মুহাম্মদ শফিকুল ইসলাম কবি, অনুবাদক, গবেষক এবং ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক। মূলত ইংরেজিতে লিখে থাকেন। বিশ্বখ্যাত বিভিন্ন গবেষণা-পত্রিকায় তাঁর প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সহজিয়ার জন্য তিনি লিখবেন গবেষণা বিষয়ক ধারাবাহিক গদ্য।
গবেষণার জন্য দক্ষতা
এ পর্বে একজন গবেষকের কী কী দক্ষতা থাকা প্রয়োজন সে বিষয়ে লিখছি। মানববিদ্যা তথা সাহিত্যে গবেষণার জন্য যেসব দক্ষতা অর্জন করা আবশ্যক তা তুলে ধরার চেষ্টা করছি। এগুলো হয়তো চূড়ান্ত নয় বা এগুলোর বাইরে আরো অনেক রয়েছে, কিন্তু আমি চেষ্টা করছি আমার অভিজ্ঞতা থেকে কিছু সুনির্দিষ্ট দক্ষতার কথা তুলে ধরার। আর আমি মনে করি এগুলো অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। একজন গবেষককে যেসব বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে বা যেসব দক্ষতা অর্জন করতে হবে সেগুলো নিম্নরূপ :
পাঠাভ্যাস
সম্ভবত আমি আগেও কিছুটা আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি যে পঠন গবেষণার জন্য কতটা প্রয়োজন। শুধু প্রয়োজন বললে ভুল হবে। গবেষণার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে পাঠাভ্যাস। গবেষণার প্রাণ বললেও অতিরিক্ত বলা হবে না। আপনি যেহেতু গবেষণা করার কথা ভাবছেন বা আপনি মনে করছেন গবেষণা আপনার ক্যারিয়ারের জন্যও প্রয়োজন তাই আপনাকে সর্বপ্রথম যে কাজটি করতে হবে সেটি হলো আপনার বিষয় সম্পর্কিত প্রচুর প্রবন্ধ এবং অনেক বই সংগ্রহ করতে হবে। সংগ্রহ করে ডেস্কে বা শেলফে রেখে দিলে হবে না। সেখান থেকে একটা একটা করে পড়তে হবে। পড়ার সময় নোট নিতে হবে। “নোট টেকিং” গবেষণার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যেসব বিষয় পড়ছেন সেগুলোর সব আপনি রিলেট করবেন না বা সেগুলোর সব আপনার লেখার জন্য রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহৃত হবে না। সুতরাং আপনার টপিক সম্পর্কিত লাইন বা প্যারাগ্রাফ চিহ্নিত করে রাখুন। এখানে আরেকটি বিষয় বলা দরকার আর তা হলো আপনি এতসব পড়ছেন কারণ আপনার গবেষণার মাধ্যমে আপনি নতুন কিছু বলতে চাচ্ছেন বা বর্তমান বিষয়ের সাথে কিছু একটা সংযোজন করতে পারবেন বলে প্রত্যাশা করছেন। পড়ে পড়ে দেখতে হবে কোন বিষয়টি গবেষণায় গুরুত্ব পেয়েছে বা সে বিষয়ে আর কি বলা যেতে পারে। আর কোন বিষয়টি বলা হয়নি কিন্তু বলা দরকার। এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো অন্য গবেষকগণ যা করেছে বা বলেছে তা যেন পুনরাবৃত্তি না হয়।
