জফির সেতুর ‘‘না চেরি না চন্দ্রমল্লিকা’’ : তার চেয়েও বেশি

কবি, কথাসাহিত্যিক ও গবেষক জফির সেতু আজ পৌঁছুলেন ৫০-এর মাইল ফলকে। তাঁর না চেরি না চন্দ্রমল্লিকা নিয়ে লিখেছেন গদ্যকার সঞ্জয় বিক্রম

 

কবি যা-কিছু দেখেন বা কল্পনা করেন, তা মনে উপলব্ধি করেন; যা-কিছু অন্তরে গ্রহণ কিংবা বর্জন করেন, তার সমন্বয়েই তাঁর চেতনার জগৎ তৈরি হয়। তাঁর হৃদয়ে কথা উথলে ওঠে, প্রকাশের পথ চায়; কবিতার শরীরে তাই আশ্রয় লয়। কবিতার শরীর গ্রহণ করে বলেই তাঁর কথা কবিতা হয়, আর তাঁকে লোকে কবি বলে জানে। জফির সেতু (জন্ম ১৯৭১) কবি। কবির সাথে অধ্যাপকের বা সমালোচকের বিরোধ আছে কি কোথাও? না থাকলে জীবনানন্দ দাশ ‘ছায়াপিণ্ড’ কিংবা ‘অজর অক্ষর অধ্যাপক’ বলে কটাক্ষ করতে যাবেন কেন! তিনি নিজেও তো শিক্ষকতাই করেছেন। আসলে কবিদের আপত্তি অধ্যাপকদের বা সমালোচকদের মিথিক মাতুব্বরিপনায়। সম্পর্কটা স্বামী-স্ত্রীর মতো। অবশ্যই কারো উপর কারো কর্তৃত্ব ফলানোর নয়। কিন্তু বঙ্গদেশের দাম্পত্যে আধিপত্য যেমন মৌলিক বৈশিষ্ট্য, তেমনি বঙ্গ অঞ্চলের কবি সমালোচদের মধ্যেও চলে নিজেদের শ্রেষ্ঠ প্রমাণের ঈর্ষাকাতর গোপন এক প্রচেষ্টা।

 

এইসব বাস্তবতা মাথায় রেখেও বলা যায়, সবকিছুর মধ্যে বাঙালি দাম্পত্য সম্পর্ক যেমন অম্লমধুর, কবি-সমালোচকের সম্পর্কও তেমনই বৈরিতার। এতে চূড়ান্ত অর্থে ভয়ানক ক্ষতির সম্ভাবনা কম। কিন্তু কথা হলো, কবি নিজেই যদি সমালোচনার ভার গ্রহণ করেন, তাহলে ব্যাপারটা কেমন দাঁড়ায়? কেউ কেউ অবশ্য তেমন কাজ করেছেনও। যেমন, কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ তাঁর কবিতার ব্যাখ্যা, যা অন্যরা দিয়েছিলেন, তার বিরোধিতা করে নিজেই নিজের কবিতার মর্মার্থ প্রকাশ করেছেন। তবে বৃহৎ অর্থে এটি কবির জন্য বরং অকল্যাণকর। যদি জীবনানন্দ দাশ তাঁর ‘বনলতা সেন’ কবিতার নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দিয়ে যেতেন, তাহলে এই একটি মাত্র কবিতা নিয়ে এতো আলোচনা হতো না,  একটি কবিতা নিয়ে আস্ত বই লেখা হতো কিনা সন্দেহ। তাই কবিরা সচরাচর নিজের কবিতা নিয়ে প্রায়ই নির্বাক থাকেন, যদিও বা কথা বলেন, সেক্ষেত্রেও পরিমিতির আশ্রয় নেন। তবুও কবির পরিচয় গোপন থাকে না।

 

