বিদেশে পড়ালেখা? এতো সহজ? চাইলেই পড়া যায়? নানা রকম প্রশ্ন মাথায় ঘোরে। বিশেষ করে তরুণ শিক্ষার্থীরা দিশাহারা হয়ে এসব প্রশ্নের জবাব খোঁজেন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ থেকে এই প্রশ্নগুলোর জবাব দিয়েছেন গবেষক ও শিক্ষক মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম। তিনি বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস, ঢাকার ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক। পিএইচডি করছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব হিউস্টনের ইংরেজি বিভাগে।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি/বাংলাসহ সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ থেকে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের অনেকেই আমেরিকা, কানাডা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, মালয়েশিয়া, হংকং, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পড়াশোনার জন্য যেতে চান। এই চাওয়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ থাকে, থাকে অনেক স্বপ্ন, অনেক উদ্দেশ্য। আমার ছোট্ট অভিজ্ঞতা থেকে বলছি; কারণ আমি অনেককে দেখেছি। অনেকের সাথে কথা বলেছি।আবার আমি নিজে ইংরেজি বিভাগের একজন শিক্ষার্থী। তিনটি বিষয় জানা আমার কাছে মনে হয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ জানার অভাবেই অনেকেই আমরা তিনটি ভুল করে থাকি :
এক. যে ভুলটি অনেকেই আমরা করে থাকি, সেটি হচ্ছে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য সাহস এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষা ধারণ করে বাধা পেরিয়ে আগাতে নিজেকে বুঝাতে পারি না। তাই এপথে নামি না, শুধু মনে মনে আশা করি।
দুই. অনেকেই আবার সময় দেন না, এটার জন্য। মনে হয়, সময় নিয়ে পরিকল্পনা করে কাজ করেন না। নিজেকে গবেষণা কনফারেন্সে নিয়োজিত করেন না। তাই ভর্তি পাওয়া এবং ফান্ড পাওয়া অনেক মুশকিল হয়। আপনারা হতাশ হয়ে পড়েন, বলতে থাকেন ইংরেজি কিংবা বাংলা বিভাগে পড়ে লাভ নেই, বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে এই বিভাগ ভালো না।
তিন. নিজের গবেষণার সাথে কিংবা আগ্রহের সাথে মিল আছে এরকম অধ্যাপক, প্রতিষ্ঠান বা স্কুলের খবরাখবর রাখেন না। যারা পড়ছে তাদের পড়াশোনা, গবেষণা কিংবা তাদের যাত্রাপথ নিয়ে চিন্তা করেন না। মানে হচ্ছে রোড ম্যাপ ছাড়া নেমে পড়েন অনেকেই।
উচ্চশিক্ষার রাস্তায় আরেকটা বিশাল বিপদে পড়েন অনেকেই, সেটা হচ্ছে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়/ বিভাগের জন্য ৩/৪ পৃষ্ঠার একটা গবেষণা প্রস্তাবনা বা রূপরেখা লিখতে হয়। এই জিনিস অনেকের মাথা খারাপ করে ফেলে। অনেকে এটা ভয় পান। তাহলে কী করবেন? বাদ দিয়ে দিবেন উচ্চশিক্ষার পরিকল্পনা? না, বাদ দিবেন না।
এখানে আমি দুটো কথা বলবো :
