শিক্ষক জফির সেতুকে যেভাবে দেখি

কবি, কথাসাহিত্যিক ও গবেষক জফির সেতু আজ পৌঁছুলেন ৫০-এর মাইল ফলকে। তাঁকে ঘিরে স্মৃতিময় এই গদ্য লিখেছেন তাঁর ছাত্র ও সহকর্মী আবু বকর সিদ্দিক

 

কথার আগের কথা

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর জীবন-কথা বইয়ে ছেলেবেলার নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকদের কথা স্মরণ করে লিখেছেন, ‘[…] এইসব শিক্ষকের জ্ঞানের পরিধি বা গভীরতা খুব বেশি ছিল না, কিন্তু যেটুকু তাঁরা জানতেন সেটুকু তাঁরা ভালো ক’রেই জানতেন, আর সব কিছু তাঁরা দরাজ হাতে ছাত্রদের কাছে উজার ক’রে দিতেন।’ (চট্টোপাধ্যায়, ২০১৫ : ৫৬)। ছেলেবেলার শিক্ষাগ্রহণের কথা স্মরণ করলে অনেকেরই হয়তো একই ধরনের মন্তব্য পাওয়া যাবে। কিন্তু, বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সুনীতিকুমারের উল্লিখিত মন্তব্যের খানিকটা বিপরীত চিত্র পাওয়া যাবে––বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জ্ঞানের পরিধি বা গভীরতা বেশি, কিন্তু তাঁরা কি সবাই ‘দরাজ হাতে’ ছাত্রদের কাছে নিজেদের উজার করে দেন? নাকি নানান কারণে নিজের আবদ্ধ বা সংকীর্ণ করে রাখেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষক হিসেবে আমার দু-রকম অভিজ্ঞতাই আছে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের আদর্শ ব্যক্তিত্ব ও শিক্ষকের ব্যাপারে কিছু লিখতে গিয়ে এইসব প্রশ্ন আমার মাথায় এসেছে।

 

শিক্ষক জফির সেতু : ‘দরাজ হাতে’ ছাত্রদের কাছে নিজেকে উজার করে দেওয়া মানুষ

সময়টা ২০১১ খ্রিস্টাব্দ। তখন সবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রেখেছি। ওই সময় শাবিপ্রবির বাংলা বিভাগে নতুন একজন শিক্ষক যোগদান করেছেন। বিদ্যায়তনিক জীবনের শুরুতেই (প্রথম বর্ষ প্রথম সেমিস্টার) তাঁর ক্লাস পেয়ে গেলাম। তিনি ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস : প্রাচীন ও মধ্যযুগ (৬৫০-১৮০০)’ কোর্সটি পড়াবেন। তাঁর প্রথম ক্লাসের স্মৃতি এখনো মনে আছে, একজন সুদর্শন মানুষ ডায়াসে দাঁড়িয়ে ভরাট কণ্ঠে কথা বলছেন––কথায় সম্মোহনী শক্তি আর চেহারায় আত্মবিশ্বাসের ছাপ যেন ঠিকরে পড়ছে! একেক করে তিনি ছাত্রদের পরিচয় জানলেন, নিজের পরিচয়ও দিলেন। সেদিনই শিক্ষক জফির সেতুকে আবিষ্কার করি। পরবর্তী ক্লাসেই তিনি পৃথিবীখ্যাত লেখকদের বইয়ের একটা তালিকা দিলেন (সংখ্যাটা ১০০ বা তারও বেশি!)। তালিকায় রয়েছে ইতিহাস, দর্শন, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও দেশি-বিদেশি সাহিত্যের অনেক বই। পুরো ক্লাসে সেই তালিকা লিপিবদ্ধ করি। এসব বই কেন পড়া জরুরি তাও তিনি সংক্ষেপে বললেন, সেই সঙ্গে আমাদের স্মরণ করিয়ে দিলেন, ‘স্নাতকের ০৪ বছরে এসব বই পড়া এবং না-পড়াদের দুনিয়া এক থাকবে না।’ তাঁর সেই কথার তাৎপর্য আজও উপলব্ধি করি।

 