কবির কবিসত্তার স্বরূপ সন্ধানের প্রচেষ্টায় সমালোচকেরা ক্ষান্ত হন না। তাতে কবি যতটাই না সন্তুষ্ট বা বিরক্ত হোন না কেন। অনেক সময় লক্ষ করা যায় যে, কবির কবিতার জগৎ আর তাঁর যাপিত জীবনের জগতের মধ্যে মিল পাওয়া দুষ্কর হয়ে ওঠে। আবার কারো কারো কবিতা আর জীবন এক হয়ে যায়। ব্যক্তি জীবনের উপলব্ধিকে কবিতার নান্দনিকতায় প্রকাশ করেন। এঁদেরকেই হয়তো স্বভাব কবি বলা বেশি সঙ্গত। প্রায়শ কবিতায় কবিকে সন্ধানের চেয়ে কবির লেখা গদ্যের মধ্যে তাঁকে তাড়াতাড়ি চিহ্নিত করা যায়। আবার তিনি যদি হোন জীবন ও শিল্পের জগতে সমান আদর্শবাদী, তাহলে তাঁর কবিতা বোঝার জন্য তাঁর লেখা গদ্য অনেক বেশি সহায়ক হয়। জফির সেতু এমনই একজন কবি। তাই তাঁর লেখা কবিতা বিষয়ক গদ্য কবিতার ইন্দ্রজাল (২০১৭) কিংবা উপন্যাস একটা জাদুর হাড় (২০২০) কিংবা ভ্রমণকাহিনি না চেরি না চন্দ্রমল্লিকা (২০২১) অথবা অন্য যেকোনো গদ্যগ্রন্থেই কবি জফির সেতুর স্বরূপটি অভিন্ন থাকে। এই লেখায় তাঁর ভ্রমণকাহিনিমূলক গ্রন্থ না চেরি না চন্দ্রমল্লিকার মূল্যায়ন করার চেষ্টা করা হবে। দেখা যাবে, কবি যখন ভ্রমণ করেন, তখন তিনি কবির চোখেই জগৎ দেখেন। উক্ত গ্রন্থে জাপান দেখেন। গ্রন্থটি কবির জাপানভ্রমণের উপর লেখা। কিন্তু বিষয় হলো, কবি এই গ্রন্থে যে দৃষ্টিতে জাপানকে দেখেছেন, তা তাঁর নিজস্ব কবিসত্তার যেমন সমান্তরাল, তেমনি এই একই কারণে তা কবির সীমাবদ্ধতা ও সাফল্যের মূল ক্ষেত্র।

 

কবি জফির সেতু তাঁর ভ্রমণকাহিনিটিতে পূর্বজ দুজন কবি-সাহিত্যিকের দুটি ভ্রমণকাহিনির কথা বারবার উল্লেখ করেছেন এবং তাঁদের কাছে ঋণস্বীকার করেছেন অকুণ্ঠচিত্তে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাপান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন জাপানযাত্রী (১৯১৯), অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁর অভিজ্ঞতা লিখেছেন জাপানে (১৯৮৬) নামক গ্রন্থে। আমাদের আলোচ্য ভ্রমণকাহিনিটি পড়লে এটা স্পষ্ট বোঝা যায় যে, উক্ত দুখানি গ্রন্থ লেখকের পড়া ছিলো এবং তাঁদের চোখে জাপান দেখে কবির মনে জাপান সম্পর্কে একটি ধারণা পূর্ব থেকেই বদ্ধমূল হয়ে ছিলো। সাথে জাপানের ইতিহাসের পঠনপাঠনও তাঁকে বহুমাত্রিক উপাদান জুগিয়েছে। তাঁর সমস্ত পাঠাভিজ্ঞতায় জাপান সম্পর্কে যে ধারণা জন্মে, তার সারকথা হলো­— জাপানের মানুষ অমায়িক, সাহায্যপ্রবণ, সৎ, সৌন্দর্যপ্রিয় এবং রুচিশীল। কবি জফির সেতু নিজে ভ্রমণ করে জাপানিদের এইসব গুণাবলির আর একজন সাক্ষী হলেন।

 

