জফির সেতুর ‘‘একটা জাদুর হাড়’’ : যাপনে উপনিবেশিকতা

কবি, কথাসাহিত্যিক ও গবেষক জফির সেতু আজ পৌঁছুলেন ৫০-এর মাইল ফলকে। তাঁর একটা জাদুর হাড় উপন্যাস নিয়ে আলোচনা করেছেন কবি ও গদ্যকার মনিরুল ইসলাম

জফির সেতুর উপন্যাস একটা জাদুর হাড়-এ (২০২০) জীবন এক কেন্দ্রীয় বিষয়। তার অনুষঙ্গগুলো হাতড়ে হাতড়ে আখ্যানের পাত্র-পাত্রীরা বারবার মুখোমুখি হয়েছে স্থির ও বিষয়গত এই আস্ত জীবনের। ভ্রু কুঁচকে তারা তাকিয়েছে সেই জীবনের পানে। প্রিজমের মতো যা বিকীর্ণ করেছে রঙের বিভ্রম। তারা মন্তব্য ছুঁড়েছে মুহুর্মুহু। বিষয়ীর দেমাগ নিয়ে অধিকার করতে গিয়েছে তাকে। হয়েছে ক্ষত-বিক্ষত। জীবনকে তারা পায়নি। কেননা, বিষয়ী ও বিষয়ের ভেদসূত্রে তা বরাবর অধরা! বরং জীবনকে অধিকার করার যে বাসনা, ধ্বনিত হয়েছে গোটা উপন্যাস জুড়ে, আদতে তা ঘোষণা করেছে উপনিবেশিত যাপনের কথা। বিষয়ী ও বিষয়ের ভেদ, বৈজ্ঞানিক যৌনলিপ্সা, নারীর বিষয়করণ ও বিষয়গত এক আস্ত জীবনের নির্মাণ উপনিবেশিত যাপনের বৈশিষ্ট্যসূচক। গ্রামের ছেলে বিজয় তাই এক উপনিবেশিত চরিত্র। বিচ্ছিন্ন ও আগন্তুক।

 

বিজয় উপন্যাসের কথক চরিত্রটির নাম। তার জবানেই আমরা শুনতে পাই পুরো গল্প। কীসের গল্প – জীবনের। যে জীবন বিজয়ের। সেই জীবনের গল্প। বিষয়ী বিজয়ের কাছে তার বিষয়গত জীবনের গল্প। ‘বিজয়’ – কী আধিপত্যশীল একটি নাম! কাকে জয় করবে সে! জীবনকে! জীবনকে কি জয় করা যায়! জীবন কি জয় করার বিষয়! নাকি মিথুনকে! মিথুন উপন্যাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। তাকে কেন্দ্র করেই পাক খেয়ে গেছে বিজয়ের জীবনের পরিধি। তাকে আশ্রয় করেই কর্তারূপে নিজের প্রতিষ্ঠা দেখেছে বিজয়। বিজয়ের কাছে মিথুন তাই জীবনেরই আরেক নাম। তার মূর্ত রূপায়ণ। মিথুন। ‘মিথুন’ শব্দের আভিধানিক একটি অর্থ  – স্ত্রী-পুরুষের মিলন; যৌন মিলন। বিজয়ের কাছে যোনিই কি হয়ে উঠেছিলো জীবনের প্রবেশদ্বার! এক অঙ্গে সীমায়িত হয়ে উঠেছিলো নারী! মিথুন টুকরো টুকরো হয়ে নয়তো কেন গড়ে উঠেছিলো ভানু ও চাঁদনির অবয়ব! প্রধান দুটি চরিত্রের বিজয় ও মিথুন নামকরণের মাধ্যমে ঔপন্যাসিক কি অর্থগত এই অনুরণনটাই সৃষ্টি করতে চেয়েছেন! স্পষ্ট করে তুলতে চেয়েছেন জীবনকে দেখার পুরুষতান্ত্রিক রকম! বর্তমান প্রবন্ধে এই পুরুষতান্ত্রিকতাকে আমরা পাঠ করবো আধুনিকতা ও উপনিবেশিকতার সঙ্গে মিলিয়ে।

 

উপনিবেশিকতা

আধুনিকতা ও উপনিবেশিকতাকে, এইভাবে, একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ হিসেবে পাঠ করেছেন পেরুর সমাজতাত্ত্বিক আনিবাল কুইজানো। তার পাঠে গড়ে উঠেছে উপনিবেশিকতার (coloniality) ধারণা। যেই সূত্র ধরে পরে আরও অগ্রসর তাত্ত্বিক পাঠ নির্মাণ করেন ক্যাথারিন ওয়ালশ ও ওয়াল্টার মিগনোলো। হাজির করেন বি-উপনিবেশিকতার (decoloniality) প্রস্তাব। তাদের তদন্তে উপনিবেশিকতা ধরা পড়ে আধুনিকতার না-বলা বয়ান হিসেবে। শর্তগতভাবে যা মূলত একই আলাপের অংশ। একে তা অপরের পরিপূরক। এই সূত্রেই উপনিবেশিকতা আধুনিকতার চেপে যাওয়া দিক। মিগনোলোদের কাছে তাই ‘যাহাই আধুনিক, তাহাই উপনিবেশিক’। কেননা, এই দুইয়ের জ্ঞানগত (epistemic) শর্ত আসলে একই। অর্থাৎ, আধুনিক ইউরোপ যে-পদ্ধতিতে জ্ঞানোৎপাদন করে, নিজেকে জ্ঞানের বিষয়ী ও অপরকে জ্ঞানের বিষয় করে তোলে, নির্ধারণ করে দেয় বিষয়ী ও বিষয়ের সম্পর্কসূত্র এবং জীবনকে পাঠ করার যে-সকল বৌদ্ধিক-প্রকার (category) গড়ে তোলে আধুনিকতার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ভূখণ্ডে তা কায়েম করেছে উপনিবেশিকতা। ফলে, একে তারা ‘ক্ষমতাকাঠামোর উপনিবেশিক ছাঁচ’-এর (colonial matrix of power) নামপদরূপেই বুঝে থাকেন। মালদোনাদো-তোরেসকে (Maldonado-Torres) উদ্ধৃত করে ক্যাথারিন লেখেন – এই সূত্রে, উপনিবেশিকতায় জর্জরিত আমরা প্রত্যেকেই – ‘একজন আধুনিক বিষয়ী হিসেবে প্রতিদিন ও প্রতিটি ক্ষণ শ্বাসের সঙ্গে আমরা গ্রহণ করি উপনিবেশিকতা’(Catherine, 2018 : 23)। মিগনোলোদের কাছে উপনিবেশিকতার জ্ঞানবিদ্যাগত (epistemological) চরিত্রটাই প্রধান। উপনিবেশের পরিসমাপ্তি ঘটলেও জ্ঞানকাঠামোর মাধ্যমে যা বলবৎ রয়ে যায়। এজন্যেই তারা উপনিবেশায়ন থেকে আলাদাভাবে উপনিবেশিকতার আলাপ তুলেছেন। চলমান আলোচনায় উপনিবেশিকতাকে জ্ঞানবিদ্যাগত প্রপঞ্চ হিসেবেই বোঝা হবে।

