সাদত হাসান মান্টোকে বলা যেতে পারে উপমহাদেশে সবচেয়ে ধারালো দেশভাগের চলচ্চিত্রের কারিগর হিসাবে; কিন্তু প্রকৃতপ্রস্তাবে এই চলচ্চিত্র আসলে সাহিত্যের মধ্যেই নির্মিত এক ‘বিশেষ চলচ্চিত্র’ — যা মান্টো নির্মাণ করেন নানান সাহিত্য-কৌশল ব্যবহারের মাধ্যমে। মান্টো নিজেও জড়িত ছিলেন সিনেমার সাথে। ওয়াকিবহাল ছিলেন সিনেমার নানান করণ-কৌশল সম্পর্কে। বম্বের ফ্লিম ইন্ড্রাস্ট্রিতে মান্টোর হাঁটা-চলার ইতিহাস সে কথারই জানান দেয় আমাদের। সিনেমার জগৎ নিয়ে তাঁর উপলব্ধি জ্ঞানের দোররা হাঁকিয়ে দেশভাগের মতো বিষণ্ণ বিষয় কোলে করে লিখে ফেলেছিলেন এক দারুণ বই, শিরোনাম : সিয়াহ হাশিয়ে, যা কালো সীমানা নামে অনূদিত হয়েছে, অনুবাদ করেছেন জাভেদ হুসেন। মান্টোর এই লেখা লিখতে গিয়ে জাভেদ হুসেনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতেই হয়, কারণ তাঁর সুবাদেই মান্টোর এই সিয়াহ হাশিয়ে পড়ার সুযোগ হয়েছে বাংলাদেশের গড় পাঠকের, আমারও। প্রান্তে আমার বাস, উর্দু জানি না; এমন অনেকেই জানেন না, তাদের কাছে জাভেদ হুসেনের অনুবাদ শেষ সম্বল।
উপমহাদেশের সবচেয়ে খতরনাক কাণ্ড হিসেবে ইতিহাসে আঁশটে ঘাঁয়ের মতো বিচ্ছিরি অবস্থায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে ‘দেশভাগ’ ব্যাপারটা। দুনিয়ার ইতিহাসে ‘ভায়োলেন্সের’ খাঁটি উদাহরণ কেউ দাবি করলে ভারতভাগের এই ইতিহাস তার পাতে তুলে দিলেই হবে; আর কিছুরই দরকার পড়বে না, এ হলফ করেই বলা যায়। সেই ব্যাপারটা বেশ সিনেম্যাটিক অ্যাপ্রোচে মান্টো পাঠকের পাতে তুলে দিয়েছেন। একটা বিষয় বলে নিতেই হয়, ইতিহাস রচনায় বাঘা বাঘা লোকজন ক্ষমতার দালাল হয়ে ইতিহাস রচনা করে। তাই ইতিহাসের আসল যে সত্য, তা ক্ষমতার চাপে পড়ে ক্ষমতার দালাল হয়ে ওঠে; সত্যি ব্যাপারটাই চর্চার অভাবে মিথ্যা হয়ে ওঠে ক্রমাগত, আমরা বঞ্চিত হই প্রকৃত ইতিহাস-পাঠ থেকে।
এইরকম একটা কথার চাউর আছে যে, উপমহাদেশের ভায়োলেন্সের পিছনে বড় চাল চেলেছিল ধর্মগুরুরা; যারা বুঁদ হয়েছিল ধর্মের আফিমে। কিন্তু এই দাঙ্গার পিছনে যে দীর্ঘ রাজনৈতিক-মনস্তাত্ত্বিক ইতিহাস-প্রবণতা সক্রিয়ভাবে কাজ করেছে এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে, তা অধিকাংশ ‘লাটসাহেব ইতিহাসবিদ’ বাদ দিয়ে যান, বেশ হেসে খেলেই। কিন্তু এই রাজনৈতিক-মনস্তাত্ত্বিক কারণের পিছনে যে দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ আর রাজনৈতিক কার্যক্রমের ইতিহাস লুকিয়ে আছে; তা আমরা সহজেই বুঝতে পারব; যদি আমাদের সেই বোধটা থেকে থাকে, না হলে নয়। যদি কেউ এ প্রশ্ন করে ফেলে, তবে তাকে ভারতে ঔপনিবেশিক আমলের রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক ইতিহাসের দিকে নজর বুলানোর জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা গেল।
মান্টো দেশভাগের গল্প বলার ছলে যে ইতিহাস আমাদের কাছে পেশ করেন; সেই ইতিহাস-সত্য প্রমাণিত করতে গিয়ে মান্টো বারবার গিয়ে হাজির হয়েছেন উপমহাদেশের ধর্ম-সত্যের দোরগোড়ায়। কারণ, ধর্মের নামেই তো খুন-খারাবির ইতিহাস নির্মিত হয়ে গেল বিশেষভাবে।
