বাংলাদেশে সংখ্যালঘুর কথাসাহিত্য ।। কিস্তি : ১১

 গীতা দাস একজন সাহিত্যিক, কলামিস্ট এবং মানবাধিকার কর্মী। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত পত্রপত্রিকায় তার কলাম, প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও ছোটগল্প নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে। সহজিয়ার জন্য ধারাবাহিকভাবে লিখবেন বাংলাদেশের সংখ্যালঘুর কথাসাহিত্য প্রসঙ্গে। আজ প্রকাশিত হলো কিস্তি ১১

ম্রো নৃগোষ্ঠীর কথাসাহিত্য : ইয়াংঙান ম্রোর একক প্রচেষ্টা

পার্বত্য চট্টগ্রামের ম্রো নৃগোষ্ঠীর ১৯৮৬ সালে মেনলে ম্রো প্রবর্তিত নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে। তবে নিজস্ব ভাষা ও বর্ণমালায় রচিত কোনো কথাসাহিত্য সৃষ্টির উদাহরণ পাওয়া যায়নি। কতিপয় ম্রো সাহিত্যিক মাতৃভাষা ও বর্ণমালায় এবং দ্বিতীয় ভাষা ও বর্ণমালায় কিছু কবিতা, রূপকথা, প্রবন্ধ ও নিবন্ধ লিখেছেন। ব্যতিক্রম শুধু ইয়াংঙান ম্রো। তাঁর রচিত উপন্যাস জুম পাহাড়ের মানুষ  ২০২০ সালে আগামী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে।

 

জুম পাহাড়ের মানুষ  উপন্যাসটিতে ইয়াংঙান ম্রো গভীর জঙ্গলে বসবাসরত ম্রো নৃগোষ্ঠীর যাপিত জীবনের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য, জুম চাষকে ঘিরে তাদের দিনাতিপাত, লোকজ্ঞানের ব্যবহার, কুসংস্কার, দৈনন্দিন জীবনে পৌরাণিক কাহিনির প্রভাব, সামাজিক বন্ধন, প্রকৃতির কাছে অসহায়ত্ব এবং অস্বাভাবিক মৃত্যুর বহর গভীর মমতায় চিত্রায়িত করার প্রচেষ্টা নিয়েছেন। এখানে মাংসা নামক একজনের চরিত্র একাধিক ঘটনায় আসলেও মূল ঘটনা আবর্তিত হয়েছে একটি অরণ্যচারী লোকালয়ের ম্রো জনগোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে। একটি বা কয়েকটি পরিবারের যাপিত জীবন নয়; একটি লোকালয়ের ম্রো নৃগোষ্ঠীর প্রাত্যহিক জীবন সংগ্রাম চিত্রায়িত হয়েছে। মাংসাকে সুমপুংইয়ের শূকর শিকারের ঘটনার খবর দিয়ে উপন্যাস শুরু। এমনি বিভিন্ন খণ্ড খণ্ড ঘটনার মাধ্যমে ম্রোদের জন্ম, জীবিকার সংগ্রাম, প্রেম, বিয়ে, অসুস্থতা, যুথবদ্ধ লোকজ আচার, লোকজীবনে অশুভ শক্তির প্রভাবের উপর বিশ্বাস, সংস্কার ও কুসংস্কার উপন্যাসে বিধৃত হয়েছে। উপন্যাসটি শেষ হয় মাংসার পরিবার নিয়ে আনন্দচিত্তে জুমের দিকে যাত্রার মধ্য দিয়ে।

 