 

ফলে, বিজয় চরিত্রটির কাছে যোনি হয়ে উঠেছিলো জীবনের প্রবেশদ্বার, এই উপপাদ্যের আলঙ্কারিক (rhetorical) অর্থটাই প্রাধান্য পাবে। অর্থাৎ, ‘যোনি’ এখানে শুধু অঙ্গেরই দ্যোতনা বহন করবে না; একইসঙ্গে, উপনিবেশিক জ্ঞানোৎপাদনের শর্তেরও বোঝা বইবে; যা গড়ে দিয়েছে বিজয়ের বিশ্ববীক্ষা; বিষয়গত আস্ত এক জীবনের দিকে তাকানোর কৌতূহলী চোখ; তাকে পর্যালোচনার জন্য অপরিহার্য সব বৌদ্ধিক-প্রকার। গোটা উপন্যাস জুড়ে বিজয় তাই যাপিত জীবনকে – যৌনতাকে – জয় করতে চেয়েছে; চেয়েছে নিজের করে পেতে; অধিকার করতে চেয়েছে তাকে; চেয়েছে তার স্থিরীকরণ করতে। নিজ সত্তা, পরিবার ও সমাজকে দেখার এই ভিন্ন চোখ – তাকে নিয়ে বোঝাপড়া করার বৌদ্ধিক-প্রকারসমূহ – ফলে, তাকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় পরিবার, সমাজ ও আত্মসত্তা থেকে। কেননা, এই বোধাকারসমূহ (categories) তার আত্মসত্তার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য নয়। এর নির্মাণ তার পরিবার ও সমাজের অন্তর্গত নিয়মে সাধিত হয়নি। অনুভবকে (intuition)  জ্ঞানে রূপান্তরের এই কৌশলসমূহ আরোপিত ও উপনিবেশিক। উপন্যাসে তাই বিজয়কে আমরা বিচ্ছিন্ন এক ব্যক্তি হিসেবে দেখি। যে বাসিন্দা এক আলাদা জগতের; আলাদা স্থান ও কালের; যেই স্থান ও কাল ভাষাগত এবং উপনিবেশিক।

 

স্থান (space) এবং কালের (time) প্রসঙ্গ উঠলে তা কান্টিয়ান অর্থে বোঝার একটা চাপ তৈরি হয়। কান্টের বিবেচনায় স্থান ও কাল পৃথক বস্তু বা বস্তুর ধর্ম নয়। বরং, আমাদের অনুভবকে সম্ভব করে তোলা আকার (form of sensibility) মাত্র। অর্থাৎ, কোনো কিছুকে অনুভব করতে হলে আমাদেরকে তা করতে হয় স্থান ও কালের আকারেই। যে-কারণে এগুলো পূর্বতঃসিদ্ধ (a priori) জ্ঞান। আর বৌদ্ধিক-প্রকারসমূহ অনুভবরাশিকে গড়ে তোলে জ্ঞানের বিষয় হিসেবে (রাসবিহারী, ২০১১ : ৩১-৪৪ ও Kant, 1998 : 155-71)। জ্ঞানোৎপাদনের এই বিন্দুতে, আমাদের অনুমান, বৌদ্ধিক-প্রকারসমূহের ভিন্নতা উৎপাদিত জ্ঞানের পৃথক চরিত্র গড়ে দেয়। যে কারণে, উপনিবেশিক জ্ঞান স্বতন্ত্র উপায়ে নির্মিত জ্ঞানকাণ্ডরূপে ধরা পড়ে। তাছাড়া অবলম্বিত বৌদ্ধিক-প্রকারসমূহ ও জ্ঞানের সর্বজনীনতার দাবি সমীচীন নয়। ক্যাথারিন ও মিগনোলো স্থান ও কালকে কান্টিয়ান অর্থে গ্রহণ করেননি। কান্টকে তারা দার্শনিকভাবে মোকাবিলাও করেননি। আমরাও, এই প্রবন্ধে, আলোচনার সূক্ষ্ম দার্শনিক পথটাকে অবহেলা করে আলঙ্কারিক দিকেই পা বাড়িয়েছি। যে-কারণে, আমাদের দাখিল করা ব্যাখ্যাসমূহের দার্শনিক খুঁত থাকা অসম্ভব নয়।

 

স্থানকে বিবেচনার উপনিবেশিক অভিমুখটা আলাদা। ইউরোপে এই অভিমুখ গড়ে উঠতে শুরু করে তাদের রেনেসাঁর সময় থেকে। পনেরো শতকের দিকে। যে-সময়ে তারা আবিষ্কার করে আমেরিকা। ‘নতুন দুনিয়া’। যে-দুনিয়ার প্রথম পরিচয় – তা ইউরোপ নয়। তা অ-ইউরোপ। ইউরোপীয় ভূখণ্ডের বাইরে তার অবস্থান। তা অপর। তা আলাদা। সেই-সময় থেকেই ‘আলাদা’কে বোঝার রকমটাও ইউরোপ আয়ত্ত করতে থাকে। পরবর্তীতে তা-ই উপনিবেশিক অভিমুখ নামে পরিচিত হয়। নিজস্ব স্থান ও অধিষ্ঠানের বাইরে অবস্থিত স্থান ইউরোপীয় জ্ঞানকাণ্ডে যে-রূপে চিহ্নিত হয়েছে তা-ই উপনিবেশিত স্থানের বৈশিষ্ট্যজ্ঞাপক। আবিষ্কৃত স্থানের নামকরণ থেকে শুরু করে তার সঙ্গে সম্পর্কের সূত্র-নির্দেশ, সংশ্লিষ্ট স্থান সম্পর্কিত জ্ঞানোৎপাদনের পূর্বতঃসিদ্ধ অধিকার ও তার ভবিষ্যৎ নির্ধারণের কর্তৃত্বও সংরক্ষণ করেছে ইউরোপীয় উপনিবেশিক শক্তিগুলো। ক্রমেই যে অভিমুখ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর রূপ লাভ করেছে। যে-সকল জ্ঞানবিদ্যাগত শর্তে স্থানের উপনিবেশায়ন সম্পন্ন হয়েছে তা উপনিবেশিকতা কায়েমের অপরাপর শর্ত থেকে অভিন্ন। তা-ই ঘটিয়েছে কালের উপনিবেশায়ন। অনুরূপ সময়েই কালকে বিবেচনায় অবলম্বিত হয়েছে এমন আদর্শ – যা তাকে বিভক্ত করে তুলেছে প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক যুগে। এবং সেই প্রাচীন ও মধ্যযুগে ভর দিয়ে দাঁড় করানো হয়েছে রেনেসাঁকে। যার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে ইউরোপের প্রগতির কল্পকাহিনি (Mignolo, 2018 : 139-41)। আর এই কল্পকাহিনিরই প্রস্ফুটিত রূপ আধুনিকতার মহিমান্বিত আখ্যান। এই আলোচনা বিস্তারিতভাবে করার সুযোগ আমরা এখানে পাবো না। ইউরোপীয় জ্ঞানকাণ্ডে বিষয়ীর নির্মাণ ও তার মুখাপেক্ষীরূপে গড়ে ওঠা বিষয় এবং দুইয়ের সম্পর্ক-নির্ধারণ – কুইজানো তার প্রবন্ধে আলোচনা করেছেন। On Decoloniality (2018) গ্রন্থে ক্যাথারিনরা তা আলোচনা করেছেন আরও বিস্তারিতভাবে। ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার সূত্রে যেহেতু আমরাও উপনিবেশিক জ্ঞানকাণ্ডে শিক্ষিত ও গড়ে ওঠা বিষয়ী, ফলে, আমাদের যাপিত জীবনের মধ্যেই উপনিবেশিকতার চিহ্ন অন্বেষণ করা অমূলক হবে না। এইটুকু বলেই আমরা চলে যেতে পারি উপন্যাসের আলোচনায়।

