দীপেশ চক্রবর্তী গ্রহীয় সচেতনতা মানুষ ও না-মানুষী ইতিহাসের অস্তিত্বকে একই সন্ধিক্ষণে নিয়ে আসে। সম্প্রতি ‘লৌকিক প্রকাশন’ থেকে প্রকাশিত দীপেশ চক্রবর্তীর জলবায়ু পরিবর্তন ও বর্তমান অতিমারি: মানুষের ইতিহাসে একটি সন্ধিক্ষণ বইটিতে এই বিষয়টি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। দীপেশ চক্রবর্তীর বইটি শুরু হয়েছে সমুদ্র জয়ের ইতিহাসের মধ্য দিয়ে। যে সমুদ্র বাস্তুসংস্থান হচ্ছে গ্রহীয় ব্যবস্থাপনা প্রধানতম উৎস। কিন্তু উপনিবেশায়ন থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত একে মানুষী কর্মযজ্ঞের ইন্সট্রুমেন্ট হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। এই সমুদ্র জয় ও তার বাস্তুসংস্থানকে নিয়ন্ত্রণের ইতিহাস হচ্ছে মানুষী সভ্যতা ও পুঁজির জয়ের ইতিহাস।
ইউরোপীয় দেশগুলো ক্রমশ সমুদ্র জয়ের জন্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লে সমুদ্র মালিকানা নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হলো। যার ফলে সমুদ্র আইন নিয়ে ইউরোপীয়রা ভাবতে শুরু করে। মানব সভ্যতার ইতিহাসের ইউরোপীয়রাই প্রথম সমুদ্রকে ভোগের জন্য আইন তৈরি করে। দীপেশ চক্রবর্তীর মতে এর ফলে আইনি পরিসর ও আইন সম্পর্কিত চিন্তাভাবনারও একটি তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন সূচিত হলো। সমুদ্রের সাথেও যে আইনি সম্পর্ক স্থাপন করা যাবে এ বিষয়টি নিয়ে মানুষ তখন চিন্তাভাবনা শুরু করে। সমুদ্রকে ঘিরে নতুন এই তৎপরতার যেসব ফলাফল দেখা গেলো তারমধ্যে একটি হচ্ছে মানুষের সংখ্যা। এই সময় মানুষের সংখ্যা পূর্বের চেয়েও বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। এর পিছনে চিকিৎসা বিদ্যা ও জনস্বাস্থ্য বিকাশই কার্যকর ভূমিকা রাখে। এছাড়া এটি নতুন যোগাযোগ ও প্রযুক্তিক ব্যবস্থাকে তরান্বিত করে। নতুন নতুন দেশে উপনিবেশায়নের ফলে মানুষের পাশাপাশি এখানকার প্রকৃতিকেও তাদের দখলে নিয়ে আসা হয়। প্রাকৃতিক এনার্জিকে ব্যবহার করে রেললাইনের মতো আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রযুক্তিগত উন্নতির ফলে জীবাশ্ম জ্বালানির পরিমাণ তখন বৃদ্ধি পেতে শুরু করে।
মানুষের ‘উন্নত’ জীবনের চিন্তাভাবনা ও ঔপনিবেশিক তৎপরতার ফলে বৈশ্বিক ব্যবস্থাপনাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করতে শুরু করে। এ সময় মানুষ বৈশ্বিক ব্যবস্থাপনার নতুন এক বিন্যাস ঘটায়। মানব সভ্যতার বিকশিত সফলতার তাৎপর্য যে বিষয়ের মধ্যে অন্তর্নিহিত ছিলো তা হচ্ছে প্রযুক্তির বিকাশ। দীপেশ চক্রবর্তী একে চিহ্নিত করেছেন ‘প্রযুক্তির ক্ষমতা’ হিসেবে।১ মানুষ স্বঘোষিতভাবে নিজেকে উন্নত প্রজাতি হিসেবে বিবেচনা কর। এর প্রভাবে তার চিন্তাভাবনা, কর্মতৎপরতা, প্রযুক্তিক বিকাশ ও ব্যবহারে মানুষ ছিলো সবসময় কেন্দ্রে। যোগাযোগ ও প্রযুক্তির মাধ্যমে যে ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠল তার নামই হচ্ছে ‘গ্লোবায়ন’ বা বিশ্বায়ন। বিশ্বায়নের মাধ্যমে যে উন্নয়ন ও মানবিক বিকাশের ধারণা সুপ্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল এটি ছিলো বিভিন্নভাবে প্রাণের জন্য ক্ষতিকর।