ইয়াংঙান ম্রো এমন এক জীবন ও জগতের চিত্র এঁকেছেন যেখানে বনের মধ্যে “মাঝপথে হঠাৎ জুতার ছাপ দেখে কোনো হিংস্র জানোয়ারের পায়ের ছাপ মনে করে ভয়ে বাড়িতে” চলে যেতে হয়। (ম্রো, ২০২০, ৩৭) তিনি বইটির পাতায় পাতায় গভীর মমতা ও বেদনাবোধ নিয়ে ম্রো নৃগোষ্ঠীর সমাজ জীবনের চালচিত্র প্রকাশে সচেষ্ট ছিলেন। নিবিড় বনের এক লোকালয়ের অসহায়ত্ব ছড়িয়ে আছে সারি সারি অস্বাভাবিক অপমৃত্যুর ঘটনার বর্ণনার মধ্যে। মৃত্যুর কারণ – কলেরা, সাপে কামড়, কুকুরের কামড়, বাঁশের ফাঁদে আটকে, শিকারে গিয়ে, পানিতে ডুবে, পানির তুমুল স্রোতে ভেসে গিয়ে, পর্বত থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা, কাশতে কাশতে মরা, অজানা অন্যান্য রোগে ভুগে মারা যাওয়া ইত্যাদি। কুসংস্কারে ভরপুর সমাজ ব্যবস্থায় “প্রথম সন্তান জন্মের সময় চন্দ্রগ্রহণ হয়েছিল।… আর দ্বিতীয় সন্তান জন্মের সময় অমাবস্যা ছিল। তাই সে রাক্ষস হয়ে জন্মেছিল বলে তাকে মেরে ফেলা হয়।” (ম্রো, ২০২০, ১৭) “তবে অনাবৃষ্টি হলে জীবন্ত কাঁকড়া নিয়ে রোদে বেঁধে রাখা হয়। তাদের বিশ্বাস, কাঁকড়া জলজ প্রাণী, তাই তাকে রোদের মধ্যে বেঁধে রাখলে পানির জন্য ছটফট করতে থাকে। তখন সে উপায় না দেখে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করবে। কাঁকড়া যেহেতু জলজ প্রাণী সেহেতু ভগবান কাঁকড়া প্রার্থনা অবশ্যি শুনবে।” (ম্রো, ২০২০, ৫৪)

 

সূর্যগ্রহণ নিয়ে ম্রো লোকালয়ে এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এবং এ নিয়ে লোকবিশ্বাস এবং  লোককাহিনিও উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে। “আজকের দিনে সূর্য নাকি এককালে মহিলা ছিল। আর আমাদের চাঁদ নাকি এককালে পুরুষ ছিল। আজকের দিনে চাঁদ সূর্যে থাকাকালে নাকি সে খুবই হিংস্র হতো।” (ম্রো, ২০২০, ৫৩) এটি না হলেও এমন ধরনের লোকবিশ্বাস ও লোককাহিনি বাঙালি সমাজেও প্রচলিত আছে এবং এখনো সূর্য গ্রহণের সময় বিভিন্ন আচার পালন করা হয়। এদিক থেকে এ ধরনের টোটেমিজম তত্ত্বের প্রভাব কম-বেশি আধুনিক বলে দাবি করা তথাকথিত বিজ্ঞানমনস্ক বিভিন্ন জাতির সংস্কৃতিতেও ছড়িয়ে আছে। তবে পার্থক্য হলো আলোচ্য উপন্যাসে বর্ণিত বনবাসী নৃগোষ্ঠীর মধ্যে এ বিশ্বাসবাদীর শতকরা হার প্রায় শতভাগ।

 

এই উপন্যাসের এরকম ধারণা প্রচলিত আছে যে, যে গ্রামে বনের কোনো পশু যে কারণেই ঢুকে পড়ুক না কেন তা অশুভ লক্ষণ। এ বিশ্বাস বৈদ্যরাও লালন করেন। “অথচ হরিণ শাবকটি শিলার আঘাতে আহত হয়ে গ্রামে ঢুকেছিল। কারণ তাঁর মাথায় শিলার আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।… সেই কথা বলেও কোনোমানুষই তাঁর কথা বিশ্বাস করবে না। কেননা গ্রামের মানুষ ভূত-প্রেত ছাড়া আর কোনো কিছু বুঝতে চাইবে না, শুনতেও চাইবে। সুমপুং অনিচ্ছা সত্ত্বেও অসহায় হরিণ শাবকটিকে মেরে ফেলতে বাধ্য হল।” (ম্রো, ২০২০, ৬৪)

ইয়াঙুন ম্রোর এটি প্রথম উপন্যাস এবং প্রত্যাশা করা যায় উনার কলমে অদূর ভবিষ্যতে অরণ্যচারী নৃগোষ্ঠীর জীবনাচারের সাথে রাষ্ট্রযন্ত্রের সম্পর্ক, রাষ্ট্রীয় আইন ও নীতির সাথে তাদের জীবনযাপনের সাংঘর্ষিক ক্ষেত্রসমূহ, পুঁজিপতিদের আগ্রাসনে তাদের জীবিকার বিপন্নতা ইত্যাদি বিষয়ে কথাসাহিত্য সৃষ্ট হবে।