 

স্থানের উপনিবেশায়ন

বিজয় ও মিথুনের সম্পর্কসূত্রেই গ্রন্থিত হয়েছে পুরো উপন্যাস। বিজয় এই উপন্যাসের মোক্ষম ফোঁড়। সেই-ই একমাত্র বিষয়ী। তার মস্তিষ্কই বয়ান করে গেছে যাবতীয় ঘটনাবলি। পাঠককে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে উপন্যাসের স্থান-কাল-পাত্রের সঙ্গে। একইসঙ্গে সে নিজেও এক চরিত্র। তার জবানে সে সংগঠিত হয়েছে নিজেই। নিজেই গড়ে নিয়েছে নিজেকে। সে স্বয়ম্ভু। অবলীলায় প্রকাশ করে গেছে নিজের অচেতন। পাঠক দেখতে পেয়েছে – বিচ্ছিন্ন এক ব্যক্তি হিসেবে – তার অধিষ্ঠান; কীভাবে সে আলাদা হয়ে পড়েছে নিজেরই জীবন থেকে। উপন্যাসের শুরুতেই তা লক্ষণীয়। দোয়া-দুরুদ পড়ে দাদির দেওয়া ফুঁ তার সঙ্গে সংযোগ তৈরি করতে পারেনি। ‘দোয়া-দুরুদ’ তার কাছে অনুবাদিত হয়েছে ‘কীসব’ সর্বনামে (জফির : ২৪)। নিজেকে বরাবর একজন আগন্তুক ভেবেছে বিজয় (জফির : ১১)। নিজের পরিবারে, নিজের সমাজে, নিজের দেশে কেন সে আগন্তুক! এই প্রশ্ন কি তার মনে ছিলো! না ছিলো না। ফলে, এর উত্তর তার কাছে যথারীতি অপ্রাসঙ্গিক। বরং, তার এই আগন্তুক হওয়ার মধ্যে ছিলো নিহিত গর্ব।

 

বিজয় যেহেতু তার জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলো, সেহেতু সে বিচ্ছিন্ন ছিলো সেই জীবনকে ধারণকারী প্রতিবেশ থেকেও। ফলে, ঘটনার যে-জমিনে দণ্ডায়মান ছিলো সে – তা ছিলো এক কল্পিত জগৎ; ভাষার জগৎ; চিন্তার জগৎ। যেখানে থরে থরে সাজানো অধ্যাসের পর আরেক অধ্যাস (illusion)। সে এক অধ্যাসের দুনিয়া। যা পরিগঠিত হয়েছে উপনিবেশিক জ্ঞানগত পক্রিয়ায়। পাহাড়, নদী, টিলা, টিলার বুকের গোরস্থান, গোরস্থানের বুকে হাড়গুঁজে পড়ে থাকা মৃতেরা, দিগন্তবিস্তারি মাঠ, মাঠের আকাশে জ্যোৎস্না, সেই হলুদ জ্যোৎস্নায় চড়ে বেড়ানো কাঠবিড়ালি, সফেদ খরগোশ অধ্যাসসমূহের একেকটি চিহ্নমাত্র। সেই জগতে বিজয় এক প্রবল পরাক্রমশালী বিষয়ী – বাকি সব তার চিন্তার বিষয় মাত্র। তাদের সঙ্গে নেই তার কোনো আন্তঃবিষয়ী লেনদেন। কেননা, বিষয়ী-বিষয় সম্পর্কের গড়নে গরহাজির এই শর্ত। বোঝাপড়ার এই ধরনটি গড়েই উঠে ভেদকে আশ্রয় করে। ভেদ বরাবর যেখানে গড়ে ওঠে আধিপত্যের ক্রম। বিষয় যেখানে সপ্রাণ কোনো সত্তা নয়। বিষয় সেখানে বিষয়ীর আশ্রিত ও জড়বৎ সত্তা। সামনে আলোচিত একটি উদ্ধৃতিতে প্রসঙ্গটি আমাদের কাছে আরও স্পষ্ট হবে। সেখানে আমরা দেখবো গোরস্থান ও সেই স্থানের অধিবাসীরা বিজয়দের কাছে কীভাবে বিষয়কৃত হয়ে উঠেছে।

 

বিষয়ী-বিষয় সম্পর্কের সূত্রেই ভাষার এই স্থানটি উপনিবেশিত। যেখানে অনুভবরাশি জ্ঞানে রূপান্তরিত হয়েছে বিষয়ী-বিষয় সম্পর্কের কাঠামো অনুযায়ী। সমস্ত কিছুর আগে বিষয়ী যেখানে নিজেই পূর্বানুমান করে নেয় নিজেকে। সে আছে। যেমনটা ভেবেছিলেন দার্শনিক দেকার্তে (Quijano : 2007)। যেমনটা ভাবে অধিকাংশ আধুনিক মানুষ। প্রথম কুইজানোই সম্পর্কের এই কাঠামোটি আমাদের হাতে ধরিয়ে দেন। ফলে, বিজয়ের সংকট বোঝার ক্ষেত্রে তিনিই আমাদের পথপ্রদর্শক। টিলায় বিজয়ের ঘর, সঙ্গী কেউ নেই (জফির : ১০)। আসলে যে ডেরায় সে বাস করেছে তা এক মনোজাগতিক ডেরা। এই ডেরা বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপের মতো। যার সঙ্গে যোগ নেই তার পরিবেশের, প্রতিবেশের। আধুনিক সমাজে ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতার এ-এক আদর্শ চিত্র। আর আমরা আগেই বলেছি – আধুনিক সমাজ আদতে উপনিবেশিত সমাজেরই আরেক নাম। এবং বিজয় এই উপনিবেশিত স্থানেরই বাসিন্দা। এবার আমরা কুইজানোর উদ্ধৃতি দিবো :

