ওমর আলীর কবিতা

আজ কবি ওমর আলীর জন্মদিন। তাঁর বিখ্যাত কবিতার বই এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি। তাঁকে স্মরণ করে লিখেছেন প্রাবন্ধিক মোহাম্মদ রউফ

বৃটিশ শাসনের শেষ দিকে কবি ওমর আলী (১৯৩৯-২০১৫) ২০ অক্টোবর পাবনার শিবরামপুর গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মেছিলেন। বাল্যবেলা পদ্মার তীরবর্তী সবুজ শোভিত নিসর্গে অতিবাহিত হলেও শিক্ষাজীবনের সিংহভাগ সময় কেটেছে রাজধানী শহর ঢাকায়। আরমানিটোলা হাম্মাদিয়া উচ্চবিদ্যালয়ে অধ্যয়কালে (দশম শ্রেণি) তিনি কবি আহসান হাবীবের (১৯১৭-১৯৮৫) বাসায় জায়গির থাকতেন এবং কবি পরিবারের সন্তানদের পড়াশোনার বিষয়টি দেখলাভ করতেন। ইংরেজি সাহিত্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যায়তনিক অধ্যয়নপর্ব সম্পন্ন (১৯৭০) করেন। শুরুতে দৈনিক সংবাদে কর্মজীবন শুরু করলেও দ্রুতই ফিরে আসেন অধ্যাপনায়। নানা প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা শেষে থিতু হয়েছিলেন পাবনা সরকারি শহিদ বুলবুল কলেজে। অবসরের (১৯৯৯) পূর্ব পর্যন্ত তিনি একলেজেই কর্মরত ছিলেন। কবি ওমর আলীর আকর্ষণেই কবি মজিদ মাহমুদ সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ ছেড়ে সরকারি শহিদ বুলবুল কলেজে পড়তে এসেছিলেন। একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে তখন কবি ওমর আলী ইংরেজি পড়াতেন। ছাত্রশিক্ষক সম্পর্ক এবং পরবর্তী সময়ের নানা স্মৃতিকথা নিয়ে কবি মজিদ মাহমুদ ‘একান্ত অনুভবে কবি ওমর আলী’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছেন। সেখানে ওমর আলীর ব্যক্তিজীবন ও সাহিত্য সম্পর্কে আমরা অনেক কথাই জানতে পারি; জানতে পারি কবি বন্দে আলী মিয়া (১৯০৬-১৯৭৯) সম্পর্কেও।

 

কবি ওমর আলীর ব্যক্তিজীবনের দিকে তাকালে দেখব, দেশভাগের (১৯৪৭) বছর কয়েক পরেই বিদ্যার্জনের লক্ষ্যে তিনি পাবনার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ঢাকায় আসছেন। এবং এখানে সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠছেন। সৈয়দ শামসুল হকের হৃদকলমের টানে (১৯৯১) এবং কবি আল মাহমুদের আত্মজীবনী ‘বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ’সহ নানা লেখায় ওমর আলী প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে দেখি। পঞ্চাশ দশকের এক ঝাঁক প্রতিভাবান কবি-সাহিত্যিকের সঙ্গে ওমর আলীর সাহিত্যিক-সখ্যতা ছিল; ছিল আড্ডার সম্পর্ক। এসব লেখকদের মধ্যে ফররুখ আহমদ (১৯১৮-১৯৭৪), হাসান হাফিজুর রহমান (১৯৩২-১৯৮৩), আলাউদ্দিন আল আজাদ (১৯৩২-২০০৯), শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬), আল মাহমুদ (১৯৩৬-২০১৯), রফিক আজাদ (১৯৪১-২০১৬), সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫-২০১৬), শহীদ কাদরি (১৯৪২-২০১৬), বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর (১৯৩৬-২০২০), মুনীর চৌধুরী (১৯২৫-১৯৭১), ফজল শাহাবুদ্দীন (১৯৩৬-২০১৪) প্রমুখ অন্যতম। এসময় ওমর আলী দৈনিক সংবাদএ বার্তাবিভাগে সাব এডিটর হিশেবে কর্মরত ছিলেন। পাশাপাশি একাডেমিক লেখাপড়াও অব্যাহত রেখেছিলেন। ওমর আলীর বেড়ে ওঠা ব্যক্তি ও কাব্যজীবনের দিকে তাকালে দেখব, ঢাকার ন্যায় পুরাতন কর্পোরেট শহরে বেড়ে ওঠা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যয়ন — এসব তার কাব্যজীবনে খুব একটা প্রভাব বিস্তার করেনি। অথচ বঙ্গসাহিত্যের অতীত ইতিহাসে তাকালে দেখব, নগরে বেড়ে ওঠা, ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যয়ন করা কবিরা একসময় বাংলা কাব্যান্দোলনে আধুনিকতার সুতীব্র ঝড় তুলেছিলেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ কবি মোহিতলাল মজুমদার (১৮৮৮-১৯৫২) থেকে শুরু করে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১-১৯৬০), জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪), বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪), অমিয় চক্রবর্তী (১৯০১-১৯৮৬), বিষ্ণু দে (১৯০৯-১৯৮২), সমর সেন (১৯১৬-১৯৮৭) হয়ে বাংলাদেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬) পর্যন্ত অনেকের নাম উল্লেখ করা যায়। এসময় এই একঝাঁক প্রতিভাবান কবি বাংলা কাব্যসাহিত্যে নেতৃত্বের আসনে ছিলেন। কিন্তু ওমর আলীর কাব্যচর্চায় ঐ প্রভাবটি দৃশ্যমান হয়নি। নাগরিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা, ইংরেজি সাহিত্যে পঠনপাঠন সত্ত্বেও তিনি রইলেন গ্রামীণ জীবন ও জনপদের ভাষ্যকার হয়ে। প্রাসঙ্গিক হওয়ায় আল মাহমুদের একটি বক্তব্য তুলে দিতে চাই। কবি ওমর আলী প্রসঙ্গে আল মাহমুদকে ‘আত্মজীবনী’তে লিখতে দেখি :