এক. আপনি যদি চলমান শিক্ষার্থী হয়ে থাকেন, তাহলে যেটা করবেন, যখন স্নাতক/ স্নাতকোত্তরের শেষের দিকে যে পেপার লিখবেন, সেটা ভালো করে করবেন, সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে কাজ করবেন। এবং যে বিষয়ে কাজ করবেন সেই এলাকার সাহিত্য/গবেষণা ভালোভাবে খেয়াল রাখবেন। খেয়াল করবেন এই বিষয়ের গবেষণার ধারা কোন দিকে যাচ্ছে, কীভাবে আগাচ্ছে? তাহলে আপনার কাজ অনেকখানি সহজ হয়ে যাবে।
দুই. যদি আপনার স্নাতক/ স্নাতক-উত্তর পর্ব শেষ হয়ে থাকে, তাহলে সভা/সেমিনার/কনফারেন্সে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে পারেন। চেষ্টা করুন একটা নতুন এলাকা খুঁজে বের করতে যাতে আপনি প্রকাশনা করতে পারেন, যাতে একটি প্রস্তাবনা লিখতে পারেন। এক্ষেত্রে আপনি আপনার সিনিয়র/ সহকর্মী/ কিংবা শিক্ষককের সাথে আপনার আপনার ধারণা বা ইচ্ছা নিয়ে মৌখিক কিংবা লিখিতভাবে শেয়ার করতে পারেন, তাদের কাছ থেকে ফিডব্যাক নিয়ে নিজের আইডিয়া ঢেলে সাজাতে পারেন।
ইউরোপ/ আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার আবেদনের জন্য আরেকটি বিষয় লাগে, সেটি হচ্ছে আপনার নিজের লেখা প্রবন্ধ। বলা যায়, একটি একাডেমিক পেপার। এটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ আপনার ভর্তির জন্য।
তারপর, আসে SOP-এর কথা। SOP-এর মানে হচ্ছে আপনি আপনার নিজের সম্পর্কে কিছু কথা গুছিয়ে বলবেন। যেমন : আপনি কী কাজ করবেন, কেন এ কাজ করবেন, আপনি কীভাবে ভাবলেন এই কাজ আপনি করতে পারবেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়/ বিভাগ কীভাবে আপনাকে এক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে, কোন অধ্যাপকের সাথে কাজ করবেন, এবং কেন করবেন? এই প্রশ্নগুলির উত্তর যদি একাডেমিক ধরন মেনে লেখা যায়, যাতে একটা গল্পের মত আকার ও থাকবে, সেটাই হবে SOP। অন্যভাবে বলতে গেলে, সিভিতে আপনি আপনার কাজ, পড়াশোনা ও প্রকাশনার লিস্ট করেন, তাহলে SOP-এ এগুলোর পেছনের গল্প বলবেন এবং সাথে থাকবে আপনার সামনের পরিকল্পনা। ৮০০-১২০০ শব্দের এই প্রবন্ধ আপনার দক্ষতা ও নিজস্বতার গুরুত্বপূর্ণ একটি পরিচায়ক।
তাই এখানে বলা দরকার, যদি অন্যের SOP-কে রিমেক করেন কিংবা কপি করার ধারণা মাথায় আনেন তাহলে এর মানে হচ্ছে নিজের ক্ষতি নিজেই ডেকে আনা। অন্য কথায়, আপনি নিজের গল্পই যদি বলতে না পারেন, তাহলে আপনি কী গবেষণা করবেন? আপনার যোগ্যতা নিয়ে তখন প্রশ্ন করা যায়। তবে হ্যাঁ, অবশ্যই কিছু SOP পড়তে পারেন, যাতে করে SOP-এর Structure, Presentation ও Diction নিয়ে আপনার দক্ষতা বৃদ্ধি পায় এবং আপনি এই জিনিসের Craft and making নিয়ে আরো বেশি সময় দিতে পারেন। এতে আপনার ভর্তি ও ফান্ড প্রাপ্তির সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাবে বলে আমি মনে করি।