আর যারা একদম প্রাথমিক পর্যায়ে আছেন অর্থাৎ গবেষণা সম্পর্কে কোন ধারণা নেই তাদের জন্য বলছি। এ পর্যায়ে গবেষণার নিয়ম-কানুন বা পদ্ধতি সম্পর্কে জানার জন্য পড়বেন। এসময় একই সঙ্গে ভালো ভালো গবেষণা প্রবন্ধ পড়া জরুরি। অর্থাৎ আপনি পদ্ধতিগত জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি কীভাবে গবেষণা প্রবন্ধ বাস্তবতায় রূপ নেয় অর্থাৎ প্রকাশিত হয় সে বিষয়েও ধারণা নিচ্ছেন। মনে রাখবেন শত শত, হাজার হাজার লাইন পড়ার পর আপনি একটি দুটি লাইন লেখার চিন্তা করতে পারবেন। এটা প্রচুর পড়ার প্রয়োজনীয়তার জন্য বলা হয়ে থাকে। গবেষক হওয়ার জন্য আপনাকে একজন আদর্শবান পাঠক হতে হবে। আর যখন কোন বিষয় নিয়ে গবেষণা শুরু করে দিয়েছেন সে পর্যায়ে আপনার পড়া হতে হবে ফোকাসড বা কেন্দ্রীভূত বা গোছানো। আপনি যা-ই পড়ছেন তা ‘সিংক্রনাইজ’ করতে হবে। অর্থাৎ বিচ্ছিন্নভাবে পড়ার অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। শেষ কথা গভীর পাঠাভ্যাস গড়ে তোলা ছাড়া গবেষণার কাজটি করা কোনভাবেই সম্ভব নয়।
প্রবন্ধের পরবর্তী অংশে যে বিষয়গুলো পর পর লিখতে হয় তা এরকম : ইন্ট্রোডাকশন, থিওরেটিক্যাল ফ্রেইমওয়ার্ক, টেক্সচুয়াল বিশ্লেষণ এবং উপসংহার। তারপর রেফারেন্স অংশ দিয়ে শেষ করতে হয়। একটা অংশে লিট্রেচার রিভিউ থাকে।
ভাষাগত দক্ষতা
এটা নিশ্চয়ই অনুমেয় যে গবেষণার ভাষাশৈলি অন্যান্য সব ধরনের ভাষাশৈলি থেকে আলাদা। অর্থাৎ গবেষণার ভাষা স্বতন্ত্র, এর সাথে সৃষ্টিশীল লেখা বা অফিশিয়াল যোগাযোগ পরিচালনার জন্য ব্যবহৃত ভাষার বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। গবেষণার ভাষার নিজস্ব ধারা রপ্ত করার জন্য উন্নত মানের জার্ণালে প্রকাশিত প্রবন্ধ পড়তে হবে বা ভালো ভালো গবেষণাধর্মী বই পড়তে হবে। আমি বলছি এমন একটা অবস্থানের কথা যেখানে ভাষা আপনার দখলে। শুধু গবেষণার জন্য যে ভাষা ব্যবহার করতে হবে তা রপ্ত করছেন। যেমন ধরুন, ইংরেজি সাহিত্য বা ভাষাবিজ্ঞান বিষয়ে গবেষণা করার জন্য অথবা মানববিদ্যা বা সামাজিক বিজ্ঞানের কোন বিষয়ে কোন প্রবন্ধ আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশ করার জন্য আপনাকে গবেষণার মান ভাষার দক্ষতা অর্জন করতেই হবে। এক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষাজ্ঞান যদি খুব সাদাসিধে হয় বা আপনি সাধারণভাবে ইংরেজিতে দুর্বল হন, তবে গবেষণার কাজ চালিয়ে নেয়া কঠিন হবে। এমনকি বাংলা ভাষাতে গবেষণা করলেও বাংলা ভাষার গবেষণা উপযোগী ভাষা রপ্ত করতে হবে।
