জেন্ডার টলিয়ে-দেয়া ওলন্দাজ ভাষা

গাস্তঁ দোরেন একজন বহুভাষী সাংবাদিক ও ভাষাতাত্ত্বিক। ওলন্দাজ ভাষার জেন্ডার বিষয়ক এই লেখাটি তার একটি বইয়ের ছোট অধ্যায়। অনুবাদ করেছেন বাংলা ভাষার খ্যাতিমান অনুবাদক জি এইচ হাবীব

 

এই সংলাপটি কেমন বলুন তো দয়া ক’রে:

# ‘Ze heeft mooie poten.’

:: ‘Ja, heeft-ie.’

ইংরেজিতে অনুবাদ করলে এটা এমন দাঁড়তে পারে–

# ‘She has nice legs.’

:: ‘Yeah, doesn’t he?”

এটা এমন এক ধরনের আলাপ যেটা শুনলে মনে হবে এখানে একটা গুরুতর গণ্ডগোল আছে। কিন্তু প্রথম বক্তা যদি বেলজিয়ামের হন আর দ্বিতীয় জন হল্যান্ডের, তাহলে তাঁদের কথোপকথনটা একদম এরকম হতেই পারে – যদি ভালো-লাগা পাগুলো কোনো ব্যক্তির না হয়ে, ধরুন, একটা টেবিলের হয়।

 

ব্যাপারটা সম্ভব তার কারণ ওলন্দাজ সেই অগুনতি ভাষার একটি যে-ভাষা শুনলে মনে হয় -– যেমনটা একজন আমেরিকান বলেছিলেন — ‘জিনিসপত্তরের যৌনাঙ্গ গজিয়ে গেছে।’ অন্য কথায় বলতে গেলে, ওলন্দাজ ভাষায় প্রতিটি বিশেষ্যর একটি জেন্ডার আছে, এমনকি এক কাপ কফিরও। সত্যি বলতে কি, ওলন্দাজ ভাষায় এক কাপ কফির নানান জেন্ডার আছে: a kop koffie ম্যাসকুলিন জেন্ডার, খানিকটা kopje koffie নিউটার, আর – মুখ্যত বেলজিয়তে — একটি tass koffie ফেমিনিন। বেলজিয়ামে a tafel (table) ফেমিনিন, যদিও নেদারল্যান্ডস-এ মুখ্যত ম্যাসকুলিন — সেই কারণেই ওপরের ছোট্ট সংলাপটাতে ওই গোলমালটা ঘটেছে। A model, ওলন্দাজ ভাষায় সবসময়ই নিউটার, তা সেটা জাগুয়ার XJ গাড়ি বোঝাক, বা নাওমি ক্যাম্পবেল বা ডেভিড গ্যান্ডিকে বোঝাক।

 

তাহলে, একটা ওলন্দাজ বিশেষ্যর জেন্ডার থাকার মানেটা আসলে কী? এই প্রশ্নের জবাব হচ্ছে : ‍কিছুইনা। জেন্ডার এই কন্টেক্সটে বা পরিপ্রেক্ষিতে স্রেফ একটি ব্যাকরণগত প্রপঞ্চ বা ঘটনা, যা, মোটের ওপর বললে, দুটো বিষয় বা জিনিস নির্ধারণ করে: ডেফিনিট আর্টিকল এবং সর্বনাম বাছাই। সব ইংরেজি বিশেষ্যই একটি ডেফিনিট আর্টিকল ‘the’ নিয়ে মহাসন্তুষ্ট, কিন্তু তাদের ওলন্দাজ তুল্যরূপ de (ম্যাসকুলিন ও ফেমিনিন) এবং  het (নিউটার)-এ বিভক্ত: de kop, de tas, de tafel, het kopje, het model। প্রাচীন ইংরেজি, সেই দ্বিতীয় শতক থেকে একাদশ থেকে শতকের আগ পরযন্ত, একইভাবে বিশেষ্যগুলোর জেন্ডার নির্ধারণ ক’রে দিয়েছিল, কিন্ত আধুনিক ইংরেজিভাষীরা যখন ওলন্দাজ বা ফরাসী বা জর্মন বা রাশি রাশি অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষার কোনো একটি শিখতে যায় তখন তাদের কাছে জেন্ডারের এই গোটা ব্যাপারটা একটা বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