শিল্পবিপ্লব পরবর্তী সময়ে মানবীয় কার্যকলাপের ফলে বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এর ফলে শুধুমাত্র বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পেল তা নয় বরং এর প্রভাব পড়ল প্রাণের উপর। কারণ ৯৩ ভাগ কার্বন-ডাই-অক্সাইড এই সমুদ্র সামুদ্রিক বনাঞ্চল শোষণ করে। কিন্তু একদিকে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের বৃদ্ধি অন্যদিকে মৎস শিল্পায়নের ফলে গভীর সমুদ্রের বাস্তুসংস্থান ধ্বংস তার গ্যাসীয় ধারণ ও শোষণ ক্ষমতার অবনতি ঘটায়। সমুদ্র জলের এসিডিক মাত্রা বৃদ্ধি পায়। এটি সমুদ্রের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণের বিনাশ ঘটায়। এর ফলে গ্রহীয় ব্যবস্থাপনার মধ্যে যে জীব বৈচিত্র, খাদ্য শৃঙ্খলা ও প্রাণের মিথোজীবী সম্পর্ক রয়েছে তার উপর ক্রমশ নেতিবাচক প্রভাব পড়তে থাকে। মানুষের কর্মযজ্ঞের ফলেই দিন দিন পরিবেশের অবনতি ঘটতে থাকে। ১৯৫০ এর দশকে পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানীরা সচেতনভাবে পরিবেশ বিপর্যয়ের ব্যাপারে বলতে শুরু করেন। যদি এ বিষয়টিকে শুরু দিকে রাজনৈতিক ব্যবস্থাপকেরা খুব একটি আমলে নেননি। এর ফলে প্রাণের সমর্থনে যে পদ্ধতি রয়েছে স্বয়ং সেই পদ্ধতিকেই মানুষ বিভিন্নভাবে ক্রমাগত ক্ষতিগ্রস্ত করতে থাকে। এই প্রাণের বিনাশ যেসব ফলাফল নিয়ে আসছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে অতিমারি।
২
দীপেশ চক্রবর্তী পুঁজি ও সাম্রাজ্যের পাশাপাশি যে বিষয়ের ব্যাপারে মানুষের সচেতন তৎপরতাকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন তা হচ্ছে প্রযুক্তির ব্যবহার। মানবকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা থেকে নির্মিত প্রযুক্তির ব্যবহাররের ব্যাপারে তিনি সচেতনতা তৈরি করতে চেয়েছেন। দীপেশ প্রযুক্তিগত পরিবর্তন সাথে প্রাণীজগতের বিপরীতমুখী চিত্র হাজির করেছেন। তার মতে লক্ষ লক্ষ বছরে বিবর্তনের মাধ্যমে প্রাণীজগতের পরিবর্তন হয় অন্যদিকে প্রযুক্তি যে পরিবর্তন সাধন করে তা হচ্ছে বৈপ্লবিক ঘটনার মতো; খুবই স্বল্প সময়ের মধ্যে। প্রযুক্তির এই বৈপ্লবিক পরিবর্তন খুবই সহজেই প্রাণীজগতকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে৷ এটি সহজেই প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। প্রযুক্তির ব্যবহার ও তার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পাশ্চাত্য জগতে দীর্ঘ সময় ধরেই পর্যালোচনা হচ্ছে। দীপেশের চক্রবর্তী মতো প্রাচ্যের বিভিন্ন চিন্তকরাও প্রযুক্তিকে ব্যবহারের যৌক্তিকতা নিয়ে ইতিমধ্যে পর্যালোচনা শুরু করেছেন। দীপেশ চক্রবর্তীর ভাষায়, ‘আমাদের টেকনোলজি নিয়ে গ্যাম্বলিং করতে হয়।’