মাওলানা রুমির ‘ফিহি মা ফিহি’ ।। বক্তৃতা ৬

১২০৭ খ্রিস্টাব্দের ৩০ সেপ্টেম্বরে জন্মেছিলেন আল্লামা জালালুদ্দিন রুমি। তাঁকে স্মরণ করে সহজিয়া প্রকাশ করছে তাঁর গদ্য ও কবিতার অনুবাদ। রুমির বিখ্যাত গদ্য রচনা ফিহি মা ফিহি থেকে প্রকাশ করা হলো একটি অংশ। সহজিয়ায় এটি ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করছেন সায়মন আলী

রুমি বললেন, “এই কথাগুলো তাদের জন্য যাদের আসলে কথা বুঝতে পারাটা প্রয়োজন। কিন্তু যারা কথা ছাড়াই বুঝতে পারে তাদের জন্য বক্তব্যের কী প্রয়োজন? স্বর্গ-মর্ত্য এদের কাছে কথার মতো, আল্লাহর ভাণ্ডার থেকে সেগুলো তাদের জন্য আল্লাহর বাণী হিসেবে পাঠানো হয়েছে। ফিসফিসিয়ে বললে যারা শুনতে পায় তাদের জন্য চিৎকারের বা গর্জনের কী দরকার?

 

একজন আরবিভাষী কবি একদিন এক রাজার দরবারে উপস্থিত হলেন। রাজা জাতিতে তুর্কি, তিনি আরবি তো দূরের কথা ফারসিও জানতেন না। কবি রাজার সম্মানে আরবিতে কয়েকটি সুন্দর কবিতা রচনা করেছিলেন আর সেগুলো নিয়ে রাজার কাছে এসেছিলেন। রাজা সিংহাসনে উপবিষ্ট হবার পর আর রাজ দরবারে উপস্থিত সভাসদগণ নিজ নিজ আসন গ্রহণ করলেন। তখন সেই কবি নিজ আসন থেকে উঠে দাঁড়ালেন এবং সাথে আনা কবিতাগুলো আবৃত্তি করা শুরু করলেন। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে, কবিতাগুলোর যে চরণগুলো করতালি পাবার মতো সেগুলো শোনার পর রাজা মাথা নাড়াতে লাগলেন আর যে চরণগুলো বিস্ময় জাগানিয়া সেখানে তিনি অবাক হলেন। পুরো কবিতাবৃত্তির প্রতিটি চরণেই রাজা কোনও না কোন আবেগ প্রকাশ করছিলেন। সভাসদগণ তা দেখে হতবাক হয়ে গেলেন। তাঁরা তখন নিজেদের মধ্যে ফিসফিসিয়ে বলতে লাগলেন, “আমাদের রাজা এক বর্ণও আরবি জানতেন না, অথচ তিনি কী করে এত ভালোভাবে কবিতার চরণগুলি বুঝতে পারলেন? তিনি নিশ্চয়ই অনেক আগে থেকে আরবি জানতেন এবং সেটা আমাদের কাছে গোপন রেখেছিলেন। হায়! এতদিন আমরা আরবিতে কতই না অসংলগ্ন কথাবার্তা বলেছি!”

 

তো সেই রাজা তাঁর এক ভৃত্যকে খুব পছন্দ করতেন। সভাসদগণ সকলে মিলে সেই ভৃত্যের কাছে গেলেন। তাকে একটি ঘোড়া, একটি খচ্চর আর কিছু টাকাপয়সা দিলেন। পাশাপাশি কথাও দিলেন যে, পরে তাকে আরো অনেক কিছু দেয়া হবে। কিন্তু এর বিনিময়ে তাকে একটি কাজ করতে হবে। কাজটি হল- রাজা আরবি জানেন কি না সেটা তাকে যাচাই করতে হবে। রাজা যদি আরবি না জেনে থাকেন তাহলে কবিতার চরণগুলোতে এত সঠিকভাবে মাথা নাড়লেন কী করে- সেটা জানতে পারলে বোঝা যাবে যে,সেটা কি কোন নাটকীয়তা ছিল নাকি ছিল কোন দৈবিক ব্যাপার?”