প্রায়শ ক্লাস রুমে যাচ্ছি কিংবা ক্লাস শেষ করে বের হচ্ছি, সে-সময় দেখতাম, ক্লাসরুমের বিপরীত দিকে চার তলা বিল্ডিঙের এক কোণে ছাত্র-ছাত্রীদের ভিড় –– বুঝতে পারলাম, শিক্ষক জফির সেতু তাঁর সহজাত পাণ্ডিত্য ও সম্মোহনী ক্ষমতাবলে যোগদানের অল্প কদিনের মধ্যেই ছাত্রদেরকে আপন করে নিয়েছেন। ক্লাসের নির্দিষ্ট সময়ে কতটুকুই-বা জানা যায়, সে-জন্যেই ছাত্ররা তাঁদের অনেক প্রশ্নের ঝাঁপি নিয়ে তাঁর রুমে হাজির হতো। তিনি অনর্গল কথা বলে যেতেন, চেষ্টা করতেন ছাত্রদের জ্ঞানতৃষ্ণা মেটাবার। আমি নিজের জড়তার জন্যে প্রথম প্রথম তাঁর রুমে যাওয়ার সাহস পাইনি। পরবর্তী সময়ে অবশ্য তাঁর সান্নিধ্য লাভের সুযোগ হয়েছে। দ্বিতীয় বর্ষ দ্বিতীয় সেমিস্টারে তাঁর অধীনে আমার সেমিনার পড়লো –– আমি তো রীতিমতো ভয়ে আছি। কারণ, ইতোমধ্যে জেনে গেছি, পড়াশোনা বা গবেষণার ব্যাপারে তিনি একচুলও ছাড় দেন না! দেনওনি। প্রথমবার, কবি মোহাম্মদ সাদিকের ওপর সেমিনার করেই তা বুঝে গিয়েছিলাম। তাঁর এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল, সেটা ছাত্রদের কাছ থেকে কাজ করিয়ে নেবার ক্ষমতা। সে-জন্য সবাই তাঁকে সমীহ করতো। ভয়ও পেতো। কিন্তু যারা তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছে, তারা ঠিক বুঝে যেতো বাইরে তিনি যতই কঠোর হোন না কেন, ভেতরে তিনি কোমলপ্রাণ!

 

বিদ্যাসাগরের চরিত্রে কুসুম কোমল হৃদয় ও বলিষ্ঠ পৌরুষের সম্মিলন পাওয়া যায় –– শিক্ষক জফির সেতুর মধ্যেও সেটা আমি লক্ষ করেছি। সেই সঙ্গে তাঁর মধ্যে আমি দেখেছি স্বাধীনচেতা আত্মমর্যাদাবোধ। স্নাতক চতুর্থ বর্ষে পড়ার সময়ে একবার তাঁর রুমে গিয়েছি –– নাইজেরিয়ান সাহিত্যিক সাহিত্যিক চিনুয়া আচেবের (১৯৩০-২০১৩) থিংস ফল অ্যাপার্ট (১৯৫৮) উপন্যাস নিয়ে লেখার আগ্রহের কথা তাঁকে বলি। তিনি শুনে খুশি হলেন, বললেন, অবশ্যই লেখো, আমি সহযোগিতা করবো। মাস্টার্স দ্বিতীয় বর্ষে আবার তাঁর অধীনে আমার সেমিনার পড়লো, তখন অবশ্য অনেকটা নির্ভার ছিলাম –– কাজও করেছিলাম অনেক গুছিয়ে। কারণ, প্রথমবারই তাঁর অধীনে কাজ অনেকটা শিখে গিয়েছিলাম। মনে পড়ে, মাস্টার্স প্রথম বর্ষের শেষ ক্লাসটির কথা –– বাংলা কথাসাহিত্যের কোর্স ছিল। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪), সত্যেন সেন (১৯০৭-১৯৮১), মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-১৯৫৬) ও মাহমুদুল হক (১৯৪০-২০০৮) প্রমুখ প্রথিতযশা সাহিত্যিকেরা পাঠ্য ছিল। শেষ ক্লাসটি যেন শেষ হতে চাইছিল না (একটানা প্রায় তিন ঘণ্টা) –– তিনি আমাদের একের পর এক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন। আমরা মোহিত হয়ে শুনছি। এখনও কানে বাজে ক্লাসরুমে বলা তাঁর শেষ কথাগুলি, ‘তোমাদের জীবনটা ৩২০ একরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তোমাদের লড়তে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রদের সঙ্গে। সুতরাং, আর সময় নষ্ট করা যাবে না।’ শেষ ক্লাসে অনেকের মতো আমার কেমন শূন্যতা অনুভব হচ্ছিল –– এটা ভাবতে পারছিলাম না যে, ক্লাসরুমে আর কখনো তাঁর কথা শুনতে পাবো না!