২ আমরা বিভিন্ন প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে আমাদের তাৎক্ষণিক সমস্যাকে সমাধান করতে চাই কিন্তু এর দীর্ঘমেয়াদি ফলাফলের ব্যাপারে চিন্তা করিনা। যার ফলে প্রযুক্তি আমাদের দীর্ঘস্থায়ী সমাধান প্রদান করেনা।
প্রযুক্তিকে ব্যবহারের মানবকেন্দ্রিক সীমাবদ্ধতার দ্বৈত ভূমিকা রয়েছে। এর একটি ধারা মানুষের অগ্রগতি, উন্নয়ন এবং বিভিন্ন প্রকারের সুযোগ সুবিধা। অন্যটি হচ্ছে মানুষের সর্বাত্মক নজরদারির মাধ্যমে ব্যক্তিস্বাধীনতাকে ধ্বংস করা। উভয় ধারায় প্রযুক্তিকে সংকীর্ণভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রগতির সাথে পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি নির্মমভাবে অন্তর্ভুক্ত। সামাজিক প্রগতির ক্ষেত্রে প্রগতির প্রক্রিয়াসমূহ মানবকেন্দ্রিক ভাবাদর্শ দ্বারা পরিচালিত হয়। মানবকেন্দ্রিক উন্নয়ন বা অগ্রগতি যে প্রযুক্তিকে ধারণ করে সেটি পরিবেশকে তার প্রতিপক্ষ ও নিয়ন্ত্রণের বিষয় হিসেবে দেখে। এখানে হার্বার্ট মারকুজের কথা উল্লেখ করা যায়। মারকুজের ভাষায়, ”উন্নত শিল্প সমাজের অধীনে, পরিতৃপ্তি সর্বদা ধ্বংসের সাথে আবদ্ধ। প্রকৃতির উপর আধিপত্যের বিষয়টি প্রকৃতির প্রতি সহিংসতার সাথে জড়িত। শক্তির নতুন উৎসের সন্ধান প্রাণ-প্রকৃতির দূষণের সাথে আবদ্ধ। নিরাপত্তা দাসত্বের সাথে; জাতীয় স্বার্থ বৈশ্বিক সম্প্রসারণের সাথে জড়িত। প্রযুক্তিগত অগ্রগতি প্রগতির বিকাশ এবং মানুষের নিয়ন্ত্রণের সাথে আবদ্ধ।”২
দীপেশ চক্রবর্তী অতিমারি ও অন্যান্য সঙ্কটককে প্ল্যানেটারি স্কেলে দেখার কথা বলেন। কেননা এটি এমন এক গ্রহীয় সচেতনতা তৈরি করে যেখানে মানুষের পাশাপাশি না-মানুষী কর্তাসত্তাও স্বীকৃতি পায়। গ্রহীয় স্কেলে চিন্তা করার অর্থ হচ্ছে নতুন গ্রহীয় সচেতনতা জন্ম দেওয়া।
বর্তমানে মানবপ্রজাতির নতুন এক যুগে প্রবেশের কথা বলছেন ভূতাত্ত্বিকরা। তারা এর নাম দিয়েছেন অ্যানথ্রোপোসিন যুগ। প্লাইস্টোসিন ও হলোসিন যুগ পার হয়ে মানবপ্রজাতি এ যুগে প্রবেশ করেছে। ভূতাত্ত্বিকদের মতে ১৯৫০ এর দশক থেকে এ যুগের সূচনা হয়েছে। এ যুগে পরিবেশের উপর মানুষের সবোর্চ্চ প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। অ্যানথ্রোপোসিন ধারণাটি পরিবেশের ওপর মানুষের প্রভাবশালী আচরণের প্রতি মনযোগ দিতে সাহায্য করে।