বনে হারিয়ে ফিরে আসা বা অসুস্থ অবস্থায় অজ্ঞান হয়ে আবার জ্ঞান ফিরে আসা মানে রাক্ষস হয়ে বা কোনো অপশক্তিরূপে ফিরে আসা। হারিয়ে যাওয়া বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ব্যক্তিটি নিজে জানে যে সে স্বাভাবিক আছে। যেমন :

  • “থমলেং মৃদু কন্ঠে বলল, ‘না, আমাকে রাক্ষস নিয়ে যায়নি। আলুর গর্ত খুঁড়তে গিয়ে আমি গর্তের ভেতরে পড়ে আটকে পড়ি।’’(ম্রো, ২০২০, ১৩)
  • “সেকতা বলল, আমাকে কোন কিছু নিয়ে যায়নি। আমি গাছের নিচে ঘুমাতে গিয়ে রাত হয়ে যায়…পরে যখন ঘুম ভেঙে যায় তখন দেখি রাত হওয়ায় অন্ধকার হয়েছে। তখন আমি অন্ধকারে পথ দেখতে পেলাম না। তবে বিশ্বাস করো মানুষরূপী কোনো মানুষ বা মাত আমাকে নিয়ে যাইনি।’’ (ম্রো, ২০২০, ২২) ম্রো ভাষায় মাত মানে বাংলায় ভূত।
  • “মাংসা বলল, ‘আমি রাক্ষস নই। আমি তোমাদের বাবা। আমি মরে যাইনি।’’(ম্রো, ২০২০, ৯৯)

এ উপন্যাসের ম্রোদের মধ্যে সামাজিক বন্ধন খুব দৃঢ়, তবে নারী পুরুষের মধ্যে বৈষম্য রয়েছে। যেমন, তারা কোনো পশু শিকার করলে সবাই মিলে ভোজের আয়োজন করে, কিন্তু সামাজিক ভোজে সবার শেষের সারি নারী ও যুবতীদের জন্য বরাদ্দ। সারি বলতে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়— এভাবে শেষের সারি, নাকি সবার শেষে খেতে হয় তা বাক্যটিতে স্পষ্ট নয়। নিজেদের গ্রামকে অশুভ শক্তির হাত থেকে রক্ষা করতে সম্মিলিতভাবে গ্রাম বন্ধ (খাং) করার ব্যবস্থা করে। লেখক ম্রো সমাজ ও পরিবারে নারী পুরুষের পৃথক ভূমিকার কথাও চিত্রিত করেছেন। যেমন :

  • “তুমুলে নারী জাতি। সে জানে তাঁর ঘরে চাল রাখার ঝুড়িতে (মিকং) একটি দানাও চাল নেই। কিন্তু পুরুষ বলে মাংসা তাঁর নিজ ঘর সম্পর্কে খুবই কম খোঁজখবর রাখে।’’ (ম্রো, ২০২০, ১২)
  • “পুরুষ লোক মারা গেলে তার মাথা পশ্চিম দিকে রাখা হয় আর পা পূর্ব দিকে রাখা হয়। পুরুষরা জীবিত অবস্থায় জুমে যাওয়ার জন্য সর্বদায় ভোর সকাল দেখে বলে এমনটি করে থাকে। আর মেয়েদের বেলায় তার উলটো অর্থাৎ মৃত মহিলার মাথা পশ্চিমে রাখা হয়। কারণ মহিলা বিকালে ভাত রান্না সময় পশ্চিমের সূর্য দেখতে হয়।’’ (ম্রো, ২০২০, ৩৪-৩৫)

উপন্যাসটির প্রথম বাক্যটি “বর্ষাকালের বিদায় আর শীতের শুরু” (ম্রো, ২০২০, ৯) পড়েই মনে সংশয় জাগে, যে লোকালয়ের কাহিনি রচিত হতে যাচ্ছে ঐখানে কি দুটি ঋতুই? এর উত্তর পরবর্তী ঘটনায় প্রাসঙ্গিকভাবেই আর আসেনি।

 

ম্রো সমাজের অন্তর্নিহিত সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে ইয়াঙুন ম্রো জন্মগ্রহণ করেছে্ন ও বেড়ে উঠেছেন। তাই ঐ লোকায়ত জীবনের পুঙ্খানুপুঙ্খ লোকজ্ঞানের ভাণ্ডার তাঁর নখদর্পণে। “অনেক বড় শূকর। ছয় সুপ বড় হবে।” পার্বত্য চট্টগ্রামের নৃগোষ্ঠীর শূকর ওজনের লোকজ পরিমাপ।