 

ক্লাসরুমের শিক্ষক জফির সেতু কোনো বিষয়ে একটানা কথা বলে যেতেন, তাঁর ক্লাস নির্দিষ্ট সময়ে খুব কমই শেষ হতো। জ্ঞানকাণ্ডের নানান শাখায় যে তাঁর সরব পদচারণা রয়েছে তা তাঁর বক্তব্য থেকে বোঝা যেতো। একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি আরো অনেক প্রসঙ্গের অবতারণা করতেন; ফলে, তাঁর বক্তব্যের মধ্যে একটা জোরালো আবেদন তৈরি হতো। ছাত্ররা প্রশ্ন করলে তিনি খুশি হতেন এবং খুব গুছিয়ে তার উত্তর দিতেন। তিনি ছাত্রদের অনুপ্রাণিত করতেন, শোনাতেন আশার বাণী। তাঁর বক্তব্যের মধ্যে আমি এক ধরনের সম্মোহন লক্ষ করেছি, যার ফলে তাঁর ক্লাসে ছাত্ররা বুঁদ হয়ে থাকতো –– এক ঘণ্টার ক্লাস কখন যে শেষ হতো তা টেরই পাওয়া যেতো না!

 

ক্লাসরুমের বাইরের শিক্ষক জফির সেতুর কথা যদি বলি তাহলে প্রথমেই বলতে হয়, তাঁর ব্যক্তিগত রুমও ছিল একটা ‘মিনি ক্লাসরুম’ –– প্রায়শ তাঁর রুমে ছাত্রদের ভিড় লেগে থাকতো। তিনি ছাত্রদের সঙ্গে অনর্গল কথা বলছেন, বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন, কারো ব্যক্তিগত সমস্যার কথাও শুনছেন; সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হলো, তিনি ছাত্রদের পড়াশোনার ব্যাপারে উৎসাহ দিতেন এবং সে-উদ্দেশ্যে নিজে ছাত্রদের হাতে বই তুলে দিতেন। গবেষণার ব্যাপারেও ছাত্রদের উৎসাহ দিতেন; আর সে-উৎসাহ যে বৃথা যায়নি তার দৃষ্টান্ত হিসেবেই বলছি, তাঁর অধীনেই শাবিপ্রবির বাংলা বিভাগে প্রথম এম. এ. থিসিস সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমানে বেশ কয়েকজন তাঁর অধীনে পিএইচ.ডি ও এম.ফিল ডিগ্রিতে গবেষণারত আছেন। এক কথায় তাঁর শিক্ষকসত্তাকে মূল্যায়ন করতে গেলে বলতে হয়, শিক্ষক হিসেবে তিনি নিজেকে ‘দরাজ হাতে’ ছাত্রদের কাছে উজার করে দিয়েছেন। আর এ-কারণেই তিনি অনেক ছাত্রের কাছে অনুপ্রেরণার বাতিঘর।

 

‘হিউম্যানিস্ট’ ও ‘আর্টিস্ট’

প্রায়শ ক্লাসে আদর্শ শিক্ষকের উদাহরণ দিতে গিয়ে জফির সেতু তেইশ বছরের তরুণ শিক্ষক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও (১৮০৯-১৮৩১) ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের (১৮২০-১৮৯১) কথা বলতেন। ডিরোজিও ও বিদ্যাসাগরকে তিনি যে অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে শ্রদ্ধা করতেন তা তাঁর কথায় অপ্রকাশিত ছিল না। তিনি জ্ঞানচর্চার পরম্পরার কথা বলতেন। পরবর্তী সময়ে এ-বিষয়টা বুঝেছি –– অর্জুনকে সৃষ্টি করতে একজন দ্রোণাচার্য লাগে, এরিস্টটলকে পেতে হলে একজন সক্রেটিসের দরকার হয়, তেমনি ডিরোজিওকে সৃষ্টি করতে হলে দরকার হয় একজন আচার্য ডেভিড ড্রামন্ডের (১৭৮৫/৮৭-১৮৪৩)। ডিরোজিওকে বলা যায় ‘নব্যবঙ্গের দীক্ষাগুরু’। ডিরোজিওর মধ্যে দুটো সত্তা ছিল –– হিউম্যানিস্ট সত্তা ও আর্টিস্ট সত্তা। তাঁর মননশীল ও সৃজনশীল সত্তার মধ্যে অপূর্ব সমন্বয়ও ছিল। বিদ্যাসাগরের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘শিক্ষকের শিক্ষক : আচার্য ডেভিড ড্রামন্ড’ প্রবন্ধে শিক্ষক ডিরোজিও ও তাঁর ছাত্রদের ব্যাপারে যে মন্তব্য করেছেন তা উদ্ধৃত করছি :