৪ যে প্রভাবের ফলে সাগর পৃষ্ঠের উচ্চতা ও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানবপ্রজাতি এখন গ্রহের সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং অপ্রতিরোধ্যভাবে ধ্বংসাত্মক ‘কর্তাসত্তা’ হয়ে উঠেছে। মানবকেন্দ্রিকতা প্রযুক্তির একমাত্রিক ব্যবহারকে অনুমোদন প্রদান করে। মানব ইতিহাসের সামাজিক বা রাজনৈতিক পরিসরে ব্যক্তি শুধুমাত্র তার অধিকার ও মযার্দার লড়াইয়ে অনবরত সংগ্রাম করে আসছে। সেই সংগ্রামের বুদ্ধিবৃত্তিক দশার একটি ফলাফল হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তির আবিষ্কার। একইসাথে প্রযুক্তিসমূহের আবিষ্কার হচ্ছে মানব প্রজাতির সৃষ্টিশীল সত্তার বহিঃপ্রকাশ। তবে আমাদের মানবকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই প্রযুক্তির ব্যবহার এবং তথ্য সরবরাহ করা হয় যা ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামোকে উপকৃত করে এবং ক্ষমতায়ন করে। একইসাথে এটি প্রকৃতিকে তার ধ্বংসযজ্ঞের কাজে ব্যবহার করে। মানবকেন্দ্রিক পরিসরে যে রাজনীতির বিকাশ ঘটে তা সার্বিক প্রাণের রাজনীতির ব্যাপারে সচেতন ছিলোনা। মানবকেন্দ্রিক রাজনীতির পদ্ধতি এখন বুমেরাং হয়ে মানুষের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে ফিরে আসছে। পরিবেশের বিপর্যয় এটিই প্রমাণ করে যে পৃথিবীতে মানবপ্রজাতি কোন চূড়ান্ত সত্তা নয় বরং সীমাবদ্ধ সত্তা। তাই মানবপ্রজাতি ধরিত্রীকেন্দ্রিক রাজনীতির ব্যাপারে সচেতন হতে হবে যেখানে সকল প্রাণের সমান গুরুত্ব থাকবে। মানবকেন্দ্রিকতা থেকে বিচ্যুত হয়ে মানবপ্রজাতিকে প্রযুক্তিকে নিয়ে নতুনভাবে চিন্তাভাবনার প্রয়োজন। যে প্রযুক্তি সবসময় মানুষের সাথে প্রকৃতির মিথোজীবী সম্পর্কের সমর্থন বজায় রাখবে।
দীপেশ চক্রবর্তী অতিমারি ও অন্যান্য সঙ্কটককে প্ল্যানেটারি স্কেলে দেখার কথা বলেন। কেননা এটি এমন এক গ্রহীয় সচেতনতা তৈরি করে যেখানে মানুষের পাশাপাশি না-মানুষী কর্তাসত্তাও স্বীকৃতি পায়। গ্রহীয় স্কেলে চিন্তা করার অর্থ হচ্ছে নতুন গ্রহীয় সচেতনতা জন্ম দেওয়া। গ্রহীয় সচেতনতা গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে। এটি এমন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার কথা বলে যেখানে সকলের প্রাণের সংকট মোকাবিলায় কাজ করে। এটি সমস্ত সৃষ্টিকেই রাজনীতির অন্তর্ভুক্ত করে। গ্রহীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে আমাদের গণতন্ত্রের পরিসরকে আরো বিস্তৃত করতে হবে। প্রাণের প্রতি মানুষের আর্থ-রাজনৈতিক বোঝাপড়া ইতিমধ্যে প্রশ্নের সম্মুখীন। যেহেতু প্রত্যেকটি জাতি জীবজগতে বাস করে এবং সবাই এটিকে প্রভাবিত করছে, তাই সকল জাতি এ গ্রহীয় রাজনীতির অংশীদার। একইসাথে মানুষের হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সার্বিক জীবন পদ্ধতির সাথে সে সম্পর্কিত। জীবজগতের