ওমর আলীর সঙ্গে আমার হৃদয়ের একটা যোগ স্থাপনের সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু ওমর ছিল প্রকৃতপক্ষে প্রকৃতিনির্ভর মানুষ এবং প্রকৃতির মধ্যে নিমজ্জমান। এখনো তিনি আগের মতোই আছেন। আমি এতে কোনো দোষ দেখি না। কবির পরিতৃপ্তির চেয়ে অন্যতর প্রবৃদ্ধি তাকে কোনো সাহায্য করে না। তবে একটা বৈপরীত্য আমি আজও বুঝতে পারি না। সেটা হলো ওমর ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। পড়াশোনাও করেছিলেন ব্যাপকতর আগ্রহে। চশর থেকে ইলিয়টস পর্যন্ত সবই ছিল তার নখদর্পণে। তবু চিরহরিৎ নিঃস্বর্গে নিমজ্জমান থাকতে ওমর আলী কেন নিজেকে এত ঘোরের মধ্যে ঠেলে দিয়েছেন তা আমার বোঝার কোনো সাধ্য আছে বলে আমি মনে করি না।

এটি কৃষ্ণকলির ন্যায় একক কোনো নারীসত্তা নয়। এই রমণী আবহমান গ্রাম বাংলার। এই রমণী সাতষট্টি হাজার গ্রাম বাংলার। এই রমণী গ্রামীণ জীবন ও জনপদের।

ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধের ন্যায় দুটি বৃহৎ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রত্যক্ষ সাক্ষী কবি ওমর আলী। স্বদেশ, স্বাধীনতা ও স্বাধিকার নিয়ে লিখেছেন প্রচুর। বেঁচে থাকতেই স্বাধীনতা সংশ্লিষ্ট কবিতাগুলোকে একটি পৃথক মলাটে সযত্নে সংরক্ষণ করেছেন। নাম দিয়েছেন স্বাধীনতার কবিতা (২০০৯)। গ্রন্থভুক্ত কবিতায় ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির অসংখ্য প্রয়োগ পরিদৃশ্যমান। ঘুরেফিরে এই শব্দটি নানা প্রতীক-সংকেতে ফিরে এসেছে বারবার। গ্রন্থটির প্রারম্ভে একটি সুন্দর ছোট্ট ভূমিকাও জুড়ে দিয়েছেন। সেখানে কবিকে লিখতে দেখি — ‘আমরা বাঙালিা একাত্তরকে আমাদের জন্ম বলেই জানি। এই জন্মকালে পারিপার্শ্বিক চরিত্র ঘটনাগুলো এসেছে সময়ের অমোঘ নিয়মে। কবিতাগুলো তাই কবিতার স্বভাবে আরেক ইতিহাস।’ অনুভব করি, স্বাধীনতা নিয়ে কবির আবেগের ঘনত্ব ও পরিশুদ্ধতা। কিন্তু সেই ইতিহাসকে তিনি কতটুকু জীবন্ত করতে পেরেছেন — সেই প্রশ্ন ঘুরেফিরেই আসে।