তিনি শুধু তরুণ ছাত্রদের মস্তিষ্ক নয়, হৃদয় স্পর্শ করেছিলেন। তাদের প্রশ্ন করতে শিখিয়েছিলেন, আন্তর্জাতিক হবার পথ বাতলেছিলেন। বলেছিলেন, ‘জ্ঞান ও সক্রিয়তা নিয়ে বিশ্বের মাঝে নিজেদের বিকীর্ণ করো, মানবজাতির মধ্যে ছড়িয়ে দাও ভালোবাসার বীজ’, ‘সত্যের জন্য বাঁচো এবং মরো’। শ্রেণিকক্ষের টেবিল চেয়ার উপচে তার ছাত্ররা বিতর্ক সভা ও পত্র-পত্রিকার মধ্যে বিশ্বাসাচ্ছন্ন কায়েমি ব্যবস্থার দিকে ধাবমান হয়ে গিয়েছিল। ফলে সামাল-সামাল রব উঠেছিল চারদিকে (মুখোপাধ্যায়, ২০১৯ : ৯৮)।

শিক্ষক জফির সেতুও একই শিক্ষা তার ছাত্রদের দিয়েছেন, সেটা ক্লাসরুমে কিংবা ক্লাসরুমের বাইরে এবং এ-কাজ তিনি এখনও নিরলসভাবে করে যাচ্ছেন। ছাত্রদের জ্ঞানচর্চায় উদ্বুদ্ধ করার জন্যে তিনি বের করেছিলেন গোষ্ঠীপত্রিকা কথাপরম্পরা –– সেখানে তাঁর ছাত্ররা লিখত। পূর্বে জ্ঞানচর্চার যে পরম্পরার কথা বলেছি তা ধরে রাখাও ছিল এ-পত্রিকার উদ্দেশ্য।

জফির সেতু চিন্তাচেতনায় ‘ক্রিটিক্যালম্যান’। তিনি ক্লাসরুমে ও তার বাইরে ছাত্রদেরকে নতুন জ্ঞানের দীক্ষা দেন। প্রচলিত জ্ঞানকে প্রশ্নের মুখোমুখি করেন। তবে তাঁর চলনে, বলনে, পোশাক-পরিচ্ছেদে একটা শান্ত, সুভদ্র ভাব বা সৌম্যকান্তিভাব আছে।

জফির সেতুর প্রথম পরিচয় তিনি শিক্ষক এবং দ্বিতীয় পরিচয় সৃজনশীল ও মননশীল সাহিত্যিক। শিক্ষক হিসেবে তিনি পালন করেছেন হিউম্যানিস্টসুলভ বৌদ্ধিক মানুষের দায় –– অধীত বিদ্যা ও শাণিত বিচারবুদ্ধি দিয়ে তিনি ছাত্রদের মস্তিষ্ক ও হৃদয় আলোড়িত করেছেন এবং মননশীল লেখক হিসেবে (প্রাবন্ধিক হিসেবে) একই ভূমিকা পালন করেছেন। আর কবি হিসেবে, কথাসাহিত্যিক হিসেবে সৃজনশীল শিল্পীর (আর্টিস্ট) ভূমিকাও পালন করেছেন।

 

‘ক্রিটিক্যালম্যান’ ও ‘জেন্টলম্যান’