জফির সেতু যদি কবি হয়ে ভ্রমণ না করতেন, তাহলে আলোচ্য গ্রন্থের চেহারা ভিন্ন হতে পারতো। কবি ভ্রমণ করেছেন বলেই পূর্বজ দুজনের মতো প্রায় একই রকম চরিত্রের সাক্ষাৎ পেয়েছেন তিনি। তবে তাঁর গ্রন্থে পূর্বের দুই গ্রন্থকারের সাক্ষ্যের অতিরিক্ত যুক্ত হয়েছে জাপানি ইতিহাস— যা তুলনামূলকভাবে বিষয়নিষ্ঠ, সংক্ষিপ্ত তবু সামগ্রিকতা ধারণকারী; সে ইতিহাসে আছে তাদের পরাধীনতার কথা, স্বাধীনতার কথা, ঐতিহাসিক ক্ষতের কথা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের ও পরের জাপানিদের মানসিকতার পরিবর্তনের কথা, যুদ্ধপরবর্তী আমেরিকান সৈন্যদের জাপানি নারীদের যৌনদাসী করার অপূরণীয় কলঙ্কের কথা, যুদ্ধপ্রবণ থেকে যুদ্ধবিমুখ ও সমৃদ্ধির দিকে অগ্রসর হওয়ার কথা, আছে সমস্ত পরিস্থিতিতে তাদের অপরিবর্তনীয় সৌন্দর্যচেতনার কথা। এক্ষেত্রে পূর্বজ দুই লেখকের লেখা গ্রন্থে আমরা যে জাপানকে পাই, এই গ্রন্থে যেন তার পূর্ণতা পরিলক্ষিত হয়। কালিক ব্যবধানে লেখক যেন তাঁর ব্যক্তি অভিজ্ঞতার সাথে পঠনপাঠনের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে জাপানি চরিত্রটিকে পূর্ণতা দান করেছেন। কিন্তু তাঁর দৃষ্টি যেহেতু কবির দৃষ্টি ছিলো, তাই তাঁর দেখা হয়েছে একরৈখিক, রোমান্টিক। বাস্তবতার নির্মম কষ্টিপাথরে তিনি তাঁর অভিজ্ঞতাকে ঘষে অমসৃণ করতে চান নি। চান নি বলছি একারণে যে, কবি এই কাজটি সজ্ঞানেই করেছেন। না চেরি না চন্দ্রমল্লিকাতে তাঁর স্বীকারোক্তিও আছে। এমনকি নামকরণের মধ্যেও কবির প্রবণতাটি ধরা পড়ে।

 

চেরি ও চন্দ্রমল্লিকার দেশ জাপান। লেখক যে সময়ে জাপান ভ্রমণ করেন, তখন চেরি ফুলের মৌশুম ছিলো না, না ছিলো চন্দ্রমল্লিকার মৌশুম। তবু লেখক যাদের সঙ্গ পেয়েছেন, যাদের সাহায্য পেয়েছেন, যাদের দেখে মুগ্ধ হয়েছেন, সেইসব মানুষ তাঁর কাছে চেরি ও চন্দ্রমল্লিকার চেয়েও মূল্যবান। তাঁর মনে প্রকৃতির চেরি বা চন্দ্রমল্লিকা নয়, জাপানের প্রকৃত শোভা এইসব মানুষেরা। তাই তাঁর গ্রন্থ ‘না চেরি না চন্দ্রমল্লিকা’ ; তার চেয়েও বেশি কিছু। লেখক ব্যাজস্তুতি করেছেন গ্রন্থের নামকরণে। যেন বলতে চেয়েছেন, ‘চেরি কিংবা চন্দ্রমল্লিকার অধিক’। জাপান নিয়ে এই মুগ্ধতা একজন কবির। দার্শনিক কিংবা ঐতিহাসিকের দেখা এমন হবে না। কিংবা একজন তাত্ত্বিকের মূল্যায়নের ভাষাও কবির ভাষা হবে না।

 