 

সর্বনামের ক্ষেত্রে, ইংরেজি ‘it’ সিঙ্গুলার ও শ্বাস-প্রশ্বাস নেয় না এমন যে কোনো কিছু বোঝাতে পারে। কিছু ব্যতিক্রম আছে যদিও, যেমন ‘fill her up’ (এই শিরোনামের স্টিং-এর সেই গানটির কথা মনে করতে পারেন) বা, ‘Britain calls upon her sons’-এর মতো ব্যবহারে, কিন্তু সেসব তো, আমরা যাকে বলি, ব্যতিক্রমই। তাই না? কিন্তু ওলন্দাজে ব্যাপারটা তা নয়: ওলন্দাজ সর্বনামের ক্ষেত্রে, সবসময়েই, সেগুলো যেসব বিশেষ্যর পরিবর্তে বসে সেগুলোর জেন্ডার বুঝিয়ে দেবার একটা ব্যাপার থাকে। কাজেই, একই কফির কাপ একজন ‘he’, একজন ‘she’, বা একটি ‘it’-এর যে-কোনোটিই হতে পারে (hij, zij বা het); আর সেটা নির্ভর করবে একজন ওলন্দাজভাষী ঠিক কোন বিশেষ্যটির কথা বলছেন তার ওপর (kop, tas, kopje)।

 

কিন্তু প্রাচীন ইংরেজিভাষীরা এই জেন্ডার বিভক্ত বিশেষ্যর বিধি বা পদ্ধতিটি প্রবল নিষ্ঠার সঙ্গে অনুসরণ করলেও, যা কিনা জর্মনরা এখনো ক’রে থাকে, সর্বনামের বেলায় ওলন্দাজভাষীদের মধ্যে এধরনের কোনো ব্যকরণগত বিধিব্যবস্থার অস্থিত্ব নেই। ওলন্দাজ ভাষায় জেন্ডার নৈরাজ্যটিই মনে হয় আদর্শ বা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে — যদিও এসবের বেশিরভাগই বেলজিয়ামে আর তার পার্শ্ববর্তী ওলন্দাজ অঞ্চলগুলোতে খাটে না।

 

এই অবস্থার কথা যদি আপনি ওলন্দাজ লোকজনের কাছে বলেন তাহলে সম্ভবত এই জবাবটি পাওয়া যাবে যে, তারা প্রাচীন নিয়মই অনুসরণ করছে, যদিও যৎসামান্য এদিক-সেদিক ক’রে। তাঁরা এ-ও স্বীকার করতে পারে যে তাঁরা  নারী ও পুরুষ মডেলের ক্ষেত্রে, যথাক্রমে ‘he’ এবং ‘she’ ব্যবহার করে (মানে, সে দুটোর ওলন্দাজ তুল্যরূপ)  ‘it’ না ক’রে। আর তাদের মধ্যে আরো ভাষা সচেতন যারা তারা হয়ত এ-অব্দিও কবুল করবে যে বহু ফেমিনিন শব্দ ম্যাসকুলিন হয়ে গেছে, যেমন tafel আর school। কিন্তু নৈরাজ্য? মোটেই না!