 

অবশেষে সুযোগের অপেক্ষা ফুরোল। একদিন রাজা শিকারে বেরিয়েছিলেন। ভৃত্যটি দেখল, রাজা খুব খোশমেজাজে রয়েছেন কারণ তিনি ভালোই শিকার পাচ্ছিলেন। সুযোগ বুঝে ভৃত্যটি রাজার কাছে বিনীতভাবে প্রশ্ন করল, “হুজুর, আপনি সেদিন আরবি কবিতাগুলোতে কী কী বুঝতে পেরেছিলেন?“ ভৃত্যের প্রশ্ন শুনে রাজা অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন।

 

“আল্লাহর শপথ, আমি এক বর্ণও আরবি বুঝি না।” রাজা হাসতে হাসতে বললেন, “তবে আমি বুঝতে পেরেছিলাম সেই কবি তাঁর কবিতায় কী লিখতে পারেন, কী থাকতে পারে তার উদ্দেশ্য। তাই আমি অমন মাথা নেড়েছিলাম আর তাঁকে সাধুবাদ জানিয়েছিলাম।”

 

সুতরাং বোঝা গেল পুরো ব্যাপারটির মূলে ছিল একটি কাঙ্ক্ষিত উদ্দেশ্য পূরণ। আর কবিতাটি ছিল এই উদ্দেশ্য পূরণের একটি শাখা মাত্র। যদি কোন উদ্দেশ্য পূরণের ব্যাপার না থাকতো তবে কবি কখনোই সে কবিতা রচনা করতেন না।

আল্লাহর সান্নিধ্যে দু’জন ‘আমি’র অস্তিত্ব থাকতে পারে না। আপনি একইসাথে নিজেকে আর আল্লাহকে জানতে পারেন না। হয় আপনার আগে তাঁর মৃত্যু হবে আর নাহলে তাঁর আগে আপনার মৃত্যু হবে; এতে দ্বিধা থাকবে না।

আমাদের আসল উদ্দেশ্য যদি বিবেচনায় রাখা যেত তবে সংশয়-দ্বিধা বিলুপ্ত হয়ে যেত। বিভিন্ন সংশয় বিভিন্ন রকম দিক তুলে ধরলেও মূল একই থাকে। সূফী শেখদের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা দেখা যায়। বেশভূষা ও  শিক্ষাদান পদ্ধতিতে তাঁরা পরস্পর থেকে ভিন্নতর হতেন, ভিন্ন হতো তাঁদের সামাজিক অবস্থানও। তাঁদের কথাবার্তা ও কার্যকলাপের দ্বারা তাঁদের দৃষ্টিকোণে যতই পার্থক্য ফুটে উঠুক না কেন, সকলের মূল উদ্দেশ্য একটাই আর তা হল আল্লাহর অনুসন্ধান।

 

বাতাসের কথাই ধরুন। বাতাসের প্রবহমানতা আমরা কীভাবে বুঝি? বাতাস যখন ঘরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয় তখন কার্পেট, কম্বল তার ঝাপটায় উড়তে থাকে। বাইরে বাতাসের প্রবহমানতা প্রমাণিত হয় খড়কুটো ও ধুলোবালিকে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ায়, জলাশয়ের পানিকে আলোড়িত করে উচু নিচু তরঙ্গের সৃষ্টি করায়, গাছের ডালপালা আর পাতাগুলোকে আন্দোলিত করায়। দৃশ্যত এ সমস্ত ব্যাপার বস্তুর অবস্থান ও প্রকৃতি সাপেক্ষে ভিন্ন ভিন্ন হলেও এর মূলে রয়েছে একটিই সত্য। তা আর কিছুই না- বাতাসের প্রবহমানতা।