যদিও মান্টো তাঁর এই গ্রন্থের অণুগল্পগুলোতে এই ব্যাপারে তেমনভাবে মুখ খোলেন না। এরও কারণ স্পষ্ট। মান্টো আসলে সিনেমার ‘বিহাইন্ড দ্য সিনের ব্যাপারে’ আগ্রহ দেখাতে পারেননি। সিনেমায় এটা সম্ভব; কিন্তু গল্পের বেলায় তো তা সেভাবে সম্ভব নয়। কিন্তু সিনেম্যাটিক অ্যাপ্রোচে লেখা এই গল্পগুলোতেও মান্টোর পিছনের বিস্তৃত বিষয় নিয়ে ফাল পাড়ার সময়ের অভাব ছিল। তার কারণটা জানতে হলে মান্টোর জীবনটাও একটু পড়ে দেখতে হবে। তাই মান্টো নিজ চোখে দেখা বাস্তব-চিত্রকেই বিশেষভাবে হাজির করেছেন কালো সীমানায়। মান্টো এই উপস্থাপনরীতির দিক থেকে অনেকটাই ফরাসি প্রকৃতিবাদীদের মতো দৃঢ়তায় সবল হয়ে উঠেছেন। কারণ বাস্তববাদকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নেওয়ার জন্য ‘ফরাসি ন্যাচারালিজমের’ একটা বড় প্রভাব সমগ্র দুনিয়ার সাহিত্যেই রয়ে গেছে, যার চিহ্নও বেশ সবল। মান্টো সেটাকে আরো ভিন্নভাবে উপস্থাপন করলেন তাঁর কালো সীমানায়; তাই বিষয়টা বিশেষ হয়ে উঠলো বিশেষের মধ্যে। আবার একইসাথে মান্টো তাঁর এই গল্প-প্রকল্পে বিশেষভাবে যে পোশাকে হাজিরা দিয়েছেন, সেই পোশাকের প্রভাব দীর্ঘদিন আমাদের গল্প পড়ার ছলে সত্য ইতিহাস বলার ব্যাপারটাও জায়মান থাকবে। ইন্টারেস্টিং ইনাফ!
মান্টো দেশভাগের গল্প বলার ছলে যে ইতিহাস আমাদের কাছে পেশ করেন; সেই ইতিহাস-সত্য প্রমাণিত করতে গিয়ে মান্টো বারবার গিয়ে হাজির হয়েছেন উপমহাদেশের ধর্ম-সত্যের দোরগোড়ায়। কারণ, ধর্মের নামেই তো খুন-খারাবির ইতিহাস নির্মিত হয়ে গেল বিশেষভাবে। এই জায়গায় আরো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রয়ে যায়, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করেছে কারা? ধর্ম বিষয়ে বাড়াবাড়ি করা লোকদের ধর্ম-জ্ঞানের পরিমাণ কতোটুকু? তারা কি ধর্ম বিষয়ে পণ্ডিত, না মূর্খ? এ প্রশ্ন আসতেই পারে। মান্টো সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে আমাদের দিকে চালান করেছেন; আমরা দেখে আসলেই হতবাক হয়েছি। বহুদিন আগে, ক্রুসেডের ভয়াবহ নৃশংসতা থেকেই জানা গেছে শান্তির নামে ধর্মের দোহাই দিয়ে অশান্তি করা লোকজনের কাজ-কারবার।
এই ব্যাপারটা যে এখন দুনিয়া থেকে ভ্যানিশ হয়ে গেছে, তা আমরা বলতে পারি না; বরং জোর দিয়েই বলতে পারি যে, ব্যাপারটা আরো তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে, হচ্ছে দিন দিন। ইয়োরোপে এর তীব্রতার নগ্নতা আমরা সরাসরি দেখতে না পারলেও ভারতীয় উপমহাদেশে এবং মধ্যপ্রাচ্যে এ ব্যাপারটা তীব্র থেকে যে আরো তীব্রতর হয়েছে : এ আমরা হলফ করেই বলতে পারি। আর এর পিছনে যে সমস্ত ধর্মের সমস্ত মানুষই কাজ করছে তেমন না। আবার কোনো প্রাজ্ঞবান ধর্মগুরু, কিংবা ধর্মগুরুর কথায় অন্যরা এই কাজ-কারবার চালিয়েছে, তেমনটাও না। আসলে ধর্মের নামে এই কাজকারবার চালিয়েছে ধর্ম বিষয়ে মূর্খের দলেরা। এরই উদাহরণ দিয়েছেন মান্টো। মান্টো বলছেন, ‘পাঠানিস্তান’ গল্পের সংলাপে, ব্যাপারটা।
‘তাহলে বল তোর নবীর নাম কী ?’