… in that presupposition, the ‘subject’ is a category referring to the isolated individual because it constitutes itself in itself and for itself, in its discourse and in its capacity of reflection. The Cartesian ‘cogito, ergo sum’, means exactly that. Second, the ‘object’ is a category referring to an entity not only different from the ‘subject’! individual, but external to the latter by its nature. Third, the ‘object’ is also identical to itself because it is constituted by ‘properties’ which give it its identity and define it, i.e., they demarcate it and at the same time position it in relation to the other ‘objects’. … It blocked, therefore, every relation of communication, of interchange of knowledge and of modes of producing knowledge between the cultures, since the paradigm implies that between ‘subject’ and ‘object’ there can be but a relation of externality. (Quijano, 2007 : 172-4)

ফলে, বিষয় কেবল জবরদখল ও ভোগের উপকরণ মাত্র; তাকে অধিকার করা যায়, তাকে বর্ণনা করা যায়; তা কেবল জ্ঞানোৎপাদনের উপকরণ; তা কখনো জ্ঞানের বিষয়ী হতে পারে না। ইউরোপ গোটা দুনিয়ার সাপেক্ষে বিষয়ী-বিষয় সম্পর্কের এই কাঠামোতেই দাঁড় করিয়েছে নিজের আত্মপরিচয়। সে বিষয়ী। উপনিবেশিত বাকি দুনিয়া তার বিষয়। এই কাঠামোটিই জ্ঞানোৎপাদনকে, ভাষার জগৎকে, চিন্তার জগৎকে উপনিবেশিত করেছে। নিজস্ব সত্তার বাইরে, এই কাঠামোতে ঠাঁই পাওয়া প্রতিটি সত্তা ও তাদের অধিষ্ঠিত স্থান, তাই জীবনের উপনিবেশিক বিন্যাসকেই স্পষ্ট করে তোলে। উপনিবেশিত হয়ে পড়ে ব্যক্তিক যাপনের বহিস্থ প্রতিটি অনুষঙ্গ। স্থানের এই উপনিবেশায়নের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত কালের উপনিবেশায়ন।

 

কালের উপনিবেশায়ন

কালের সঙ্গে স্থান এক অচ্ছেদ্য সূত্রে গাঁথা। ফলে, স্থানের উপনিবেশায়ন একইসঙ্গে কালেরও উপনিবেশায়ন। ঔপন্যাসিক তার উপন্যাসে দারুণভাবে এই সূত্রটি আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন। তাকে বরং উদ্ধৃতই করি :

এখন বাংলা কোন মাস? আমি আমি জানি না। সনটাও জানা নেই। আসলে আমার জানার দরকারও পড়ে না অনেক বছর। খ্রিস্টীয় হিসাবই আমরা হিসাব।

বাংলা মাসের নাম জানতে পারলে নদীর বিষয়ে ভাবা যেত কিছু। (জফির : ৩৯)

বিজয়ের কথায় স্পষ্টভাবে স্থান ও কালের সঙ্গে তার বিচ্ছিন্নতা প্রকাশ পেলেও এর চেয়ে জরুরি বিষয়ের ইঙ্গিত এখানে রয়েছে। তা হলো বিচ্ছিন্নতার কারণের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ। যদিও ‘আমার জানার দরকারও পড়ে না অনেক বছর’ এই অংশটুক দ্বারা সে বোঝাতে চেয়েছে তার দীর্ঘ প্রবাস জীবনের কথা। যেখানে তার হিসাব ছিলো খ্রিস্টীয় হিসাব। অর্থাৎ, খ্রিস্টীয় এই ইউরোপীয় হিসাব, সময়ের এই উপনিবেশিক হিসাব বিজয়কে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে তার নিজস্ব স্থান ও কাল থেকে। যে-কারণে নদীর সঙ্গে সে সংযোগ ঘটাতে পারে না। সংযোগ গড়তে পারে না শহরের সঙ্গে। একাত্ম হতে পারে না জীবনের সঙ্গে। খ্রিস্টীয় কাল এভাবেই স্থানেরও খ্রিস্টীয়করণ ঘটায়। খ্রিস্টীয়করণকেই আমরা আধুনিকায়ন বলি। বলি ইউরোপীয়করণ। খ্রিস্টীয় এই কাল সরলরৈখিক। সময়ের যেই রেখা সোজা চলে গেছে ইউরোপ ও আমেরিকামুখী। ফলে, শুধু বিজয়ের সময় নয়, বিজয় চরিত্রের মাধ্যমে ঔপন্যাসিক নির্দেশ করেছেন বিষয়ীর কালের উপনিবেশায়ন।

একটা জাদুর হাড় উপন্যাসের পাত্র-পাত্রীদের পরস্পর সম্পর্কিত ঘটনাবলি ঘটনার উপনিবেশিত স্থান ও কালের পরিচয়ই বহন করেছে। উপন্যাসটিতে বিজয় যেমন তার নিজের গল্প বলেছে, তেমনি বয়ান করেছে অপরেরও কাহিনি।

কলেজে পড়তে আসা বিজয় এই উপনিবেশিত কালেই বসবাস করেছে। সেখানেই গড়ে উঠেছে সে। সেখানেই সে গ্রহণ করেছে উপনিবেশিক দীক্ষা। তিলে তিলে গড়ে উঠেছে তার উপনিবেশিত মনন। সেই পর্বের বিস্তারিত বিবরণ ঔপন্যাসিক দেননি। তাই কালের উপনিবেশায়ন ব্যাখ্যা করার জন্য খুব বেশি উপাদান উপন্যাসে মেলে না। অবশ্য উপন্যাসের অভিমুখ-বিচারে তা হয়তো আবশ্যিকও ছিলো না। তবে, ঔপন্যাসিক ঠিকই যোগ করেছেন এক জোরদার অনুচ্ছেদ :

সময় থেকে ছিটকে পড়েছি আমি, ছিটকে পড়েছে কামরুল। এখন আর কেউ নেই। কোথাও কেউ নেই। কামরুলের সঙ্গে দেখা হয়নি এজীবনে আর। কামরুল আমেরিকা সেটেল হয়েছিল। একটা কোম্পানির দারোয়ান হয়েছিল। বারোঘণ্টা ডিউটি করত। আটঘণ্টা, আর চার ঘণ্টা। নিউইয়র্কে বাড়ি করেছিল। দেশকে সে ভালোবাসত না। একটা বিরাগ ছিল। কেন জানি আমাদের সময়ে একটা জেনারেশন দেশের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছিল। (জফির : ৭২)

মজার ব্যাপার হলো, কেবল বিজয় নয়, মিথুন ও কামরুল দুজনই পাড়ি দিয়েছিলো ইউরোপ-আমেরিকায়। আদতে বরাবর তারা সেখানকার মানসজগতেই বসবাস করে এসেছে। মজার ছলে হলেও আমাদের কাছে ঔপন্যাসিক তা প্রকাশ করেছেন। তা ধরা পড়ে কামরুল ও বিজয়ের আলাপে :

প্রথম শরাব খাব মানুষের খুলিতে ঢেলে!

আমি অবাক হই। কামরুল বলে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নাই। ফরাসি দেশে একদল কবি ও শিল্পী মৃতদের মাথার খুলিতে মদ ঢেলে উল্লাসে পান করত। আমি প্রথম শুনি কথাটা। সত্যি!