কেউ একজন বলল, “আমি সেই সত্য উদ্দেশ্যটিকে অবহেলা করেছি।”

রুমি উত্তরে বললেন, “এই চিন্তাটি যখন কারো মনে আসে আর সে আত্মসমালোচনা করে বলতে থাকে যে, ‘আমি আসলে কী? আর আমি এগুলো কেনইবা করছি?’ তখন নিশ্চিত থাকুন, আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন এবং তাদের প্রতি করুণাময়। এ চিন্তা আর চিন্তার ফলে আত্মোপলব্ধি তাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহের প্রমাণ।” কবি বলেছেন,“ভালোবাসা ততক্ষণই, তিরস্কার যতক্ষণ।” আমরা আমাদের সুহৃদদেরকে তিরস্কার করতে পারি, কারণ তাদেরকে আমরা ভালোবাসি; কিন্তু আমরা কোন অচেনা লোককে তিরস্কার করি না, কারণ সেখানে ভালোবাসার কোন স্থান নেই।

 

তিরস্কারের কিছু স্তর আছে। যখন কোন ব্যক্তি এই তিরস্কারের দংশনে দংশিত হয় আর এই তিরস্কারের মধ্যে বৈধতা খুঁজে পায় তখন বুঝতে হবে আল্লাহ তাকে পছন্দ করেন এবং তার প্রতি করুণাময়। কিন্তু যদি সে ব্যক্তির মধ্যে তিরস্কার কোন দংশন তৈরি না করে তবে সেটা তার প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহের প্রমাণ নয়। যখন কার্পেট পরিস্কার করার জন্য লোকে সেটাকে পিটিয়ে পিটিয়ে ধুলো ঝাড়ে তখন সেটাকে তিরস্কার বলা যায় না। কিন্তু যখন কোন মহিলা তার প্রিয় সন্তানকে প্রহার করেন তখন সেটাকে তিরস্কার বলা যায় কারণ সেটা সন্তানের প্রতি ঐ মায়ের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। সুতরাং, যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি আপনার মধ্যে বেদনা আর আক্ষেপ অনুভব করবেন বুঝবেন সেটা আপনার প্রতি আল্লাহর ভালোবাসা ও অনুগ্রহের নিদর্শন।

 

আপনি যদি আপনার ভাই বোনের মধ্যে কোন ভুল দেখতে পান তো বুঝবেন আপনিও সে ভুলের বাইরে নন। একজন সত্যিকারের সূফি আয়নার মতো- যার মধ্যে আপনি নিজেকে দেখতে পাবেন এই বিশ্বাসে যে, “একজন মুমিন তার সহবিশ্বাসীদের দর্পণস্বরূপ।” সুতরাং সেসব ভুলত্রুটি থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখুন যেগুলো অন্যের মাঝে দেখামাত্র আপনি বিরক্ত হন, কারণ আপনার মধ্যে সেগুলো আছে বলেই  আপনি বিরক্ত হন।

 

একটি হাতি জলপান করার জন্য একটি কুয়োর দিকে গেল। কুয়োর পানিতে নিজেকে দেখতে পাওয়া মাত্রই এটি কুয়া থেকে দূরে সরে গেল। হাতিটি মনে করেছিল কুয়োর ভিতর আরেকটি হাতি আছে। হাতিটি বুঝতেই পারে নি যে এটি আসলে নিজেকে দেখেছিল।

 

