১২০৭ খ্রিস্টাব্দের ৩০ সেপ্টেম্বরে জন্মেছিলেন আল্লামা জালালউদ্দিন রুমি। তাঁকে স্মরণ করে সহজিয়া প্রকাশ করছে তাঁর গদ্য ও কবিতার অনুবাদ। রুমির কাব্যসম্ভার থেকে ৫টি কবিতা অনুবাদ করেছেন কবি ও নাট্যকার বদরুজ্জামান আলমগীর।
জালালউদ্দিন রুমি ১২০৭ সনের ৩০শে সেপ্টেম্বর আফগানিস্তানের বাল্খে জন্মগ্রহণ করেন। জীবনের প্রারম্ভিক বিলোড়ন থেকেই তিনি এক আধ্যাত্মিক উন্মত্ততার ভিতর বড় হয়ে উঠতে থাকেন : রুমির জনক বাহাউদ্দীন ওয়ালাদ একইসঙ্গে তাঁর জন্মদাতা পিতা ও মুরশিদ। ক্রমান্বয়ে রুমি অতুল সিদ্ধপুরুষ ফরিদউদ্দীন আত্তার, এবং হাকিম আবদুল মাজিদ মাজদুদ ইবনে আদম সানাই গজনভির সংস্পর্শে আসেন, মাওলানা রুমি সঠিকভাবেই তৎকালে বুজুর্গ পণ্ডিত, ধর্মের ব্যাখ্যাকার, কাজি, মুরশিদ ও অনন্য এক ধর্মতত্ত্ব বিশারদে পরিণত হয়ে ওঠেন। কিন্তু এই সামগ্রিক প্রস্তুতির পরও জালালউদ্দিন রুমির জীবন এক অন্য স্তরে সমাসীন হয় যেদিন তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে শামস তাব্রিজির সাথে। বলা হয়, তাব্রিজি এবং জালালউদ্দিন রুমির দেখা হলে একজন আরেকজনের পায়ের ধুলি নিতেন: এভাবেই দৃশ্যত আশেক-মাশেক, গুরু-শিষ্য, ছাত্র-শিক্ষক, পীর ও মুরীদানের মধ্যকার দূরত্ব ঘুছে এক নোতুন পরম্পরা তৈরি হয় : লাভার ও বিলাভেডকে আলাদা করার শরিয়া লুপ্ত হয়ে যায়- এ যেন থিসিস নয়, নয় এন্টিথিসিস- এ হলো সিনথেসিসের খেলা: যেভাবে স্রষ্টা মানুষের গোপন — মানুষ স্রষ্টার গোপন।
দার্শনিক কবি জালালউদ্দিন রুমি ১৭ই ডিসেম্বর, ১২৭৩ সনে তুরস্কের কোনিয়ায় অদৃশ্যতার বন্ধনে উড়ে যান।
পাথরে নিমজ্জন
মৃত্যু পান করে আমি পাথর হয়ে ছিলাম
আবার পুঁই মেলেছি তরু লতায়,
গাছটি আবার ঢলেছি মৃত্যুর শয়ানে
আবার এসেছি একটি প্রাণীর খাঁচায়
জীবটি আমি লুকিয়েছি ফের মরণের অন্তঃপুরে
ফিরেছি আবার মানুষের রূপ ধরে।
কেন ভয়, কিসের ডরে আঁখি করে ছলোছলো
মৃত্যু আমার কী কেড়ে নিয়েছে বলো?
ইংরেজি পাঠ : A stone I died
পরিশেষে
কল্পনায় তামাম দুনিয়া
পাহাড় গিরি
ঘুরে এসে দিনশেষে মনে হয়
গন্তব্য একটাই — বাড়ি।
আমার সুদীর্ঘ জীবনের
সাকল্য যোগফল — ক্ষমার আখর।
বড় মহব্বত করে
তুমি আমার অফুরান জীবনের
ধারাবিবরণী শুনে গ্যাছো,
এখন সারকথাটি বলি —
এ একটি রূপকথা ছাড়া আর কিছু নয়।
ইংরেজি পাঠ : In the end.
কাঠামো পেরিয়ে
রাত্তিরে তোমার কাজের জায়গা কিংবা বাড়ি থেকে
যেই না রাস্তা পেরুতে পা বাড়াও — সামনে পড়ে কবরখানা।
তুমি শোনো — আমি তোমার অন্তরের অচিনপুর থেকে
তোমাকে ডাকি,
তোমার সামনের উন্মুখ কবরখানার দিকে চাইলেই
বুঝতে পারো —
আমাদের মধ্যে কোন ফাঁক নেই- আমরা একসঙ্গেই আছি!
