কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের `জর্মান ভাবাদর্শ’

হেগেল ভাববাদী আর ফয়েরবাখ বস্তুবাদী : সমগ্র দর্শন অধ্যয়নে এমন সরল সীমারেখা টানার প্রবণতা জ্ঞানের জগতে প্রভূত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। তার ফলে বহু মেধাবী দার্শনিকের কাজও ভ্রান্ত মায়াজালে ঘুরপাক খেয়ে পথ হারিয়েছে। মূলত পূর্বজ দার্শনিকদের গুরুত্বপূর্ণ কাজের যথাযথ মূল্যায়নের বিপরীতে সাধারণীকরণের ফলে এই বিপত্তির সূচনা। জ্ঞানের জগতে কার্ল মার্কস যে ‘জ্ঞানতাত্ত্বিক ছেদ’ ঘটিয়ে সমগ্র বিশ্বে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন, তাঁর সেই অভিযাত্রার (পরিণত পর্যালোচনার সাহায্যে ইতিহাসের নতুন পাঠ নির্মাণ) প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে জর্মান ভাবাদর্শকে বিবেচনা করা যায়।

 

মার্কসের থিসিসে হেগেল ও ফয়েরবাখের প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। মার্কস তাঁদের থেকে নিয়েছেন, তবে যা কিছু গ্রহণ করেছেন, সমস্তই করেছেন পর্যালোচনা করে, পর্যালোচনা করার জন্য। তাঁদের কাছে সে কারণেই তিনি ঋণ স্বীকার করেন। কিন্তু গ্রহণ করার পরে তিনি যেভাবে তাকে উপস্থাপন করলেন, তা হয়ে উঠলো একান্তই তাঁর নিজস্ব সৃষ্টি। এই অভিযাত্রার পূর্ণাঙ্গ পরিচয় উক্ত গ্রন্থে পাওয়া যাবে না। তবে যে প্রক্রিয়ায় মার্কস নির্মিত স্বতন্ত্র জ্ঞান হয়ে উঠলো, এখানে তার প্রাথমিক পরিচয় পাওয়া যাবে।

 

গ্রন্থখানির প্রথমেই ‘ফয়েরবাখ : বস্তুবাদী ও ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে’ শিরোনামটি পাওয়া যাবে। এক্ষেত্রে মার্কস ও এঙ্গেলসের দৃষ্টিভঙ্গিটি আমাদের বিবেচ্য বিষয়। হেগেলের সর্বাপেক্ষা বড় অবদান সম্ভবত ‘বিচার করার পদ্ধতি’। তাঁর সৃষ্টিকর্মে চিন্তার বদলে চিন্তা করার পদ্ধতি দর্শনশাস্ত্রে নতুনত্ব দান করেছিলো। ‘তরুণ হেগেলীয়ান’ নামে হেগেল-পরবর্তী জর্মান দার্শনিকেরা হেগেলকে বিরোধিতা করলো, হেগেলেরই ধাঁচে। হেগেলের পদ্ধতিকে তাঁরা গুরুত্বের সাথে নিতে পারলেন না। কার্ল মার্কসও প্রথম দিকে ‘তরুণ হেগেলীয়ান’ ছিলেন। কিন্তু তিনি সেই গণ্ডি পেরিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। জর্মান ভাবাদর্শে এঁদের (তরুণ হেগেলীয়ান এবং বিশেষ করে ফয়েরবাখ) ক্রিয়াকর্ম ও প্রবণতার পর্যালোচনা করার মধ্যেই মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গির অভিমুখটি বুঝতে পারা যায়। শুরুর দিকেই এঁদের সম্পর্কে এই গ্রন্থে বলা হয়, ‘তরুণ হেগেলীয়ানরা সবকিছুতে একটা ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য আরোপ করে নয়তো একে ধর্মতত্ত্বীয় বিষয় আখ্যা দিয়ে সমালোচনা করে।’ আর তাই “ ‘দুনিয়া কাঁপানো’ বাগাড়ম্বরগিরি সত্ত্বেও তরুণ হেগেলীয় ভাববাদদর্শীরা সবচেয়ে গোঁড়া রক্ষণশীল।’ (পৃ. ১২০)