এই গ্রন্থের ভ্রমণকারী একজন কবি। তাঁর লেখার সূচনা করছেন তিনি মাতশুয়ো বাশোর একটি লাইন দিয়ে। লাইনটি এই— ‘স্বর্গ আর মর্ত্যরে কোথাও যার ঘর নেই’। ভ্রমণের শুরুতেই জানিয়ে দিচ্ছেন, ‘আমার মনও ছিল আকাশের চঞ্চল একখণ্ড সাদা মেঘের মতো।’ যদিও তিনি জানান যে, ‘জ্ঞানকে সত্য-অন্বেষণের একমাত্র পথ বলে জেনেছি এখন, মুক্তিরও পথ। যদিও জ্ঞানমাত্র সর্বৈব সত্য নয়। কেননা মানুষ জ্ঞানের কাঠামো নির্মাণ করেছে নিজের বিষয়বুদ্ধি থেকেও[ই]।’ জ্ঞান মস্তিষ্কের ক্রিয়ার সাথে সম্পর্কিত। আর বোধ উপলব্ধির সাথে। তিনি উপলব্ধিকে গুরুত্ব দেন। জীবনকে উদযাপন করতে ভালোবাসেন।

 

জফির সেতু জাপানে গিয়েছিলেন টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক বঙ্গবিদ্যা পরিষদ কর্তৃক আয়োজিত সেমিনারে জাপানি কবিতা ‘হাইকু’র উপরে বক্তৃতা দিতে। এটি যেন তাঁর একটি জাগতিক কাজ ছিলো মাত্র, আসল উদ্দেশ্য ছিলো পাঠাভিজ্ঞতায় প্রাপ্ত জাপানের সৌন্দর্যকে বাস্তবে উপভোগ করা। কবি এই সৌন্দর্য উপভোগে মুক্তমনা। কিন্তু মানুষ তাঁর সংস্কারকে ভুলতে পারেন না। কেউ তা স্বীকার করেন, কেউ করেন না। কবি জফির সেতু দ্বিধাহীন। বলেন, ‘যে-সমাজ ও ধর্মে আমি বড়ো হয়ে উঠেছি, সে-সমাজের রীতিনীতি ও সংস্কার আমার ভিতরে সর্বদা কাজ করে।’ তাই চাইলেও সংস্কার-বহির্ভূত আহার গ্রহণে তিনি স্বস্তি পান না।

 

রোমান্টিক ভাবনা কবিকে যেন সর্বদাই আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো। আসলে তিনি তাঁর রোমান্টিক মনকে কখনোই আড়াল করতে চান নি। উড়োজাহাজে তাঁর অনুভূতির প্রকাশ করেছেন এভাবে, ‘উষ্ণ পানীয়ের সঙ্গে কবিতা। তাও আকাশে। আহা, যদি মরে যাই ফুল হয়ে যেন ঝরে যাই।’ এমন মনোভাবের সমর্থনে জানাচ্ছেন, ‘আমার দীর্ঘ পাঠাভিজ্ঞতায় দেখেছি রচনার রসই আমার কাছে মুখ্য, তথ্য বা তত্ত্ব নেহাত গৌণ।’ তাই ইউরোপ-আমেরিকা হয়ে আসা জ্ঞান আমাদের কাছে যে গুরুত্ব  পায়, এর পেছনে যে উপনিবেশিত মন দায়ী, তা জেনেও এক ধরনের রোমান্টিক আফসোস করা ছাড়া তাঁকে আর কিছু বলতে শোনা যায় না।

 