তরুণ শিক্ষক ডিরোজিওর মতো জফির সেতুরও শিক্ষার মূল কথা ছিল –– ‘সবকিছুকে কষে নিতে হবে যুক্তির কষ্টিপাথরে।’ অন্ধ বিশ্বাস, ধর্মীয় গোঁড়ামির বাইরে এসে ছাত্ররা যাতে যুক্তিবাদী হয়ে উঠতে পারে সে-দিকে তাঁর সজাগ দৃষ্টি ছিল। উদার ও মুক্তমনের মানুষ হিসেবে তাঁর একটা নিজস্ব আদর্শ ছিল। সে-আদর্শ তিনি ধরে রেখেছেন। সে-আদর্শিক জায়গা থেকে তিনি ছাত্রদের মুক্তিবুদ্ধির চর্চার কথা বলেন। কারণ, তিনি বিশ্বাস করেন, এর মাধ্যমেই নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি হবে। তাঁর সম্পাদনায় যে গোষ্ঠীপত্রিকাটি (কথাপরম্পরা) বের হতো সেখানেও এর প্রতিফলন পাওয়া যাবে। ‘ক্রিটিক্যাল’ জফির সেতুর পরিচয় পাওয়া যাবে তাঁর শিষ্যদের মাঝেও। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে কিছু নাম (যাদের অনেকের লেখা আমি কথাপরম্পরায় পড়েছি) –– অপূর্ব পাল, আজির হাসিব, আলমগীর হোসেন, আবদুল্লাহ আল মামুন, নেসার শহিদ, ম. শিব্বির, রফিকুল রনি, লাকী বেগম, সুফি সুফিয়ান, হালিমা-তুস-সাদিয়া ও বিজিৎ দেব প্রমুখ। এঁদের অনেকের ওপর আমি ‘ক্রিটিক্যাল’ জফির সেতুর প্রভাব লক্ষ করেছি। তাঁর ‘ক্রিটিক্যালম্যান’ পরিচয়ের দৃষ্টান্ত হিসেবে অবিদ্যা (২০১৯) নামের সংগঠনটির কথা না-বললেই নয়––এটি তাঁর উদ্যোগে গঠিত হয়। এই সংগঠনের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিদ্যায়তনিক জায়গায় পুরোনো জ্ঞানকে প্রশ্নের মুখোমুখি করা এবং নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি করা।

 

জফির সেতু চিন্তাচেতনায় ‘ক্রিটিক্যালম্যান’। তিনি ক্লাসরুমে ও তার বাইরে ছাত্রদেরকে নতুন জ্ঞানের দীক্ষা দেন। প্রচলিত জ্ঞানকে প্রশ্নের মুখোমুখি করেন। তবে তাঁর চলনে, বলনে, পোশাক-পরিচ্ছেদে একটা শান্ত, সুভদ্র ভাব বা সৌম্যকান্তিভাব আছে। ক্লাসরুমে এবং তার বাইরে তিনি যে-কোনো বিষয়ে আত্মসম্মান বজায় রেখে কথা বলেন। বিভাগের মিটিঙেও আমি সেটা লক্ষ করেছি। তাঁর বক্তব্যে থাকে আবেগ ও যুক্তির মিশেল। সততার সঙ্গে বক্তব্য উপস্থাপনে এক ধরনের পরিশীলিত রুচির দীপ্তি ফুটে ওঠে। এ-কারণে বলছি, তিনি চিন্তাধারায় ‘ক্রিটিক্যালম্যান’ আর চলনে, বলনে বা ব্যক্তিত্বে ‘জেন্টলম্যান’।

 

শেষকথা

আমার কাছে জফির সেতু আপাদমস্তক একজন শিক্ষক –– যাকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। যার সান্নিধ্যে আমি সমৃদ্ধ হয়েছি। অনুপ্রেরণা পেয়েছি। সেটা ছাত্র হিসেবে, বর্তমানে তাঁর সহকর্মী হিসেবেও। শিক্ষক সত্তার বাইরে, সাহিত্যিক হিসেবে আমার কাছে তাঁর প্রধান পরিচয় কবি; দ্বিতীয়ত, তিনি কথাসাহিত্যিক এবং তৃতীয়ত, মননশীল লেখক বা প্রাবন্ধিক। তাঁর কবি-পরিচয়কে বড়ো করে দেখার একটা কারণ আছে। আমার মনে হয়েছে, জফির সেতুর কবিতা তাঁর কথাসাহিত্যকে শাসন করেছে, তবে প্রবন্ধে অবশ্যই নয়। যাহোক, তাঁর শিক্ষক সত্তা ও লেখক সত্তার মধ্যে দারুণ সমন্বয় লক্ষ করেছি। যে-কারণে তিনি দু-পরিচয়েই উজ্জ্বল।