সমস্ত দোষত্রুটি যেমন: নিপীড়ন, ঘৃণা, হিংসা, লোভ, নির্দয়তা, অহংকার ইত্যাদি যখন আপনার স্বভাবে উদ্ভুত হয় তখন সেগুলো আপনার মধ্যে কোন বোধ তৈরি করে না। কিন্তু যখন আপনি সেগুলো অন্য কারো মধ্যে উদ্ভুত হতে দেখেন তখন তা ঠিকই আপনার মধ্যে লজ্জা আর বেদনা জাগায়। আমরা নিজেদের চর্মরোগের ফলে দগদগে ঘা বা ক্ষততে বিরক্তিবোধ করি না। আমরা নির্দ্বিধায় নিজেদের নাপাক হাত দিয়ে ভরপেট খাই, পেটের অসুখের পরোয়া না করে আঙ্গুলগুলো পর্যন্ত চেটেপুটে খাই। কিন্তু আমরা যদি একইরকম ঘা বা ক্ষত অন্য কারো হাতে সামান্য পরিমাণে হলেও দেখি, অথবা ঘা এর মতো কোন দাগ দেখি তখন আমরা ঐ ব্যক্তির দেওয়া খাবার চেখে দেখা তো দূরে থাক, তা থেকে যথাসম্ভব নিরাপদ দুরত্বে সরে আসি। ঐ খাবার যেমনই হোক, যতই সুস্বাদু হোক না কেন তার জন্য আমাদের কোন রুচি জাগে না। দোষত্রুটিগুলো এই ঘা আর ক্ষতের মতো; যখন তারা আমাদের মধ্যে থাকে তখন তা আমাদেরকে বিচলিত করে না। কিন্তু ঐ একই ত্রুটির সামান্য পরিমাণও যদি আমরা অন্যের মধ্যে দেখি তখন আমরা বিরক্তি ও দুঃখ বোধ করি।

 

একইভাবে আপনি আপনার ভাইবোন থেকে দূরে সরে গেলে তারাও আপনার থেকে দূরে সরে যাবে। আর তখন আপনার উচিত তখন তাদেরকে ক্ষমা করা। যে দোষত্রুটিগুলো দেখে আপনি দুঃখবোধ করেন, তারাও  দোষত্রুটিগুলোকে দেখে একইভাবে দুঃখিত হয়। সত্যান্বেষী ব্যক্তি তার প্রতিবেশীদের দর্পণ স্বরূপ। তবে সত্যের তাড়না যাদের মধ্যে কোন বোধ তৈরি করে না তারা কখনও অন্যের দর্পণ হতে পারে না, তারা নিজেরাই নিজেদেরই প্রতিবিম্ব।

 

একদিন এক রাজা নদীর ধারে বিমর্ষ হয়ে বসেছিলেন। তাঁর সান্ত্রীসেপাই আর পারিষদবর্গ রাজার এই বিমর্ষতার জন্য উদ্বিগ্ন ও ভীত। তাঁরা শত চেষ্টা করেও রাজার মুখে হাসি ফোটাতে পারছিলেন না।  রাজসভায় রাজার খুব পছন্দের একজন ভাঁড় ছিলো। রাজার পারিষদবর্গ সেই ভাঁড়ের কাছে গেলেন আর প্রতিশ্রুতি দিলেন যে, সে যদি রাজার ‍মুখে হাসি ফোটাতে পারে তবে পুরস্কার হিসেবে একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ পাবে। ভাঁড় তখন রাজার কাছে গেল এবং তাকে হাসানোর অনেক চেষ্টা করল। কিন্তু সে যা ই করে, রাজা তার দিকে ফিরেও তাকান না। রাজা এক দৃষ্টিতে নদীর দিকেই তাকিয়ে থাকলেন আর কিছুতেই মাথা তুললেন না।

ভাঁড় তখন রাজাকে জিজ্ঞেস করল, “মহারাজ, আপনি পানিতে কী দেখতে পাচ্ছেন?”