ইউরোপ/ আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার আবেদনের জন্য আরেকটি বিষয় লাগে, সেটি হচ্ছে আপনার নিজের লেখা প্রবন্ধ। বলা যায়, একটি একাডেমিক পেপার। এটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ আপনার ভর্তির জন্য। সাধারণত ১৫-২০ পৃষ্ঠার একটি গবেষণালব্ধ লেখা জমা দিতে হয়। এক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় জেনে রাখতে পারেন :
এক. এই লেখাটি প্রকাশিত কিংবা অপ্রকাশিত হতে পারে কিন্তু সেটাকে অবশ্যই আপনার নিজের/ অরিজিনাল একটি লেখা হতে হবে। এর মানে হচ্ছে এটা হতে পারে আপনার স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর পর্বের জন্য লেখা থিসিস বা অভিসন্দর্ভ। অথবা হতে পারে আপনার লেখা যেকোনো গবেষণামুলক লেখা। হতে পারে জার্নালে প্রকাশিত কিছু, অথবা প্রকাশের জন্য লিখিত কোন একটি একাডেমিক পেপার।
দুই. এই লেখাটির তিনটি গুণ অবশ্যই থাকতে হবে : অরিজিনালিটি, নতুনত্ব এবং একাডেমিক ফরম্যাট অনুসৃত। এর মানে হচ্ছে যেভাবে আমরা থিসিস কিংবা প্রকাশের জন্য প্রবন্ধ লিখে থাকি, সেভাবে লিখতে হবে।
তিন. লেখাটি আপনি যে বিষয়ে গবেষণা করতে চান সে বিষয়ক, কিংবা তার সাথে সম্পর্কযুক্ত হলে ভালো হয়। কারণ তখন তা আপনার আগ্রহের প্রমাণ হিসেবে কাজ করে।
চার. আপনি যে বিভাগ/অনুষদ/ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদন করছেন, তাদের ফোকাসের সাথে যদি আপনার আগ্রহ ও লিখিত প্রবন্ধের মিল থাকে, তাহলে অনেক ভালো হয়। কারণ আপনার সাথে কাজ করার এই বিভাগে কিংবা অনুষদে কেউ আছে কিনা সেটাও অনেক জরুরি।
পাঁচ. এই প্রবন্ধটি সাবমিট করার আগে আপনি অনেক বার পড়বেন, সাম্প্রতিক গবেষণাকে সাইট করে আপডেট করে নিবেন, অন্যকে দিয়ে পড়াবেন, ফিডব্যাক নিবেন, জার্নালে সাবমিট তাদের ফিডব্যাক দিবেন, তাহলে লেখাটি অনেক সম্পাদনা হলে অনেক ভালো হবে।
এই প্রবন্ধটিকে বলা হয় Writing Sample । এর মাধ্যমে আপনার লেখার দক্ষতা ও মান যাচাই করা হবে। একজন অধ্যাপক হয়তো আপনার এই লেখাটি পড়বেন এবং বুঝতে চেষ্টা করবেন এই লেখাটি ভালো মানের কিনা, যার ফলে যিনি লিখেছেন তার ভালো গবেষক হওয়ার মত একটি চলনসই দক্ষতা আছে কিনা। যেহেতু আপনি আপনার সবচেয়ে ভালো লেখাটিই সাবমিট করবেন, তাই এই লেখাটিই হবে আপনার নিজেকে প্রমাণের একটি বড় সুযোগ। তাই এটি তৈরি করতে হবে সময় নিয়ে, আগ্রহ নিয়ে, পরিকল্পনা করে এবং যথেষ্ট নিষ্ঠার সাথে। মূলত একটি ভালো লেখা আপনার মেধা, মনন, জেদ ও আগ্রহের স্থিরতার একটি ফলাফল। এর জন্য যত্ন লাগবে, লাগবে ব্যাপক সময় এবং অনেক বেশি সহ্যক্ষমতা। আপনাকে লেগে থাকতে হবে।
এখন, সিভি/রেজুমি ও রেকমেন্ডেশন লেটার বা সুপারিশপত্র নিয়ে কিছু বলবো। প্রথমেই বলে নেই, এগুলো ভর্তির অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানে আপনি চাইলেই বাদ দিতে পারবেন না কিংবা যেনতেনভাবে করে দিয়ে দিতে পারেন না, দিলে আপনার সম্ভাবনা অনেক কমে যাবে।