‘মোহাম্মদ খান।’
‘ঠিক আছে… যা।’ (সাদত হাসান মান্টো, কালো সীমানা, অনুবাদ : জাভেদ হুসেন, ৪৬ : ২০১৯)
এই সংলাপ শুনলে যে কোনো কমজান্তা মুসলমান ফিক্ করে হেসে দিতে বাধ্য; আবার হাসতে হাসতে গড়িয়েও পড়তে পারে। কিন্তু মান্টো দেখালেন পাঠানিস্তান বানানোর মূল কারিগররাই ওয়াকিবহাল নয় ধর্মের প্রাথমিক কাণ্ডজ্ঞান সম্পর্কে। তাহলে ধর্মের নামে, ধর্ম বিষয়ে ফাঁপা ও ফাঁকা মানুষেরা, ধর্মের বড়াই করে, মানবিকতার চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করে যে অরাজকতা সৃষ্টি করল এর কারণ কী? মান্টো এ প্রশ্নেরও উত্তর দিয়েছেন তাঁর এই গল্পগ্রন্থের অণুগল্পে।
সহিংসতার বিকৃত মনস্তত্ত্ব আমাদের যে কাউকে বিশেষভাবে ভাবিয়ে তুলতে সক্ষম। ভারতের দাঙ্গার সময় এমন বিকৃত হত্যাকাণ্ডেরই ছড়াছড়ি দেখা যায়।
সহিংসতার বিকৃত মনস্তত্ত্ব আমাদের যে কাউকে বিশেষভাবে ভাবিয়ে তুলতে সক্ষম। ভারতের দাঙ্গার সময় এমন বিকৃত হত্যাকাণ্ডেরই ছড়াছড়ি দেখা যায়। দীর্ঘদিন ভারতবর্ষ যে সহিংসতার অভিজ্ঞতা বহন করেছিল, যা সচল ছিল ইংরেজের শোষণের নানামাত্রিক স্কেলে, সেই ব্যাপারটাকেই পরবর্তী সময়ে ভারতবর্ষের জনগণ আত্মস্থ করেছিল। আত্মগত এই অভিজ্ঞতা নিজেরাই ফলাতে চেষ্টা করেছিল নিজেদের বিরুদ্ধেই; আর সেটা ঘটেছিল দেশভাগের সময়, দেশভাগের পূর্বেও অল্পবিস্তর কিছু ঘটেনি এমন না, ঘটেছে। বহুদিন যাবৎ কোনো একটা ব্যাপার সামনাসামনি ঘটছে, আর তা কেউ দেখছে; যে দেখছে এই ব্যাপারটা, সেও নানাভাবে প্রভাবিত হবে দর্শিত ব্যাপরটাতে। ‘জবাই আর কোপ’ নামক গল্পে মান্টো এই বিকৃত মনস্তত্ত্বকেই যুৎসইভাবে তুলে ধরেছেন। এই গল্পে এক দাঙ্গাবাজ আরেক দাঙ্গাবাজকে বলছে জবাই করতে গেলে দেরি হতে পারে, তাই কোপ দিয়ে হত্যা করলেই সুবিধা হবে। ভেবে দেখুন একবার, এতোই খুন করতে হয়েছে যে, জবাই করার সময় পর্যন্ত নেই! ‘একেবারে ছুটি গল্পে’র পাঁচ লাইনে মান্টো দিয়ে দিয়েছেন লক্ষ লক্ষ মানুষের হত্যার বিবরণ। এই দেশভাগের দরুন কেউ যে ছাড় পায়নি; তারই প্রামাণ্য দলিল এই গল্পটা। ছুটিতে বাড়ি যাওয়া লোকের মতো লক্ষ লক্ষ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে; আসলে হত্যা হয়ে গেছে ‘এ’ ‘ওর’ কোপে; ‘ও’ ‘এর’ কোপে — পারস্পরিক দা চালাচালিতে জান হারিয়েছে সাধারণ জনগণ।
