জালালউদ্দিন রুমির মসনবি ও কবিতা

কবি ও দার্শনিক জালালউদ্দিন রুমির মসনবি ও কবিতা ছুঁয়েছে বিশ্বের হৃদয়। বাঙালি পাঠকের অতি প্রিয় এই কবির একগুচ্ছ কবিতা অনুবাদ করেছেন কবি ও নাট্যকার বদরুজ্জামান আলমগীর

শূন্য আকাশে

ধরো তুমি একটি সুন্দর গন্ধ পাচ্ছো, কিন্তু জানো না কোত্থেকে আসছে,
তুমি নিজেকে সেখানে আটকে রাখতে পারো না

তুমি বেরিয়ে যাবে খালি আকাশের পানে — তাবৎ দুনিয়ার যে কোন সুন্দর,
যে কোন বাসনা এক লহমায় তোমার হয়ে উঠতে পারে।

যদি তুমি হৃদয়ের গহীন ভিতরে বসতি গড়তে জানো
তোমার আয়নায় কোন ধূলা জমবে না, একদম ফকফকা পরিস্কার দর্পন হবে তোমার।

শামস-ই-তাব্রিজি নিজের মধ্যে পরমেশ্বরের অধিষ্ঠান বুঝতে পেরেছিলেন
তুমিও যদি নিজেকে ওই মোকামে তুলতে পারো তোমার মধ্যেও কোন
দুর্ভাবনা পেরেশানির লেশমাত্র থাকবে না।

তাহলেই তুমি শত উলেমার কোটি মতভেদ আর তাফসিরের ধাঁধার বাইরে
আসতে পারো, যেদিন তুমিও শামস-ই-তাব্রিজির মত বুঝতে পারবে

তোমার বুকের ভিতর ঈশ্বর বাসা বেঁধেছেন — সেদিনই একাগ্র পরিচ্ছন্নতায়
নিজের বোধে আসবে- তারা যা চাউর করে তা দিয়ে আসলে কী বোঝায়।।

 

একটি হাসি ও নম্রতা

সবার অন্তঃপুরে একটি হাসি আর নম্রতা আছে
তার খোঁজ পাওয়ামাত্রই আমি ওখানে ডুব দিই

দেখি গন্ধের হাটে তুমি সুবাস বিক্রি করো
আমি তোমাকে জোড়াত করে বলি — আমার রোখ

দেখে ধান্ধায় ফেলো না, আবরণ ভেঙে সোজা
বেরিয়ে এসো — চলো নিঃশর্ত খেলায় মেতে উঠি।

আমাকে চুম্বনের মহাবিদ্যায় তালিম দাও
মাটির উপর বিছাও কম্বলখানি — সুরক্ষিত করি

মানোত্তীর্ণ আগুনের নাম ও নির্মল লেলিহান
আর কালক্ষেপ কেন করো — জিরার বীজ দেখো

শুকিয়ে যায়, এদের সবার ভিতরে আমি আছি।।

 

একটি অদৃশ্য মৌমাছি

দেখো তোমার অন্তর্গত বাসনা কেমন বদলে গ্যাছে
এখন তা কতোটা-ই না অনায়াস আর নিপাট,

তার সাথে গোটা দুনিয়া কতোটা উচ্ছ্রিত হয়ে উঠছে নতুন ভঙ্গিমায় নবতর বিকাশে

তোমার আত্মা উত্তীর্ণ হয়ে উঠেছে এক অদৃশ্য
মৌমাছির গুঞ্জনে, দেখি না — দেখতে পাই না

অমৃত মাছিখানি, কিন্তু দেখি মধুভরা চাক
যেমন ছয়ফুট উঁচু হয়তো তোমার দেহ

কিন্তু অন্তর বিরচিত ৯তবক আসমানের বাঁকে
এক আলিশান পিঁপের মুখে আটকানো বসুন্ধরা ছিপি

কাঁচা কাঠের ঝাড় একান্ত আড়ালে তুলে রেখেছে
পুরনো মদের উষ্ণ সঞ্জিবনী পসরাখানি

আমি তোমাকে দেখি — তোমার আকার যেথায় উধাও
যা দেহাতীত দুই আকুতির এক মোহনায় বিলীন

প্রেমাষ্পদের পানে নিষ্কলুষ আগুনে পোড়া তোমার অদম্য সংরাগ লোটায় প্রেমের দীক্ষাদাতার পায়ে