 

ফয়েরবাখের বস্তুবাদের সমালোচনায় এই গ্রন্থে দেখানো হয়েছে যে, ‘প্রকৃত ঐতিহাসিক মানুষে’র বদলে তিনি কেবল বলেন, ‘মানুষ’, এই ‘মানুষ’ আবার একান্তভাবেই ‘জর্মান মানুষ’। সুস্পষ্ট করে বলা হয় —

তাঁর চোখে ধরা পড়ে না, চারপাশের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য দুনিয়া কেন সরাসরি অসীম থেকে পাওয়া যুগের পর যুগ ধরে একই রকম তা নয় বরং উল্টো, তা শিল্পোৎপাদনের এবং সমাজের দশা-পরিস্থিতির ফসল; এবং সে অর্থে এটা একটা ইতিহাসের ফসল বটে, সমগ্র প্রজন্ম পরম্পরায় কর্মতৎপরতার ফলাফল, যার প্রত্যেকটা পূর্ববর্তীকালের অর্জনের কাঁধে দাঁড়িয়ে থাকা শিল্পোৎপাদনের বিকাশ, বিনিময়-সম্পর্কিত মানুষের সম্পর্কের বিকাশ, বদলে যাওয়া চাহিদার ধরন অনুসারে যা সামাজিক ব্যবস্থার বদল ঘটিয়ে চলেছে। (পৃ. ১৩৩)

‘মানুষ’ তাঁর কাছে কেবল ‘অনুভবের বিষয়’ হয়ে রয়ে গেছে, ‘ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কর্মতৎপরতা’র আকারে ধরা পড়ে নি। অর্থাৎ ‘মানুষ’ নামক ধারণা তাঁর কাছে তত্ত্বের বেড়াজালেই আবদ্ধ থেকেছে, মানুষকে ‘সামাজিক সম্পর্কের ভিতর উপলব্ধি’ করতে পারেন নি। জীবনের বিরাজমান শর্তগুলোর কোনো পর্যালোচনা করেন নি। মোটের উপর, ‘ফয়েরবাখ যতটুকু বস্তুবাদী তাতে ইতিহাস তাঁর বিষয় নয়, আবার যতটুকু ইতিহাস বিবেচনা করেন তাতে তিনি বস্তুবাদী নন। তাঁর বস্তুবাদ ও ইতিহাস পরস্পর বিপরীতগামী।’ (পৃ.১৩৬)

 

মার্কসের মতে ইতিহাস মূলত মানুষের সমবয়সী। ইতিহাসের পূর্বানুমান হিসেবে তিনি ‘ইতিহাস সৃষ্টিক্ষম’ মানুষকে বিবেচনা করেছেন (এর পূর্বের কোনো কাল্পনিক ‘প্রাক-ঐতিহাসিক’ ধারণা বস্তুবাদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না)। প্রকৃতির জীবসত্তা হিসেবে মানুষকে শুরু থেকেই খাওয়া-পরা-জীবিকার চাহিদা পূরণ করতে হয়েছে । তাই কার্ল মার্কস মনে করেন, ‘প্রথম ঐতিহাসিক কাজ হলো এই চাহিদাগুলো মিটানোর উপায় উৎপাদন মানে, খোদ বস্তুগত জীবন উৎপাদন।’ চাহিদা পরিপূরণের জন্য নতুন চাহিদার জন্ম হয় (যেমন জীবন টিকিয়ে রাখতে আহার দরকার, আহারের জন্য, ধরা যাক, পশু শিকারের প্রয়োজনে সৃষ্টি হয় পাথর বা বর্শার চাহিদা)। ‘এই নতুন চাহিদার উৎপাদনই হলো প্রথম ইতিহাস সৃষ্টিকারী কাজ।’ একদম শুরু থেকেই ‘মানুষের ইতিহাস’ বিকাশের ধারায় প্রবেশ করেছে বলেও মার্কস মনে করেন। সামাজিক তৎপরতার এই তিনটি দিক ইতিহাসের সূচনা থেকেই আছে এবং তা বিচ্ছিন্নভাবে নয়, বরং আছে তিনটি মাত্রা হিসেবে।