এইরকম নানা গল্পে মান্টো সহিংসতার আদি চিত্রকে তুলে ধরেছেন। দীর্ঘদিনের সহিংসতার মধ্য দিয়ে যে মানুষ সময় পার করছে; আসলে সে সেই সহিংসতা-চরিত্রেই বিশেষভাবে পাকা হয়ে উঠছে। এবং দীর্ঘদিন কোনো ভূমিতে এই সহিংস-বাস্তবতা যদি এক নাগাড়ে চলতে থাকে তবে এই চরিত্র গড় জনগণের রক্তের মধ্যেও প্রোথিত হতে বাধ্য। ইংরেজ আসার আগে এই ব্যাপারটা চোথে পড়েনি; এমনকি শান্ত-শিষ্ট ভারতের গ্রামসমাজেও এই প্রবল সহিংসতার ব্যাপারটা চোখে পড়ে না। ফলে সহিংসতার এই মনস্তত্ত্ব যে আসলেই একটা নেতিবাচক ব্যাপার, তা তো আর বলতে হয় না আলাদা করে। এবং এই নেতিবাচক প্রভাব যে সহিংসতার ভূমির মানুষের বৈকল্যে কাতর মানুষের বাস্তব চিত্র উদ্ঘাটনে প্রয়াসী হয়েছেন। মান্টো এই গল্পের চরিত্র দিয়ে বলাচ্ছেন এমন কথা :
‘গুলি তো শেষ হয়ে গেছে।’
‘চুপ করো! এতো ছোট বাচ্চা বুঝবে নাকি!’ (সাদত হাসান মান্টো, কালো সীমানা, অনুবাদ : জাভেদ হুসেন, ৩৯ : ২০১৯)
যে কারো কাছে এটা হাস্যকর ঠেকতে পারে; কিন্তু আদতেই এমনটা ঘটেছিল। কিন্তু গড় জনগণের মধ্যে সহিংসতার দীর্ঘ অভিজ্ঞাতার প্রভাব এমন একটা জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছিল যে, ‘গুলি বাদেই মানুষ মারার হাস্যকর কৌশল’ আবিষ্কার করে ফেলেছিল দীর্ঘ সময় ধরে মানসিক বৈকল্যে ভোগা জনগণ।
উপমহাদেশের দাঙ্গার সময় সমগ্র ভারতবর্ষই হয়ে পড়েছিল একটা আস্ত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প। যে যেখানে পেয়েছে সেখানেই হত্যার বাজার বসিয়ে রেখেছে। হয়তো তা বাসে, ট্রেনে, পাড়ায়, দোকানে, মহল্লায়; যেখানেই হোক না কেন — আস্ত এক কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের আবহ তৈয়ার হয়েছিল সেই সময়। ধরা যাক একটা বাসে করে দু সম্প্রদায়ের মানুষ পথ মেপে মেপে আশ্রয় খুঁজছে। হঠাৎ বাস থেমে গেল, এক সম্প্রদায়ের লোকজনকে নামিয়ে হত্যা করা হলো আর এক সম্প্রদায়কে হালুয়া, দুধ আর ফল দিয়ে বরণ করে নেওয়া হলো। কিন্তু একটু সামনেই বাস গেলে দুধ-খাওয়া দলটা যে দা-এর কোপ খাবে; এ নিশ্চিত করে বলা যায়। আসলে কমিউনাল ভায়োলেন্সে কেউ কাউকে ছাড় দেয় না, ছাড় দিলে আসলে কমিউনাল ভায়োলেন্সের সূত্র মেলে না। এই ব্যাপারটাই একেবারেই কম কথায় (পাঁচ লাইন) পূর্ণাঙ্গ দৃশ্য পেয়েছে ‘আতিথেয়তা’ গল্পে।
