ঘরে মা-বোন থাকাই কি সব সমস্যার সমাধান?

বাংলা সিনেমায় একটা দৃশ্য এখনো অহরহ দেখতে পাওয়া যায়; তা হলো, নায়িকাকে ভিলেন বিরক্ত করছে আর তার জবাব হিসেবে নায়িকা বলছে, “তোর ঘরে কী মা-বোন নেই?” যুগ যুগ ধরে এই শক্তিশালী বাক্যের এত বেশি প্রয়োগ ঘটেছে যে, মানুষের মনে এক ধরনের বদ্ধমূল ধারণাই জন্মে গেছে যেন ঘরে মা-বোন থাকাই ঘরেবাইরে নারী হয়রানির এক এবং একমাত্র প্রতিকার।

 

এই বিষয়ে বলতে গেলে আমাদের বাহির থেকে ঘরের ভেতর আসতে হয়, দেখতে হয় মা-বোন থাকার প্রকৃত কার্যকারিতা। বর্তমান সময়ে নারীর সামাজিক অবস্থার অনেক পরিবর্তন এসেছে এবং তা বোঝার জন্য এখন আর টেলিভিশন কিংবা খবরের কাগজ পড়ার দরকার হয় না। বাইরে বেরোলেই আমরা দেখতে পাই, সকল সেক্টরে নারীর সরব উপস্থিতি। নারীর উপস্থিতির সাথে সাথে পাল্লা দিয়েই বাড়ছে যেন নারী হয়রানির হার।

 

‘নারী হয়রানি’ শব্দটি শুনলেই প্রথমেই আমরা ভাবি যৌন নিপীড়নের কথা। অথচ নারী হয়রানি বলতে যৌন নিপীড়নও হতে পারে, শারীরিক অথবা মানসিক নির্যাতনও হতে পারে। যৌন নিপীড়ন আর শারীরিক নির্যাতনের মধ্যে সূক্ষ্ম সীমারেখা টেনেছিলেন পশ্চিম বাংলার প্রয়াত পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ তার ‘দহন’ সিনেমাটির মাধ্যমে। যা ছিল লেখিকা সুচিত্রা ভট্টাচার্যের উপন্যাস, তাও আবার কলকাতার রাস্তায় ঘটে যাওয়া একটি বাস্তবকাহিনির ছায়া অবলম্বনে। তিনি দেখিয়েছেন, একটি হয়রানি নারীর সামাজিক জীবন তো বটেই, পারিবারিক জীবনেও কত বিরূপ প্রভাব ফেলে যায়। তাই ঘরে মা-বোন থাকার মত অব্যর্থ মহৌষধ সমাজ থেকে নারীর প্রতি সহিংস, নিপীড়নমূলক আচরণ প্রদর্শনে কতটা ফলপ্রসূ তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়।

 

দেশের বুক ফালাফালা করে গজিয়ে ওঠা স্থাপনাগুলো যেমন লোকের দারিদ্র্য কমাতে পারছে না, তেমনি সমাজে নারীরা যতই আর্থিক সাবলম্বিতার দিকে এগিয়ে যাক না কেন, পারিবারিক জীবনে এখনো মান্ধাতার আমলেই পড়ে আছে তারা। একজন নারীর সামাজিক অবস্থান যাই হোক না কেন, পরিবারে তিনি কারো মা, কারো বোন, কারো স্ত্রী। কর্মক্ষেত্রে তার যেমন নিজের দায়িত্ব পালন করতে হয় তেমনি ঘরের ভেতর তিনি কোনো-না-কোনো ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। আমরা যখন কোনো পুরুষকে তার মা-বোন থাকার কথা বলি, এর অর্থ দাঁড়ায় তুমি কী পারতে তোমার আপনজনের সাথে এমন অন্যায় হতে দেখলে চুপ থাকতে? অথবা আমাকে কেন মায়ের চোখে, বোনের চোখে দেখছো না?

ঘরের পুত্রসন্তানটি দেখে মা সারাজীবন কাটিয়ে দিয়েছে তাদের মা হয়ে, বাবার স্ত্রী হয়ে। কখনো তারা ভাবতেই শেখে না — মায়ের একঘেয়ে ম্যাড়ম্যাড়ে রঙ ছাড়াও প্রিয় রঙ আছে, প্রতিদিন আমাদের পছন্দের খাবার রাঁধলেও কিছু খাবার আছে যা মাও খেতে ভালবাসে, রাতের আঁধারে মাও দুঃখ পেয়ে কাঁদতে পারে।

আমাকে নারী ভাবলে বুঝি সব সর্বনাশ আমার মাথা পেতে নিতেই হবে…

 