এই রোমান্টিক কবির কাছে অচেনা সুন্দরী ভালো লাগে। নারী তাঁর কাছে নিসর্গের সমান। সামান্য সময়ের জন্য কোনো আলাপ না-হওয়া, কেবল চোখে দেখা নারীর প্রতিও তাই তাঁর মমত্ব জাগে। কথা না-হওয়া মানুষটির সাথেও কোনো এক সম্পর্ক অনুভব করেন। ফুজি দেখতে গিয়ে অপরূপ এক সুন্দরীকে তুলনা করেন পরি কিংবা বনদেবীর সাথে। আবেগের আতিশয্যে বলেন, ‘ফুজি, লেক আর এই সুন্দরী; এই তিনে মিলেই পৃথিবী।’ কবির সমস্ত হৃদয় যেন হরণ করে নিয়েছে জাপানবাসী। এমনকি তাকাহাশি শিজু ও ৎসুতোমু তাকাহাশির পরার্থপরতায় মুগ্ধ কবি তাদেরকে বিদায় দেয়ার প্রাক্কালে তিনজনই ‘হাউমাউ করে কেঁদে’ উঠেছিলেন।

 

জাপানিদের ফুল সাজানোর শিল্প নিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভ্রমণকাহিনিতে লিখেছেন। লিখেছেন চা-পানের নান্দনিকতার কথাও। জফির সেতুও এসব বিষয় নিয়ে বলেছেন। এক্ষেত্রে তাঁর গ্রন্থে যুগের ব্যবধানে যতটুকু পরিবর্তন এসেছে এসব আয়োজনে, তা ধরা পড়েছে। জাপানি হাইকুর সাথে বাঙালিকে প্রথম পরিচয় করিয়ে দেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই। কিন্তু হাইকু নিয়ে তাঁর ধারণা যে পূর্ণাঙ্গ ছিলো না, জফির সেতু তা উল্লেখ করেছেন। এমনকি একটি হাইকুর অনুবাদ মূলানুগ থেকে বহুদূর সরে গেছে বলেও মন্তব্য করেছেন। নগ্নস্নানের যে সংস্কৃতির কথা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখে গেছেন, জাপান ভ্রমণের আগে অন্নদাশঙ্কর রায় যে-বিষয় নিয়ে ঠাট্টা করেছেন, তা বর্তমানে যে প্রায় অদৃশ্য হয়ে গেছে, লেখক তা উল্লেখ করেছেন। চিত্রকলায় নগ্নমূর্তির অনুপস্থিতি নিয়ে রবীন্দ্রনাথের অনুরূপ মনোভাবই প্রকাশ করেছেন জফির সেতু।

 

চেরি ও চন্দ্রমল্লিকার দেশ জাপানকে তাঁর কাছে মনে হয়েছে এক আধ্যাত্মিক জ্ঞানচর্চার দেশ বলে। জেনসাহিত্যের উৎকর্ষের কথাও এসেছে এই প্রসঙ্গে। তাদের দুই প্রিয় ফুলের মধ্যে চেরি যেন জীবনের ক্ষণস্থায়ীত্বের প্রতীক আর চন্দ্রমল্লিকা যেন রাজকীয় তথা আভিজাত্যের প্রতীক। লেখক যখন বলেন, ‘জাপানের সবকিছু পরিপাটি, সুন্দর। এর মূলে জাপানি কোমল ও সৌন্দর্যপ্রিয় মন’, তখন ঐতিহ্যগত যুদ্ধপ্রবণ জাপানিদের যেন আলাদা বলে মনে হয়। এই দুই সত্তা সমানভাবে আছে বলেই তাঁর কাছে জাপানি জাতিকে অদ্ভুত বলে মনে হয়েছে। সমগ্র গ্রন্থ জুড়ে জাপানিদের ব্যবহার ও আচরণে লেখক বর্ণনাতীতভাবে বিমোহিত ছিলেন। বলেছেন, জাপানিরা যা করে তা তারা মনের আনন্দে করে। অন্যের জন্য কিছু করতে পারলে তারা সুখ পায়। এমন জাতি পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি আছে কিনা, তা নিয়ে লেখক সংশয় প্রকাশ করেন।

লেখকের বর্ণনায় আমরা দেখি জাপানিরা সাহায্যপ্রবণ, সময়ানুবর্তী, পরচর্চা পছন্দ করে না, প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলে না। কিন্তু বাঙালি চরিত্র ঠিক যেন তার উল্টো।