তুমি যে মানব নিধি — আমি তার অন্তহীন সজ্ঞা
তোমার বিষাদের মর্মমূলে আমি আনন্দ উৎসার।
সে রাতের কথা ভেবে দেখো —
সাপে কাটার ভয়ে তুমি পালিয়ে গ্যাছো, আর পিলপিলিয়ে শরীরে উঠে আসছে পিপড়া,
তারমাঝে মোম জ্বলে আছে, আমি ডাকছি তোমায় —
শুনতে পাও আমার চিরচেনা গলা,
ধুপবাতির ঘ্রাণ নীরবে মৌমৌ;
খাবারের আয়োজন দেখে তুমি রীতিমতো হতবাক!
একজনের ভালোবাসা কতো প্রাণের অন্তরালে
ফল্গুধারায় জাগে।
জানি আমার তারস্বরে তোমার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে,
আমি এভাবেই চেঁচাই — তুমি যেন কবরে মাতমে জ্বলে ওঠো।
কাফনের কাপড় নিয়ে অনুযোগ করো না,
গোরস্তানের পথ থাক না ধুলামলিন, তাতে কী!
শবদেহে মোড়ানো কাপড় ছেঁড়া হয় গেরোদেয়া কোণায়।
আখেরাতে দীর্ণ মানুষের স্বনন ধুয়ে দেয়
মৃতদের শ্রান্তি ও ঘাম!
আমাকে খোঁজো না মানুষের দেহ-খাঁচায়
ভালোবাসার তীব্র ঝড় আমাকে ভেঙে একাকার করে দিয়েছে
সকল আকার, ক্ষেত্রফল ও মালিকানা।
বাজাও ডঙ্কা, কবিকে আমন্ত্রণ — বলুক তিনি পদাবলী কালাম।
এদিন এসেছে সেদিনের কাছে — যেদিন তুমি পরিশুদ্ধ
হতে পারো — যারা পেয়েছো বোধের মখমল,
যারা প্রেমের আঙিনায় আসবে বলে নিয়ত করেছো।
তুমি মৃত্যুর কিনারা অবধি অপেক্ষা করো না,
এখানে বহুকিছু চাওয়ার আছে যা টাকার চেয়ে দামী,
কেবল বিখ্যাত হয়ে ওঠার কী-বা মূল্য আছে বলো —
কাচ্চিবিরিয়ানি এমন কিছু নয় যার জন্য লালায়িত হও!
কী নামে ডাকি তারে —
এই নগরে গড়েওঠা নতুন এক নিরুদ্বেগের বাড়ি —
মানুষেরা বসে নিঃশব্দ, চোখ ডোবে সহজ দৃশ্য প্রভার কারণ
প্রশ্ন নেই, উত্তরে হাওয়ায় মেশে প্রাণের শনশন!
ইংরেজি পাঠ : No room for form.
ইংরেজি ভাষান্তর : কোলম্যান বার্কস
মৃত্যুর গুমর
মৃত্যু এক অনন্ত যাত্রার সঙ্গে বিবাহ।
এ কিসের গুমর? পরমেশ্বর তো অখণ্ড।
সূর্যালোক জানালা গলিয়ে ঘরে ঢোকার বেলায়
ভেঙে চিলতা হয়।
আঙ্গুর ফলের বাকল বহুবিধের যৌগ,
কিন্তু আঙুরের রসে কোন ভাগ নেই।
যে ঈশ্বরের আলোর নিরিখে বাঁচে
মৃত্যুর ফলে তার আত্মা আরেক বর্ধিত উদযাপনে
অধিষ্ঠিত হয়।
যে চলে গ্যাছে তাকে আর ভালো-মন্দের তকমায় বেঁধো না,
বরং তোমার চোখ একাগ্র করো ঈশ্বরে;
যে অদৃশ্য তাকে নিয়ে বেহুদা কথা বলো না —
সে হয়তো তোমার দৃষ্টির অতলে ভর করে আছে।
চর্মচক্ষুর দৃকপাত কেবলই এক জাগতিক আচার,
তারমধ্যে দেখাদেখির কোন অদেখা নেই,
কিংবা নেই গোপনতার মর্ম!