 

জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রভাব ওমর আলীর কাব্যজীবনে প্রবল হলেও সেটিকে শৈল্পিক রূপ দিতে পারেননি তিনি। পাঠকমনকে নাড়া দেবার মতো শিল্পসফল কবিতা কোথায়? কয়েকটি কাব্যচরণ না দিলেই নয়। ‘কাঁধে এলএমজি তার সাথে যেতে ইশারায় ডাকলো আমাকে / তার লম্বা চুল দাড়ি গোঁফ জুঁই জোনাকিরা তার দেহ ঘিরে / বুকে আঁকা স্বাধীনতা পতাকার লাল সূর্য রক্ত ঝরা ক্ষত..’। বুঝতে পারি, গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুরা কবিকে নিতে এসেছিলেন। কিন্তু কবি গিয়েছিলেন কি? ‘স্বাধীনতা কাঁধের দুপাশে লম্বা চুল / ঝুলিয়ে দেওয়া কিশোরী কুমারী ডগমগে যুবতী / কিংবা পরিপূর্ণ রমণীর বেণী’ — এটি কি কবি শামসুর রাহমানের দুর্বল অনুকরণ নয়? অথবা ‘কি নিষ্ঠুর পরিহাস আমাকে দিয়েই / খোঁড়া হল আমার কবর / আমাকে জীবিত তাতে চাপা দেয়া হলো’ — এই প্রকৃতির কবিতা ওমর আলীর কম নয়। ‘স্বাধীনতার কবিতা’ শীর্ষক গ্রন্থটির দিকে তাকালে দেখব, স্বাধীনতা নিয়ে প্রচুর কবিতা লিখলেও শিল্পবিচারে এসব কবিতা উতরে যায়নি। তার সমসায়িক দশকের কবিদের ন্যায় স্বাধীনতার শিল্পফসল ঘরে তুলতে পারেননি তিনি। আবেগ এবং আন্তরিকতা থাকলেও বাকপ্রতীম সক্ষমতা ছিল না তার। আবার গ্রামীণ লোকজ সমাজ ও সংস্কৃতির বিবেচনা করলে জীবনানন্দ দাশ, জসীম উদদীন, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আল মাহমুদ অথবা সৈয়দ শামসুল হকের কবিতার পাশাপাশি রাখলে ওমর আলীকে নিতান্ত জইফ মনে হয়। এদের মতো করে গ্রামীণ জীবনের ছবি রূপায়ন করতে পারেননি ওমর আলী। এমনকি শামসুর রাহমান অথবা শহীদ কাদরির ন্যায় ওমর আলীর কবিতায় নাগরিকতার প্রভাবও পরিদৃশ্যমান নয়। প্রশ্ন জাগে, তাহলে কোন তরিকায় দাঁড়িয়ে ওমর আলীকে পাঠ করব?

 

মূলত ছাত্রজীবনেই ওমর আলীর লেখালেখির হাতে খড়ি। আজীবন তিনি কবিতার সঙ্গেই ছিলেন। প্রেমপ্রকৃতিসহ সমকালীন নানা সংকট-সংঘাত, দ্বিধাদ্বন্দ্ব, হতাশা-ক্ষোভ, পাওয়া-না পাওয়ার ব্যথাবেদনা ইত্যাকার প্রসঙ্গ ওমর আলীর কাব্যসাহিত্যে দৃশ্যমান। সাংবাদিক জীবনে তিনি ‘খেলাঘর আসর’ এর নিয়মিত লেখক ছিলেন। পাকিস্তান রেডিওতে কবিতা পাঠ করতেন। কবি ফররুখ আহমদসহ অনেকেই উপস্থিত থাকতেন। উপস্থাপনা করতেন মুনীর চৌধুরী। নানাভাবে অপরাপর সাহিত্যিকদের সঙ্গে ওমর আলীর পরিচয় ও সখ্যতা ঘটতে থাকে। কবি হওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে কুমিল্লা থেকে কবি আল মাহমুদ ‘একটি টিনের সুটকেস’ হাতে নিয়ে এসেছিলেন প্রাচীন মোগলাই শহর ঢাকায় (পুরান ঢাকা)। ওমর আলীর কবিতা প্রকাশ প্রসঙ্গে আল মাহমুদ বলেন, ‘এক-পা এক-পা করে সিঁড়ি ভেঙে কাগজটি যথাস্থানে রেখে আমি নাস্তার জন্য বের হতে যাচ্ছিলাম। এমন সময় দেখি বোগলের নিচে দৈনিক সংবাদ নিয়ে ওমর আলী হাঁপাতে হাঁপাতে এসে হাজির। আল মাহমুদ আমার কবিতা ছাপা হয়েছে।’ আল মাহমুদের এই উক্তি থেকে অনুভব করা যায়, ওমর আলী কতটা গভীরভাবে কবিতার প্রেমে পড়েছিলেন।