 

উপন্যাসটিতে বিভিন্ন ঘটনা ও কাহিনি বর্ণনায় লেখকের সাহিত্য রস, ম্রো জনগোষ্ঠীর সৌন্দর্য উপভোগ এবং লোক সাহিত্য চর্চার উল্লেখ পাওয়া যায়।

  • সুখ খবর একটি চমৎকার নতুন শব্দের প্রয়োগ। “ঐ কারবারি মাংসা, এই সাতসকালে এত ঘুম! তাড়াতাড়ি উঠ, সুখ খবর আছে।’’ (ম্রো, ২০২০, ৯)
  • “ফেরার সময় যুবক-যুবতিরা জুম থেকে নানা ফুল তুলে কানে দিয়ে যেত। তবে অনেকে ফুল নিয়ে যেত ঘরে ঘুমানোর স্থানে রেখে শোভাবর্ধন ও সুগন্ধের জন্য।’’ (ম্রো, ২০২০, ২১)
  • ঘুম পাড়ানিয়া গান গেয়ে শিশুকে ঘুম পাড়ানো চর্চা ছিল। যেমন: “তাকে ঘুমপাড়ানির গান শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেবে। রাক্ষস-রাক্ষসীর গল্প বলে বলে স্নেহের বুকে রেখে তাকে অনেক আদর করবে।’’ (ম্রো, ২০২০, ২৭)। “ রাতে রেংথন না ঘুমানো পর্যন্ত ঘুমপাড়ানির গান শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতে হতো।’’ (ম্রো, ২০২০, ৩০)। “রুইচুমের জন্য গভীর রাত পর্যন্ত গল্প বলতে হতো।” ( ম্রো, ২০২০, ৩৫)

বইটিতে ঘটনার অসামঞ্জস্যতা ও কিছু পুনারাবৃত্তি রয়েছে। বাংলা ও ম্রো—এ দুই ভাষার শব্দ ব্যবহারে কোনো একটি নিয়ম অনুসরণ করেননি। বন্ধনীতে কখনো বাংলা, কখনো ম্রো শব্দ লিখেছেন। অনেক ভুল বানান রয়েছে। বাক্য গঠনে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে বাংলা লেখকের দ্বিতীয় ভাষা।

 

উপন্যাসটিতে কাহিনির ধারাবাহিক কোন পরম্পরা নেই। ইয়াঙান ম্রো বিভিন্ন খণ্ড খণ্ড অশুভ শক্তির ভয়মিশ্রিত ঘটনা, লোকসালিশ ব্যবস্থা, লোকগাথা, লোকবিশ্বাস, লোকধর্ম সংযোজন, লোকপ্রবাদ, লোকসংস্কৃতির চিত্র নিয়ে কাহিনির বিন্যাস করেছেন। বইটিতে কোন নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকার পরিচয় নেই। ম্রো সমাজের জীবন যাপনের জন্য বিভিন্ন ব্যবহার্য বস্তুর কথা বলা হলেও তা খুব স্পষ্ট করে নয়। কাজেই উপন্যাসে বর্ণিত সংখ্যালঘু ম্রো সমাজের কাল ও স্থান অনুমান সহজসাধ্য বিষয় নয়। অর্থাৎ উপন্যাসটিতে ঘটনাপ্রবাহে ভৌগোলিক অবস্থান ও জাতিগত পরিচয় মুখ্য নয়; হতে পারে তা বাংলাদেশের ম্রো নৃগোষ্ঠী, অথবা ভারতের অন্য কোনো নৃগোষ্ঠী, কিংবা আফ্রিকার কোন অরণ্যের অন্য কোনো নৃগোষ্ঠীর কাহিনি। তবে ব্যবহার্য উপকরণ বিশ্লেষণ করলে সময়টা নির্ণয়ও করা যেতে পারে।

 