আপনি যদি আন্তর্জাতিক জার্নালের খোঁজখবর রাখেন নিশ্চয়ই জানেন সেখানে ভাষাকে কীভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়। অর্থাৎ একটি প্রবন্ধ খুব ভালো হয়েছে, অন্যান্য সবকিছু খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, কিন্তু তার ভাষা সেই মানের হয়নি। সুতরাং এ প্রবন্ধটি প্রকাশিত হবে না। আপনি লক্ষ্য করে থাকবেন টেইলর এন্ড ফ্রান্সিস সহ এরকম মানের প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত জার্নালগুলো ভাষা বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে। এমনকি তারা প্রফেশনালি ভাষা পরিশীলিত করার জন্য বিভিন্ন ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠানের রেফারেন্স দিয়ে থাকে। আর সেখানকার প্রতিশব্দ হিসেব করে যে টাকা (পড়ুন ডলার) দাবি করা হয় তা ‘গ্লোবাল সাউথ’ থেকে কোন গবেষকের জন্য রীতিমত অত্যাচার। তার চেয়ে ভালো আপনি গবেষণার ভাষা রপ্ত করতে থাকুন। আগেই বলেছি কোন কিছুই অসম্ভব নয়। এক্ষেত্রেও তাই। কিন্তু পরিশ্রম করতে হবে। প্রতিটা শব্দ ধরে, প্রতিটা লাইন ধরে শিখতে হবে। তবে আপনি লেগে থাকলে কোন একটা সময় নিজেই বুঝতে শুরু করবেন কোন শব্দটা গবেষণা প্রবন্ধে লেখা যাবে কোনটা লেখা যাবে না। তবে যতদিন গবেষণা উপযোগী ভাষাজ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হবেন না, ততদিন আন্তর্জাতিক উঁচুমানের কোন জার্নালে প্রকাশ অসম্ভবই রয়ে যাবে।
একজন গবেষকের যেসব দক্ষতা অর্জন করা আবশ্যক তন্মধ্যে কাঠামোগত জ্ঞান অর্জন করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আগেই বলেছিলাম গবেষণার কাজটি একটি গোছানো কাজ এবং এ-কাজটি নিয়মের মধ্যে থেকে করতে হয়। এর জন্য নির্ধারিত কাঠামো অনুসরণ করা আবশ্যক। সাহিত্য তথা মানবিক বিদ্যায় গবেষণার জন্যও নির্ধারিত কাঠামো অনুসরণ করতে হবে।
এক্ষেত্রে প্রথমেই একটি শিরোনাম ঠিক করতে হবে। শিরোনাম ঠিক করা বা শিরোনাম কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে একটি আলাদা পর্ব লেখা যেতে পারে। তবে দু’একটি কথা বলছি। শিরোনাম হতে হবে সংক্ষিপ্ত, অর্থাৎ এখানে অনেক কিছু লেখার প্রয়োজন নেই। পুরো প্রবন্ধটা কি নিয়ে তা যেন একটি বাক্যে বুঝে নেয়া যায় তা নিশ্চিত করা। শিরোনাম পড়ে পাঠক যেন পুরো প্রবন্ধ কি নিয়ে তার একটা ধারনা পেতে পারে। এর ভাষা হতে হবে প্রাঞ্জল এবং সহজে বোধগম্য। কেউ কেউ মনে করে থাকেন শিরোনামে কঠিন ভাষা ব্যবহার করতে হবে অথবা ‘রেটরিক্যাল’ শব্দ প্রয়োগ করতে হবে। কেউ কেউ ‘এলিটারেশন’ বা ‘এসোন্যান্স’ ব্যবহার করার প্রবণতা দেখিয়ে থাকেন, যা মোটেই কাম্য নয়। আবার এরকম কিছু শব্দ যদি শিরোনামের প্রয়োজনে অবধারিতভাবে চলে আসে তাতে কিছু করার নেই। তবে শিরোনাম পড়ে যেন কখনোই মনে না হয় গবেষক জোর করে শব্দ নিয়ে খেলার চেষ্টা করেছেন। অর্থাৎ শব্দচয়ন থেকে শুরু করে বাক্য – কোন জায়গাতেই যেন ভাষার ‘ফোরসড’ ব্যবহার পরিলক্ষিত না হয়। আবার খেয়াল রাখতে হবে শিরোনামের ভাষা যেন একেবারে নিউজপেপারের ভাষার মত না হয়।