ফেরার পথে বিমানবন্দরে লেখকের সাথে দেখা হয় ওমর নামী এক পাকিস্তানির সাথে। বাংলাদেশের প্রতি পাকিস্তানিদের অন্যায় আচরণের কথা কবিমন ভুলতে পারে না। তাই আজন্ম এক ঘৃণা বদ্ধমূল পাকিস্তান নামের প্রতি। কিন্তু ১৯৭১ পরবর্তী পাকিস্তানি প্রজন্ম বাংলাদেশের প্রতি কেমন মনোভাব পোষণ করে, তা জানতে পারেন লেখক ওমরের মাধ্যমে। তারা একাত্তরের ঘটনায় অনুতপ্ত। এই কথাটাই বলার জন্য পাকিস্তানি ওমর লেখকের সান্নিধ্য নিয়েছিলো। জফির সেতু মনে করেছেন, পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় এখনো আভিজাত্যবাদীদের আধিপত্য বিরাজ করছে। এর অবসান ঘটলে, পাকিস্তানি মধ্যবিত্ত বা নতুন প্রজন্ম যদি রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে, তাহলে তারা অবশ্যই একাত্তরের বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের জন্য, অমানবিক আচরণের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে, যে কাজটি এযাবৎকাল পর্যন্ত পাকিস্তান সরকার করেনি।

 

লেখকের বর্ণনায় আমরা দেখি জাপানিরা সাহায্যপ্রবণ, সময়ানুবর্তী, পরচর্চা পছন্দ করে না, প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলে না। কিন্তু বাঙালি চরিত্র ঠিক যেন তার উল্টো। অচেনা বিদেশ-বিভূঁইয়ে অপরিচিত জাপানিরা তাঁকে সাহায্য করেছে পরম আন্তরিকতার সাথে। বিপরীতে তাঁর এক সহকর্মীর (বাংলাদেশী এবং একই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত, যিনি কিনা উচ্চশিক্ষার জন্য বৃত্তি নিয়ে জাপানে পড়তে গেছেন) কথা দিয়েও সাহায্য করার পরিবর্তে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা, বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় খাবার গ্রহণের সময় নিয়ম লঙ্ঘন করা, অন্তঃসারহীন আত্মগরিমা প্রকাশ করা ইত্যাদি বাঙালির চরিত্র হিসেবে হাজির করেছেন। জাপানিদের আহার গ্রহণের মধ্যেও একটা নান্দনিকতা লক্ষ করেছেন লেখক। অথচ বাঙালিরা খায় ‘গপ গপ করে’। এমন বৈপরীত্য কবিকে মর্মাহত করেছে। কিন্তু লেখক রোমান্টিক ভাবনায় মোহাচ্ছন্ন না থাকলে হয়তো এমন বিপরীতধর্মী আচরণের ঐতিহাসিক-সামাজিক-ভৌগোলিক-নৃতত্ত্বগত কারণ অনুসন্ধানে ব্রতী হতে পারতেন। এমনকি হয়তো তিনি তাঁর ভ্রমণের অভিজ্ঞতায়, নানান স্থাপত্য, মন্দির-মঠ, ঐতিহাসিক সাক্ষ্যের মধ্যে প্রমাণও পেয়ে যেতেন। বাঙালি চরিত্রের স্বরূপ এমন কেন হলো, তারও একটি নির্দেশনা পাওয়া যেতে পারতো। যদি তা সম্ভব হতো, তাহলে তাঁর ভ্রমণকাহিনির চরিত্র ভিন্নধর্মী হতো। তাহলে এই গ্রন্থে একজন কবি নয়, সত্যাদর্শী পর্যটকের জবানবন্দি বাণীবদ্ধ হতে পারতো। কিন্তু রোমান্টিক মুগ্ধতা এতটাই তাঁকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে যে, তিনি জাপানের সবকিছুতেই ভালো দেখতে পেয়েছেন।

 