প্রথমেই আসুন, সিভি বা রেজুমিতে আপনি কী কী লিখতে পারেন, সে বিষয়ে একটু কথা বলি। সিভি বা রেজুমি হচ্ছে আপনার এক ধরনের একাডেমিক রেকর্ড অথবা বিবরণ। এখানে আপনি আপনার পরিচয়, শিক্ষাগত যোগ্যতা, প্রকাশনার বিবরণ, গবেষণার ইতিবৃত্ত, কনফারেন্স, সিমেনার, কাজের অভিজ্ঞতা, বিভিন্ন ক্লাব বা সংগঠনে কাজের অভিজ্ঞতা, মেধাপুরস্কার এবং গবেষণার আগ্রহগুলো অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। সাধারণত এটি ৩/৪ পেইজের হয়। তবে এর চেয়ে কম বেশি হতে পারে। এক্ষেত্রে আমার পরামর্শ হলো আপনি একটি মাস্টার সিভি তৈরি করবেন যেখানে আপনার সব তথ্য সুন্দরভাবে গুছানো থাকবে। পরে প্রোগ্রামের ফোকাস দেখে সিভিকে এডিট করে চূড়ান্ত করবেন। মানে হচ্ছে যদি একটি তথ্যের কোন উপযোগিতা না থাকে বরং নেতিবাচক হতে পারে এমন হল, সেই তথ্যকে বাদ দিতে হবে।
এখন হচ্ছে LoR বা রেকমেন্ডেশন লেটার, অন্যের কাছে নেয়া এক ধরনের সুপারিশপত্র, যেখানে আপনাকে ছাত্র হিসেবে, গবেষক হিসেবে এবং একজন ব্যক্তি হিসেবে কেউ একজন মূল্যায়ন করবে এবং আপনার জন্য সুপারিশ করবে। সাধারণত এই মহান কাজ করেন অধ্যাপক কিংবা আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ। প্রতিটি আবেদনের জন্য ২/৩/৪ করে সুপারিশপত্রের ব্যবস্থা আপনাকে করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র কিংবা কানাডার ক্ষেত্রে, আমার জানা মতে, আপনি আপনার সুপারিশকারীর নাম, পদবি, ইমেইল আইডি আবেদনপত্রে উল্লেখ করবেন। পরে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আপনার সুপারিশকারীকে ইমেইল করবে, লিংক পাঠিয়ে দেবে। সুপারিশকারী সেখানে গিয়ে আপনাকে মূল্যায়ন করবেন এবং সুপারিশপত্র লিখবে বা আপলোড করবেন।
এখন কথা হচ্ছে কে আপনাকে সুপারিশ করতে পারে? শুধু ই কি আপনার শিক্ষক? না, ব্যাপারটা এমন নয়। অনেকেই আপনার জন্য সুপারিশপত্র লিখতে পারে। যেমন আপনার শিক্ষক, আপনার সুপারভাইজার, আপনার কোন সহকর্মী, কিংবা যেখানে আপনি কাজ করেন, সেখানকার প্রধান ব্যক্তি। আপনাকে ভালোভাবে জানেন, কিন্তু যিনি আপনার আত্মীয় নয় বিধায় তিনি পক্ষপাতিত্ব না করে ঠিকভাবে আপনাকে নিয়ে লিখবেন। যেমন লিখবেন, আপনি কেমন শিক্ষার্থী, আপনার গবেষণার হাত কেমন, কাজের দক্ষতা কেমন ইত্যাদি। এক্ষেত্রে আমার মনে হয়েছে, প্রতিটি শিক্ষার্থীকে একটু সচেতন এবং দূরদর্শী হতে হয়, পরিকল্পনা করতে হয়, সম্পর্ক রাখতে হয়, সম্পর্কের যত্ন করতে হয়। আবার, শিক্ষকদের ও যত্নশীল, বিবেকবান ও দায়িত্বশীল হতে হয় শিক্ষার্থীদের প্রতি।
