কাজী নজরুল ইসলামের ১০টি গান

সেতার হাতে কাজী নজরুল ইসলাম

১১ জ্যৈষ্ঠ, ২৪ মে — এই দিনে জন্মেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলা কবিতার ভাব ও সুর বদলে দেয়া এই কবি বাংলা গানের এক কিংবদন্তি প্রতিভা। পিছন ফিরে পড়ে দেখা যাক তার দশটি গান।

খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে।
প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুল খেলা নিরজনে প্রভু নিরজনে॥
শূন্যে মহা আকাশে
মগ্ন লীলা বিলাসে,
ভাঙিছ গড়িছ নিতি ক্ষণে ক্ষণে॥
তারকা রবি শশী খেলনা তব, হে উদাসী,
পড়িয়া আছে রাঙা পায়ের কাছে রাশি রাশি।
নিত্য তুমি, হে উদার
সুখে দুখে অবিকার;
হাসিছ খেলিছ তুমি আপন মনে॥
আমায় নহে গো – ভালবাস শুধু ভালবাস মোর গান।
বনের পাখিরে কে চিনে রাখে গান হ’লে অবসান॥
চাঁদেরে কে চায় – জোছনা সবাই যাচে,
গীত শেষে বীণা প’ড়ে থাকে ধূলি মাঝে;
তুমি বুঝিবে না বুঝিবে না –
আলো দিতে পোড়ে কত প্রদীপের প্রাণ॥
যে কাঁটা-লতার আঁখি-জল, হায়, ফুল হ’য়ে ওঠে ফুটে –
ফুল নিয়ে তায় দিয়েছ কি কিছু শূন্য পত্র-পুটে !
সবাই তৃষ্ণা মিটায় নদীর জলে,
কী তৃষা জাগে সে নদীর হিয়া-তলে –
বেদনার মহাসাগরের কাছে কর সন্ধান॥
প্রিয় যাই যাই বলো না, না না না
আর ক’রো না ছলনা, না না না॥
আজো মুকুলিকা মোর হিয়া মাঝে
না-বলা কত কথা বাজে,
অভিমানে লাজে বলা যে হ’ল না॥
কেন শরমে বাধিল কে জানে
আঁখি তুলিতে নারিনু আঁখি পানে।
প্রথম প্রণয়-ভীরু কিশোরী
যত অনুরাগ তত লাজে মরি,
এত আশা সাধ চরণে দ’লো না॥
যায় ঝিল‌মিল্‌ ঝিল্‌মিল্‌ ঢেউ তুলে দেহের কূলে
কে চঞ্চলা দিগঞ্চলা মেঘ-ঘন-কুন্তলা।
দেয় দোলা পুব-সমীরণে বনে বনে দেয় দোলা॥
চলে নাগরি দোলে ঘাগরি
কাঁখে বরষা-জলের গাগরি
বাজে নূপুর-সুর-লহরি
রিমি ঝিম্‌, রিম্‌ ঝিম্‌, রিম্‌ ঝিম্‌ চল-চপলা॥
দেয়ারই তালে কেয়া কদম নাচে
ময়ূর-ময়ূরী নাচে তমাল-গাছে।
এলায়ে মেঘ-বেণী কাল-ফণি
আসিল কি দেব-কুমারী নন্দন-পথ-ভোলা।।
দূর দ্বীপ-বাসিনী, চিনি তোমারে চিনি।
দারুচিনির দেশের তুমি বিদেশিনী গো, সুমন্দভাষিণী॥
প্রশান্ত সাগরে
তুফানে ও ঝড়ে
শুনেছি তোমারি অশান্ত রাগিণী॥
বাজাও কি বুনো সুর পাহাড়ি বাঁশিতে?
বনান্ত ছেয়ে যায় বাসন্তী-হাসিতে।
তব  কবরী-মূলে
নব  এলাচীর ফুল দুলে
কুসুম-বিলাসিনী॥  
মোর ঘুমঘোরে এলে মনোহর নমো নম, নমো নম, নমো নম।