পিছনে চন্দ্র-সূর্য একপায়ে খাড়া তোমাদের সম্ভ্রমে।।

 

আশেক মাসুকে অভেদ

খুব সকালে দয়িতা তার দয়িতকে জিজ্ঞেস করে —
তুমি কী আমাকে তোমার নিজের চেয়ে বেশি ভালোবাসো?
আমার নিজের চেয়ে বেশি?
অবশ্যই, আমি বলে কিছু নাই আমার।
আমি তুমি হয়ে গ্যাছি।
আমি — বিলীন হয়ে গ্যাছি, কেবল তুমি রূপায়িত হয়েছো।
আমার পরিচয় লুপ্ত হয়েছে।
এটিই আমার নিরেট উত্তর।
তুমি আর আমি বলতে কিছুই বোঝায় না আর।
আমি নাই হয়ে গ্যাছি
মধুর সমুদ্রে আমি একফোঁটা মধু হয়ে বিলীন।।

 

জীবনবৃক্ষ

একজন বড় মুন্সী একবার গল্প বলার ছলে বলেন, ভারতে এমন একটি বৃক্ষ আছে — যার ফল খেলে মানুষ কোনদিন বুড়ো হয় না।

একবার এক বিচক্ষণ লোক রাজার ধন কিছুটা হাতিয়ে নেবার আশায় রাজার সকাশে এই কাহিনী বলে। রাজা তো জীবনবৃক্ষের ফল সংগ্রহের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। রাজা অতঃপর নানা যোগাড়যন্ত্র করে তাঁর রাজ্য থেকে একজনকে সেই ফলের খোঁজে ভারতে পাঠিয়ে দেন, তিনি এমন ব্যবস্থা করেন — যেন ওই মুসাফিরের খোরপোষ ও অর্থকড়ির ন্যূনতমও কমতি না হয়। মুসাফির তার যাত্রা শুরু করে — ভারতের একশহর থেকে আরেক শহর, এক পাহাড়ি দুর্গম অঞ্চল থেকে আরেক উপত্যকার দিকে, এক দ্বীপ থেকে নতুন চর অভিমুখে, এক সমতল ভূমি থেকে মাইলের পর মাইল ভিন্ন অঞ্চলের অন্বেষায় ছুটে যেতে থাকে, আর পথে যাকে পায় তাকেই জিজ্ঞেস করে — তারা কেউ জীবনবৃক্ষের খবর জানে কিনা।

যাকেই মুসাফির জীবনবৃক্ষের কথা জিজ্ঞেস করে সে-ই তাকে ঠাট্টা করে, বলে কী- কারো মাথা বিগড়ে না থাকলে এমন একটি গাছের তালাশ করা কী সম্ভব? বড় কোন কারণ ছাড়া এমন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কেউ রাতকে দিন দিনকে রাত করতে পারে?

আবার কিছু লোক ওই তালাশকারী মানুষটির সঙ্গে মশকরা ও খেলায় মাতে- আরেকটু বেগে ধেয়ে যান ভাই, জীবনবৃক্ষ আপনার আয়ত্তে এলো বলে- পেয়ে যাবেন মশাই- সে এক অতিকায় বৃক্ষ, কোনভাবেই আপনার চোখ এড়িয়ে যাবে না, সে গাছ ইয়া লম্বা — চারদিকে ছড়ানো তার ডালপালা- দেখামাত্রই আপনার চক্ষু ছানাবড়া হবে, বিশ্বাস করতেই আপনার জিভ বেরিয়ে যাবে! এমন মিথ্যা আশ্বাসে মুসাফির নিজেকে তুলা তুলা করে জীবনবৃক্ষের নাগাল পেতে আরও নাকাল করে ফেলে।

রাজার দূত আরও শক্ত পায়ে কোমর বেঁধে মাঠে নামে, নিজের সমস্ত শক্তি একাগ্র করে রাজার জন্য জীবনবৃক্ষ খুঁজে বের করতে এককাট্টা হয়ে নামে — রাজাও বিরতিহীনভাবে তার খায়খোরাকি, অর্থকড়ি, সোনাদানা পাঠাতেই থাকেন।