কমিউনাল ভায়োলেন্সে একপক্ষ জিতে যাওয়ার জন্য অপর পক্ষকে আক্রমণ করে, নানা উপায়ে, নানা পদ্ধতিতে। এরই আরেকটা কৌশল অপর পক্ষের নেতৃস্থানীয় লোকজনের ওপর আক্রমণ করা। আরেকটা ব্যাপার হলো, অপর পক্ষের গুরুত্বপূর্ণ মানুষ যদি মৃত হয় তবে অবক্ষ মূর্তি ভাঙা কিংবা মূর্তির সাথে জীবিত মানুষের চেয়েও জঘন্য ব্যবহারে মেতে ওঠা। গঙ্গারাম নামের জনহিতৈষী ব্যক্তির মূর্তির ওপর হামলা করে ভাঙচুর সহ নানা অপকীর্তির পর যখন গুলি খেয়ে পড়ে গেল দাঙ্গাকারী; তখনই তাকে যেতে হলো সেই গঙ্গারামের হাসপাতোলে! এ এক দারুণ রিডিকিউলিং, গল্পে তৈয়ার করে ফেললেন মান্টো। এইরকম আরো রিডিকিউলিং চোখে আগুনের আঁচ লাগায়; ‘কপাল’, ‘ভর্ৎসনা’, ‘সব তার দয়া’, ‘সরি’ গল্পগুলো পড়ার পর। আসলে এইভাবেই তো প্রতিবাদ করেন বাঘা সাহিত্যিকরা। তাঁদেরকে দাঁড়াতে হয় না রাস্তায়; ফ্ল্যাগ, কার্ড, ব্যানার আর ফেস্টুন নিয়ে। কারণ সেই প্রতিবাদ করার তো অনেক লোক আছে। লেখক তো প্রতিবাদ করবেন তার লেখাতে, খাতা-কলমে। আসলে বাস্তবে যে মান্টো কনক্রিট প্রতিবাদ করেন না, এমন নয়; করেছেন, ঢের করেছেন — তার উদাহরণ আছে ভুরিভুরি। এই যে এতো কথা বললাম, তার মূল সূত্র পেলাম মান্টোর একটা অণুগল্পে : গল্পের নাম ‘জুতো’। পাঠক গল্প পাঠ করলে ওপরের আলাপের সাথে একাত্ম হতে পারবেন। না হলে না।
স্যাটায়ার সাহিত্যে তীব্র চাবুকের মতো। স্যাটায়ার দিয়ে যে কোনো সাহিত্যিক সমাজ, রাষ্ট্র, বিশ্বের নানা অনিয়মকে চাবকাতে পারে, ইচ্ছেমতো; এবং তা বিশেষভাবে কার্যকরও বটে। স্যাটায়ার নিয়ে এম এইচ আব্রামসও এই এক কথাই বলছেন :
Satire has usually been justified by those who practice it as a corrective of human vice and folly; Alexander Pope, for example, remarked that “those who are ashamed of nothing else are so of being ridiculous.” Its frequent claim (not always borne out in the practice) has been to ridicule the failing rather than the individual, and to limit its ridicule to corrigible faults, excluding those for which a person is not responsible. (M. H. Abrams, A Glossary of Literary Terms, 276 : 1999, Heinle & Heinle, U S A)
অণুগল্পের আয়তন কম, মান্টোর এই গ্রন্থের গল্পগুলো আয়তনে আরো ভীষণভাবে কম। কিন্তু এই বিন্দুর মধ্যে স্যাটায়ারের সিন্ধু ঢুকিয়ে আরামসে দেশি মদ গেলায় ব্যস্ত থেকেছেন মান্টো; অথবা বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে কেঁদে গেছেন ভিতরে ভিতরে। আর এ গল্প পড়ে এদিকে আমরা না পারি হাসতে, না পারি কাশতে, না পারি কাঁদতে — বিমূঢ় বিস্ময়ে তাকিয়ে তাকিয়ে গল্প দেখি। আসলে