রাজা উত্তরে বললেন, “আমি এক অবিশ্বস্ত মহিলার স্বামীকে দেখতে পাচ্ছি।”

ভাঁড় তখন বলল, “হে রাজাধিরাজ, আপনার এ দাসও অন্ধ নয়।”

সুতরাং এটি একান্তই আপনার নিজের ব্যাপার। যদি আপনার সহকর্মীর মাঝে বেদনাদায়ক কিছু দেখতে পান তো বুঝবেন তারা কোনভাবেই অন্ধ নয়। তারা ঠিক তা ই দেখে যা আপনি দেখেন।

 

আল্লাহর সান্নিধ্যে দু’জন ‘আমি’র অস্তিত্ব থাকতে পারে না। আপনি একইসাথে নিজেকে আর আল্লাহকে জানতে পারেন না। হয় আপনার আগে তাঁর মৃত্যু হবে আর নাহলে তাঁর আগে আপনার মৃত্যু হবে; এতে দ্বিধা থাকবে না। কিন্তু তাঁর মৃত্যু একইসাথে অকল্পনীয় ও অসম্ভব ব্যাপার বরং তিনিই সদা জাগ্রত এবং অবিনশ্বর। তিনি পরম করুণাময় এবং যদি আদৌ কখনো সম্ভব হতো তবে  তিনি আপনার জন্য নিজের মৃত্যু ঘটাতে পারতেন। যেহেতু এটি সম্ভব নয় সেহেতু আপনাকেই মরতে হবে আর এর মাধ্যমে আপনার মধ্যে আল্লাহর সৃষ্টির প্রকাশ ঘটবে এবং সকল দ্বিধা লোপ পাবে।

 

দুটি পাখিকে একসাথে বাঁধুন। তখন তাদের মোট চারটি ডানা হবে। অর্থাৎ তাদের তখন উড়বার মতো দ্বিগুণ সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তারা উড়বে না। কারণ তারা দ্বিধায় ভুগবে। তবে একটি পাখি যদি মরে যায় তবে অপরটি অবশ্যই উড়ে পালাতে চাইবে। কারণ তখন জীবিত পাখিটির মধ্যে কোন দ্বিধা থাকবে না।

 

শামস ই তাবরেজ ছিলেন আল্লাহর একজন একনিষ্ঠ সেবক। একজন বন্ধুর প্রয়োজনে তিনি খুব সহজেই নিজেকে উৎসর্গ করতে পারতেন । তিনি সেই বন্ধুটির জন্য আল্লাহর নিকট আর্জি রেখেছিলেন  কিন্তু আল্লাহ তাঁর প্রার্থনা গ্রহণ করেন নি। “আমি চাই না তুমি তাকে সাহায্য কর।” একটি কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। কিন্তু সূর্যের পুত্র শামস নাছোড়বান্দা (শামস ই তাবরিজের আক্ষরিক অর্থ সূর্যের তাবরিজ) এবং তাঁর প্রার্থনা বন্ধ না রেখে বলতে থাকলেন,“হে আল্লাহ, আপনি তার জন্য এই আকাঙ্ক্ষাটি আমার ভেতর বুনে দিয়েছেন তাই আমি এ থেকে বিরত হতে পারছি না।” অবশেষে সেই কণ্ঠস্বর আবার ভেসে এলো আর বলল, “তাহলে কি তুমি চাও যে তোমার এই প্রার্থনাটি পূরণ হোক? তাহলে নিজেকে উৎসর্গ কর আর হারিয়ে যাও। অপেক্ষা করো না এবং এই দুনিয়া পরিত্যাগ কর।” উত্তরে শামস বললেন, “হে আল্লাহ, আমি তৈরি।“ অতএব তা ই হল। তিনি তাঁর সে বন্ধুর জন্য নিজের জীবন বাজি রাখলেন আর তাঁর প্রার্থনা পূরণ হল। [এই গল্পের বন্ধুটি রুমি নিজেই। রুমির কিছু ঈর্ষাকাতর অনুসারী শামসকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু রুমি শামসকে ডেকে পাঠান। শামস পরে ফিরে এসেছিল। কথিত আছে যে, রুমির এক পুত্র আর সেই ঈর্ষাকাতর অনুসারীরা মিলে শামসকে খুন করেছিল। এই নিখোঁজ শামসের অনুসন্ধান রুমির বহু কবিতার উৎস, যাঁকে তিনি নিজের মধ্যে খুঁজে পেতে চেয়েছিলেন।]