অথচ, জাপানে ধর্মীয় গোঁড়ামি ছিলো। ধর্ম নিয়ে সংঘাতও ছিলো। একসময় বর্ণপ্রথাও ছিলো। নাচগানের পেশাজীবী গেইশ্যা নামক বেশ্যা ছিলো, যারা কিনা ভারতীয় বাইজিদের মতো। তাঁদের জীবনের সুখদুঃখ ছিলো। উদার ও আবেগপ্রবণ জাপানিরা একসময় ‘জার্মানদের মতো যুদ্ধবাজ’ ছিলো। ছিলো ‘ব্রিটিশদের মতো সাম্রাজ্যবাদী’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে চীনের উপর বর্বরোচিত গণহত্যা চালিয়েছিলো। যা কিনা ‘নানজিং হত্যাযজ্ঞ’ নামে পরিচিত। এর সবকিছুই জফির সেতু তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তবে তা অবশ্যই নিষ্ঠাবান তাত্ত্বিকের জায়গা থেকে নয়। রোমান্টিক কবির দৃষ্টিকোণে। যে-কারণে এসব বর্ণনা পড়ার সময়ও জাপানিদের প্রতি বিরূপ মনোভাবের জন্ম হয় না।

 

জাপানের গ্রাম ও শহরের জীবনযাপনের মধ্যে তফাৎ আছে। আছে দারিদ্র্যতার অভিঘাতও। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের বিমানবন্দর বা হোটেলে খণ্ডকালীন চাকরি করা, মিওর একাকীত্ব ইত্যাদি প্রসঙ্গে যার বর্ণনা পাওয়া যেতে পারতো। জাপানিদের উদারতা, পরার্থপরতার পরিচয় লেখক সকল ক্ষেত্রেই পেয়েছেন, কিন্তু তাদের উপলব্ধির স্বরূপ কেমন, দুঃখের প্রকৃতি কেমন, তাদের আত্মহত্যাপ্রবণতার কারণ কী, লেখক তাঁর পরিচয় জানতে পারেননি। অথচ, এই গ্রন্থে তিনি আগাগোড়া রোমান্টিক কবি। প্রাসঙ্গিকভাবেই এসব বিষয় তাঁকে আকৃষ্ট করার কথা। বিষয়গুলোর কাছে গিয়েও তিনি যেন গভীরে প্রবেশ করতে পারেননি। হয়তো খুবই অল্পসময়ের এই ভ্রমণপরিক্রমায় তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সবকিছু মিলিয়ে তাঁর কাছে ‘অদ্ভুত এই জাতি জাপানি। অদ্ভুত এই কারণে যে, একই সঙ্গে তারা যুদ্ধপ্রিয় ও সৌন্দর্যপ্রিয়। চণ্ডস্বভাব ও নরম মনের মানুষ।’

 

তিনজন লেখকের লেখাতেই জাপান সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। জাপানিদের চারিত্রিক গুণ মুগ্ধ করেছে তিনজনকেই। হয়তো যেকোনো বঙ্গবাসীকেই মুগ্ধ করবে জাপানভ্রমণ। জাপানিদের উদারতা, সৌন্দর্যপ্রীতি, পরিমিতিবোধ, পরার্থপরতা ইত্যাদি মানবিক গুণ নিয়ে সংশয় রাখার সুযোগ হয়তো নেই। কিন্তু এমন বৈশিষ্ট্য অর্জন করার পেছনে তাদের ঐতিহাসিক পরিক্রমাটি জানা হয়নি এই গ্রন্থেও। তেমনি জানা হয়নি বাঙালিদের চরিত্রধর্ম প্রকৃত কী কারণে বিপরীতধর্মী এবং কীভাবেই বা জাপানিদের মতো কাঙ্ক্ষিত মানবিক হয়ে উঠতে পারে। জফির সেতুর এই ভ্রমণকাহিনির সবচেয়ে দুর্বল দিক রোমান্টিক কবির মুগ্ধতা, তেমনি এই গ্রন্থের সবচেয়ে শক্তিশালী তথা আবেদনময় ক্ষেত্রও এটি। তিনি তাত্ত্বিকের দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করলে আমরা হয়তো নতুন কোনো ঐতিহাসিক সত্যকে পেতাম। তবে রস থেকে বঞ্চিত হতাম। জফির সেতুর পক্ষে তা করা সম্ভবও নয়। কেননা তিনি কবি এবং তাঁর কবিসত্তা আর যাপিত জীবনের আদর্শ সমান্তরাল।