দেখি যেন সিনেমার ফিতে চলে যাচ্ছে কেবল রিল মেশিনের ভেতরে, আর আমরা দেখে যাচ্ছি সেই সিনেমা — যে সিনেমা যোগান দিয়েছে এক করুণ ইতিহাসের সত্য দৃশ্য-চিত্র। মান্টো শুধু সিনেমা বলেই ক্ষান্তি দিচ্ছেন না; মান্টো নির্মাণ করে যাচ্ছেন একের পর এক স্যাটায়ার। যে স্যাটায়ার যে শুধু আমাদের রস-কষে হাসিয়ে ফেলে এমন নয়, হাসির সাথে সাথে এক গভীর দুঃখের দিকে নিয়ে যায়; যে দুঃখ আসলে আমাদের ভীষণ ক্লান্ত করে ফেলে। হাসার সাথে সাথে কান্নাটাও ভীড় করে আমাদের চিন্তার আঙিনায়।
ভায়োলেন্সেরকালে জাগতিক ধন-সম্পদের প্রতি মানুষের মায়া ঠিক গনগনে আখার মতো; কাঠ ফেললেই জ্বলবে, তাকানোর সময় নেই। দেশভাগের সময় এই ব্যাপারটাই ঘটে গেছে। সাধারণত এই ব্যাপারটা গল্প-উপন্যাসে তুলতে গড়পড়তা লেখকের শব্দ-খরচার হিসাব মানে না। মান্টো তা বলেছেন সামান্য দু-চার কথাতেই; যার নিট হিসাব হাজার হাজার কথার সমান। ‘খবরদার’ গল্পে এই বিষয়টা বিশেষ হয়ে উঠেছে। দাঙ্গাকারীদের সাবধান করতে গিয়ে বাড়ির মালিক যখন বলে, ‘চাইলে আমাকে মেরে ফেলো, কিন্তু খবরদার, আমার টাকাপয়সায় হাত দেবে না!’ — আসলে তখন ব্যাপারটা হাস্যকরই ঠেকবে যে কারো কাছে। কিন্তু, এই হাসির পিছনে সংঘাত-নির্মিত দুঃসহ অবস্থারই প্রকাশ ঘটে। তবে এও যে এক ধরনের প্রতিবাদ, তা বুঝে নিতে হয় সাবধানে। সহিংসতার চূড়ান্ত পর্যায়ে সহিংসতাকারীরা নিজেদের সহিংসতার বুমেরাঙে ধরা পড়ে গেছে। বলতে চাচ্ছি সহিংসতার আর দাঙ্গার সময় দাঙ্গাকারীদের লোভের ব্যাপারে। আগে যে ব্যাপারটা ঘটে গেল, ‘খবরদার’ গল্পে, সেই ব্যাপারটা এবার আসলো উল্টোভাবে, ‘চ্যালেঞ্জ’ গল্পে। দাঙ্গাকারীরা সকল দোকানপাট ধ্বংস করলেও গৃহনির্মাণসামগ্রীর দোকান ভাঙেনি। এর একটাই কারণ, তা মানুষের অস্থাবর সম্পদের প্রতি দুনির্বার লোভ। তবে এর মাধ্যমে মান্টো ‘বাড়ি বানানোর মালাসামান’ গল্পের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন মূলত নতুনভাবে একটা স্থিতিশীল অবস্থা-প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষাকেই।
এই গল্পগুলোতে দারুণ সব দৃশ্য চাঙড় দিয়ে উঠেছে। ব্যাপারটা কেমন? আসলে বহুদিন যাবৎ উপমহাদেশের সাহিত্যে দাঙ্গার আর দেশভাগের নৃশংসতার দৃশ্যের বাস্তবচিত্রের সাথে পরিচিত ছিল না গাণিতিক গড়ের সাধারণ মানুষজন। সেই খেদ আর হাহাকারের এক বাস্তবচিত্র-দৃশ্য তুলে ধরেছেন মান্টো। মান্টো আমাদের দেশভাগের ভায়োলেন্সের একেবারে