সব মিলিয়ে আপনি একটি আবেদন করতে কী কী করবেন এবং কীভাবে করবেন — আমরা যদি একটি বিবরণ তৈরি তাহলে যে জিনিসগুলি লাগবে তা হলো : Academic Transcripts and certificates, SOP, Research Outline, Writing Sample, CV, LoR, language proficiency Certificates,(IELTS, TOEFL, GRE) and Passport (photo page)। Language Proficiency Certificates, (IELTS, TOEFL, GRE) মূলত আপনার টার্গেট বিভাগ/বিশ্ববিদ্যালয়ের চাহিদা অনুযায়ী আপনাকে অন্ততপক্ষে হাতে ৩/৪/৫ মাস সময় হাতে নিয়ে পরীক্ষা দিতে হবে। মানে হচ্ছে, আপনি ২০২৩ এর ফল-এ আবেদন করতে চান, তাহলে আপনাকে জানুয়ারি মাস থেকে ২/৩ মাস নিয়ে এই ভাষা দক্ষতা যাচাই পরীক্ষাটি দিলেন। এবং সেই সময় থেকেই আপনি আপনার টার্গেট করা বিভাগ/ অনুষদ/ বিশ্ববিদ্যালয়ে আরো যা যা লাগবে সেগুলো সংগ্রহ করতে শুরু করে দিলেন। যেমন : পছন্দের অধ্যাপককে ইমেইল করা। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
একজন অধ্যাপককে সাধারণত জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে ইমেইল করতে পারেন, চেষ্টা করবেন বাংলাদেশ সময় রাত ৯-১২টার ভেতর ইমেইল করতে। ইমেইলটি লিখবেন সংক্ষিপ্ত যেখানে আপনার পরিচয়, শিক্ষাগত যোগ্যতা, গবেষণা-আগ্রহ কিংবা প্রকাশনা, তাকে ইমেইল করছেন, কোন প্রোগ্রামে পড়তে চান — এগুলো এক প্যারাগ্রাফের ভেতরে লিখবেন। চাইলে এই ইমেইলে আপনার সিভিটাও সংযুক্ত করে দিত পারেন। মনে রাখবেন, একই সাথে এক বিভাগের সব অধ্যাপককে ইমেইল করবেন না। এতে আপনার কথার দাম কমে যাবে। একজন অধ্যাপকের উত্তর দেয়ার অপেক্ষা করবেন অন্ততপক্ষে এক সপ্তাহ। অধ্যাপককে ইমেইল দেয়ার আগে ওয়েবসাইটে গিয়ে তার সম্পর্কে জেনে নিবেন, গুগুল স্কলারে গিয়ে তার কাজ সম্পর্কে পড়ে নিবেন, তার কাজের রিভিউ পড়তে বা দেখতে পারেন। এগুলো আপনার আবেদনের আগে করতে হবে, কারণ এই অধ্যাপকের কথা আপনাকে হয়ত এসওপিতে লিখতে হবে যে, আপনি তার সাথে কাজ করতে চান এবং কেন করতে চান।
ভর্তির আবেদনের আগে আপনাকে বিশ্ববিদ্যালয়/ বিভাগে/ অধ্যাপকে একটি ফর্দ বানাতে হবে, যেখানে ইমেইল কিংবা ওয়েবলিংক থাকবে, থাকবে গুরুত্বপূর্ণ তারিখগুলো। অনেকেই এই লিস্টটা বিশাল করে ফেলেন, কিন্তু আমি বলবো বেশি হলে আপনি সামলাতে পারবেন না। তাই ভালো করে বুঝে ৭-১০ বিশ্ববিদ্যালয়/বিভাগ টার্গেট করতে পারেন। এই সিলেক্ট করার ক্ষেত্রে আপনি অধ্যাপকের রেসপন্স, বিভাগে গবেষণা শেখার সুযোগ, ফান্ডিং, আবহাওয়া ও র্যাংকিং দেখতে পারেন। আপনার পরিচিত কেউ আছে এই রকম বিশ্ববিদ্যালয় হলে অনেক ক্ষেত্রেই ভালো হয়। অনেক সহযোগিতা পাওয়া যায়।
আপনার আবেদন আপনি নিজেই করবেন, এই কাজগুলি শিখবেন। যেমন : কীভাবে সময় নিয়ে নিজের ডকুমেন্টস গুছাতে হয়, কীভাবে যোগাযোগ করতে হয় কিংবা বজায় রাখতে হয়, কীভাবে উত্তর দিতে হয়, কী লিখতে হয়। আপনার একাডেমিকসহ যাবতীয় ডকুমেন্টস আপনাকে স্ক্যান করে পিডিএফ ফাইলে একটি ফোল্ডারে রাখতে হবে, কপি রাখতে হবে অনলাইন ড্রাইভে, যাতে করে আপনি যেকোন জায়গা থেকে এক্সেস নিতে পারেন। কারণ এগুলো আপনাকে আপলোড করতে হবে বিভিন্ন সময়ে। যে বিশ্ববিদ্যালয় বা বিভাগে আবেদন করবেন, তাদের ওয়েবসাইটে গিয়ে আপনাকে একটি একাউন্ট