কামরুল বলে, সত্য। তাও ন্যাংটো হয়ে দলবেঁধে খেত। তাও সম্ভব?

কেন নয়? আমরাও পারি। (জফির : ৭৩)

কামরুল-বিজয়দের কাছে এভাবে মৃতরাও হয়ে উঠেছিলো বিষয় মাত্র। বিষয়গত হয়ে উঠেছিলো তাদের আবাস।  উদ্ধৃত অংশটুকু আমাদের কাছে তা-ই স্পষ্ট করে। বিজয়ের বয়ানে বারবার উল্লেখিত হয়েছে এই কবরস্থানের কথা। মৃতদের কথা। মৃত্যুর কথা। জীবনের কথা। এভাবে প্রতিটি অনুষঙ্গই যে তাদের কাছে পরিণত হয়েছিলো বিষয়ে – তা আর অপরিষ্কার থাকেনি। এভাবেই তাদের কাল ধারণ করেছে উপনিবেশিকতা। ফলে, কামরুল-মার্থা, বিজয়-মিথুন, দীপালি-যতীন প্রত্যেকের এরা শ্বাসের সঙ্গে উপনিবেশিকতা গ্রহণ করেছে। এরা হয়েছে উপনিবেশিত স্থান ও কালেরই পাত্র।

 

পাত্রের উপনিবেশায়ন

স্থান ও কাল থেকে পাত্র বিজড়িত নয়। ফলে, স্থান ও কালের উপনিবেশায়নের সঙ্গে পাত্রের উপনিবেশায়ন ঘনিষ্ঠভাবে অন্বিত। আদতে উপনিবেশিত পাত্রের মাধ্যমেই স্থান ও কালের উপনিবেশায়ন নির্ণয়যোগ্য হয়ে ওঠে। একটা জাদুর হাড় উপন্যাসের পাত্র-পাত্রীদের পরস্পর সম্পর্কিত ঘটনাবলি ঘটনার উপনিবেশিত স্থান ও কালের পরিচয়ই বহন করেছে। উপন্যাসটিতে বিজয় যেমন তার নিজের গল্প বলেছে, তেমনি বয়ান করেছে অপরেরও কাহিনি। সে বলেছে তার বেড়ে উঠার কথা। বয়ঃসন্ধির শুরুর দিককার কথা। যখন সে প্রথম টের পায় যে, তার একটি শরীর রয়েছে। সেই শরীরের কী নাম, কী পরিচয় তখনও সে জানে না। সেই শরীর প্রকৃতিগত শরীর। সেই শরীরে বিরাজ করে যেসব স্বতঃস্ফূর্ত স্বভাব তা পাপ ও পূণ্য বা যেকোনো কিছুরই ঊর্দ্ধে। বিজয় জানিয়েছে :

সেক্সের বিষয়টা কেউ আমাকে কখনও শিখিয়ে দেয়নি। কেমন করে যেন আমি নিজেই টের পেয়ে গিয়েছিলাম। শীতের শেষরাতগুলো আমাকে যৌবনপ্রাপ্ত করে, যৌনপ্রাপ্তও।

শীতের শেষরাতেই আমি প্রথম যৌনতা, যৌনসুখ অনুভব করি। যৌনতার প্রথম উত্থান হয় শীতকালেই। ভোররাতে। সূর্য ওঠার মুহূর্তে, কোনও একদিন আমার প্রথম বীর্যপাত ঘটে। স্বমেহনেই।

তখন জানতাম না একে হস্তমৈথুন বলে, পরে জেনেছি মাস্টারবেশন। . . .

স্কুলে বন্ধু হাবিবকে ঘটনাটা বলি প্রথমে। সে প্যান্টের দাগ দেখতে চায়। আমি দেখাইও। শুকিয়ে চটচট করছে। এই প্রথম আমি ‘মাল’ শব্দটার সঙ্গে পরিচিত হই। হাবিব আমার গুরু হয়ে ওঠে এ-ব্যাপারে। (জফির : ৩১)

ঘটনাটি বর্ণনা করেছে পরিণত বিজয়। যে জানে ‘মাস্টারবেশন একটা আর্ট এবং স্বাস্থ্যসম্মত যৌনতাও’ (জফির : ৩১)। তাই উপনিবেশিত ছিলো তার বয়ানভঙ্গি। কিন্তু বয়ানভঙ্গিকে উপেক্ষা করলেই আমাদের সামনে স্পষ্টভাবে যা ধরা দেয় তা হলো শরীরের উপনিবেশায়ন। কেননা, প্রকৃতিগত সেই স্বতঃস্ফূর্ত স্বভাবের নামকরণ ও পরিচয় নির্ধারণের মাধ্যমেই মূলত দেহের উপনিবেশায়ন সম্পন্ন হয়। তখন শরীর বিভাজিত হয় পুরুষ ও নারীতে। পুরুষ হয়ে ওঠে ‘সটান লিঙ্গ’। নারী হয়ে ওঠে ‘ব্যাকুল যোনি’। পুরুষকে কেন্দ্রে রেখে, তার আধিপত্যকে বহাল রেখে, তখন গড়ে ওঠে যৌনতা সম্পর্কিত কথাবার্তা (ডিসকোর্স)। তাই তো কামরুল বলে, ‘শোন, মেয়েরা ওটা করার জন্যই প্রেম করে। তুই করিসনি, পাখি তাই চলে গেছে। যে করবে তাকে ভালোবাসবে!’ (জফির : ৩৫)।

 

এভাবেই উপনিবেশিত হয় শরীর, ফলে, উপনিবেশিত হয়ে পড়ে শরীরের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিটি অনুষঙ্গ, প্রতিটি সত্তা। নারী সীমায়িত হয় তার যোনিতে। তাকে নিয়ে পুরুষ গড়ে তোলে তার কল্পনার রাজ্য। পুরুষের চোখে বদলে যায় নারীর মানচিত্র। সেখানে জেগে ওঠে নতুন নতুন লোভনীয় এলাকা। ভানু চরিত্রটি এক্ষেত্রে খুবই প্রাসঙ্গিক। যৌনতার কল্পিত অভয়াশ্রম ভানু। অথবা পুরুষালি কামনার উচ্ছিষ্ট ছুঁড়ে ফেলার ভাগাড়। উপন্যাসে ভানুকে সেভাবেই গড়ে তোলা। সে যেন কেবলই একটি অঙ্গের নাম – যোনি। তার সকল অঙ্গই যেন একেকটি যৌনাঙ্গ। ভানুকে মনে পড়লে বিজয়ের তাই মনে পড়ে তার পুষ্ট দুটি স্তনের কথা। বিজয়ের ভাষায় :

ভানুকে আমার মনে পড়ে। পুষ্ট স্তনদুটি তার। কান-দুটি খাড়া, খরগোশের মতো। ঊরুগুলো ছাতিম গাছের মতো ঘ্রাণময়। মিলনকালে সে পাগল হয়ে যায়। তার মনে পাপবোধ আছে বলে মনে হয়নি। সাধারণ মানুষের মনে অযথা পাপবোধ কাজ করে না। অর্ধশিক্ষিতের বেলায় যতটা ঘটে। শেষবার ভানুর মুখে তৃপ্তি ও পবিত্রতার ছায়া দেখেছিলাম। (জফির : ৬৭)