শ্রাবণ-মেঘে নাচে নটবর রমঝম, রমঝম, ঝমরম
(ঝমঝম, রমঝম, রমঝম)॥
শিয়রে বসি চুপি চুপি চুমিলে নয়ন
মোর বিকশিল আবেশে তনু নীপ-সম, নিরুপম, মনোরম॥
মোর ফুলবনে ছিল যত ফুল
ভরি ডালি দিনু ঢালি’ দেবতা মোর
হায় নিলে না সে ফুল, ছি ছি বেভুল,
নিলে তুলি’ খোঁপা খুলি’ কুসুম-ডোর।
স্বপনে কী যে কয়েছি তাই গিয়াছ চলি’
জাগিয়া কেঁদে ডাকি দেবতায় প্রিয়তম, প্রিয়তম, প্রিয়তম॥
রাঙা মাটির পথে লো মাদল বাজে, বাজে বাঁশের বাঁশি,
বাঁশি বাজে বুকের মাঝে লো, মন লাগে না কাজে লো,
রইতে নারি ঘরে ওলো প্রাণ হলো উদাসী লো॥
মাদলিয়ার তালে তালে অঙ্গ ওঠে দুলে লো,
দোল লাগে শাল পিয়াল বনে, নোটন খোঁপার ফুলে লো,
মহুয়া বনে লুটিয়ে পড়ে মাতাল চাঁদের হাসি লো॥
চোখে ভাল লাগে যাকে, তাকে দেখব পথের বাঁকে,
তার চাঁচর কেশে বেঁধে দেব ঝুমকো জবার ফুল
তার গলার মালার কুসুম কেড়ে করব কানের দুল।
তার নাচের তালের ইশারাতে বলবো ভালবাসি লো॥
আলগা কর গো খোঁপার বাঁধন দিল ওহি মেরা ফঁস্‌ গয়ি।
বিনোদ বেণীর জরীন ফিতায় আন্ধা এশ্‌ক্‌ মেরা কস্‌ গয়ি॥
তোমার কেশের গন্ধ কখন,
লুকায়ে আসিল লোভী আমার মন
বেহুঁশ হো কর্‌ গির্‌ পড়ি হাথ মে বাজু বন্দ মে বস্ গয়ি॥
কানের দুলে প্রাণ রাখিলে বিধিয়া,
আঁখ্‌, ফিরা দিয়া চোরী কর্‌ নিদিয়া,
দেহের দেউড়িতে বেড়াতে আসিয়া আউর নেহিঁ উয়ো ওয়াপস্‌ গয়ি॥
আকাশে আজ ছড়িয়ে দিলাম প্রিয়।
আমার কথার ফুল গো,
আমার গানের মালা গো ─
কুড়িয়ে তুমি নিও॥
আমার সুরের ইন্দ্রধনু
রচে আমার ক্ষণিক তনু,
জড়িয়ে আছে সেই রঙে মোর
অনুরাগ অমিয়॥
আমার    আঁখি-পাতায় নাই দেখিলে
আমার আঁখি-জল,
আমার    কণ্ঠের সুর অশ্রুভারে
করে টলমল।
আমার হৃদয়-পদ্ম ঘিরে
কথার ভ্রমর কেঁদে ফিরে,
সেই ভ্রমরের কাছে আমার
মনের মধু পিও॥
১০
শুকনো পাতার নূপুর পায়ে
নাচিছে ঘুর্ণিবায়
জল তরঙ্গে ঝিল্‌মিল্ ঝিল্‌মিল্
ঢেউ তুলে সে যায়॥
দীঘির বুকে শতদল দলি’
ঝরায়ে বকুল-চাঁপার কলি
চঞ্চল ঝরনার জল ছল ছলি
মাঠের পথে সে ধায়॥
বন-ফুল আভরণ খুলিয়া ফেলিয়া
আলুথালু এলোকেশ গগনে মেলিয়া
পাগলিনী নেচে যায় হেলিয়া দুলিয়া
ধূলি-ধূসর কায়॥
ইরানি বালিকা যেন মরু-চারিণী
পল্লীর-প্রান্তর-বনমনোহারিণী
আসে ধেয়ে সহসা গৈরিক বরণী
বালুকার উড়্‌নি গায়॥

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here