সাধারণভাবে আদিবাসীদের কিছু কিছু সামাজিক রীতিনীতি ও পৌরাণিক বিশ্বাসের চর্চাসমূহ আধুনিক দৃষ্টিতে অন্যায় ও অপরাধ বলে পরিগণিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে আধুনিক মানববাধিকারও লংঘিত হয়। যেমন, উপরে উল্লিখিত চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণের সময় জন্মগ্রহণ করা শিশুকে মেরে ফেলা সম্পর্কিত ঘটনা (ম্রো, ২০২০, ১৭)। অথচ আদিবাসীদের চর্চিত এই বিশ্বাস প্রকৃত অর্থে আদিকাল থেকে বহমান লোকবিচার ব্যবস্থা ও অলৌকিক শক্তির অলিখিত নির্দেশ বলেই বিবেচিত হয়ে আসছে। আলোচ্য বইটি পড়ে আদিবাসী সমাজের সাথে তথাকথিত সভ্যতার সাংঘর্ষিক বিষয়টি অনুধাবন করা যায়। প্রত্যেক নৃগোষ্ঠীর মধ্যে (বাঙালিসহ) কোনো না কোনো আদিম অভ্যাসের চর্চা রয়েছে। আধুনিকতার নামে তথাকথিত সভ্য আচরণ দিয়ে তা আড়ালের চেষ্টা করা হয়। অনেক সময় ধর্মের লেবাসে এসব আদিম অভ্যাসের চর্চাকে তথাকথিত সভ্য সমাজে অব্যাহতও রাখা হয়। কাজেই বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর রচিত সৃষ্টিকে পর্যালোচনা করতে গেলে এ ক্ষেত্রটি বিবেচনা করা আবশ্যক।

 

উপন্যাসটিতে বনচারী এক লোকালয়ের মানুষ রাজার অনুচরদের খাজনা আদায়ের চাপে অতিষ্ঠ হয়ে ভগবানের শরনাপণ্ণ হয় এবং বর পায় রাজার লোকেরা তাদের গ্রামে আসলেও তাদের দেখতে পাবে না। ভগবানের বরে নিজেদের অদৃশ্য করে রাখার এমন একটি লোকগল্প সংযোজন করা হয়েছে এ বইটিতে।

“তিনি তখন তাদের আশীর্বাদ দিলেন, আজ থেকে যেন গ্রামবাসীকে আর কোনো লোক দেখতে না পায়। ভগবানের আশীর্বাদ বাস্তবে পরিণত হলো। পরের বছর রাজার অনুচররা খাজনা আদায়ের জন্য ম্রোরংদের গ্রামে গেলে আর আর কাউকে দেখতে পেল না।’’ (ম্রো, ২০২০, ১০) এ লোকগল্পটির মাধ্যমে রাজা তথা ক্ষমতাবানদের হাত থেকে সংখ্যালঘু হিসেবে রক্ষা পাওয়ার জন্য ম্রো সম্প্রদায়ের নিবিড় বনে আশ্রয় নিয়ে অদৃশ্য হওয়ার বিকল্প ব্যবস্থার ইঙ্গিত বহন করে।

 

ইয়াঙুন ম্রোর এটি প্রথম উপন্যাস এবং প্রত্যাশা করা যায় উনার কলমে অদূর ভবিষ্যতে অরণ্যচারী নৃগোষ্ঠীর জীবনাচারের সাথে রাষ্ট্রযন্ত্রের সম্পর্ক, রাষ্ট্রীয় আইন ও নীতির সাথে তাদের জীবনযাপনের সাংঘর্ষিক ক্ষেত্রসমূহ, পুঁজিপতিদের আগ্রাসনে তাদের জীবিকার বিপন্নতা ইত্যাদি বিষয়ে কথাসাহিত্য সৃষ্ট হবে। এও আশা করা যায় যে, তিনি এমন কোনো সুদৃঢ় চরিত্র সৃষ্টি করবেন যে নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে অনগ্রসরতা দূরীকরণের জন্য পথ দেখাবে। তাছাড়া উপন্যাসের প্রধান যে বৈশিষ্ট্য — বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে একটা কাহিনির গাঁথুনি তা এ বইটিতে অনুপস্থিত।

 

ম্রো নৃগোষ্ঠীর বাংলা ভাষায় কথাসাহিত্য ও ইয়াংঙান ম্রো নিয়ে অনুসন্ধান এখানেই সমাপ্ত করে দিলে তাঁর অপচেষ্টা-সংক্রান্ত কিছু অজানা বিষয় অনুদঘাটিত রয়ে যেত।

(চলবে। পরবর্তী পর্ব ম্রো নৃগোষ্ঠীর কথাসাহিত্য : ইয়াংঙান ম্রোর প্রচেষ্টা-সংক্রান্ত অনুদঘাটিত বিষয়)

 

পড়ুন ।। কিস্তি ১০

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুর কথাসাহিত্য ।। কিস্তি : ১০

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here