিন্তু তা বর্তমান তরূণদের রাজনীতিতে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের জন্য যথেষ্ট নয়।
তারুণ্যকে নিয়ে আমি যে স্বপ্ন দেখি বাংলাদেশের কাছেও প্রত্যাশা তাই। তারুণ্য একটা দেশের সম্পদ। তারুণ্যই ঠিক করতে পারে একটা দেশ আজ থেকে ১০-২০ বছর কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। আমাদের বাংলাদেশ একটা জাতি হিসেবে এগিয়ে যাবে নাকি পিছিয়ে পড়বে। কিন্তু তার জন্য দরকার তরুণদের চিন্তার স্বাধীনতা, কাজের স্বাধীনতা।
তরুণরা সবসময় চায় পুরনোকে ভেঙে নতুন নিয়ম গড়তে, ভুল-ভ্রান্ত নিয়মগুলোকে দূর করতে। তরুণদের তাদের মত করে ভাবার, তাদের মত করে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। ইতিবাচকতা এবং উৎসাহ খুব দরকার এই জায়গাটায়। তরুণদের মধ্যে যে সম্ভাবনা রয়েছে তাকে যদি ইতিবাচক ভাবে কাজে লাগানো যায় দেশ এগোবেই।
এদেশে তরুণদের হতাশার প্রধান কারণ চাকরি ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা। তাছাড়া বেকারভাতাও নেই। সেশনজটের পাশাপাশি গ্র্যাজুয়েশন শেষেও চাকরি পাওয়ার নিশ্চয়তা খুব কম। এর একটি কারণ চাকরিক্ষেত্রে দুর্নীতি। যার ফলে রাত-দিন খেটেও চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে খুব কম। আবার একটা পর্যায়ে গিয়ে পরিবারও চায় সন্তান পরিবারে আর্থিকভাবে সাহায্য করুক। এভাবে পরিবার এবং তরুণদের মধ্যে একটা মানসিক টানাপোড়নের সৃষ্টি হয়। হতাশা থেকে তরুণদের নৈতিক অবক্ষয় ঘটে, লক্ষ্যচ্যুতি হয় এবং অনেকে আবার আত্মঘাতি হয়ে যায়। এছাড়া অনেক সময় আমাদের একাডেমিক পড়ার সাথে চাকরির সামঞ্জস্য থাকেনা।
তাই বাংলাদেশের কাছে আমার প্রত্যাশা দুর্নীতি রোধের পাশাপাশি আমাদের একাডেমিক পড়ার সাথে চাকরির পড়ার সামঞ্জস্য যেন থাকে। একাডেমিক পড়ার বিষয় অনুযায়ী যেন চাকরি পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকে। এখন সব চাকরিতে প্রযুক্তিতে দক্ষতা খুব প্রয়োজন। তাই প্রযুক্তিতে দক্ষ করে তুলতে আমাদের একাডেমিক পড়ার সাথে একটা বাধ্যতামূলক কম্পিউটার কোর্সের সুযোগ রাখা। সর্বোপরি তরুণদের সাহায্য করা।
এই যে বিভিন্ন কারণে দারুণ মেধা, দারুণ সম্ভবনা থাকার পরেও অনেক তরুণ হতাশ হয়ে যাচ্ছে, পথভ্রষ্ট হচ্ছে এর দায় শুধু তারুণ্যকে না দিয়ে সরকার, পরিবার তথা গোটা সমাজকেই নিতে হবে।