খাঁটি দৃশ্যের যোগানদাতা; সেই যোগান তিনি দিয়েছেন তাঁর গল্পে, বিশেষ করে কালো সীমানায়। কালো সীমানায় একের পর এক দৃশ্য আমাদের সামনে ভেসে ওঠে; সেই দৃশ্যে থাকে নানারকম ভায়োলেন্স; ভায়োলেন্সের পূর্ববর্তী ও পরবতী কার্য-কারণ সম্পর্ক। যেই সম্পর্ক থেকে পাঠক সহজেই লুফে নিতে পারে দেশভাগের আগের এবং পরের নানা বিষয়। এই দৃশ্যের সুন্দরের মধ্যেই একের পর এক বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে।
এই গল্পগ্রন্থের সবচেয়ে বড় গল্প ‘মজুরি’; এই গল্পে দাঙ্গার লুটপাটের নিখুঁত বয়ানের সাথে সাথে সূক্ষ্ম হিউমারে ঝলসে গেছে গল্পের বিষয়। তবে এই ঝলসানোর মতো বিষয়টা গল্পের কোনো স্বাদ বদল করে না, বরং আমাদের নতুন এক স্বাদের যোগান দেয়। ‘মজুরি’ গল্পের চিত্র-দৃশ্যে দারুণ স্যাটায়ার সহযোগে মান্টো দাঙ্গার পূর্ণাঙ্গ সত্য দৃশ্যটাই তুলে দিয়েছেন। লুটপাটের হিসাব-নিকাশ শ্রেণির হিসাবে পুরোপুরি বদলে গেছে। ধরা যাক, কোনো ষণ্ডাগোছের লুটপাটকারী লুটের মাল নিয়ে পালিয়ে যেতে পেরেছ সহজে। এ ব্যাপারে পুলিশও বেশ ছাড় দিয়ে দিয়েছে; কারণ পুলিশ পিছে আর নিজেদের ভেতর ঝামেলা বাধাতে ইচ্ছুক হয়নি! কারণ কে কার গায়ে পড়ে ঝামেলায় জড়াতে চায় বলুন! দাঙ্গার সময় আসলে পুলিশের ভূমিকাটা ছিল এমন — দু’ ধর্মের লোকজন নিজেদের মধ্যে কামড়া-কামড়ি করে মরছে মরুক, তাতে আমাদের কী!
ব্যাপারটা আসলেই ঠিক। পুলিশের কী দায় বেঁধেছে যে এই সাম্প্রদায়িক কামড়াকামড়ির মধ্যে তারা প্রবেশ করবে! কিন্তু পুলিশ ষণ্ডাগোছের লোকদের বারবার লুটপাটের হিসাব-খাতার মধ্যে না রাখলেও দুর্বলকে, মানে ঐ ষণ্ডাগোছের লোকের বিপরীত, হেনস্থা করতে একটুও দেরি করেনি। ‘সহযোগিতা’ নামের গল্পে এই ব্যাপারটা দগদগে ঘায়ের মতো উজ্জ্বল। এই গল্পে বাড়ি লুটেরাদের প্রায় সবাই আগে বর্ণিত ষণ্ডাগোছের, তারা লুটপাট করে নবাবি আয়েশে বের হয়ে গেছে লুট হয়ে যাওয়া বাড়ি থেকে। কিন্তু ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে পথ চলা শারীরিকভাবে দুর্বল মজুর ধরা পড়ে যায় পুলিশের হাতে। পুলিশ কেড়ে নেয় তার বস্তা-টস্তা সব। কিন্তু এর প্রতিবাদ করার শক্তি তো নেই ল্যাংচানো শ্রমিকের। ফলে সে পুলিশের কাছেই লুটের মাল দিয়ে যাওয়ার বদলে মজুরি চেয়ে বসেন! গল্পে ল্যাংচানো মজুর বলছে, ‘আচ্ছা হুজুর, বস্তা আপনি রেখে দিন, আমার বস্তা বওয়ার মজুরি হলেই চলবে, চার আনা।’ মান্টো পারেনও বটে!