 

হতে পারে তারাই ঠিক – একটা পর্যায় অব্দি  সেটা নৈরাজ্য নয়। কিন্তু কথা হচ্ছে, ওলন্দাজভাষীরা পুরনো নিয়মকানুন সব ওলট পালট ক’রে ফেলেছে, বিশেষ ক’রে কথা বলার সময়, কিন্তু তারা তাদের ইশকুলজীবনে যা কিছু শিখেছিল সেসব তাদের এতটাই অন্ধ ক’রে রেখেছে যে আসলে কী হচ্ছে সেটা বের করার জন্য এই বই রচনায় একজন কনট্রিবিউটর, জেনি অড্রিং-এর মতো বিদেশীকে, আমদানী করতে হয়েছে। আর তাঁর তিনি লক্ষ করেছেন যে ওলন্দাজ ভাষা রীতমত একটা জেন্ডার রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে গেছে।

ওলন্দাজ লেখকরা কিন্তু একটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় দশার মধ্যে নিজেদের আবিষ্কার করেন, কারণ ‘he’, ‘she’ বা ‘it’ ব্যবহার করতে গেলেই তাঁদেরকে দু’বার ভাবতে হয়।

তো, এই হলো অবস্থা। ‘শি’ (She) শব্দটির ব্যবহার একটি ক্ষুদ্র ক্যাটাগরিতে এসে ঠেকেছে: জীবন্ত প্রাণী, যার ‘ফিমেল সেক্স’ সম্পর্কে বক্তা প্রবলভাবে সচেতন। এর মধ্যে রয়েছে সব নারী, সেই সঙ্গে কারো পরিচিত সব মাদী জন্তু, যেমন পোষা প্রাণী এবং ঘোড়া, অথবা আপনি কৃষক হলে, ভেড়া, গাভী, এবং শুকরি। সত্যি বলতে ইংরেজির চাইতে তেমন ভিন্ন কিছু নয় আসলে।

 

কিন্তু একজন ইংরেজি ভাষীর কাছে যেটা বেখাপ্পা ঠেকবে তা হলো, নন-লিভিং বা অ-প্রাণীবাচক জগৎ ‘it’ দিয়ে ভরপুর হয়ে যায়নি। কাজটা অনেকটাই সাধিত হয়েছে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ‘he’-কে দিয়ে। সনাতন জেন্ডার নির্বিশেষে সব সিঙ্গুলার বস্তুই এখন ‘he’ দিয়ে বোঝানো হয়:  a cup of coffee, an aeroplane, an atom, a planet, কী নয়? মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণী যা নিশ্চিতভাবেই ফিমেল নয় সেগুলোও এই অবেজেক্ট ক্যাটাগরিতে ঠাঁই পেয়েছে – যেটা সেক্সিযমের একটা স্থূল উদাহরণ। তৃতীয় এবং শেষ সিঙ্গুলার সর্বনাম–এর কথা বলতে গেলে বলতে হয় সেটাকে বরাদ্দ করা হয়েছে ওয়াইন, লাগেজ, এবং ইনফরমেশনের মতো ‘মাস-নাউন’ আর joy, honesty, এবং ফের সেই information-এর মতো বিমূর্ত ধারণার জন্য।

Amersfoort, schrijver Gaston Dorren

অবশ্যই, সব ভাষাতেই রাস্তার ভাষা আর অভিধান ও ব্যাকরণ বইয়ে যতটুকু নমোঃ নমোঃ ক’রে তুলে রাখা হয় তার মধ্যে তারতম্যের একটা মাত্রা আছে। ভাষা নিত্য পরিবর্তনশীল। এবং তথাকথিত বিধিগুলো বাস্তবতার সঙ্গে অনেকসময়ই রীতিমত সাংঘর্ষিক। এই যেমন, ইংরেজির প্রাচীন ঘরানার বৈয়ানকরিণকেরা আপনাকে বলবেন যে, ‘they’ হচ্ছে থার্ড পারসন প্লুরাল সর্বনাম, এবং সেটাকে সবসময় সেভাবেই ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু কথা বলার সময় লোকে বহুদিন ধরেই they–কে একটা সিঙ্গুলার সর্বনাম হিসেবে ব্যবহার করছে, যাতে ক’রে বিশেষ কোনো জেন্ডার বোঝানোর ব্যাপারটা এড়ানো যায়, যেমন: তারা বলবে, ‘Any English speaker will tell you that they have used “they” in this way’। এটা নয় “Any English speaker will tell you that he has used ‘they’ in this way. ভবিষ্যতে ‘they’ শব্দটির এই ব্যবহার দাপ্তরিকভাবেও গৃহীত হবে বলে আশা করা যায়।

