আহমদ ছফার (১৯৪৩-২০০১) কবিতা পড়তে গিয়ে বারবার ছফার মুখখানা ভেসে ওঠে। খুব সাদামাটা, সহজসরল একখানা মুখ। আমি অনেক সময় অবাক দৃষ্টিতে ঐ মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। চোখ বন্ধ করলেই ঐ মুখের প্রতিচ্ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আমি আহমদ ছফাকে দেখতে পাই। দেখতে পাই, তার কবিতার অন্তর্নিহিত বয়ান ও বিশ্লেষণ। কবিতায় কল্পনার প্রাধান্য থাকলেও আহমদ ছফা খুব সম্ভবত কল্পনা খুব একটা পছন্দ করতেন না। জীবন ও জনপদের বাস্তবতা দিয়েই তিনি কবিতার জমিন সাজাতে চাইতেন। নিজের মতো করে লিখে যেতেন। কারো মতো লিখতে চাননি; কারো মতো হতে চাননি। নিজেই নিজের মতো করে বেড়ে উঠেছিলেন। নিজের মতো করে কবিতার ভুবন গড়ে তুলেছিলেন, গড়ে তুলেছিলেন তার লেখকসত্তা। শব্দ, ছন্দ, অলংকার নানা কিছু কবিতার উপাদান হলেও আহমদ ছফা মানুষকেই কবিতার উপাদান করেছিলেন।
নিজেকেই বারবার নানাভাবে কবিতায় রূপায়ণ করতে চেয়েছেন। চেয়েছেন এই জীবন, জনপদ ও জনমানুষের দুঃখকষ্টকে শানিয়ে তুলতে। তাঁর কবিতাগ্রন্থের শিরোনামও হয় দুঃখের দিনের দোহা (১৯৭৫)। দুঃখকেই তিনি জীবনের সঙ্গী করেছিলেন। দুঃখী মানুষের মধ্যেই নিজেকে খুঁজে পেতে আরামবোধ করতেন। হাটমাঠঘাট, পথপ্রান্তরের একজন হিসেবে নিজেকে মেলে ধরতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন তিনি। তিনি নির্দ্বিধায় লিখতে পারতেন-‘আমি তো দেহাতি লোক/ সর্বক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকি, এমন তৌফিক নেই/ অক্ষমতা ঢাকি। বুলিতে মাটির গন্ধ, লেবাসে/ মিসকিন, ভাঙ্গাচোরা মানুষের সঙ্গে কাটে দিন।’
এটি কেবল আহমদ ছফার কবিকল্পনা ছিল না। বাস্তব জীবনটাও তিনি ঐভাবেই সাজিয়ে নিয়েছিলেন। ঝলমলে দরবার কক্ষ এড়িয়ে চলতেন তিনি। চাইলে তিনি দিব্যকান্তি দেহধারীদের মতো ঝলমলে রাজ দরবারে যেতে পারতেন। সেই সুযোগ ও সামর্থ্য ছিল তার। কিন্তু ঐ পথে পা বাড়াননি তিনি। নিজের সুখসৌন্দর্যের প্রতি তাকাননি তিনি। তিনি তাকিয়েছেন সমসাময়িক সময় ও সমাজের দিকে, জীবন ও জনপদের দিকে, মানুষ ও মানবতার দিকে। জনমানুষের জনজীবনের দুঃখকষ্টকে তিনি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতেন। আর এই উপলব্ধিই তিনি শব্দ ও ছন্দ সংযোগে শিল্পময় করে তুলতে চাইতেন। ব্যক্তি জীবনে আহমদ ছফা বিয়েশাদি করেননি। ঘর-সংসার ছিল না। সাহিত্য-সাধনাকে সঙ্গি করে একজীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। কবিতার সুরে ও স্বরে ঐ দুঃখকথাই লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন তিনি, ‘ঘর করলাম নারে আমি/ সংসার করলাম না/ আউল বাউল ফকির সেজে/ আমি কোন ভেক নিলাম না।’
দুই
স্বাধীনতা-উত্তর স্বাধীন স্বদেশে আহমদ ছফা পুনর্জাগরণ প্রত্যাশা করেছিলেন। প্রত্যাশা করেছিলেন সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা আধুনিক রাষ্ট্র-ব্যবস্থাপনার। কিন্তু সেই প্রত্যশা পূরণ হয়নি। তার স্বপ্ন স্বপ্নের জগতেই থেকে যায়। দুর্নীতি-দুর্ভিক্ষ, মহামারি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আইন-শৃঙ্খলার অবণতিতে জনজীবনে নাভিশ্বাস নেমে আসে। সরাসরি কাউকে দায়ী না করে সেদিন তিনি সময়কেই দায়ী করেছিলেন। তার কবিতাগ্রন্থের শিরোনাম হয়েছিল জল্লাদ সময় (১৯৭৫)। তাকে লিখতে দেখি, ‘এইখানে মানুষ পশুর দোসর/ তরাসে পালায় মৃগের দল।’ দিবালোকে হায়েনার হাসি তাকে অস্থির করে তুলেছিল। আর দশজন কবির মতো ঝাঁকের কৈ এর ন্যায় ঝাঁকের দলে নিজেকে মিলে যেতে দেননি তিনি। তার ব্যক্তিজীবন ছিল অনেকটাই আলাদ। সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে প্রথমদিকে খানিকটা সম্পর্ক থাকলেও শেষ পর্যন্ত ফিরে আসতে হয় তাকে
সুবিধাবাদী, স্বার্থপর, সুযোগ-সন্ধানী কবির সঙ্গে গা মিলিয়ে চলতে চাইতেন না তিনি। তার সাহিত্যিক জীবন অনেকটাই নিঃসঙ্গ ও নির্জনতায় কেটে যায়। ফন্দিবাজ-ফক্বিবাজদের চেয়ে দূর আকাশের তারার সঙ্গে রাত জেগে কথা বলতেন তিনি। লতাপাতা, ফুলফল, পাখির সঙ্গে তিনি সুগভীর সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন; সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন শুভ্রসকালের সঙ্গে। তাকে লিখতে দেখি, ‘আমার কথা কইবে পাখি/ করুণ করুণ ভাষে/ আমার দুঃখ রইবে লেখা/ শিশির ভেজা ঘাসে/ তারার সাথে রাত জেগেছি/ ফুলের সাথে হৃদয় বিনিময়/ বলবে সবাই কেমন ছিল/ মধুর পরিচয়।’ এই পরিচয়ই আহমদ ছফা তার কবিতার জমিন জুড়ে লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন।
আহমদ ছফার কবিতা একটুখানি নিবিড়ভাবে পাঠ করলে দেখব, প্রকৃতির প্রতি তার সুগভীর আস্থা ছিল। তিনি বারবার প্রকৃতির কাছে প্রত্যাবর্তন করতে চাইতেন।
তিন
সাহিত্য-সাধনার প্রায় পুরো সময়টাই আহমদ ছফা রাজধানী শহর ঢাকায় ছিলেন। ঢাকায় অবস্থান করলেও তার কবিমন ছুটে যেতো গ্রামীণ জীবন ও জনপদের দিকে। যেখানে মাঠ থেকে সদ্য কেটে আনা ধান স্তুপাকারে সাজানো রয়েছে, যেখানে দুধকমল আর চন্দ্রমণি ধানের মাড়াই চলছে, যেখানে বনের মর্মরে পূর্বপুরুষের পদধ্বনি শোনা যায়, শ্রবণে মায়ালোকের যাদু রচনা করে; আর্যত্বের গৌরবে স্ফীত হয় না যাদের নাসারন্ধ, ইরান-তুরানের স্বপ্ন হানা দেয় না যাদের অন্তরে, আভিজাত্যের অভিজ্ঞান লিখিত নেই যাদের ঠিকুজিতে, সেই সব গ্রামীণ জীবন ও জনপদে ফিরে যেতে চান তিনি। তাকে লিখতে দেখি, ‘নিয়ে চল আমাকে করুণ বেহালার মত/ সেই সব মানুষের জীবন রঙ্গভূমিতে/ কায়িকশ্রম বংশপরম্পরা যাদের উত্তরাধিকার/ যাদের কাছে আমি রক্তের ঋণে ঋণী/ এবং যাদের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছি বলে আমি গর্বিত।’ আহমদ ছফা নিজেকে দ্রাবিড় পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। ফেলে আসা দ্রাবিড় সমাজেই প্রত্যাবর্তন করতে চাইতেন তিনি।
চার
আহমদ ছফার কবিতা একটুখানি নিবিড়ভাবে পাঠ করলে দেখব, প্রকৃতির প্রতি তার সুগভীর আস্থা ছিল। তিনি বারবার প্রকৃতির কাছে প্রত্যাবর্তন করতে চাইতেন। একটি প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনা (১৯৭৭) কবিতাগ্রন্থে দেখব, আহমদ ছফা নিজেকে প্রকৃতির সন্তান বিবেচনা করছেন। প্রকৃতির কাছেই নিজের সুখদুঃখের বয়ান তুলে ধরছেন। প্রকৃতি বিশেষত প্রাচীন বটবৃক্ষের ওপর মনুষ্যত্ব আরোপ করছেন। তাকে বৃদ্ধ পিতামহ বলে সম্বোধন করছেন। সম্বোধনের শব্দরাজির দিকে তাকালে দেখব, আহমদ ছফা কি গভীরভাবে বটবৃক্ষকে আপন করে হৃদয়ে তুলে নিয়েছেন। মাননীয় বৃদ্ধ তরুবর, হে সৌম্য ধীমান, পিতামহ বৃদ্ধ বনস্পতি, তরু ত্রিকালেশ্বর, যুগান্তের বার্তাবহ, বৃদ্ধ বনস্পতি, প্রবীণ মনীষীবৃক্ষ ইত্যাদি নামে আহবান করে প্রকৃতিকে তিনি একান্তভাবে আপন করে নিয়েছিলেন। সুবোধ সন্তানের মতোই বৃদ্ধ বনস্পতি পিতামহের কাছে আহমদ ছফা আকুল প্রার্থনা, ‘পিতামহ বনস্পতি/ বিনীত সন্তানে তুমি দাও এই বর/ সূক্ষ্ম শরীর ধরে এই মাঠে/ যেন আমি বেঁচে থাকি অনেক বছর।’