শেষপর্যন্ত রাজার লোক আর কুলিয়ে ওঠে না, সমস্ত শরীরমন ভেঙে আসে তার — এবার রণে ভঙ্গ দেয়। সমস্ত ত্যাগ-তিতিক্ষা, আশাভরসা ভেস্তে যায় — জীবনবৃক্ষের একতিল সন্ধানও করে উঠতে পারেনি দূত। ফলে তার সাকল্য আশা মুখ থুবড়ে পড়ে, আশার বাতি নিরাশার অন্ধকারে নির্বাপিত হয়।

সে অতীব দুঃখে সম্পূর্ণ ভগ্নমনোরথ হয়ে রাজার কাছে ফেরত যেতে মনস্থির করে, ভাঙা মন আরও ভাঙা দেহে রাজদরবারের দিকে যাবার পথে তার এক শেখের সঙ্গে মোলাকাত হয়, মুন্সী শেখ তার এই অপার হতাশার কারণ জিজ্ঞেস করতেই রাজার লোক জীবনবৃক্ষ খোঁজার আদ্যোপান্ত তাঁকে খুলে বলে; সব শুনে শেখ বলেন এই বৃক্ষ জৈবিক কাণ্ড ডাল ও লতাপাতার গাছ নয়, যে বৃক্ষের ফল খেলে মানুষ জরা ও বার্ধক্য জয় করতে পারে তার নাম জ্ঞানবৃক্ষ — সেই বৃক্ষের কাণ্ড দীঘল, আকার সুশক্ত, অনেক তার ডাল ছড়ানো, অসীম তার বিস্তার, ঈশ্বরের করুণাজল থেকে সেই গাছের শিকড় রসদ টেনে নেয়, তার নির্দিষ্ট আকার নাই- কখনও গাছ, আবার হয়তো সে সূর্য, আবার একসময় সমুদ্রের অসীম, কখনও বা মেঘরূপে আকাশজুড়ে ওড়ে।

এমন এক জ্ঞানবৃক্ষ থেকে শতসহস্র জায়গায় জীবন লকলকিয়ে ওঠে — ওখানে হয় মৃত্যুহীন প্রাণ, হয়তো এর উৎস এক — কিন্তু ওখান থেকেই আসে দুই, ও বহু, এ কোন আকারে দৃশ্যমান নয় — এ কেবল চৈতন্য ও মর্মের মনোনয়ন। যদি তুমি একটি আকৃতি বা চেহারা অন্বেষা করো — কোনদিনই হয়তো তার দিদার পাবে না তুমি, পেলেও তা অসিদ্ধ আকারে মূর্তিমান, নামের তকমায় তাকে বেঁধে ফেলো না — তথ্য নয় বরং তুমি তাৎপর্যের বাঞ্ছা ধরো- আদল তোমার গন্তব্য নয়- তুমি যাচ্ছো ভাবের স্পন্দনের দিকে।।

আগের লেখাবিদেশে উচ্চশিক্ষার যাত্রাপথ কতোটা কঠিন?
পরের লেখাকাজী নজরুল ইসলামের ১০টি গান
বদরুজ্জামান আলমগীর
বদরুজ্জামান আলমগীর: কবি, নাট্যকার, অনুবাদক। জন্মেছিলেন ভাটি অঞ্চল কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে। পড়াশোনা বাজিতপুরে, পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বহুদিন দেশের বাইরে- যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় থাকেন। বাঙলাদেশে নাটকের দল- গল্প থিয়েটার- এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য; নাট্যপত্রের সম্পাদক। নানা পর্যায়ে আরও সম্পাদনা করেছেন- সমাজ ও রাজনীতি, দ্বিতীয়বার, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, পূর্ণপথিক, মর্মের বাণী শুনি, অখণ্ডিত। প্যানসিলভেনিয়ায় কবিতার প্রতিষ্ঠান- সংবেদের বাগান-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। প্রকাশিত বই।। আখ্যান নাট্য: নননপুরের মেলায় একজন কমলাসুন্দরী ও একটি বাঘ আসে। কবিতা: পিছুটানে টলটলায়মান হাওয়াগুলির ভিতর। আখ্যান নাট্য: আবের পাঙখা লৈয়া। প্যারাবল: হৃদপেয়ারার সুবাস। কবিতা: নদীও পাশ ফেরে যদিবা হংসী বলো, দূরত্বের সুফিয়ানা। ভাষান্তরিত কবিতা: ঢেউগুলো যমজ বোন। ছিন্নগদ্য : সঙ্গে প্রাণের খেলা।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here