 

প্রায় সাতাত্তুর বছর জীবনকালে ওমর আলী কম লেখেনি। দুএকটি গদ্যগ্রন্থসহ কমবেশি প্রায় চল্লিশটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তন্মধ্যে এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি (১৯৬০) গ্রন্থটি সর্বাধিক পরিচিত ও পঠিত। এই গ্রন্থটি কবিকে আদমজি পুরষ্কার এনে দিয়েছিল; এরচেয়েও বড় কথা — এনে দিয়েছিল কবি-পরিচিতি, বিপুল সুনাম-সুখ্যাতি। বিদ্যুৎবেগে ছড়িয়ে পড়েছিল ওমর আলীর কবিনাম। তিনি সর্বত্র কবি হিশেবে সমাদৃত হয়েছিলেন। এমনকি আজ অবধি গ্রন্থটি বহুল প্রশংসিত, বহুল উচ্চারিত। যারা গ্রন্থটি পাঠ করেননি অথবা যারা কখনো পাঠ করবেন না, তারাও ওমর আলীকে চেনেন-জানেন কেবল এই গ্রন্থটির কারণে। প্রশ্ন আসতে পারে, কী আছে গ্রন্থটিতে? মাত্র চারটি ফর্মা, চৌষষ্ট্রি পৃষ্ঠার একটি কবিতাগ্রন্থ। পাতার পর পাতা উল্টালে দেখব, প্রেমপ্রকৃতি গ্রন্থটির মৌলপ্রবণতা বিশেষত নারীপ্রেম। কিন্তু প্রেম তো নতুন কিছু নয়। যুগযুগ ধরে, কালকাল ধরে সেই শ্রীকৃষ্ণকীর্তন থেকে রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান হয়ে পদাবলি সাহিত্য পর্যন্ত প্রায় পুরো মধ্যযুগব্যাপি অযুতনিযুত কবিরা প্রেমকে উপজীব্য করে কাব্যকবিতা রচনা করে আসছিলেন। এখনও রচনা করছেন। হয়তো ভবিষ্যতেও করবেন। এসব কাব্যকবিতা স্মরণে রেখেও বলা যায়, ওমর আলীর কবিতায় বিশেষ বিশেষত্ব রয়েছে। বিশেষত্ব রয়েছে নামকরণেও।

 

এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি কবিতাগ্রন্থের নাম কবিতাটি পড়তে গিয়ে বারবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের  ‘কৃষ্ণকলি’ কবিতাটির চিত্রকল্প ভেসে ওঠে। কবিগুরু মেঘলা দিনে ‘ময়নাপাড়ার মাঠে’, ‘আলের ধারে দাঁড়িয়ে’ ছিলেন একাকি। এসময় কৃষ্ণকলি এসেছিল ওদের শ্যামল গরুদুটি ফিরিয়ে নিতে। কৃষ্ণকলি কবির মুখের দিকে তাকিয়েছিল একপলক। তাকিয়েছিল কবি নিজেও। ‘কালো মেয়ের কালো-হরিণ চোখ’ সেদিন কবিমনে রোমান্টিক প্রেমের জোয়ার এনেছিল। কিন্তু ওমর আলীর কবিতায় ‘মেয়ে’ শব্দটির পরিবর্তে ‘রমণী’, ‘কালো’ রঙের পরিবর্তে ‘শ্যামলা’ শব্দ প্রয়োগ করতে দেখি। এই রমণীর সঙ্গে কৃষ্ণকলির ন্যায় ওমর আলীর চোখাচোখি হয়নি। সুনাম শুনেছে মাত্র।

 