যেসব পুরুষ রাস্তায়, কর্মস্থলে, সোশাল মিডিয়ায় নারীদের হয়রানি করে থাকে দেখবেন অধিকাংশের ঘরেই জননী, ভগ্নি, জায়া, প্রিয়া সবই আছে। তবুও তারা নারীকে যথার্থ সম্মান করতে পারে না, করতে জানে না এবং অনেক সময় এমনও হয়, করতে শেখে না। এর পেছনে দায়ী থাকে ঘরের অবলা মা, ভগ্নিটিই। ছোটবেলা থেকে ঘরের নারী সদস্যরা এমনভাবেই প্রতিপালিত হয় যেন তারা দুর্বল শারীরিকভাবে তো বটেই, মানসিকভাবেও। জলে কুমির, ডাঙায় বাঘের ভয় দেখিয়ে তাদের ঘরের বাইরে বের হতে দেয় ঠিকই, কিন্তু এই বিপদ মোকাবিলা করার উপায় কী সে সম্বন্ধে কেউ কিছু বলে দেয় না। ভীতসন্ত্রস্ত রাজকুমারীর সারাজীবন যায় অজানা জুজুর ভয়ে দরজা জানালা বন্ধ রেখে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকতে থাকতে আর কবে ঘোড়া চেপে স্বপ্নের রাজপুত্র আসবে তারই আগমন পথের দিকে চেয়ে। যেন সব মুক্তির ঠিকানা ঐ রাজপুত্রের মাঝে লুকোনো।

 

অথচ এই অলীক অবাস্তব কল্পনা একজন নারীর জীবনকে কতটা দুর্বল, পরনির্ভরশীল বানিয়ে দেয় সেই ভাবনা কখনো কেউ করে না। ঘরের পুত্রসন্তানটি দেখে মা সারাজীবন কাটিয়ে দিয়েছে তাদের মা হয়ে, বাবার স্ত্রী হয়ে। কখনো তারা ভাবতেই শেখে না — মায়ের একঘেয়ে ম্যাড়ম্যাড়ে রঙ ছাড়াও প্রিয় রঙ আছে, প্রতিদিন আমাদের পছন্দের খাবার রাঁধলেও কিছু খাবার আছে যা মাও খেতে ভালবাসে, রাতের আঁধারে মাও দুঃখ পেয়ে কাঁদতে পারে। সেই মা-ই তার মেয়েকে একটু বড় হতেই শিখিয়ে পড়িয়ে দেয়, ‘রাস্তায় কেউ কিছু বললে মাথা নিচু করে চলে আসবে। প্রতি উত্তর করবে না।’

 

বেগম রোকেয়া যথার্থই বলেছেন,”শিশুকে মাতা বলপুর্বক ঘুম পাড়াইতে বসিলে ঘুম না পাওয়ায় শিশু যখন মাথা তুলিয়া ইতস্ততঃ দেখে তখনই মাতা বলেন, ঘুমা শিগগির ঘুমা! ঐ দেখ জুজু! ঘুম না পাইলেও শিশু অন্তত চোখ বুজিয়া পড়িয়া থাকে। সেই রূপ আমরা যখন উন্নত মস্তকে অতীত ও বর্তমানের প্রতি দৃষ্টিপাত করি, অমনই সমাজ বলে, ঘুমাও ঘুমাও! ওই দেখ নরক! মনে বিশ্বাস না হইলেও অন্তত আমরা মুখে কিছু না বলিয়া নীরব থাকি।”

 

যেখানে ভাইটি দেখেছে, একজন মেয়েকে সমাজের তাবৎ অন্যায়ের প্রতি কতটা আপস করে চলতে হয় এবং সেই অন্যায় আদৌ অন্যায়ই নয় উলটো ‘বয়সের দোষ’। এমতাবস্থায় আমরা কীভাবে ভাবতে পারি, ছেলের ঘরে মা-বোন থাকলে আর কোনো চিন্তা নেই? ছেলেমেয়েদের দিনের পর দিন সবচেয়ে শর্টকাট, প্রচলিত অথচ ভুল শিক্ষা দিয়ে বড় করার কারণে মেয়েদের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি কিছুমাত্র কমছে না বরং বাড়ছে। ফলস্বরূপ এইসব উঠতি বয়সের ছেলেরা ‘বয়সের দোষের’ বাতাসে ভেসে ভেসে বড় হয়, কর্মস্থল হোক বা সোশাল মিডিয়া সবখানেই নারীকে অসহায়, বিপন্ন ভেবে যেকোনো জায়গায় যেকোনো উপায়ে তাকে বিপদে ফেলতে চায় এবং তা তাদের কাছে নারীর প্রতিরক্ষামূলক সতর্কতার কিছু যান্ত্রিক ত্রুটি বৈ আর কিছুই নয়।

 

তাই নারী হয়রানি বন্ধ করতে “ঘরে কী মা-বোন নেই” নামক প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা মূলত চরম হাস্যরসের উদ্রেক করা এবং নারীকে অসহায় প্রতিপন্ন করা ছাড়া আর কোনো কাজে আসতে পারে বা পেরেছে বলে আমি মনে করি না।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here