সব্যসাচী সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হকের (১৯৩৫-২০১৬) মহাপ্রয়াণের পরে ক্ষমতাবানেরা ঈগলের ন্যায় ডানা মেলে শত মাইল উড়াল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে ছুটে গিয়েছিল কুড়িগ্রামে। আহমদ ছফাকে শ্রদ্ধা জানাতে ওভাবে কেউ কখনো এগিয়ে আসেনি।
আহমদ ছফা একটি সাক্ষাৎকারে পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত বাঁচার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু সময়ের ধাবমান রথচক্র খুব দ্রুতই তাকে রথে তুলে নেয়। নিসর্গের সন্তান আহমদ ছফা আবার নিসর্গের কোলেই ফিরে যান। এই ঝলমলে রাজধানী শহরের প্রাণকেন্দ্রে তার কবর হয়নি। আহমদ ছফা বোধহয় এটি আগেই জানতেন। আগেভাগেই তিনি লিখে রেখেছিলেন, ‘আমি যখন চলে যাব/ আমার খবর/ হাওয়ার কাছে নিয়ো/ বিশদ যদি জানতে চাহ/ শিশিরে শুধায়ো।’
পাঁচ
আহমদ ছফা শিশিরের মতোই জল ও মাটির সঙ্গে স্বদেশের সর্বত্র মিলিমিশে একাকার হয়ে আছেন। খুব সাধারণ সাদামাটা একখানা জীবন নিয়ে তিনি এসেছিলেন এই বাংলায়। ভালোবেসেছিলেন দেশ ও দেশের মানুষকে। মানুষের জন্যই জীবনখানা মুঠিমুঠি করে বিলিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। আহমদ ছফা কোনোদিন ক্ষমতার কাছে যাননি। ক্ষমতাও তার কাছে আসেনি। সব্যসাচী সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হকের (১৯৩৫-২০১৬) মহাপ্রয়াণের পরে ক্ষমতাবানেরা ঈগলের ন্যায় ডানা মেলে শত মাইল উড়াল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে ছুটে গিয়েছিল কুড়িগ্রামে। আহমদ ছফাকে শ্রদ্ধা জানাতে ওভাবে কেউ কখনো এগিয়ে আসেনি। এসব ঘটনা স্মরণ রেখেও বলা যায়, আহমদ ছফা দেশের একমাত্র সাহিত্যিক, প্রয়াণের পর যিনি প্রবলভাবে তার দেশবাসীর কাছে ফিরে এসেছেন। আল মাহমুদ (১৯৩৬-২০১৯) কিংবা শামসুর রাহমানের (১৯২৯-২০০৬) ন্যায় বড় কবির কোনো গ্রন্থ নিয়ে কেউ আর রাজপথে দাঁড়ায় না। কিন্তু আহমদ ছফার গ্রন্থ বুকে ঝুলিয়ে এখনো তরুণেরা বুক ফুলিয়ে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে দাঁড়িয়ে যায়। বুঝতে পারি, তরুণ প্রজন্মের তরুণ হৃদয়ের অনেকখানি জুড়েই আহমদ ছফার অবস্থান।
ছয়
আহমদ ছফার নামের আগে ‘কবি’ শব্দের প্রয়োগ খুব একটা দেখা যায় না। কি অতীতে কি বর্তমানে আহমদ ছফাকে কবি হিসেবে কেউ মানতে চায়নি। আজো চায় না বিশেষত কবিরা। মানুক চাই না মানুক, আহমদ ছফার কবিতা যে আমার ভালো লাগে। আমি যে বারবার তার কবিতার পাঠ করতে চাই। তার কবিতা যে হৃদয় ছুঁয়ে যায়। তিনি যে যথার্থ অর্থে সুকবি ছিলেন। নিজের সৃষ্টিকর্মের প্রতি তার সুগভীর আস্থা ছিল; আস্থা ছিল স্বরচিত কবিতার প্রতিও। তাকে লিখতে দেখি, ‘কার সাধ্য আমাকে ঠেকায়?/ আমার সাধনায় ফুল ধরছে, ফল ফলছে।’
অসাধারণ লিখেছেন স্যার