এই সুনাম শুনে ওমর আলী নানা উপমা-অনুচ্ছেদে, অনুপ্রাসে ‘শ্যামল রঙ রমণী’র চিত্রকল্প হাজির করতে সচেষ্ট হলেন। আইভি লতার ন্যায় সরল, স্নানের পর রোদ্দুরে চুল শুকানো, হরিণীর ন্যায় মায়াবী উচ্ছ্বল চোখ, হালকা লতার ন্যায় শাড়ি দিয়ে দেহ ঢাকা; দেহে তার নদীর বাঁধভাঙা জোয়ার — এই হলো ওমর আলীর ‘শ্যামল রঙ রমণী’র সুনাম। রমণীর রূপ দেশের মাটি দিয়েই আঁকা — এপর্যন্ত ওমর আলী প্রথম দু স্তবক ‘রঙ রমণীর’ চিত্রকল্প হাজির করলেন। পরের স্তবকে দেখি — এই রমণী উপহার চায়, ভালোবাসার সন্তান চায়। সেই সন্তানও আসে। একহাতে আঁতুরে শিশু, অন্যহাতে রান্নার উনুন জ্বালানো। সে সংসার পছন্দ করে। ঘরের লোকের মন্দ আশঙ্কায় শঙ্কিত হয়। সুযত্নে গড়া সংসারের আনাচেকানাচে ফোটে সাজানো গোছানো রাশিরাশি সারল্যের ছবি। ওমর আলী সুনাম শুনে ‘শ্যামল রঙ রমণী’র যে চিত্রকল্প হাজির করলেন সেই চিত্রকল্প দেখার চেয়েও বেশি দেখা। বাস্তবের চেয়ে বেশি বাস্তব। গভীর হৃদয় দিয়ে সেটি অনুভব করতে হয়।

 

এটি কৃষ্ণকলির ন্যায় একক কোনো নারীসত্তা নয়। এই রমণী আবহমান গ্রাম বাংলার। এই রমণী সাতষট্টি হাজার গ্রাম বাংলার। এই রমণী গ্রামীণ জীবন ও জনপদের। এই রমণী তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফের। এই রমণী আমাদের দৈনন্দিন যাপিতজীবন ও যৌবনের। এই রমণী শাশ্বত বঙ্গ নারীসত্তার প্রতীক। এই রমণী কেবল রোমান্টিক প্রেমেই ভাসায় না; সংসার গড়ে তোলে। সন্তানও উপহার দেয়। ভালোবাসার সন্তান। এই রমণী সুখেদুখে, ব্যথাবেদনায়, বিপদেআপদে আগলে রাখে ভালোবাসার পুরুষকে। কর্মঠ পুরুষ সেই রমণী, সেই সংসারের চতুষ্পার্শে হাজির থাকে। একটু নিবিড়ভাবে দেখলে দেখব, রোমান্টিকতার সঙ্গেসঙ্গে এই ‘শ্যামলা রঙ রমণী’র প্রতি রয়েছে কবির সুগভীর শ্রদ্ধাবোধ। এই শ্রদ্ধা নারীর প্রতি, নারীজাতির প্রতি, মানুষের প্রতি, মানবতার প্রতি। বলতেই হয়, অসাধারণ। ভেবে দেখলে কবিতাটি রবীন্দ্রনাথের ‘কৃষ্ণকলি’ কবিতার চেয়েও আরো ব্যাপক, আরো সুবৃহত্তর বঙ্গজীবন ও জনপদজুড়ে ব্যাপকভাবে বিদ্যমান।

 

ওমর আলীর কবিতার জমিনজুড়ে হাঁটতে থাকলে দেখব, অন্তিমতক তিনি প্রেমের কবিতাতেই সক্রিয় ছিলেন। প্রত্যন্ত অঞ্চলের যাপিত জীবন, যৌবন-যৌনতা, নারী-নিসর্গ — এগুলোই তার কবিতাভুবনে বারবার ফিরে এসেছে। নানাভাবে, নানা উপায়ে ও অনুপ্রাসে। প্রেমের সাথে এসেছে গ্রাম, গ্রামীণ জীবন ও জনপদ। জনপদের সাহিত্য-সংস্কৃতি। প্রকৃতি-পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা। নিসর্গের সাথে এসেছে উদ্ভিদ ও বনজ বনভূমি। লোক ও লোকালয়, লোকায়ত জীবন ও লোকসংস্কৃতি। প্রথম পর্বে কর্পোরেট শহর ঢাকায় থাকলেও মধ্যজীবনে ফিরতে হয় গ্রামে। আমৃত্যু গ্রামীণ পরিবেশেই কেটে যায় প্রায় পুরোটা জীবন। তাই ওমর আলীর কাব্যসত্তার ঐ গ্রামীণ জীবন ও জনপদের প্রভাবই প্রবলভাবে হাজির থাকে। সেই সঙ্গে থাকে শাশ্বত মানবচিন্তা। নিঃসঙ্গতা, নির্লিপ্ততা, পরপারের ভাবনা; প্রভূর পায়ে সমপর্ণের সুতীব্র আকাক্সক্ষা — ‘একটি নিঃশ্বাস থেকে মনে হয় আরেক নিঃশ্বাসে / আমিও যেতেছি কমে; যে রকম ধীরে ধীরে গলে / মোমের প্রদীপ জ্বলে আগুনের উত্তাপে, বাতাসে / তাহলে, কি হবে, যদি আমারো সময় শেষ হয় / কী হবে, হে প্রভু, পাবো সে মুহূর্তে তোমার আশ্রয়?’ — এই আকুলতা কম কথা নয়। তবু ওমর আলী প্রেমের কবি।