শ্রমবিভাজনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে মার্কস দেখান, পণ্যের উৎপাদন ও বাণিজ্যের মধ্যে বিচ্ছেদকে, যে পর্যায়ে এই দুয়ের মধ্যখানে এক বিশেষ শ্রেণির উদ্ভব ঘটে, যাদেরকে বলা হয়েছে ব্যবসায়ী শ্রেণি। ক্রমে বাণিজ্য হয়ে উঠেছে ‘রাজনৈতিক তাৎপর্যমূলক ব্যাপার’।

সহযোগী উৎপাদন-সম্পর্কের মধ্যে সম্পর্কিত ব্যক্তিসমষ্টি নিয়েই সমাজের সৃষ্টি বলে মনে করেন কার্ল মার্কস। তার মানে সমাজের ইতিহাসও মানুষের ইতিহাসের সমবয়সী। এই মানুষের প্রসঙ্গে চলে আসে ‘চেতনা’র বিষয়টিও। মার্কস এক্ষেত্রেও বলেন—

চেতনা একেবারে শুরু থেকেই একটা সামাজিক ফসল আর তা হাজির আছে যতদিন মানুষ আছে। চেতনা অবশ্যই প্রথমত একেবারে কাছের পারিপার্শ্বিক ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পরিবেশ সংক্রান্ত চেতনা এবং ক্রমেই আত্মসচেতন হয়ে ওঠা অন্য মানুষ ও বাইরের জিনিসের সাথে সীমিত সংযোগের চেতনা। (পৃ. ১৩৯-১৪০)

চেতনা ব্যবহার করতে ভাষা লাগে। ‘ভাষা চেতনার সমবয়সী।’ ‘ভাষা চেতনার মত কেবল চাহিদা থেকে, অপরিহার্যতা থেকে, অপর মানুষের সাথে বিনিময়ের প্রয়োজন থেকে উৎসারিত।’ (পৃ. ১৩৯)

মার্কস বলছেন, পশুবৎ বা গোত্র চেতনার প্রবৃদ্ধি, বিস্তার ও বিকাশ, উৎপাদনশীলতা এবং চাহিদার বিকাশের সাথেই চলমান থাকে। ফলে জনসংখ্যার বৃদ্ধির সাথে সাথে যৌনবৃত্তিতে শ্রমবিভাজন ঘটে এবং তা বিকশিত হতে থাকে। এই ধারায় ‘যে মুহূর্ত থেকে শ্রম মানসিক শ্রম আর কায়িক শ্রম রূপে বিভাজিত হয়েছে তখন থেকেই সত্যি সত্যি এটা শ্রমবিভাজন হয়ে উঠেছে।’ (পৃ. ১৪০) এই ‘শ্রমবিভাজন ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি, একই বিষয়ের দুই রকমভাবে প্রকাশ’ বলে তিনি চিহ্নিত করেছেন। এরই ধারাক্রমে আসে উৎপাদন-শক্তি ও বিনিময়-সম্পর্কের সংঘাত। শ্রেণির জন্ম ও শ্রেণিগত সংঘাতও ইতিহাসে অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। ইতিহাস পর্যালোচনার শেষে এই গ্রন্থে চারটি সিদ্ধান্ত টানা হয়েছে। এখানে তার দ্বিতীয় এবং চতুর্থ সিদ্ধান্ত দুটি উল্লেখ করা যেতে পারে—

ক. যে শর্তের মধ্যে একটা নির্দিষ্ট উৎপাদন শক্তি প্রযোজ্য থাকে তা সমাজের একটা নির্দিষ্ট শ্র্রেণীর শাসকের শর্ত। এর সামাজিক ক্ষমতা তার সম্পত্তির জাত এবং এর কার্যকর-আদর্শিক প্রকাশ সব ক্ষেত্রেই ঘটে রাষ্ট্রের রূপে। অতএব, প্রত্যেক বিপ্লবী সংগ্রাম ঐ সময়ের ক্ষমতাসীন শ্রেণীর বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়।