 

আল্লাহর কোন সেবক যদি নিজের জীবন উৎসর্গ করার মতো অনুগ্রহ অর্জন করতে পারে, যার জীবনের সামান্য একটি অংশের মূল্য এই গোটা দুনিয়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সকল জীবের জীবনের মূল্যের চেয়ে বেশি; তবে সেটি কি শুধুই অনুগ্রহ? ভালবাসাও নয় কি? বরং তা না মনে করাটাই অযৌক্তিক। অতএব তাঁর মৃত্যু অসম্ভব বলে আপনিই পারেন মৃত্যুবরণ করতে।

 

জনৈক মহান সাধু এক জায়গায় বসেছিলেন, এক বেকুব এসে তার উপরের জায়গায় আসন গ্রহণ করল। এরকম বেকুবের দল নিচেই বসুক আর উপরেই বসুক তাতে সাধুর কী আসে যায়? আলো যদি উপরে থাকতে চায় তবে তা এটি নিজের জন্য চায় না। এর উদ্দেশ্য থাকে অন্যের উপকার সাধন করা যাতে অন্যরা এই আলোটা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে উপভোগ করতে পারে। আলো যেমনই হোক, উপরে কিংবা নিচে যেখানেই থাক; এটি সূর্যের মতোই চিরন্তন। সাধুরা যদি পার্থিব পদমর্যাদা আর আস্তানা অনুসন্ধান করে থাকেন তবে তার পেছনে একটি উদ্দেশ্য আছে। আর তা হল- যে লোকেরা পার্থিব পদমর্যাদার ফাঁদে পড়ে নিজেদের সত্যিকারের উন্নতি সম্পর্কে কোন ধারনা রাখে না তাদের মধ্যে সে উন্নতির মোহ তৈরি করা। এর মাধ্যমে সেসকল ব্যক্তি সত্যিকারের উন্নত জগতের পথ খুঁজে পেতে পারে এবং ঐশ্বরিক অনুগ্রহের মোহে পড়তে পারে।

 

একই কারণে নবীজী মুহম্মদ (স.) মক্কা ও আশেপাশের অঞ্চল জয় করতে চাননি কারণ এ সকল অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে তাঁর প্রয়োজন ছিল। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল সকলকে জীবন ভিক্ষা দিয়ে আলোর পথে নিয়ে আসা। তিনি বলতেন, “এই যে হাত দেখছেন তা শুধু দিতে অভ্যস্ত, নিতে নয়।” পয়গম্বরগণ জনসাধারণের মাঝে ছদ্মবেশে থাকেন তাদের প্রাপ্য উপহার বুঝিয়ে দেয়ার জন্য, তাদের কাছ থেকে কোনকিছু নেয়া তাঁদের উদ্দেশ্য নয়।

 

যখন কেউ ফাঁদ পেতে ছোট ছোট পাখি ধরে, তা খাবার জন্যই হোক অথবা বিক্রি করার জন্যই হোক; তখন সে ফাঁদ পাতাকে আমরা ধূর্ততা বলি। কিন্তু যখন কোন রাজা বাজপাখিকে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত করার জন্য ধরার জন্য ফাঁদ পাতেন, সে বাজপাখিটি যেমনেই হোক রাজা সেটাকে প্রশিক্ষিত করে তোলার চেষ্টা করেন, বাজপাখি স্বভাবে  শিকারী কিন্তু প্রশিক্ষণ দিয়ে দিয়ে সেটিকে আরো তুখোড় শিকারীতে পরিণত করা হয়; তখন রাজার বাজিপাখিকে প্রশিক্ষিত করার এই প্রক্রিয়াটিকে কিন্তু আমরা ধূর্ততা বলি না। বাহ্যিকভাবে ব্যাপারটিকে একপ্রকার ধূর্ততা বলে মনে হলেও এটিকে বিশেষ যত্নশীলতা ও মহত্ত্বের উৎকৃষ্ট প্রমাণ হিসেবে মনে করা উচিত। এটি অনেকটা মৃতের মাঝে প্রাণ প্রতিষ্ঠা কিংবা আকরিককে ঘষে মেজে চুণি-পান্নার মতো মূল্যবান পাথরে পরিণত করার মতো। বাজপাখিটি যদি জানতো যে রাজা কোন্ কারণে এটিকে ধরার জন্য ফাঁদ পাতছেন তবে এটির জন্য কষ্ট করে ফাঁদ পাতার কোন দরকার হতো না। এটি আপনা আপনি ফাঁদ খুঁজে নিতো এবং নিজে থেকেই রাজার হাতে উড়ে এসে বসতো।