নারীর বিষয়করণের এর চেয়ে চূড়ান্ত উদাহরণ আর কী হতে পারে! হ্যাঁ, ভানুর কোনো পাপবোধ নেই। কেননা, বিষয়ের কোনো পাপবোধ থাকতে পারে না। বিষয়ের কোনো প্রকার বোধই থাকতে পারে না। ফলে, তার মুখে তৃপ্তি ও পবিত্রতার যে ছায়াটুকু বিজয় লক্ষ্য করে তা পুরুষতন্ত্রেরই আরোপিত ছায়া। এই পুরুষতন্ত্রের কাছেই নারী কেবল দখলের বিষয়। অধিকার করার বিষয়। নারীকে দখল ও অধিকার করার মধ্যেই সংরক্ষিত হয় সকল আত্মতৃপ্তি। ঔপন্যাসিক আমাদের সূত্র ধরিয়ে দেন :

আমি তোমাকে ধরলাম। ধরতে গিয়ে তোমার স্তনের স্পর্শ পেলাম। ধারালো, কুসুমিত ও রুটির মতো উষ্ণ। রোমাঞ্চ ছড়িয়ে পড়ল আমার সারা শরীরে। এই নারী আমার! শুধু আমার। অদ্ভুত সে অনুভূতি। (জফির : ২১)

উপনিবেশিক কাঠামো অনুযায়ী বিষয় সর্বদাই বিষয়ীর মুখাপেক্ষী। ফলে, উপন্যাসে মিথুনই যে বিজয়ের দিকে প্রথম হাত বাড়াবে, তা কোনো আকস্মিক ব্যাপার নয়। সেই একইসূত্রে পুরো উপন্যাস জুড়ে মিথুনের প্রতি প্রকাশ পেয়েছে বিজয়ের তীব্র কৌতূহল। আপাদমস্তক তাকে জ্ঞানের বিষয় করে তোলার বাসনা। বিজয় ব্যক্ত করেছে তার হৃদয়ের আকাক্সক্ষা, ‘তোমার শরীরটা দেখতে চাই। তোমার শরীরের কোথায় কী আছে দেখতে চাই’ (জফির : ৮৪)। আসলে মিথুন নয়, বিজয়ের কৌতূহলের বিষয় ছিলো জীবন। তার কৌতূহলের বিষয় ছিলো নারী। আর মিথুন ছিলো সেই নারী-ধারণার প্রতিনিধি। জীবনে মিথুন না এলে তাই সে প্রেমে পড়ত মার্থার (জফির : ৪০)। চিঠিতে সে মিথুনের নাম দিয়েছিলো বাতাস (জফির : ৪০)। প্রেমের দিনগুলোতে চাঁদনি হয়ে উঠেছিলো তার বিকল্প প্রেমিকা (জফির : ১৩২)। উপন্যাসে বিজয়ের মনের অস্থির ভাবনাসমূহও নারী ও যৌনতার বিষয়করণ বুঝতে আমাদের সহায়তা করে। বিজয় ভাবে :

একদিন মনে হল আসলে আমি তোমাকে হত্যা করতে চাই! হ্যাঁ, ঠিক তোমাকে হত্যা করব আমি। টুকরো টুকরো করে নদীতে ভাসিয়ে দেব। তোমাকে ধাক্কা মেরে ছাদ থেকে ফেলে দেব। তোমার টুঁটি চেপে ধরব। তোমার নিষ্ঠুর ঘাতক হব আমি।

আবার এটাও ভাবলাম তোমাকে বিক্রি করে ফেলব আমি কোনও লম্পটের কাছে। বেশ্যার দালালের কাছে কিংবা আদমবেপারির কাছে। তোমার সর্বনাশ করব আমি। ঠিক করবই। (জফির : ১৬)

 

লক্ষ করার মতো বিষয় হলো, মিথুনকে নিয়ে বিজয় যা যা করতে চেয়েছে তাকে উল্টে দিলেই সমাজে নারী-পুরুষ সম্পর্কের উপনিবেশিক আদর্শ রূপটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অর্থাৎ, পুরুষের কাজ নারীর জীবন ও যৌনতার সংরক্ষণ। তার রক্ষণাবেক্ষণ। আবেগের প্রাবল্যে বিজয় যা করতে অস্বীকৃতি জানায়। এবং এই অস্বীকৃতিই প্রকাশ করে তার চিন্তায় নিহিত উপনিবেশিক ছক। কেননা, স্বীকৃতি বা অস্বীকৃতি যা-ই হোক, একই তাদের গাঠনিক শর্ত। এই একই দৃষ্টির অধিকারী ছিলো কামরুল। তার কাছেও যৌনতা তাই ‘শরীরের প্রতি শরীরের আকর্ষণ ও বিকর্ষণের প্রতিক্রিয়া মাত্র’ (জফির : ৭৪)। এক্ষেত্রে খুবই প্রাসঙ্গিক আরেকটি উদ্ধৃতি উপন্যাস থেকে আমরা দিবো। বিজয়ের সঙ্গে আলাপকালে কামরুল বলছে:

তাহলে মাগিবাজি কর। মাগির ঊরুর ফাঁকে হৃদয়ের জ্বর তামাদি হয়ে যাবে!

তাই করব! আমি অশান্ত। আমি তপ্ত। আমি শান্তি চাই। আমার কোনও বাধা নাই। বন্ধন নাই।

পরদিন আমি ঠিক বেশ্যালয়ে গেলাম। প্রেমিকার চেয়ে বেশ্যা ঢের ভালো। ওরা প্রতারণা জানে না। আমি প্রতারিত হতে চাই না। (জফির : ১০৩)

বেশ্যারা প্রতারণা জানে না, কারণ তারা চূড়ান্ত বিষয়। বিষয়ের নেই কোনো প্রতারণার বোধ। বেশ্যা কোনো সত্তা নয়। বেশ্যা হলো পণ্য – নারীর চূড়ান্ত বিষয়কৃত পরিচয়। গতর ছাড়া যার আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। গতরের নেই কোনো প্রতারণার বোধ। গতর অনুসরণ করে শরীরবৃত্তীয় বৈজ্ঞানিক ধারা। যেকোনো উপনিবেশিত সমাজে পুরুষের সঙ্গে নারীর সম্পর্কের এটিই কার্যকর মাপদণ্ড। অনুরূপ মাপকাঠিতেই নির্ণীত হয় পারস্পরিক প্রতিটি সম্পর্ক। যা বদলে দেয় মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক, বাবার সঙ্গে সম্পর্ক, দাদির সঙ্গে সম্পর্ক। বদলে দেয় প্রতিটি সম্পর্ক। যে-সম্পর্ক প্রতিনিয়ত উৎপাদন করে চলে স্বতন্ত্র এক বিষয়ীকে। বিষয়ীর সাপেক্ষে যেখানে বিষয়গত হয় বাদবাকি সবকিছু। চলে বিষয়ের উৎপাদন। স্থান, কাল ও পাত্রের উপনিবেশায়ন আদতে সম্ভবই হয় পারস্পরিক সম্পর্কের এই মাপনীটাকে উপনিবেশিত করার মাধ্যমে।