 

তিনি এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি কবিতাগ্রন্থের কবি। তার পরিচয় ওভাবেই। পাঠকÑঅপাঠক সবাই তাকে ওভাবেই ভাবতেই পছন্দ করে। তবে ওমর আলীর বেশিরভাগ কবিতাই তারল্যেসারল্যে লিখিত। সম্ভবত শিল্পমানের দিকে খুব একটা নজর ছিল না তার। প্রকাশ ও পরিমাণের দিকে ঝোঁকটা ছিল বেশি। ব্যক্তিঅভিজ্ঞতায় দেখেছি, ওমর আলীর কবিতাপাঠে মনোযোগ ধরে রাখা বেশ কঠিন। শিল্পমান নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপনেরও যথেষ্ঠ সুযোগ থেকে যায়।

 

মূলত সাতচল্লিশউত্তর একটি ইতিহাস পরিক্রমার ভেতর দিয়ে ওমর আলীর হেঁটে যাওয়া। ঢাকাকেন্দ্রিক সাহিত্য সমাজের সঙ্গে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন তিনি। সমসাময়িক সবার সঙ্গে সহঅবস্থান করেও তিনি ছিলেন সবার থেকে আলাদা। অনেকটা জীবনানন্দ দাশের ন্যায় ‘সকল লোকের মাঝে বসে / আমার নিজের মুদ্রাদোষে / আমি একা হতেছি আলাদা’ — প্রকৃতির। কি স্বদেশি কি বিদেশি, কারো দ্বারা প্রভাবিত হননি তিনি; প্রভাবিত করেনি অপর কাউকে। প্রভাবিত হননি কোন নব্য কাব্যআন্দোলন দ্বারা। নিজের মতো করে নিজেকে উপস্থাপন করতে চেষ্টা করতেন। যেভাবে কবিতার ভাববস্তু এসেছে, যেভাবে দেখেছেন এই জীবন ও জনপদকে, ঠিক সেভাবেই উপস্থাপন করতে চেষ্টা করেছেন। কোন বিশেষ তত্ত্বকথা অথবা চিন্তাদর্শন তার কবিমনে ক্রিয়া করেনি। কবিতায় তত্ত্বকথা থাকতেই হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। কি স্বদেশি কি বিদেশি, যে কোনো চিন্তাদর্শন ছাড়াই তার কবিতার রস আস্বাদন করা যায়। তিনি সহজ জীবনে বিশ্বাসী ছিলেন। সহজভাবেই কবিতায় মেলে ধরেছেন নিজেকে। সেই মেলে ধরাতে তার বাকপ্রতিম সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু আন্তরিকতার অভাব ছিল না। মূলত কবিতা লেখার মতো একটি কবিমন নিয়েই জন্মেছিলেন ওমর আলী। দুচোখে যা দেখেছেন, যেমন দেখেছেন সেভাবেই কবিতায় ধারন করতে চেয়েছেন। লেখাটি শেষ করতে চাই মাহফুজামঙ্গলের কবি, কবি মজিদ মাহমুদের এই উক্তি দিয়ে, ‘সামাজিক ইতিহাসের প্রয়োজনে আজ আমরা যেভাবে মুকুন্দরাম চক্রবর্তীকে জানতে চাই, সাম্প্রতিক দ্রুত পরিবর্তমান গ্রামজীবন ও একদিনের বাংলাদেশকে জানার জন্য হয়তো ওমর আলীই সবচেয়ে বড় উৎস হয়ে উঠবেন।’

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here