গত ৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যারের একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু অত্যন্ত উঁচু মানের একটি বক্তব্য শুনেছি। এটি ছিল একটি ভার্চুয়াল সভা। আয়োজন করেছে ATLEB – Association of Teachers of Literatures in English, Bangladesh । এতে অংশগ্রহণ করেছিলেন বাংলাদেশের ইংরেজি সাহিত্যের প্রায় সকল নামজাদা অধ্যাপক। যেমন কয়েকটি নাম বলতে পারি — অধ্যাপক ও কবি কায়সার হক, অধ্যাপক নিয়াজ জামান, অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, অধ্যাপক ফকরুল আলম, অধ্যাপক ফেরদৌস আজিম সহ অনেকেই। ছোট্ট করে কিছু কথা বলেছেন অধ্যাপক কায়সার হক ও অধ্যাপক নিয়াজ জামান। সভার মধ্যমণি ছিলেন আমাদের সবার প্রিয়, গণবুদ্ধিজীবী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইমিরেটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
শ্রোতা হিসেবে ছিলেন কয়েকশো শিক্ষক। অধিকাংশই ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক। আমি নিজেও শুনেছি অনুষ্ঠানটি। এতো ভালো লেগেছে এই প্রতিথযশা অধ্যাপকের কথাগুলি, পরে ধারণকৃত অনুষ্ঠানটি কমপক্ষে আরও সাত বার শুনেছি, প্রতিবারই হৃদয় ছুঁয়েছে তার কথামালা। তিনি কথা বলেছেন ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে, সাহিত্য পাঠের ধারা নিয়ে, সাহিত্যের সাথে মানববিজ্ঞানের সম্পর্ক নিয়ে, বলেছেন শিক্ষকের কাজ নিয়ে, এবং লেখা, গবেষণা ও অনুবাদের গুরুত্ব নিয়ে। মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষার এলাকায় সাহিত্যচর্চার যে বেহাল দশা তার কারণ কী এবং এর জন্য করণীয় কী হতে পারে এই বিষয়কে মাথায় রেখে অতি সরল কথায়, গল্পের মত করে দিকনির্দেশনা দিলেন আমাদের সময়ের শ্রেষ্ঠ একজন অধ্যাপক। বুঝতে বাকি থাকলো না যে, তিনি কেবলই শিক্ষক নন, বরং একাধারে এক সব্যসাচী লেখক, সমাজ বিশ্লেষক, দার্শনিক এবং নিরলস জ্ঞান-সাধক।
যাই হোক, এখন আজকের এই প্রবন্ধে এই অধ্যাপক নিয়ে আর কিছু বলবো না। শুধু তার দেয়া বক্তব্যের কয়েকটি কথা তুলে ধরবো। অতি সংক্ষেপে এই অধ্যাপক যা বলেছেন, সেগুলো আমি তুলে ধরার চেষ্টা করছি আমার নিজের ভাষায় (যদি আমি ঠিক বুঝে থাকি)। সেগুলো হচ্ছে :
এক. ভাষাকে সাহিত্য থেকে কিংবা সাহিত্যকে ভাষা থেকে আলাদা করে বিবেচনা করে পড়াশোনা করা একটি খণ্ডিত পাঠ-পদ্ধতি। এটি ঔপনিবেশিক ধারা এবং অনেক মেকি একটি পদ্ধতি। এতে না থাকে আনন্দ, না থাকে বোধের পূর্ণতা।
দুই. ইংরেজিতে সাহিত্যচর্চা অনেক বড় এক পরিসরের নাম। এটা কেবল ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়ে থাকে না। ইংরেজি ভাষা দুনিয়ার বিভিন্ন এলাকার সাহিত্যকে জুড়ে দিচ্ছে। এতে সাহিত্য নিয়ে আলোচনার পরিসর বেশ বড় হচ্ছে।
তিন. তত্ত্বের মাধ্যমে সাহিত্য পাঠ, সাহিত্যের মানকে ছোট করে না বরং সাহিত্যকে সমাজের, বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে বুঝতে সহায়তা করে। উদাহরণ হিসেবে এই অধ্যাপক স্মরণ করলেন তার শিক্ষক আরনন্ড কেটলের কথা।