শিরোনামের পরেই এবস্ট্রাক্ট, যা নিয়েও বিস্তারিত বলার সুযোগ আছে এবং আমি তা আরেক পর্বে করতে চাই। তবে এটুকু বলে রাখি, এবস্ট্রাক্ট-এ আপনি পুরো প্রবন্ধে কী বলবেন তা সংক্ষেপে বলে থাকেন। অর্থাৎ প্রবন্ধটির একেবারে সংক্ষিপ্ত অংশ এবস্ট্রাক্ট। এখানে আপনি ‘সেন্ট্রাল আর্গিউমেন্ট’ প্রতিষ্ঠা করে থাকেন। কোন তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে প্রবন্ধটি অগ্রসর হবে তাও সংক্ষেপে বলে দিতে পারেন। এবস্ট্রাক্টের পরেই আসে ‘কী ওয়ার্ডস’ যা চার, পাঁচ বা ছয় শব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। এ শব্দগুলো পড়ে একজন পাঠক ঝটপট বুঝে নিতে পারে প্রবন্ধটিতে কী কী বিষয় গুরুত্ব পেয়েছে। অর্থাৎ প্রবন্ধের বিষয়বস্তু থেকে কয়েকটি মূল বিষয় এখানে উল্লেখ করতে হয়।
প্রবন্ধের পরবর্তী অংশে যে বিষয়গুলো পর পর লিখতে হয় তা এরকম : ইন্ট্রোডাকশন, থিওরেটিক্যাল ফ্রেইমওয়ার্ক, টেক্সচুয়াল বিশ্লেষণ এবং উপসংহার। তারপর রেফারেন্স অংশ দিয়ে শেষ করতে হয়। একটা অংশে লিট্রেচার রিভিউ থাকে। তবে এটা আলাদা করে না দেখিয়ে সূচনা অংশে দেয়া যেতে পারে। এ বিষয়গুলো নিয়ে পরবর্তী সময়ে বিস্তারিত বলব। যেমন, থিওরেটিক্যাল ফ্রেইমওয়ার্ক একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ যার উপর নির্ভর করে প্রবন্ধের মান। আর টেক্সচুয়াল বিশ্লেষণ হতে হবে সিম্বাইওটিক – থিওরির সাথে টেক্সট এর আলোচনা এবং বিশ্লেষণ হতে হবে খুব গভীর এবং নিখুঁত। এখানে বিশ্লেষণ যত শক্তিশালী হবে, প্রবন্ধটির মান তত বৃদ্ধি পাবে।
এখানে একটা বিষয় বলা দরকার, আর তা হলো লেখক পরিচিতি। আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন সাময়িকীগুলোতে লেখকের/গবেষকের একটা ছোট্ট পরিচিতি থাকে যেখানে লেখক বা গবেষকের অতীত প্রকাশনা, এরিয়া অভ ইন্টারেস্ট, প্রজেক্ট ইত্যাদি উল্লেখ করা হয়। আমাদের একটা প্রবণতা দেখা যায় আমরা পরিচিতি একেবারে বড় করার চেষ্টা করি যেখানে কখনো কখনো, বুঝে না বুঝে, অনেকগুলো এরিয়ার কথা লিখে থাকি এবং দাবি করে থাকি সেগুলোর বিশেষজ্ঞ হিসেবে। অথচ আন্তর্জাতিক ভালো গবেষকগণ দু’টি বা তিনটির বেশি এরিয়ার কথা লিখেন না বলেই সাধারণত দেখা যায়। একজন ভালো গবেষক দিন দিন যত পরিপক্ব হতে থাকেন ততই অনুধাবন করতে থাকেন তিনি কত কম জানেন।
(চলবে)
নতুন গবেষকদের জন্য সাহিত্যে গবেষণা ধারাবাহিক লেখাটি প্রয়োজনীয়। তবে প্রাবন্ধিক ইচ্ছে করলেই পাঠকটু কিছু শব্দ বর্জন বা বাংলায় লিখতেই পারতেন। যেমন: প্রফেশনালি ।