 

সম্পর্কের উপনিবেশায়ন

মিথুনকে কাছে পাবার পর – মুদ্রার মতো এপিঠ-ওপিঠ – উল্টেপাল্টে তাকে দেখতে ও বুঝতে চেয়েছে বিজয়। ফলে, মিথুন হয়ে ওঠে মিথুনের শরীর। শরীরের ভরকেন্দ্র হয়ে ওঠে যোনি। যোনিদ্বারের অবগুণ্ঠন হয়ে ওঠে যৌনতার পতাকা। সেই পতাকার নাম প্যান্টি। উপন্যাসে যার বিনিময় হয়েছে জাদুর হাড়ের বরাতে। ‘একটা জাদুর হাড়’। নারীকে জানার এই একাগ্রতা বিজয়ের বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসার ফল। যৌনতাকে বোঝার এটিই আধুনিক দৃষ্টি। উপনিবেশিক দৃষ্টি। এই প্রক্রিয়ায় বিষয়গত হয়ে ওঠে যৌনতা। হয়ে ওঠে দখল ও নিয়ন্ত্রণের বিষয়। জ্ঞানের বিষয়। এর সঙ্গে জড়িত ক্ষমতার প্রশ্ন। মিশেল ফুকোর লেখায় ইউরোপীয় যৌনতা ও ক্ষমতার এই জড়াজড়ি সম্পর্ক খোলাসা হয়। ফুকোর কথা হলো, ক্ষমতা তৈরি হয় যৌনতা বিষয়ে জ্ঞানোৎপাদনের মাধ্যমে। এবং সেই সম্পর্কিত সত্য উদ্ঘাটনের তাগাদা থেকে (Foucault, 1978 : 48)। তিনি অবশ্য যৌনতা বিষয়ক ইউরোপীয় বোঝাপড়াকে উপনিবেশিক বলে চিহ্নিত করেননি। ইউরোপীয় প্রেক্ষিতকে মাথায় রেখে ফুকো লিখেছেন যৌনতার ইতিহাস। দেখিয়েছেন কীভাবে তা ক্ষমতা-চর্চা ও শরীর নিয়ে রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত। আমাদের পথ ভিন্ন। আমরা প্রমাণও করতে চাইছি ভিন্ন কিছু। কেবল ইউরোপে যৌনতা-চর্চার বৈজ্ঞানিক চরিত্র নির্দেশ করার জন্যই ফুকোকে এখানে সাক্ষী হিসেবে আনা। ফলে, ফুকো নয়, এক্ষেত্রে বরং কুইজানো ও কুইজানোর তত্ত্ব নিয়ে যারা আরও অগ্রসর হয়েছেন সেই মিগনোলোদের চিন্তাসূত্র ধরেই আমরা এগোচ্ছি। এই মর্মে মিগনোলোর কথা বেশ স্পষ্ট। তিনি লিখছেন :

Since the Renaissance the rhetoric of modernity was and continues to be built on the logic of coloniality: the denial and disavowal of non-European local times and spaces and non-European ways of life. The rhetoric of modernity was built on the opposition between Christians and non-Christians, masculine and feminine, white and nonwhite…   (Mignolo, 2018 : 155)

অর্থাৎ, উপনিবেশিক যুক্তিকে আশ্রয় করেই সমাজে কার্যকর হয়েছে আধুনিকতা। ফলে, উপনিবেশিকতা সেই আধুনিকতারই উল্টাপিঠের নাম। আধুনিক বয়ানসমূহ যেই পিঠ বরাবর আড়ালে রাখে। এই কারণেই পারস্পরিক সম্পর্কের আধুনিকায়ন সমাজে ধরা দেয় অনিবার্য প্রগতিশীলতারূপে। এবং তাকে মনে হয় সমাজস্থিত ভাবনা। আলোচনার শুরুতেই এই প্রসঙ্গের সূত্রপাত আমরা করেছি। তবু, উপনিবেশিকতার প্রসঙ্গটি এখানে আরেকটু স্পষ্ট করা জরুরি। কুইজানোর মতে, রাজনৈতিকভাবে উপনিবেশবাদের পরিসমাপ্তি ঘটেছে, ঠিক আছে, কিন্তু ইউরোপীয় সংস্কৃতির সঙ্গে অপরাপর সংস্কৃতির বিষম সম্পর্ক সেই উপনিবেশিক আধিপত্যকেই ধরে রেখেছে এবং এটি কেবল বাহ্যিক আনুগত্য প্রদর্শনেরই ব্যাপার নয়; এটি ইউরোপীয় সংস্কৃতি কর্তৃক অপর সংস্কৃতির উপনিবেশায়নের সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট। তাছাড়া, পারস্পরিক এই বিষম সম্পর্কের প্রথম শর্তই হলো, উপনিবেশিতদের চিন্তার উপনিবেশায়ন। ফলে, এটি কাজই শুরু করে ভাবনার অন্তর্গত হয়ে। যে-কারণে মনে হয়, তা যেন চিন্তারই অংশ (Quijano, 2007 : 169)। কুইজানো প্রবন্ধটি লিখেছেন ১৯৯২ সালের দিকে। তার সূত্র ধরে এগিয়ে ২০১৮ সালে মিগনোলো লিখছেন :

Coloniality is shorthand for coloniality of power. The expression suggests that what is imprinted in colonial cultures is the effect of the imperiality of power. And the imperiality of power in the modern/ colonial world … is written not by guns and armies but by the words that justify the use of guns and armies … (Mignolo, 2018 : 140)

গোটা প্রবন্ধে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এই সূত্রগুলোর সহায়তাই আমরা নিয়েছি। এবং এই জোরেই মূলত দাবি করেছি, স্থান-কাল-পাত্রের পারস্পরিক সম্পর্ক উপনিবেশিত হয়েছে আধুনিকায়ন প্রক্রিয়ায়। মিগনোলো লিখছেন: ‘Hence, if coloniality is engendered by modernity, there cannot be modernity without coloniality; and there would be no coloniality without modernity. (Mignolo, 2018: 109)’। মিথুন-মার্থা-দীপালি, বিজয়-কামরুল-যতীন-হাবিব উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রই আধুনিক। আর আধুনিক বলেই তারা উপনিবেশিত। মননে তাদের উপনিবেশিকতা। যা তাদের বিচ্ছেদ ঘটিয়েছে আপনাপন আত্মসত্তা, স্থান ও কাল থেকে। পারস্পরিক স্বতঃস্ফূর্ত সম্পর্ক থেকে।

 