 

কবিতায় যে জফির সেতুকে পাওয়া যায়, এই ভ্রমণকাহিনিতেও তাঁকেই পাওয়া যায়, পাওয়া যায় কবিতার চেয়েও আন্তরিক ও স্পষ্টভাবে। সমগ্র গ্রন্থ জুড়েই তাঁর কবিসত্তার পরিচয় আছে। তবে লক্ষণীয় বিষয় হলো, প্রকৃতি তাঁকে সুখী করলেও সর্বদাই তাঁর কাছে প্রকৃতির চেয়ে মানুষ বড় হয়ে উঠেছে। নিজেই উল্লেখ করেছেন সেকথা। বলেছেন, ‘সবকিছু ছাপিয়ে মানুষই আমার আরাধ্য।’ তাঁর একথা মনে করিয়ে দেয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুলনাচের ইতিকথা উপন্যাসের শেষের বর্ণনাকে। যেখানে শশী ডাক্তারের চোখ প্রকৃতির পরিবর্তে খুঁজে ফেরে মানুষ। সে কারণেই জাপানে গিয়ে জাপানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরিহার্য দুই ফুল চেরি ও চন্দ্রমল্লিকার দেখা না পেলেও তা নিয়ে লেখকের মনে কোনো অনুশোচনা নেই। তিনি যেন প্রকৃতির চেরি ও চন্দ্রমল্লিকার পরিবর্তে জাপানের প্রকৃত সৌন্দর্য ‘মানুষে’র পরিচয় পেয়ে এসেছেন। তিনি চেরিও পান নি, চন্দ্রমল্লিকাও পান নি, পেয়েছেন তারও অধিক কিছু; মানুষের সাক্ষাৎ, মানবতার পরিচয়, জীবনের সান্নিধ্য।

2 মন্তব্যসমূহ

  1. স্যার
    নিখুঁত বর্ণনামূলক বিশ্লেষণে জাপান সম্পর্কে লেখকের বাস্তব অভিব্যপ্তির যথার্থতা পরিলক্ষিত হয়েছে।
    নামকরণের চমৎকার বিশ্লেষণ “তাদের দুই প্রিয় ফুলের মধ্যে চেরি যেন জীবনের ক্ষণস্থায়ীত্বের প্রতীক আর চন্দ্রমল্লিকা যেন রাজকীয় তথা আভিজাত্যের প্রতীক” এর মাধ্যমে জাপানি জাতিসত্তার পরিচয় পরিস্ফুটিত হয়েছে।।

  2. স্যার
    চমৎকার বর্ণনার মধ্য দিয়ে জাপানিদের প্রকৃত সৌন্দর্য বিষয়ক বাস্তব অভিজ্ঞতার আবির্ভাব ফুটে উঠেছে।
    ”সবকিছু ছাপিয়ে মানুষই আমার আরাধ্য।’’সেই মানুষ যেন মানবিক মানুষ, মনুষ্যত্ববোধের মানুষ, সত্যিকারের মানুষ।
    জফির সেতু ( স্যার)”তিনি যেন প্রকৃতির চেরি ও চন্দ্রমল্লিকার পরিবর্তে জাপানের প্রকৃত সৌন্দর্য ‘মানুষে’র পরিচয় পেয়ে এসেছেন। তিনি চেরিও পান নি, চন্দ্রমল্লিকাও পান নি, পেয়েছেন তারও অধিক কিছু; মানুষের সাক্ষাৎ, মানবতার পরিচয়, জীবনের সান্নিধ্য”। কথাটি আমাদের প্রকৃত মানুষ হওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা যোগায়।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here