খুলতে হবে এবং সেই একাউন্ট থেকে আবেদন করতে হবে, বিভিন্ন ব্যক্তিগত ও একাডেমিক তথ্য লিখতে হয়। পরে একটি একটি করে ডকুমেন্ট আপলোড করতে হয়। আপনার প্রতিষ্ঠানিক ইমেইল কিংবা ব্যক্তিগত ইমেইল আইডিতেই তারা আপনার সাথে যোগাযোগ রাখবে, তাই আপনাকে সতর্ক ও দায়িত্বশীল হতে হবে। প্রতিদিন সময় দিতে হবে, নিয়ম করে ইমেইল চেক করতে হবে, ওয়েবসাইট ঘাঁটাঘাঁটি করতে হবে এবং টুকে রাখতে হবে জরুরি জিনিসগুলি। বন্ধু-বান্ধব কিংবা আপনার পরিচিতজন হয়তো আপনাকে ক্ষেত্রবিশেষে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু কাজটা মূলত আপনাকেই করতে হবে, তাই শিখতে হবে।
আমার কাছে মনে হয়েছে, একটি আবেদন মূলত একটি প্যাকেজ যেখানে হয়তোবা আপনার প্রতিটি আইটেম সমানভাবে ভালো নাও থাকতে পারে। কিন্ত সব মিলিয়ে কেমন প্যাকেজটি গুরুত্বপূর্ণ। যেমন : একজনের হয়তো CGPA এবং publications ভালো, কিন্তু language score এতোটা ভালো না কিংবা প্রথমটা ভালো কিন্তু বাকিগুলো বেশি ভালো না। কাজেই এগুলো মাথায় রাখবেন যে, আপনার আবেদনটি গৃহীত হওয়া বা না হওয়া অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। এতে আপনি হতাশ কম হবেন এবং কাজ চালিয়ে যেতে থাকবেন। অনেক সময় এ রকম ও হয় একজন আবেদনকারীর আবেদন গৃহীত হয়ে যায় একটু ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্ত অপেক্ষাকৃত নিচের সারির বিশ্ববিদ্যালয় বা বিভাগ তার আবেদনটি গ্রহণ করে নি। কাজেই লেগে থাকবেন। মনে রাখবেন আপনার যেমন বিশ্ববিদ্যালয় পাওয়া প্রয়োজন তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ও শিক্ষার্থীর প্রয়োজন।
আমি মনে করি, আপনি যদি মেধাবী, পরিশ্রমী ও সচেতন একজন শিক্ষার্থী হয়ে থাকেন, তাহলে নিজের কিংবা পরিবারের এত টাকা খরচ সহজেই এড়াতে পারেন, পেতে পারেন ফুল ফান্ডিং। এমনকি আয় করে, অল্প করে হলেও বাড়িতে পাঠাতে পারেন।
এই প্রক্রিয়া শুরু থেকে শেষ করতে গেলে একাডেমিক যোগ্যতা ছাড়া আপনার অনেকগুলি দক্ষতা/গুণ লাগবে। আপনার লাগবে প্রবল ইচ্ছা ও আশাবাদ। আপনার থাকতে হবে সহ্যক্ষমতা ও লেগে থাকার শক্তি। লাগবে যোগাযোগ দক্ষতা, ভাষা দক্ষতা এবং কম্পিউটার ও অনলাইনে কাজের ক্ষমতা। আপনি বিভিন্ন মাধ্যমে তথ্য জানার চেষ্টা করবেন, যারা বাইরে আছে বা যাবে, তাদের সাথে কথা বলবেন, জানতে চেষ্টা করবেন, নিজে নিজে গুগল করবেন, ঘাটাঘাটি করবেন এবং পরে দেখবেন একেক ধাপ এগিয়ে আপনিও এই প্রক্রিয়াটিকে রপ্ত করে ফেলছেন। এটি একটি বেশ লম্বা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটু কঠিন প্রক্রিয়া।