শেষ

উপসংহারে এসে, আমাদের প্রস্তাবিত পাঠকে আরও পোক্ত করার জন্য বিজয়ের উপর্যুপরি মাস্টারবেশনের প্রসঙ্গটি আমরা উল্লেখ করতে পারি। শব্দটির বাংলা তর্জমা করলেই বরং আমরা অনেকটা ব্যাখ্যার নিকটে পৌঁছে যাই। ‘মাস্টারবেশন’-এর সুন্দর একটি বাংলা হলো – আত্মমৈথুন। একজন আধুনিক ব্যক্তি তো জীবনভর তার বিচ্ছিন্ন ও কল্পিত আত্মকে মৈথুনই করে বেড়ায়। এবং এটিই তার জীবন ও যৌনতাকে যাপনের ধরন। সে ছুটে চলে তার আকাঙ্ক্ষার পিছু। বিজয়ের ক্ষেত্রেও কি আমরা তা-ই লক্ষ্য করিনি! উপন্যাসের সোনিয়া চরিত্রটি বিজয়ের আকাঙ্ক্ষার সম্প্রসারিত সীমানা। মিথুন চরিত্রেরই সে সম্প্রসারিত রূপ। সোনিয়ার কণ্ঠ থেকে তাই তো নিঃসৃত হয়, ‘সেই বয়সে দেখা পেলে আমিও আপনার প্রেমে পড়তাম!’ (জফির : ১২৬)। আর আত্মশ্লাঘা অনুভব করে বিজয়। সমস্ত উপন্যাস জুড়ে বিজয় এই আত্মমৈথুনেই রত ছিলো। ব্যক্তিসত্তার মৈথুন সেখানে প্রতীকায়িত হয়েছে দেহের মৈথুনে।

 

কোনো পাঠক হয়তো আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন, উপন্যাসে ঘুরে-ফিরে উচ্চারিত নাম, সিদ্ধার্থ ও তার সঙ্গে কমলার সম্পর্কের রসায়নের দিকে। বলবেন, সিদ্ধার্থের মতো বিজয় তো মিথুনকে পেতে চেয়েছে সাধনায় (জফির : ৫৮)। বিজয়ের আকাঙ্ক্ষা তাহলে কীভাবে উপনিবেশিত! আমরা ইঙ্গিত করবো, বিজয়ের এই পেতে চাওয়ার ভিন্নতার দিকে। সিদ্ধার্থ সে হতে পারেনি। সিদ্ধার্থের থেকে আলাদা ছিলো তার যাপন ও অভিপ্রায়। সিদ্ধার্থ ও কমলার কাহিনি বিজয়ের কাছে ছিলো বিষয়গত আখ্যান মাত্র। শুধু কালগত দূরত্বই নয়, তাদের দুইয়ের মধ্যে ছিলো জ্ঞানবিদ্যাগত ফারাক। এবং ঘটনা নয়, আমরা এগিয়েছি বিষয়ীর এই জ্ঞানগত কাঠামো ধরেই। এই উত্তর দেওয়ার মানে অবশ্য, উপন্যাসটির অপরাপর পাঠসমূহকে নিরুৎসাহিত করা নয়। নিঃসন্দেহে, রচনাটিকে আরও অনেকভাবে পাঠ করা সম্ভব। ব্যাখ্যাও করা সম্ভব ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে। আমরাও এখানে কুইজানো ও মিগনোলোদের প্রস্তাবকে মেনে নিয়ে উপন্যাসটি পাঠ করেছি মাত্র। তাদের প্রস্তাবের দার্শনিক সক্ষমতা যাচাইও করতে যাইনি। ফলে, আধুনিক বিষয়ীর যাপনে উপনিবেশিকতার যে রকমটা প্রতিভাত হয় তার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণের চেষ্টা আলোচনায় ঠাঁই পায়নি। কয়েকটি সামান্য সূত্রের আলোকে ব্যাখ্যাত হয়েছে যাপনের উপনিবেশিকতা।

 

আচ্ছা, উপন্যাসে যেমন-যেমন ঘটলো, বাস্তবে কি এইরকম ঘটা সম্ভব! এমন কখনো ঘটে! এর উত্তরে বলা যায়, শুধু এমনটাই নয়, উপন্যাসে ঠিক যেমনটা ঘটেছে, বাস্তব আরও অনেকরকম হওয়ার সম্ভাবনা ধারণ করে। আর এই সম্ভাবনাই উপন্যাসের প্রাণ। সম্ভাবনাগুলোকে চিত্রিত করাই উপন্যাসের কাজ। তার কাজ হুবহু বাস্তবকে চিত্রিত করা নয়। বরং প্রতিনিয়ত তাকে লঙ্ঘন করা। তাকে মাড়িয়ে যাওয়া। যতো উপায়ে মাড়িয়ে যাওয়া যায়। ফলে, বাস্তব কতো কতো রকম হতে পারতো তা প্রকাশ ও প্রচার করাই উপন্যাসের দায়। এভাবেই, একমাত্রিক বাস্তবের বিপরীতে দাঁড়িয়ে তার, চেপে যাওয়া, অবদমিত অপরাপর সম্ভাবনাগুলো উপন্যাসে হাজিরা দেয়। এবং বাস্তবকে লঙ্ঘন করার শর্তেই তা সম্ভব হয়ে ওঠে। শুধু তাই নয়, বাস্তবের এই লঙ্ঘন উপন্যাসেরও উপন্যাস হয়ে উঠার গুরুত্বপূর্ণ একটি শর্ত। শিল্প হিসেবে তার প্রতিষ্ঠার শর্ত। এভাবে চিন্তা করতে গিয়ে থিয়োডর অ্যাডর্নোর কাছে আমাদের ঋণ তৈরি হয় (Adorno, 2002: 4)। জফির সেতু তার একটা জাদুর হাড়-এ বাস্তবের চিত্রায়ণ করাকেই দায় হিসেবে গ্রহণ করেননি। তাই আড়ষ্ট বাস্তবতার একমাত্রিক প্রকরণে যেইসব চরিত্র ধরা দেয় না, তার উপন্যাসে সেই চরিত্রগুলোও ভিড় করেছে সমানতালে। পাঠকের সামনে মেলে ধরেছে তাদের অচেতন।

 

সহায়কপঞ্জি

জফির, ২০২০, জফির সেতু, একটা জাদুর হাড়, সিলেট : নাগরী।

রাসবিহারী, ২০১১, রাসবিহারী দাস, কান্টের দর্শন, ঢাকা : জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন।

Adorno, 2002, Theodor W. Adorno, Aesthetic Theory, Trans. Robert Hullot-Kentor, London & New York : Continuum.

Foucault, 1978, Michel Foucault, The History of Sexuality, Volume 1: An Introduction, Trans. Robert Hurley, New York : Pantheon Books.

Mignolo, 2018, Walter D. Mignolo & Catherine E. Walsh, On Decoloniality, United States of America : Duke University Press.

Kant, 1998, Immanuel Kant, Critique of Pure Reason, Trans. Paul Guyer & Allen W. Wood, United Kingdom : Cambridge University Press.

Quijano, 2007, Anibal Quijano, ‘Coloniality and Modernity/ Rationality’, Cultural Studies, 21: 2, 168-178, http://dx.doi.org/10.1080/09502380601164353

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here