 

লোকেরা কেবল মুনি ঋষিদের বাণীসমূহের বাহ্যিক তাৎপর্য শোনে। তারা বলে, “আমরা এমন কথা বহুবার শুনেছি। আমাদের অন্তর এমন কথায় ভর্তি হয়ে গেছে।” আল্লাহ বলেন, “তোমাদের মনপ্রাণ সেসব কথা দ্বারা ভর্তি করতে কি আমি নিষেধ করেছি! তোমরা তোমাদের নিজেদের মধ্যে ফিসফিসানি আর ভ্রান্ত ধারণাতে মত্ত রয়েছ। তোমরা লোভ আর মোহে অন্ধ হয়ে গেছ। সুতরাং তোমাদের জীবন অভিশপ্ত।”

 

তারা যদি বুঝতো যে তারা শুধু দোষত্রুটিতে পরিপূর্ণ তবে তারা মুনি ঋষিদের বাণী শোনার জন্য সর্বদা উন্মুখ থাকতো। কিন্তু তারা তা শুনবার জন্য উন্মুখ থাকে না। কারণ আল্লাহ তাদের চোখে-কানে এবং হৃদয়ে একধরণের প্রতিবন্ধকতা দিয়ে রেখেছেন। তারা যা, তাদের চোখ তার বিপরীতটা দেখে; তাদের কান জ্ঞানের কথাসমূহকে ফালতু আর অর্থহীন মনে করে। তাদের মন স্বার্থপরতা ও অহংকারের ভাণ্ডারে পরিণত হয়ে গেছে। দম্ভ, ঈর্ষাকাতরতাসহ চরিত্রের অন্যান্য কালো দিকগুলো জট পাকিয়ে শীতের কুয়াশার মতো তাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তাদের মন বরফের মতো কঠিন আর তুষারের মতো শীতল হয়ে গেছে।

কানকে করলেন বধির আর

চোখে পড়ালেন ঠুলি

মনের তালা তাঁর অনিচ্ছায় কীভাবে যে খুলি!

এমন সত্য বচন পরিপূর্ণ ভাবে ধারণ করে- এমন মানুষের সংখ্যা কতই বা? আর যদি ধারণ করেই থাকে তবে তা তিল পরিমাণের বেশি নয়। তারা পুরো জীবনে সেগুলোর বিন্দু পরিমাণও আমল করে নি; তারা তো নয়ই, বরং তারা যাদের অনুসরণ করে তারাও নয়, এমনকি তাদের পরিবারের সদস্যরাও নয়। আল্লাহ প্রত্যেককে এক ধরনের কলসি দেখান। কারো চোখে কলসিটি পানিভর্তি হিসেবে ধরা দেয় এবং যতক্ষণ না তারা পরিতৃপ্ত হচ্ছে ততক্ষণ তারা তা থেকে পান করতেই থাকে। কিন্তু আল্লাহ কারো কাছে কলসিটিকে শূন্য করে দেখান। শূন্য কলসির জন্য কেউ কি কোনরূপ ধন্যবাদ দিতে পারে? তিনি যাদেরকে পূর্ণ কলসি দেখান কেবল তারাই এই উপহারের জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here