চিত্রকল্প আলোচনায় কেবলই ঘুরেফিরে কবিতাকে টেনে আনা হয়। ভেবেই নেওয়া হয়, চিত্রকল্প যেন কবিতার বাপ নয়, দাদার সম্পদ। এ কথার মুখে কালি ঘষে দিলেন মান্টো, মুখ কালো হয়ে গেল কালিতে, কালো সীমানার কালো গল্পগুলোতে। মান্টো তাঁর এই গল্পগুলোতে একের পর এক চিত্রের সমহার ঘটিয়ে জানিয়ে দিলেন, চিত্রকল্প ব্যবহারে মান্টোর ক্যারিশম্যাটিক ক্ষমতাকে। মান্টো বাপ-দাদার সম্পদকে আনায়সে নিজের করে নিলেন এই অণু গল্পগুলোর মাধ্যমে। কিন্তু গল্পের বেলায়ও তো চিত্রকল্পের ব্যাপারটা দেখা হয় মান্টোর এই গল্পের বেলায়।
মান্টোর গল্প পাঠে আমরা সহসা সচকিত হয়ে ভাবতে থাকি, আসলে আমরা কী পড়ছি? আমরা কি কবিতা পড়ছি, নাকি পড়ছি ছোটগল্প? কিন্তু আসল ব্যাপারটা হলো এই যে, মান্টোর এই গল্পগ্রন্থ পাঠ করলে আমরা স্পষ্ট হই যে, এই গল্পেরা এক একটা কবিতা হয়ে ওঠে। কিন্তু কবিতা তো ক্রমাগত শামুকের মতো গুটিয়ে থাকে, নিজের মধ্যেই নিজে। কিন্তু কথাসাহিত্য তো এক লাফিয়ে চলা খরগোশ। এই ব্যাপারটাও ঠিক রেখেছেন মান্টো; তাঁর গল্পগুলোতে। অর্থাৎ, গল্প পড়ে যে মাল-মসলা পাওয়া উচিৎ, তাও পাওয়া যায় যেমন, তেমনি করে কবিতা পড়ার, বিশেষ করে কবিতার চিত্রকল্পের ব্যাপারটা, ছবির ব্যাপারটা পাওয়া উপরি পাওনা হিসাবেই পেয়ে যাবেন যে কেউ। কবিতার দৃশ্য ও চিত্রকল্পের উপাদান জুতসই আকারে নির্মিত হয়েছে মান্টোর এই গল্পগ্রন্থের গল্পে।
বেশ কথাবার্তার ফল পাড়া হলো। এবার তা কুড়িয়ে এক জায়গা করা যাক। দেখা যাক কী পাওয়া গেল এতো ঝাঁকাঝাঁকিতে। মান্টোর কালো সীমানায় দেশভাগ বিষয়ক গল্পগুলো একত্রিত করলে একটা পূর্ণাঙ্গ সিনেমাই যেন দাঁড়িয়ে যায়। সেই সিনেমা আমরা যদি দেখি, তাহলে দেখব যে, দেশভাগের পূর্ণাঙ্গ একটা দলিল মান্টো নির্মাণ করে ফেলেছেন। যে দলিলে বাস্তবতা আর সত্য এমন মিলেমিশে আছে যে, মিথ্যা তার ধারেকাছে ঘেঁষতে পারেনি; আর ধান্দাবাজি অথবা গাল-গপ্পের তো কোনো স্থানই নেই। শিরোনামে ‘স্ন্যাপশট’ নামক সিনেমার যে করণকৌশলের কথা আগেই বলা হলো; সেই করণকৌশল যে খাতা-কলমের মাধ্যমে ‘টেকনোলজির মোটামুটি ভালো পর্যায়ে’ উৎপাদন সম্ভব, মান্টো আমাদের তা ভালোভাবেই করে দেখিয়ে দিলেন। ছোট ছোট স্ন্যাপশট মিলে একটা সিনেমা নির্মিত হয়। সমগ্র স্ন্যাপশট যদি আমরা একটা করে ফেলি তবে আমরা দেখি যে একটা সম্পূর্ণ সিনেমা। যাতে ধরা পড়ে গেছে সমগ্র দেশভাগের চালচিত্রের পূর্ণরূপ। মান্টো দেখালেন কীভাবে খাতা-কলমের দৃশ্যের উৎপাদনে হয়ে যেতে পারে একটা পূর্ণাঙ্গ সিনেমা। যেই সিনেমায় বাস্তবতা এমন আঁটোসাঁটো হয়ে রয়েছে যে সিনেমার দর্শকেরই সিনেমা দেখার পর, কার্যত গল্প-পাঠ, কানে-মুখে তালা লেগে যেতে বাধ্য।
Exactly.