সাহিত্য কোন ভাষার? এই প্রশ্ন আমাদের মধ্যে ব্যাপক দূরত্ব তৈরি করছে। স্থানীয় ভাষা, জাতীয় ভাষা এবং বিদেশি ভাষা এগুলোর লড়াই চলে। কেবল ভাষার কারণেই সাহিত্যের/ লেখকের/ শিক্ষকের মান কমে যায় বা বেড়ে যায় বলে ধরে নেয়া হচ্ছে। তাইতো, বাংলা বিভাগ ও ইংরেজি বিভাগের ভেতর থেকে যায় বিশাল এক আদিম খাল, মনে হয় কোন সেতু নাই।
চার. শুধু তত্ত্বের ভেতরে সীমাবদ্ধ থাকবে না সাহিত্যের আলোচনা। ছাড়িয়ে যাবে তত্ত্বের এলাকা, ছড়াবে আনন্দ, তুলে ধরবে বিশুদ্ধ মানুষের চেতনা। তত্ত্ব ও আনন্দ ভাগাভাগি করার কাজটা আবার একে অপরের শত্রু নয়, বরং বন্ধু। তারা বিচ্ছিন্ন নয়, তারা গভীরভাবে সম্পর্কিত। এক্ষেত্রে তিনি বিশেষভাবে মনে করলেন তার তিনজন প্রিয় শিক্ষকের কথা, তারা হলেন উইলসন নাইট, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, মুনীর চৌধুরী যারা সাহিত্য পড়াতেন মনের আনন্দকে ভাগাভাগি করার জন্য, মানুষের আবেগ, কল্পনা কিংবা মানবিক গুণাবলি চর্চার জন্য।
পাঁচ. সাহিত্যকে ইতিহাস, দর্শন কিংবা মানববিদ্যা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা এক ধরণের জ্ঞানতাত্ত্বিক অক্ষমতা, চরম এক বিচ্ছিন্নতার উদাহরণ। কারণ এতে সাহিত্যের প্রাণ হারিয়ে যায়, হারিয়ে যায় তার ভেতরের সংগীত, মর্মবাণী।
ছয়. সাহিত্যের শিক্ষকদের বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে শিক্ষকতা চাকরির নাম নয়, প্রশিক্ষণের নাম নয়, বরং একটি প্রতিজ্ঞার নাম। এই প্রতিজ্ঞা মানবতার প্রতি, জ্ঞানের প্রতি, সমাজের প্রতি। যাতে করে সমাজে বিচ্ছিন্নতা নামক ব্যাধিটা কমে আসে, সমাজে আন্তরিকতা বাড়ে, বোধ তৈরি হয়।
সাত. এক শিক্ষক সক্রিয় পাঠক হতে হবে। পড়তে হবে সবসময় এবং সাথে সাথে লিখতে হবে। লেখার চর্চা করা ছাড়া পাঠ্য বিষয়টি হৃদয়ংগম করা যায় না। বুঝার ফারাক থেকে যায়। তাই বেশি কাজে আসে না।
আট. সাহিত্যের শিক্ষকদের অনুবাদের করতেই হবে এই প্রতিজ্ঞাবোধ থেকে। ইংরেজি থেকে বাংলা, বাংলা থেকে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করাটা এই সময়ে শিক্ষকদের অন্যতম কাজ। এতে জ্ঞানের আদান-প্রদান হবে, হবে সাহিত্যের ভাব বিনিময় যাতে তৈরি হয় বিশ্বসাহিত্যের রুপরেখা।
নয়. সাহিত্যকে সবসময় বাস্তব সমাজের সাথে যোগাযোগ ঘটিয়ে পর্যালোচনা করতে হবে, নতুবা সাহিত্যের আলোচনা বায়বীয় রুপ ধারণ করে। সাহিত্য তা হতে পারে না। সাহিত্যের আলোচনায় দর্শন, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান সহ মানববিজ্ঞানের প্রতিটি শাখাই অত্যন্ত যুক্তিসংগতভাবে প্রাসঙ্গিক।
এখন আমি আমার নিজের দুয়েকটি কথা বলতে চাই বাংলাদেশে সাহিত্যচর্চা নিয়ে। কথাগুলি খুব অগভীর এবং অগুরুত্বপূর্ণ মনে হতে পারে তবুও আমি বলতে চাই। যদি ‘সাহিত্যচর্চা’ বলতে যে এলাকা আমাদের আছে সেখানে বিস্তর বিভেদ ও হরেক ধরনের ঘরানা দেখা যায় যারা আবার একজন আরেকজন থেকে অনেক দূরে অবস্থান করেন, অনেকক্ষেত্রে সৌজন্যবোধের সম্পর্ক ও থাকে না তাদের মাঝে। এই ব্যবধান অনেক ভাবেই দেখা যেতে পারে।