অথচ এই চোখই যদি পরমার্থের বিভামণ্ডিত হয়
তাতে থাকতে পারে দেখার অন্তঃপুরে দেখার আড়াল।
যে-কোন ঝলকানিকেই ঈশ্বরের নূর ভেবো না।
ক্ষণাচারী আলোর স্ফূর্তি হতে পারে শুধুই দুনিয়াদারির জরি।
যে-আলো সমগ্রের অধীন ও উপর কেবল তা-ই পারমার্থিক উদ্ভাসের বিস্তার।
ঈশ্বর, কেবল তুমিই জানো আলোর কী মাজেজা!
তোমার আলোয় মিলনের তীব্র বাসনা লইয়া পক্ষী
তোমা পানে ধায়!
ইংরেজি পাঠ : secrets of death.
ইংরেজি ভাষান্তর : সিমোন ফেটাল
নতশির চূড়া
আমি ছিলাম মৃত, সহসা আবার জীবন পাই;
কাঁদছিলাম, আবার হাসছি এখন।
আমার মধ্যে প্রেম জন্মায়,
আমি সিংহের প্রচণ্ডতায় মাতি,
তারপর সন্ধ্যাতারার স্নেহাশিসে আসমানে উদিত হই।
অধিকর্তা বলেন, তুমি এখনও যথেষ্ট উন্মাদ নও,
এই ঘরে তুমি থাকতে পারো না।
আমি বন্যতার চূড়ান্ত করি- তার বেশি কিছু করার ছিল না।
অধীশ্বর কহেন, এখনও সেরকম বন্য হয়ে উঠতে পারোনি
যাতে আমাদের সঙ্গে থাকতে পারো।
আমি অতঃপর আনন্দের জোয়ারে উন্নীত স্তরে পৌঁছাই।
তিনি বলেন, না, না, এ যথেষ্ট নয়।
আমি মৃত্যুবরণ করি।
পরমেশ্বর বলেন, তুমি ভীষণ চতুর,
তুমি কানায় কানায় উচ্ছ্বাস আর দোটানার আধার!
আমি আমার শরীর থেকে সব পালক তুলে ফেলি
আর নিজেকে বানিয়ে ফেলি সম্পূর্ণ অবুঝ
তিনি ঘোষণা করেন, এই তো এতোক্ষণে তুমি হয়েছো
এই সমাবেশের মোমবাতি সম।
কিন্তু না, আমি মোমবাতি নই- ভালো করে দেখো
আমি ছড়িয়ে পড়ছি ধুঁয়ার টুকরো ও ছিন্নতায়।
তিনি বলেন, তুমিই এখন বুজুর্গ, তুমিই চলনদার।
কিন্তু না আমি শিক্ষক নই, আমার কোন ক্ষমতা নেই।
পরমনিধি কহেন, তুমি জানো না — তোমার পাখা আছে
আমি তোমাকে আর পাখা দিতে পারি না।
কিন্তু আমি যে পরমাশ্বরের ডানা চাই।
আমি যে এখনও পাখাহীন মোরগের ছানা হয়ে আছি!
আমি এবার এক গায়েবি আওয়াজ শুনি —
তুমি স্থিতধী হও, এক অলক্ষ্যের অনুকম্পা
তোমার মধ্যে প্রোথিত হোক — তুমি স্থির হয়ে থাকো!
আমি অতঃপর শ্রবণ করি আদিতম প্রেমের বাণী —
তুমি আমার নিবিড়ে রহো।
আমি কহি: আমি থাকিবো!
তুমি যে আলোকের এই ঝর্ণাধারা,
আমি গাছের কথায় লতায় পাতায় শ্যামলিমা ছায়া
আমার জীর্ণ বসনে তুমি মখমলের ছোপ।
প্রাণ বুঝি প্রভাতের কৃষ্ণ কালো জল
যে কানে কানে বলে, আলোকের এই ঝর্ণাধারায় বইয়ে দাও!
প্রভাকর মুখ লুকায় সন্ধ্যার আবীরের নিচে
আবার আলতো করে মুখ বাড়ায় চাঁদের কায়ায়
অসীম আকাশের নীল জ্যোৎস্না লহরায় সমস্ত ভাসায়!
তোমার হাসি ওই দূর হাসির গরিমায় মেশে।
এই সংসার দাবার ছকে খেলতে বসে না বড় খেলোয়াড়
নিঃসীমের আড়ালে থেকে চাল দেয় মৌল কারিগর।
আমি না-বোঝ, চালের গুটি
যেমনি বলো তেমনি খেলি — আমি আছি, আছি আমি
দাবার ছকে- তাইতো খুশি পরমপুরে নিত্য দিবস যামি!
ইংরেজি পাঠ: Sublime Generosity.
ইংরেজি তরজমা : কোলম্যান বার্কস।