এখানে বলে রাখি, আমার মত অপরিপক্ব মানুষ যদি কাজটি করতে পারে, তাহলে আমি মনে করি বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই পারবে। এটি বিশ্বাস করি। কিন্তু আমার মত জেদি হতে হবে, আমি অল্প অল্প করে নিজে সব করেছি, কারণ আমার সামনে রেফারেন্স পয়েন্ট তেমন মানুষজন ছিল না কিংবা আমি খুব বেশি যোগাযোগ বজায় রাখতে পারি নি। প্রায় বছর তিনেক লেগেছে এই প্রক্রিয়াটিকে বুঝে উঠতে কিংবা ফলাফল পেতে। কিন্তু আমার কাছে এখন মনে হয়, কেউ যদি সঠিক তথ্য ও গাইডলাইন পায় এবং মন দিয়ে কাজগুলো করে তাহলে এক/দেড় বছর চেষ্টা করলেই সে বিদেশে পড়তে আসতে পারবে। এই পড়তে আসাটা তো কেবল পড়া নয়, আপনার জীবন ও জীবিকার এক অনন্য সুযোগ পাওয়াও বটে। কাজেই সময়কে বিনিয়োগ করেন বুঝেশুনে।
এবার কিছু কথা বলবো ফান্ডিং বা শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে। বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার খরচ জোগানো এবং নিজের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা অনেক ব্যয়বহুল। তাই অনেকেই ফান্ডিং/স্কলারশিপ নিয়ে চিন্তিত থাকেন। কিন্তু আমি মনে করি, আপনি যদি মেধাবী, পরিশ্রমী ও সচেতন একজন শিক্ষার্থী হয়ে থাকেন, তাহলে নিজের কিংবা পরিবারের এত টাকা খরচ সহজেই এড়াতে পারেন, পেতে পারেন ফুল ফান্ডিং। এমনকি আয় করে, অল্প করে হলেও বাড়িতে পাঠাতে পারেন। এখন প্রশ্ন হলো আমি কীভাবে ফান্ড পাবো? কোথায় খুঁজবো ফান্ডিং?
সাধারণত স্কলারশিপগুলো দুধরনের হয়ে থাকে — External and Internal. অর্থাৎ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর থেকে আসা স্কলারশিপ অথবা বাইরের কোন উৎস থেকে। বাইরের উৎস হতে পারে আপনার দেশের সরকারের দেয়া, কোন সংগঠনের দেয়া, কোন ফাউন্ডেশনের ইত্যাদি। যেমন : ফুলব্রাইট প্রোগ্রাম, শিভেনিং, কমনওয়েলথ, ইরাসমাস মোন্ডাস, হাঙ্গেরি সরকার বৃত্তি, তুর্কি সরকারের বৃত্তি এবং বাংলাদেশ সরকারের দেয়া শিক্ষাবৃত্তি। এক্ষেত্রে শিক্ষাবৃত্তি ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি আলাদা আলাদা করে আপনাকে ব্যবস্থা করতে হবে, মানে হচ্ছে দুটোতেই আবেদন করবেন। কিন্তু আশার কথা হচ্ছে যদি আপনি বৃত্তি পেয়ে যান, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি আপনি পেয়েই যাবেন, অথবা ভর্তি আগে হয়ে গেলে, বৃত্তি পেতে সহজ হয়ে যায়।
অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীন শিক্ষাবৃত্তির জন্য আপনাকে আপনার টার্গেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে গিয়ে এইড অ্যান্ড স্কলারশিপ সেকশনে গিয়ে ঘাটাঘাটি করবেন, তাদের ইমেইল করবেন, আপনার পরিচিত কেউ থাকলে তার সাথে যোগাযোগ করে জানতে পারেন। আপনার মেধা ও গবেষণাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্যই এগুলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাই আপনাকে প্রমাণ করতে হবে আপনার মেধা ও দক্ষতা। অনেক প্রতিযোগিতা করে জিততে হবে এই শিক্ষাবৃত্তিগুলো। অনেক সময় ১/২/৩টা বৃত্তি মিলে আপনার পুরো খরচ কভার হয়।