খ. কমিউনিস্ট চেতনার ব্যাপক উত্থান ও নিজের উদ্দেশ্যের সাফল্য এই উভয়ের জন্য মানুষের মধ্যে গণপরিবর্তন অপরিহার্য, পরিবর্তন একমাত্র ঘটবে কার্যকর আন্দোলনে, বিপ্লবে, এই বিপ্লব অপরিহার্য, অতএব, তা শাসক শ্রেণীকে অন্য কোনভাবে উৎখাত করা সম্ভব নয় সেজন্য নয় বরং যে শ্রেণী উৎখাত করবে তা কেবলমাত্র বিপ্লবের মাধ্যমেই নিজেকে শতাব্দীর সব ময়লা-পাক থেকে মুক্ত করতে সফল হবে এবং এক নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সক্ষম হবে, তাই। (পৃ. ১৫১)

‘দার্শনিকেরা এতকাল কেবল দুনিয়াকে ব্যাখ্যা করেছেন, আসল কাজ একে বদলে দেয়া’ বলে ‘ফয়েরবাখ সংক্রান্ত থিসিসে’ মার্কস যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, জর্মান ভাবাদর্শে সেই বিষয়ের প্রথমদিককার ভাবনার পরিচয় রয়েছে। হেগেলের কৃত্বিত্ব হিসেবে তাঁর তত্ত্বকে নয়, বরং হেগেলের চিন্তা করার পদ্ধতির কথা বলেছেন মার্কস। জর্মান ভাবাদর্শে মার্কস বলেন, ‘পর্যালোচনা নয় বরং বিপ্লবই ইতিহাসের চালিকা শক্তি, এমনকি ধর্ম, দর্শন ও অন্য সব ধরনের তত্ত্বেরও।’ (পৃ. ১৫৩) অতীতের সমস্ত লিখিত ইতিহাসে ‘ইতিহাসের প্রকৃত ভিত্তি হয় সম্পূর্ণ উপেক্ষিত’ হয়েছে, অথবা তুচ্ছজ্ঞানে বিবেচিত হয়েছে। ‘প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্ক ইতিহাস থেকে বাদ পড়ে গিয়েছে ফলে, প্রকৃতি ও ইতিহাসের এক বিপরীত-প্রতিপাদ্য দাঁড় করানো হয়েছে।’ (পৃ.১৫৫) “যদিও লাখ লাখ প্রলেতারিয়েত ও কমিউনিস্ট বিষয়টা ভিন্নভাবে দেখবে ও সময়ে প্রমাণ করবে, তাদের ‘অস্তিত্ব’ ও ‘সারসত্তা’ এর সমতা বিধান করবে বাস্তবজ্ঞানে, বিপ্লবে।” (পৃ. ১৬০)

 

বিপ্লবের জন্য শ্রেণিবিভাজনের শর্ত হাজির থাকবে। শাসকশ্রেণি ও শোষণকারী ক্ষমতার পরমচেতনার আধিপত্য নিয়ে হেগেল যে ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছিলেন, মার্কস তার সংশোধন ও পরিগঠন করেন। বলেন—‘প্রত্যেক কালপর্বে শাসক শ্রেণীর ভাবনাই কর্তৃত্বশালী ভাবনা (ruling ideas) অর্থাৎ যে শ্রেণী সমাজের কর্তৃত্বশালী বৈষয়িক শক্তি সে একইসাথে এর কর্তৃত্বশীল বু্দ্ধিবৃত্তিক শক্তি। বস্তুগত উৎপাদনের উপায় যে শ্রেণীর দখলে আছে মানসিক উৎপাদনের উপায়ও একইসাথে তার নিয়ন্ত্রণে আছে’ (পৃ. ১৬১) (সব ক্ষেত্রেই মনে রাখতে হবে, মার্কসের মতে শ্রমবিভাজনই তাঁর সমকাল অবধি ইতিহাসের মূল চালিকা শক্তি)। শাসকশ্রেণি যে তাদের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রাখতেই তাদের শ্রেণিস্বার্থকে সাধারণ তথা সর্বজনীন স্বার্থ বলে প্রচার ও প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট হয়, মার্কস তা স্পষ্ট করেই বলেন। এর মধ্যদিয়ে শাসক শ্রেণির স্বার্থের বৈধতা দেয়া হয়। আর ইতিহাসের ধারাক্রমে স্বাভাবিক ভাবেই ‘প্রত্যেক নতুন শ্রেণী তাই কেবল আগের শাসক শ্রেণীর চেয়ে মোটা দাগে অধিকতর প্রভাব অর্জন করে, যার কারণে পরবর্তীকালে নতুন শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে শাসক-নয়-এমন শ্রেণীর বিরোধিতা আরো জোরালো ও বড় আকারে বেড়ে উঠতে পারে।’ (পৃ.১৬৩)