প্রথমত : লেখক ও শিক্ষকের ভেতরে আমাদের তেমন কোন প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগ নেই। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য বিভাগের সভা/সেমিনারে কবি, লেখক, অনুবাদককে এনে তাদের সাথে সাহিত্যের আলাপ-আলোচনা হচ্ছে এটা তেমন দেখা যায় না। কেন জানি মনে হয়, লেখক সবসময়ই মৃত। কালো কালিতে হামলা করতে যেন সবাই মজা পায়। আবার, শিক্ষক লেখক এবং অ-শিক্ষক লেখকের মাঝে আছে ব্যাপক ফারাক।
দ্বিতীয়ত : সাহিত্য কোন ভাষার? এই প্রশ্ন আমাদের মধ্যে ব্যাপক দূরত্ব তৈরি করছে। স্থানীয় ভাষা, জাতীয় ভাষা এবং বিদেশি ভাষা এগুলোর লড়াই চলে। কেবল ভাষার কারণেই সাহিত্যের/ লেখকের/ শিক্ষকের মান কমে যায় বা বেড়ে যায় বলে ধরে নেয়া হচ্ছে। তাইতো, বাংলা বিভাগ ও ইংরেজি বিভাগের ভেতর থেকে যায় বিশাল এক আদিম খাল, মনে হয় কোন সেতু নাই। কুমির ভরা এই খালে কোন সাঁকো ও আছে বলে মনে হয় না। তাই আমরা এখন আর মাইকেল মধুসূদন, জীবনানন্দ দাশ, মুনির চৌধুরী, বুদ্ধদেব বসু কিংবা শামসুর রাহমানদের দেখা পাই না সাহিত্যে। এমন কি পাই না আরেক জন হুমায়ুন আজাদও। হতে পারে, এই বেড়াজালে পড়ে ব্যাপক হারে কমছে আমাদের সাহিত্যপ্রেমী পাঠকের সংখ্যা।
তৃতীয়ত : আরো রয়েছে কেন্দ্রের বিশ্ববিদ্যালয়/ প্রান্তিক বিশ্ববিদ্যালয়/ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা সরকারি কলেজের শিক্ষকদের মধ্যকার অতি জটিল এক অসম সম্পর্ক। নিজ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমের কিংবা অন্যান্য কারণে হয়তো ব্যক্তিগত কিছু মানুষ একে অন্যকে জানে কিন্ত কাজের জায়গায়, চর্চার জায়গায় কিংবা যোগাযোগের জায়গায় রয়েছে বিশাল এক জাতীয়াবাদী সীমানা। এই ছায়ারেখা যেন অভেদ্য, যাবতীয় শান ও শওকতের জ্বলন্ত মোহর।
তাই আমি মনে করি, ATLEB – Association of Teachers of Literatures in English, Bangladesh মত ফোরামগুলো অনেক কার্যকরী হবে। আরো বড় বড় ফোরাম গড়ে উঠবে যেখানে এই ভিন্ন ভিন্ন ধরনের বিভেদকে সরিয়ে রেখে বহু ভাষার, সব এলাকার, সকল প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ থাকবে, থাকবে তাদের আওয়াজ ও প্রতিনিধিত্ব। যেখানে লেখক, অনুবাদক, শিক্ষক, বিশ্লেষক ও পাঠক একই মঞ্চে ভিন্ন ভিন্ন সুর ও স্বরের অবতারণা করবেন। চলবে তুমুল বিতর্ক এবং এগিয়ে যাবে আমাদের সাহিত্যচর্চা এক অভিনব গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়।
লেখক, অনুবাদক, শিক্ষক, বিশ্লেষক ও পাঠক
“সানতিয়াগো’র প্রজ্ঞা ও বালকের চোখ” পড়লাম। পড়ে মনে হলো ATLEB – Association of Teachers of Literatures in English, Bangladesh এর মতো বাংলা সাহিত্য শিক্ষা প্রসারের জন্য এ ধরনের সংগঠন প্রয়োজন।