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) তাঁর সাহিত্যে মানুষের গতিময় জীবন কামনা করেছেন। তাঁর কাছে এগিয়ে চলাই জীবনের ধর্ম। জফির সেতু শিক্ষকতার পথে, সৃজনশীল ও মননশীল সাহিত্যের পথে ক্রমাগত অগ্রসর হচ্ছেন। ক্রমাগত অগ্রসর হওয়াতেই তাঁর আনন্দ। শিক্ষক জফির সেতু, ‘হিউম্যানিস্ট’ ও ‘আর্টিস্ট’ জফির সেতু এবং ‘ক্রিটিক্যালম্যান’ ও ‘জেন্টলম্যান’ জফির সেতুর সৃষ্টিশীলতা অব্যাহত থাকুক––তিনি যেন ‘দরাজ হাতে’ নিজেকে আরো উজার করে দিতে পারেন ছাত্রদের মাঝে, আমাদের মাঝে ও আরো অনেকের মাঝে। তাঁর জন্মদিনের সুবর্ণজয়ন্তীতে সৃজনশীলতার অন্যূন শতবর্ষ কামনা করি।

 

তথ্য-ঋণ

চট্টোপাধ্যায়, সুনীতিকুমার (২০১৫), জীবন-কথা, কলকাতা : প্রকাশ ভবন

মুখোপাধ্যায়, শক্তিশাধন (২০১৯), ‘শিক্ষকের শিক্ষক : আচার্য ডেভিড ড্রামন্ড’, রেনেসাঁসের আলোয় বঙ্গদর্শন, কলকাতা : পুনশ্চ

2 মন্তব্যসমূহ

  1. স্যার,
    মানুষ জফির সেতু (স্যার) থেকে কবি, সাহিত্যক, গবেষক ও শিক্ষক জফির সেতু (স্যার) সম্পর্কে আপনার স্বচ্ছ সরল বাস্তব মূল্যয়ন। আপনার এই সাবলিল লেখনীর মাধ্যমে জফির সেতু (স্যার) এর সম্পর্কে আপাদমস্তক একটা সহজ ধারণা প্রতিফলিত হয়েছে। প্রেরণার বাতিঘর প্রিয় জফির সেতু স্যারের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে নিজেকে সর্বদাই সৌভাগ্যবান মনে করি।”অর্জুনকে সৃষ্টি করতে একজন দ্রোণাচার্য লাগে, এরিস্টটলকে পেতে হলে একজন সক্রেটিসের দরকার হয়, তেমনি ডিরোজিওকে সৃষ্টি করতে হলে দরকার হয় একজন আচার্য ডেভিড ড্রামন্ডের (১৭৮৫/৮৭-১৮৪৩)।”

  2. স্যার
    আপনার চমৎকার লিখন ভঙ্গী আমাকেও স্মৃতিবিজড়িত করে দিয়েছে। জফির সেতু স্যারের প্রথম ক্লাসের কথাগুলো এখনো আমার কাছে লিপিবদ্ধ করা আছে। স্যার বলতেন, ‘সময় ই সবচেয়ে বড় শিক্ষক, সময় কে অবহেলা করা মানেই নিজেকে অবহেলা করা ‘
    আপনার শিক্ষক জফির সেতু (স্যার) আর আমাদের শিক্ষকের শিক্ষক জফির সেতু (স্যার) আলাদা নন,যেন উনার সব সময়ের কথা সবার জন্যই সার্বজনীন, সর্বকালীন, অনুপ্রেরণার বাতিঘর।
    ‘অর্জুনকে সৃষ্টি করতে একজন দ্রোণাচার্য লাগে, এরিস্টটলকে পেতে হলে একজন সক্রেটিসের দরকার হয়, তেমনি ডিরোজিওকে সৃষ্টি করতে হলে দরকার হয় একজন আচার্য ডেভিড ড্রামন্ডের (১৭৮৫/৮৭-১৮৪৩)।
    ‘ আমি যদি নিজেকে একজন সত্যিকারের শিক্ষার্থী হিসেবে দাবী করি, তাহলে সবচেয়ে বড় অবদান জফির সেতু স্যারের এবং তাঁর শিক্ষার্থী যাঁরা এখন আমাদের ও শিক্ষক ‘।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here