 

মানুষের ইতিহাসে পুঁজির আগমন ভয়াবহ পরিবর্তন এনেছে। সম্পত্তির রূপের বদল হয়ে গেছে, বিনিময় মাধ্যম হিসেবে অর্থের আগমনে স্থাবর সম্পত্তির পরিবর্তে অস্থাবর সম্পত্তি প্রধান হয়ে উঠেছে । তারই সাথে উৎপাদনের হাতিয়ারেরও বিবর্তন ঘটেছে। ফলে উৎপাদন-পদ্ধতি ও বিনিময়-সম্পর্কের পরিবর্তন হয়ে গেছে। শহর ও মফস্বল/গ্রামে শ্রেণির নতুন রূপ দাঁড়ানোর ফলে দিনমজুর কামলার আধিক্য দেখা দিয়েছে। ‘শহরে দিনমজুরের চাহিদা কামলা সৃষ্টি হওয়ার কারণ।’ এই কামলাদের বৈশিষ্ট্য হলো—

ঠিক যেমন আলাদা আলাদাভাবে তাঁরা শহরে প্রবেশ করেছিল পরস্পরের কাছে ছিল তেমনই আগন্তুক মানুষের মতো, অথচ অসংগঠিতভাবে তাঁদের মুখোমুখি হতে হয়েছিল এমনই এক ক্ষমতার সামনে ও বিরুদ্ধে যা এক সংগঠিত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত আর ঈর্ষান্বিত দৃষ্টিতে তার দিকে লক্ষ্য রাখছে।’ (পৃ.১৭০)

 

শ্রমবিভাজনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে মার্কস দেখান, পণ্যের উৎপাদন ও বাণিজ্যের মধ্যে বিচ্ছেদকে, যে পর্যায়ে এই দুয়ের মধ্যখানে এক বিশেষ শ্রেণির উদ্ভব ঘটে, যাদেরকে বলা হয়েছে ব্যবসায়ী শ্রেণি। ক্রমে বাণিজ্য হয়ে উঠেছে ‘রাজনৈতিক তাৎপর্যমূলক ব্যাপার’। এরই বিকশিত ধাপে সাম্রাজ্যবাদী চেতনার বিকাশ ঘটে এবং তার প্রভাব সমগ্র বিশ্বে অবধারিতভাবে পড়ে। মার্কসের মতে, এতে প্রলেতারিয়েত শ্রেণি শাসক শ্রেণি থেকে আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, ফলে তা প্রকৃতপক্ষে শাসক শ্রেণির পতনকেই ত্বরান্বিত করে। কেননা বিচ্ছিন্নতার সূত্রে তাঁরা একত্রিত হয়ে যায় এবং এক সময় বুঝতে পারে যে, সংঘবদ্ধ ক্ষমতার বিরুদ্ধে ‘এক দীর্ঘ সংগ্রামের ভিতর দিয়ে’ কেবল এই বিচ্ছিন্নতা কাটতে পারে। এই বিচ্ছিন্নতার মূল কারণ ‘প্রতিযোগিতা’। ‘প্রতিযোগিতা কেবল ব্যক্তি হিশাবে বুর্জোয়াকে নয় বরং শ্রমিককে আরও বেশি একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন করে, আবার তা সত্ত্বেও তাঁদের একত্র করে, এটাও সত্যি।’ (পৃ.১৮৩) বৃহৎ শিল্প সমাজে বুর্জোয়াদের ভেতরেও বিরোধ দেখা দেয়। কিন্তু বৃহৎ শিল্প এমন এক শ্রেণি তৈরি করে, যাতে ভিন্ন ভিন্ন বুর্জোয়াদের স্বার্থ রক্ষিত হয়। বিপরীতে ‘বৃহৎ শিল্প শুধু শ্রমিকের সাথে পুঁজিপতির সম্পর্ক নয়, শ্রমের সাথে শ্রমিকের সম্পর্কও অসহনীয় করে তুলে।’ (পৃ. ১৮১)