তাহলে ফান্ডিং কী? ফান্ডিং আসলে কাবিখা, মানে হচ্ছে কাজের বিনিময়ে খাদ্যের মতো। আপনাকে ফুল বা হাফ বা একটি পরিমাণ ফান্ডিং তারা অফার করবে, এতে আপনাকে কাজ করতে হবে, এবং সেই কাজ হয় সাধারণত সপ্তাহে ২০ ঘণ্টা। এই কাজের দাপ্তরিক নাম হচ্ছে RA এবং (গবেষণা সহকারী), TA (শিক্ষক সহকারী)।
এখানে একটি আশার কথা হচ্ছে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ বিভাগের প্রোগ্রামগুলোতে RAship, TAship দেয়া হয় এবং আপনাকে আলাদা করে তার জন্য আবেদন করতে হয় না। এতে প্রতিমাসে তারা আপনাকে যা টাকা দিবে, এতে আপনার থাকা-খাওয়ার হয়ে যাবে। থাকবে শুধু আপনার শিক্ষা ফি, সেটা ও অনেক সময় তারা মওকুফ করে দেয়। তবে সবকিছুতেই একটি শর্ত থাকে, আপনাকে মনেপ্রাণে পড়াশোনা ও গবেষণা করতে হবে। এখানে একটি কথা বলে রাখা দরকার, বিদেশে পড়তে আসা মানুষের ঘোরাঘুরির ছবি ফেইসবুকে দেখে আমরা যাতে এটা মনে না করি যে, ঘোরাঘুরির মাঝখানে কিছু কিছু পড়বো। এখানে পড়ালেখায় কোন ছাড় নেই, অনেক বেশি প্রেশার প্রতিটি শিক্ষার্থীর। কিন্তু থাকা-খাওয়া, পড়াশোনা সব মিলিয়ে একটি উন্নত জীবন আছে আপনি বলতে পারেন।
এই বৃত্তি/ ফান্ডিংগুলো সম্পর্কে জানতে হলে বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা সেই প্রতিষ্ঠাননের ওয়েবসাইট, জাতীয় পত্রিকা, আপনার সিনিয়র বা শিক্ষকদের সাথে নেটওয়ার্ক করা খুব জরুরি। আপনাকে জানতে হবে এগুলোর সারকুলার কবে আসে, কোথায় পাবেন, কিভাবে আবেদন করবেন ইত্যাদি ইত্যাদি। নিজেকে তৈরি রাখতে হবে, সময়, সুযোগ ও মেধাকে কাজে লাগাতে হবে। একমাত্র সচেতন, মেধাবী ও পরিশ্রমী শিক্ষার্থীরাই এই কাজ করতে বলে আমি মনে করি। কাজেই কাজে লেগে যান, নেমে পড়েন এই যাত্রায়।
পরিশেষে, আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে আমার কাছে মনে হয়েছে উচ্চশিক্ষার যাত্রা আমাদের অনেকের কাছে খুব বেশি কঠিন মনে হয়। এর কারণ হচ্ছে ভয় কিংবা আত্মবিশ্বাসের অভাব। আমাদের নিজের বিভাগে কিংবা বিষয়ে এই ব্যাপারে তেমন কোন তথ্য পাই না, শিখতে পারি না আধুনিক গবেষণা পদ্ধতি কিংবা অর্জন করতে পারি না আধুনিক প্রযুক্তিগত দক্ষতা। ফলে আমাদের ভয় বাড়তে থাকে, বাড়তে থাকে হতাশা ও নেতিবাচকতা, যেগুলো আবার আমাদেরকে নতুন করে কিছু করার, কিছু শেখার আগ্রহ থেকে অনেক দূরে রাখে, আর এভাবেই আমরা পিছিয়ে পড়ি।
আমি মনে করি সামাজিক বিজ্ঞানের পড়াশোনা অনেক বিস্তর, গভীর ও জটিল। শুধু আমাদের উন্নত পদ্ধতি শিখতে হবে চিন্তা করার, শিখতে হবে লেখার আধুনিক কৌশল, জানতে হবে জানার বিভিন্ন রকম মাধ্যম ও উপায় নিয়ে। কাজেই একজন শিক্ষার্থী যদি গবেষণা করতে আগ্রহ রাখে, ভাষা বুঝতে পারে মানুষের ও মেশিনের, তাহলে এই যাত্রা তার জন্য তেমন বড় কিছুই নয়। শুধু লাগবে সময়ের ভালো ব্যবহার, বুদ্ধিকে শানিত করা আর একটু বেশি পরিশ্রম, তাতেই এই শিক্ষার্থী দুনিয়ার যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করার মত যোগ্য ও দক্ষ হয়ে ওঠবে।