উপর মানুষ নির্ভরশীল বলেই একে অপরের ব্যাপারে দায়িত্বশীলতা রয়েছে। যে দায়িত্বশীলতা রাজনৈতিক নীতিমালায় প্রতিফলিত না হলে গ্রহীয় সচেতনা অকার্যকর হয়ে থাকবে। তাই গ্রহীয় রাজনীতি হচ্ছে নতুন ধরনের আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি, যার মানবকেন্দ্রিক রাজনীতি চর্চার অন্তর্নিহিত সঙ্কটের মধ্য দিয়েই এটি ক্রমবর্ধমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। এটি জাতিগুলির একে অপরের সাথে আচরণ ও ক্ষমতা সম্পর্কের উপায়গুলিকে পরিবর্তন করবে একইসাথে এটি আমাদের জীবনযাপনের পদ্ধতিকে পরিবর্তন ঘটাবে।
৩
গ্রহীয় সচেতনতায় ইতিহাসের পর্যবেক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। এর কাজ হচ্ছে ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গির পুনর্নির্মাণ করা। তাই বর্তমানে প্রাকৃতিক ইতিহাস থেকে সামাজিক ইতিহাসকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। মানব ইতিহাস এবং পৃথিবীর ইতিহাস অবিভাজ্য এক সন্ধিক্ষণে পৌঁছেছে। দীপেশ চক্রবর্তী তার বইটিতে দেখিয়েছেন যে এই বিভাজনের পদ্ধতি ইতিমধ্যেই সমাপ্ত ঘটেছে। আঠার শতকের শেষে এবং উনিশ শতকের শুরুর দিকে সমাজতাত্ত্বিক ও দার্শনিকদের নিকট মানুষের ইতিহাস মানবমুক্তি সম্পর্কিত চিন্তাভাবনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো। অর্থাৎ মুক্তি ও স্বাধীনতা সম্পর্কিত ধারণার সম্পূর্ণভাবে মানবকেন্দ্রিক ছিলো। তবে ক্রমবর্ধমান গ্রহীয় পরিবেশের সঙ্কট, মুক্তি ও স্বাধীনতার অন্তর্নিহিত ধারণাকে সম্প্রসারণ ঘটায়। সমাজতাত্ত্বিকদের অভিজ্ঞতায় এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে শুধুমাত্র মানুষের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দেওয়া টেকসই ফলাফল নিয়ে আসবেনা। মানুষ যে গ্রহীয় প্রাণের উপর তার প্রভাব ও আধিপত্য সম্প্রসারণ ঘটায় সেই প্রাণেরও ইতিহাস রয়েছে এবং ইতিহাস সজীব ও নির্জীব সত্তার সাথে আন্তঃসম্পর্কিত।
বর্তমান সময়ে আমরা যে অতিমারির মোকাবিলা করছি এর যে ইতিহাস তা ডিপ এবং রেকর্ডেড হিস্টোরির মাধ্যমে তিনি একে সংশ্লেষণ করেছেন। ভাইরাসের যে বিবর্তনের ইতিহাস তা মিলিয়ন বছরের ইতিহাস। এগুলো বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে নিজেরকে পুনরুৎপাদন করছে। পৃথিবীর আদিতম প্রাণ হচ্ছে এসব ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণী। এগুলোই হচ্ছে জৈবিক প্রাণ পদ্ধতির ভিত্তি। এসব অণুজীবগুলো হচ্ছে ‘প্রাণের প্রভাবশালী রূপ।’ দীপেশ চক্রবর্তী মতে মানুষ যেহেতু ক্রমশ বিভিন্ন শিকারী প্রজাতি মেরে ফেলছে, তাই একমাত্র ‘ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া’ মানুষের শিকারী হিসেবে রয়ে গেছে।৫ ভাইরাস ও অতিমারির এই ইতিহাস যেমন প্রাণের বিবর্তন সম্পর্কের মাধ্যমে গ্রহীয় ইতিহাসের সাথে সংযুক্ত করে তেমনি এটি গ্লোবাল ইতিহাসের সাথেও সংযুক্ত।
