মাটির প্রদীপ : ৪

সন্ন্যাসী, ধর্মগুরু ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে ভগবান শ্রীরজনীশ বা ওশো সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। জীবদ্দশায় এবং মৃত্যু-পরবর্তী কালে অটুট তাঁর প্রভাব। মূল হিন্দি থেকে ওশোর মিট্টি কে দিয়ে বইটির অনুবাদ করেছেন অজিত দাশ

বো ধি ক থা সংকলন : ৪

বৃদ্ধদের একটা আসরে বসেছিলাম। অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধরা, ধর্ম নিয়ে আলোচনা করছিল। লোক-পরলোক নিয়ে ব্যর্থ আলাপে মগ্ন আর সেটাকে ধর্ম বলে চালিয়ে দিচ্ছিল। অবশ্য তাদের আলোচনা একদিক থেকে ঠিকই ছিল। কারণ ধর্মশাস্ত্র বলে আমরা যেটাকে জানি বা পড়ি সেখানেও এই একই জিনিসে ঠাসা। কখনো কখনো ভাবি, এই ধর্মশাস্ত্রগুলো এমন অবকাশপ্রাপ্ত বৃদ্ধরাই রচনা করেছে কিনা কে জানে!

আমি মনে করি, ভ্রান্ত শব্দ, সিদ্ধান্ত আর বিচারবোধ থেকে মুক্ত চেতনাকে আমি ধর্ম মনে করি।

যদি ধর্ম বলে কিছু থেকেই থাকে তাহলে সেটা হলো স্বয়ং আমাদের জীবন; ব্যর্থতার বিচারবোধের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু শাস্ত্র তো হলো বেঁধে দেওয়া কিছু শব্দ আর বাক্য মাত্র। আর তথাকথিত ধার্মিক ব্যক্তিদের স্বপ্ন আকাশযাত্রা করে তৃপ্ত হয়। শাস্ত্র আর সিদ্ধান্ত তাদের হৃদয়ে পথে বাধা হয়ে থাকে, ধর্মকে প্রবেশ করতে দেয় না।

তাহলে ধার্মিক চিত্ত কী রকম?

আমি মনে করি, ভ্রান্ত শব্দ, সিদ্ধান্ত আর বিচারবোধ থেকে মুক্ত চেতনাকে আমি ধর্ম মনে করি।

ধার্মিক চিত্ত, কল্পনাবেষ্টিত চিত্ত নয়। কল্পনাবেষ্টিত চিত্ত যথার্থবাদী হতে পারে না, তাদের হৃদয় সত্যের কঠোর ভূমিতে দাঁড়াতে পারে না।

 

আমি যখন আনন্দ নিয়ে অবসরপ্রাপ্ত এই বৃদ্ধদের আলাপ শুনছিলাম তখন সেখানে একজন সন্ন্যাসীর আগমনও ঘটলো ততক্ষণে। তিন বলতে লাগলেন, কয়েক জন্ম তপস্যার ফলে জীব মুক্তি লাভ করে। ধর্ম নিয়ে তার জানাশোনা ভাল। তাই গলার আওয়াজও উঁচু হয়ে গেল। চিৎকার করে তার বিচার অন্যদের শোনাতে লাগলেন। একজন বলে মুক্তির জন্য কয়েকজন্ম লাগে, তো আরেক জন বলে মুক্তির জন্য অনুতপ্ত হলেই হয়। জন্মান্তরের কোনো সম্পর্কে নেই।

 

এরপর এক ফাঁকে তাদের একজন আমাকে জিজ্ঞেস করে বসলেন, আমার ধারণা কী ধর্ম নিয়ে। আমি যথারীতি চুপ ছিলাম। সাধারণত এমন আড্ডায় আমার কিছু বলতে ইচ্ছে হয় না। চুপ থেকে গেলাম। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে আরও একজন জানতে চাইলেন। তারপরও আমি চুপ থেকে গেলাম। সম্ভবত আড্ডার সবাই কথা বলতে বলতে ক্লান্ত তাই আমার কথা শুনতে চাইছিলেন। আমিও ফেসে গেছি, সবাই মিলে আমার মতামত শুনতে চাইছে। আমি বললেও আর কী বলবো? আমি তাদের একটা গল্প বললাম, “একটা গ্রামে এমন পরম্পরা ছিলো যে, সেখানে কোনো যুবক বিয়ে করলে অবশ্যই কনে পক্ষকে ৫ হাজার টাকা দিয়ে বিয়ে করবে। এটাই ছিলো শাস্ত্রসম্মত। পণ্ডিতদের নির্ধারিত ছিল সেই শাস্ত্র। কয়েক প্রজন্ম সেই শাস্ত্র মেনেই গ্রামের যুবকরা বিয়ে করেছে। তারা নিজেরাও জানে না আসলে শাস্ত্রে কী নির্দেশ দেওয়া ছিলো। আর শাস্ত্র তো সর্বদাই সত্য। কোনোকিছু শাস্ত্রে উল্লেখ থাকা মানে এর সত্যতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।  শুরু থেকেই সেখানে উল্লেখিত সব সত্য।  কিন্তু একবার এক যুবক মাত্র পাঁচশ টাকা কনে পক্ষকে দিয়ে বিয়ে করে ফেললো। নিশ্চই সেই যুবক বিপ্লবী ছিলো। গ্রামের লোকেরা ইতিমধ্যে জেনে গিয়েছিল তার ঘটনা।

 

পঞ্চায়েতের জমায়েত হলো সেই যুবকের বিচার করার জন্য। সে শাস্ত্র ভঙ্গ করেছে। পঞ্চায়েত সেই যুবককে জিজ্ঞেস করল, তুমি ভুল কাজ করেছ, পাঁচ হাজার মূল্য পরিশোধ না করা পর্যন্ত কোনো বিয়ে হবে না।‘ সেই যুবক হাসতে হাসতে জবাব দিল, পাঁচশ টাকায় বিয়ে করা যাবে, নাকি পাঁচ হাজার টাকায়, এই তর্ক আপনারা করতে থাকেন। আমি বউ পেয়ে গেছি আর তাকে নিয়ে আনন্দেই আছি।“

 

এই বলে সেই যুবক বাড়ি চলে গেল। আমিও গল্প শেষ করে সেখান থেকে কেটে পড়লাম।

 

পড়ুন ।। কিস্তি ৩

মাটির প্রদীপ : ৩

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here