 

বুর্জোয়া আধিপত্যে ব্যক্তি আগের চেয়েও কম স্বাধীনতা ভোগ করে। তাঁর অবস্থান এক পর্যায়ে আর ব্যক্তি হিসেবে থাকে না, থাকে কোনো বিশেষ শ্রেণির একজন সদস্য হিসেবে। ‘এপর্যন্ত ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত সমাজ যার মধ্য দিয়ে সমষ্টিগতভাবে প্রকাশিত, এই রাষ্ট্রই সেই রূপ। অতএব, নিজেদেরকে ব্যক্তিমানুষ হিশাবে জাহির করতে হলে তাঁদের অবশ্যই রাষ্ট্র উৎখাত করতে হবে।’ (পৃ. ১৮৯) বৃহৎ শিল্পের বিকাশে, বুর্জোয়াদের বাড়বাড়ন্ত চূড়ান্ত হলেও, প্রলেতারিয়েতদের আন্দোলনের গতি কমে যায় না বলে মনে করেন কার্ল মার্কস। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, তখনও বৃহৎ শিল্প তাদের উৎপাদন ও ভোগের প্রক্রিয়ায় যাদের নিজেদের স্বার্থের পক্ষে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে, তার চেয়ে অন্তর্ভুক্ত না-করতে পারার সংখ্যাধিক্য থাকে এবং এই পর্যায়ে প্রলেতারিয়েতরা নিজেরাই আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করে ও সমগ্র জনগণকে সাথে নিয়ে এগিয়ে চলে।

 

কার্ল মার্কস তাঁর পরিণত বয়সে যে প্রকল্পকে দাঁড় করিয়েছিলেন, যার প্রভাবে তাঁর মৃত্যুর পঞ্চাশ বছরের মধ্যেই প্রায় অর্ধেক বিশ্ব প্রভাবিত হয়েছিলো, তাঁর সেই প্রকল্পের প্রাথমিক পরিচয় দৃঢ়তার সাথে জর্মান ভাবাদর্শে উপস্থাপিত হয়েছে। গ্রন্থখানির মধ্যে তাঁর প্রবণতাগুলো কেমন ছিলো, তার পরিচয় দেয়ার চেষ্টা করা হলো। শেষে তাঁর উদ্দেশ্য ও অভিযাত্রা কোন দিকে, তা বোঝার জন্য, এই গ্রন্থে উল্লিখিত তাঁর একটি মন্তব্যের মধ্যদিয়েই আলোচনা শেষ করছি—

আগের সব আন্দোলন থেকে কমিউনিজম আলাদা কারণ, এটা পূর্বের উৎপাদন ও বিনিময় সম্পর্কের সমস্ত ভিত্তি উপড়ে ফেলে এবং প্রথমবারের মত সচেতনভাবে সব প্রাকৃতিক পাটাতনকে এপর্যন্ত বিদ্যমান মানুষের সৃষ্টি বলে আমল দেয়, এর প্রাকৃতিক চরিত্র উন্মোচন করে দেখায় ও একতাবদ্ধ ব্যক্তির ক্ষমতার অধীন করে। (পৃ. ১৯০)

সহায়ক গ্রন্থ

কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস (২০০৯)। জর্মান ভাবাদর্শ (গৌতম দাস অনূদিত)। আগামী প্রকাশনী, ঢাকা।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here