 

সে যাই হোক, ওলন্দাজ লেখকরা কিন্তু একটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় দশার মধ্যে নিজেদের আবিষ্কার করেন, কারণ ‘he’, ‘she’ বা ‘it’ ব্যবহার করতে গেলেই তাঁদেরকে দু’বার ভাবতে হয়। আমার ভাষাটি আমারই নাকের ডগায় বসে কীভাবে বদলে যাচ্ছে সেটা জেনি অড্রিং যেভাবে ব্যাখ্যা করছেন তা দেখে একজন ভাষাতাত্ত্বিক হিসেবে আমি বেশ শিহরিত।যদিও একজন লেখক হিসেবে আমি সুখী নই, কারণ এখন আমি জানি যে ওলন্দাজ ভাষার জন্য দুই সেট বিধি বা নিয়মকানুন আছে – রাস্তার নিয়ম, আর অভিধানের নিয়ম, আর, লেখার জন্য যখন-ই আমাকে আমার টেবিল চেয়ারে বসতে হয় তখন আমাকে এই দুই নিয়মের মধ্যে থেকে বেছে নিতে হয়। ভালোই একটা যন্ত্রণা বটে।

 

পাদটীকা: ১. লো কন্ট্রিগুলো ইংরেজি ভাষাতে যত শব্দ রপ্তানি করেছে তা অবাক হওয়ার মতোই:  ৩০০-রও বেশি। ‘beleaguer’, ‘cruise’ ‘coleslaw’ থেকে শুরু ক’রে ‘plug’, easel’ gfv ‘smuggler’ অব্দি।

২. Uitwaaien —  হাওয়াবহুল, প্রায়শই কনকনে ঠান্ডা আর বৃষ্টিপ্রবণ, কোনো স্থানে গিয়ে আরাম করা ওলন্দাজদের মতো ব্রিটিশরাও যেহেতু এমন আচরণ করাতে অভ্যস্ত, তাই এই শব্দটি তাদের কাজে লাগবে।

 

লেখক পরিচিতি

গাস্তঁ দোরেন একজন ভাষাতাত্ত্বিক, সাংবাদিক এবং বহুভাষাবিদ। তিনি ওলন্দাজ, লিম্বার্গিশ, ইংরেজি, জর্মন, ফরাসী, এবং হিস্পানীতে কথা বলতে পারেন, পড়তে পারেন আফ্রিকানস, ফ্রিসীয়, পর্তুগীজ, ইতালীয়, কাতালান, ডেনিশ, নরওয়েজীয়, সুইডিশ এবং লুক্সেমবুর্গিশ। ওলন্দাজ ভাষায় তিনি দুটো গ্রন্থ রচনা করেছেন — অভিবাসীদের ভাষা নিয়ে রচিত Nieuwe tongen (New Tongues), এবং Taaltoerisme (Language Tourism), যে-বইয়ের ওপর ভিত্তি ক’রে Lingo: A Language Spotter’s Guide to Europe ইংরেজিতে রচিত হয়েছে, এবং তৈরি হয়েছে Language Lover’s Guide to Europe নামের একটি অ্যাপ (বক্ষ্যমাণ রচনাটি Lingo বইটির-ই একটি নাতিদীর্ঘ অধ্যায়ের অনুবাদ)। অবসরে গাস্তঁ দোরেন গান গাইতে পছন্দ করেন, এবং অবশ্যই তা বহু ভাষায়। নেদারল্যান্ডের আমার্সফুর্ট-এ তিনি সস্ত্রীক বাস করেন।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here