মানুষ গ্লোবাল হয়ে ওঠার যে আর্থ-রাজনৈতিক তৎপরতা তার সীমাবদ্ধ ফলাফলের একটি দিক হচ্ছে এ অতিমারি। মানুষ তার অর্থনীতি ও উন্নয়নের সম্প্রসারণ করতে শিকারী প্রজাতিগুলোকে বিভিন্নসময় গ্রাস করছে। জঙ্গল ধ্বংসের মাধ্যমে জীব-বৈচিত্রের অবক্ষয় এই অতিমারির প্রভাবকে তীব্র ও ত্বরান্বিত করেছে। অতিমারির যে পুনরাবৃত্তির ঘটনা এটি বর্তমান সময়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি লক্ষণীয় যে বর্তমান সময়ে অতিমারির খুবই স্বল্প বিরতিতে ফিরে আসছে। এর কারণ হচ্ছে মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর মধ্যকার সহজাত সম্পর্ক ক্রমশ বিলুপ্ত হচ্ছে। মানুষ তার উন্নয়নমূলক কাজে লাগাতার জঙ্গল কেটে বন্য প্রাণীদের নিজের কাছাকাছি নিয়ে আসছে। ব্যাপকভাবে বনভূমি উজাড়, নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে মানুষ অন্যান্য প্রাণীদের বাস্তুসংস্থান ধ্বংস করে তাদেরকে উদ্বাস্তু করছে যার ফলে এগুলো আরো বেশি মানব সংস্পর্শে আসছে।
অন্যদিকে আমিষের জন্য চীনের মতো বিভিন্ন দেশের মানুষ উদ্ভট প্রজাতির মাংস খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। এর ফলে খুব সহজেই মানুষের মধ্যে বিভিন্ন প্রাণীর ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে এবং বৈশ্বিক অতিমারির আকার ধারণ করছে। ভাইরাসের কাজই হচ্ছে বিভিন্ন স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্য দিয়ে নিজেকে পুনরুৎপাদন করা। মানুষের কর্মযজ্ঞের পরিণতিতে মানুষের মধ্যে প্রাণীজ রোগব্যাধির পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অতিমারি আমাদের যে অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে তা হচ্ছে গ্রহীয় ব্যবস্থাপনার ভবিষ্যতের ব্যাপারে আমাদের আরো বেশি আন্তরিক ও কার্যকরী হয়ে ওঠা। অতিমারির সংকটকে মোকাবিলা করতে হলে মানুষ সাথে সার্বিক প্রাণের ইতিহাসের বোঝাপড়াকে কার্যকর করে তুলতে হবে।
তথ্যসূত্র
১. দীপেশ চক্রবর্তী, জলবায়ু পরিবর্তন ও বর্তমান অতিমারি: মানুষের ইতিহাসে একটি সন্ধিক্ষণ, লৌকিক প্রকাশন, নভেম্বর ২০২১, পৃ.২৮
২. প্রাগুক্ত, পৃ.৪৮
৩. Herbert Marcuse, Ecology and the Critique of Modern Society, Capitalism Nature Socialism, Published online: 25 Feb 2009, p.33
http://dx.doi.org/10.1080/10455759209358500
৪. Dipesh Chakrabarty, Anthropocene Time,
History and Theory Volume 57, Issue 1 p. 5-32, Wiley Online library, Published: 09 March 2018
https://onlinelibrary.wiley.com/doi/full/10.1111/hith.12044
৫. প্রাগুক্ত, পৃ.৫২