‘পপুলার কালচার’ বা ‘জনপ্রিয় সংস্কৃতি’ শব্দটির সঙ্গে আমাদের পরিচয় থাকলেও তার ধারণা বেশির ভাগের ক্ষেত্রেই ভাসা ভাসা। পপুলার কালচারের চেয়ে ‘পপ কালচার (Pop Culture)’ শব্দটির সঙ্গে আমাদের পরিচিতি বেশি। পপুলার কালচার হোক কিংবা পপ কালচার, জনপ্রিয় সংস্কৃতি একটি সময়কে কীভাবে ধারণ এবং নিয়ন্ত্রণ করে সে ব্যাপারে কিঞ্চিত কথা বলাই আমার লেখার মূল লক্ষ্য।
‘জনপ্রিয় সংস্কৃতি’ শব্দটির উদ্ভব ঊনবিংশ শতাব্দী বা তারও আগে। জনপ্রিয় সংস্কৃতি Popular culture/ pop culture বলতে সেই সমস্ত সাংস্কৃতিক উপাদানের সমষ্টিকে বোঝায় যেগুলো বিভিন্ন জনপ্রিয় গণমাধ্যম, সমাজে বহুল প্রচলিত ভাষা ও লোকাচারে আধিপত্য বিস্তার করে। একটি নির্দিষ্ট সময়ব্যাপী সাংস্কৃতিক উপাদানগুলো সমাজে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে ব্যাপক ভূমিকা রাখে এবং চিত্তকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের প্রতিদিনকার জীবনের নানা চাহিদা ও মিথষ্ক্রিয়ার ফলে সৃষ্ট সাংস্কৃতিক মুহূর্তগুলো সংঘবদ্ধ হয়ে মূলধারার লোকজনের দৈনন্দিন জীবনের প্রকৃতি নির্ধারণ করে। জীবনের প্রাত্যহিক কাজকর্ম, যেমন : রান্নাবান্না, কাপড় চোপড়, গণমাধ্যম, বিনোদন, খেলাধুলা, সাহিত্য ইত্যাদিতে জনসংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটে।
স্টোরে দাবি করেন শিল্পবিপ্লবের ফলে বিশ্বজুড়ে নগরায়নের সৃষ্টি হয়েছে এবং তারই হাত ধরে জনপ্রিয় সংস্কৃতির উদ্ভব হয়েছে। শেক্সপিয়রের রচনা নিয়ে চালানো গবেষণা, রেঁনেসার জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে অংশগ্রহণের কারণে তার নাটকের অধিকাংশ গুণগত প্রাণবন্ততা চিহ্নিত করে। কিন্তু সমসাময়িক গবেষক যেমন : ডারিও ফো ও জন ম্যাকগ্রাথ জনপ্রিয় সংস্কৃতিকে গ্রেসামীয় তত্ত্বের (Bad money drives out the good) আলোকে ব্যবহার করেন যাতে প্রাচীন লোক ঐতিহ্যকে জনপ্রিয় সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত করে। পপুলার কালচার নিয়ে অনেকে বলে থাকেন, সমাজের ‘হাই সোসাইটি’ বা এলিট শ্রেণীর লোকেরা এবং অভিজাতরা সমাজে তাদের চেয়ে অধস্তনদের নিয়ন্ত্রণের জন্য জনপ্রিয় সংস্কৃতিকে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। এ কথাও বলা হয়ে থাকে যে, পপ কালচার “সাধারণ মানুষদের” মনকে সংকীর্ণ করে তোলে, তাদের আরো নিষ্ক্রিয় এবং সহজে নিয়ন্ত্রণযোগ্য করে দেয়। জনপ্রিয় সংস্কৃতির প্রকৃত সংজ্ঞা নিয়ে যত বিতর্কই হোক না কেন একটা বিশাল জনগোষ্ঠীর মাঝে এর শক্তিশালী প্রভাবকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই।
ফেসবুক সৃষ্টি হয়েছে ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’ খেলার রঙ্গমঞ্চে। যেহেতু ফেসবুক বিশাল জনগোষ্ঠীর মনোভাবকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম তাই পপ কালচারের নিয়ত্তা হয়ে গেছে ‘মিম (Meme Culture) কালচার’।
বাংলাদেশে ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ার আগে মানুষের পপ কালচার এর প্রধান আধেয় ছিল টেলিভিশন, নাটক, সিনেমা, রিয়্যালিটি শো, খেলাধুলা ইত্যাদি। আকাশ সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আগে এদেশের মানুষ বাংলাদেশি নাটক, সিনেমা, সংগীতের প্রতি প্রবল আগ্রহী ছিল, যার ফলে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত বাংলাদেশের বিনোদন জগতে মানসম্মত ‘শিল্প এবং শিল্পী’ উভয়ের সাক্ষাৎই মেলে এবং তা এদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে খুব উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। তবে আকাশ সংস্কৃতির আগমনের ফলে এদেশের মানুষ বাইরের দেশ, বিশেষ করে ভারতের সিরিয়ালের প্রতি অতি মাত্রায় ঝুঁকে পড়ে। এই ঝুঁকে পড়ার মাত্রা ইন্টারনেটের কল্যাণে কিছুটা কমে এলেও এদেশের মানুষ কোন পপ কালচারের দিকে আকৃষ্ট হয়ে আছে সেদিকে নজর দেয়া প্রয়োজন। ইন্টারনেট আসার পর এদেশের এক ঝাঁক তরুণ ইউটিউবে বিভিন্ন কনটেন্ট নির্মাণের মাধ্যমে দেশের বিনোদন জগতে এক নতুন যুগের সূচনা করে। এদের মধ্যে সালমান মুকতাদির, আয়মান সাদিকসহ আরও অনেকের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। প্রযুক্তির কল্যাণে পশ্চিমা দেশগুলোর সংস্কৃতির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করার সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় মানুষ অন্য সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে পড়ার যে প্রবণতা দেখা গিয়েছিল তার চেয়েও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এবং দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, নির্মাতা কিংবা প্রযোজকেরা নাটক/সিনেমার মানের চেয়ে বাণিজ্যিক দিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
এক্ষেত্রে প্রশ্ন আসতে পারে, কেন তারা দর্শককে নিজেদের দিকে আকৃষ্ট করার বদলে বাণিজ্যের দিকে বেশি ঝুঁকে আছে? বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া বেশ কঠিন। কেননা, বিনোদন জগত থেকে শুরু করে রাজনীতি কোনো ক্ষেত্রেই আর তথ্যের প্রবাহ একমুখী নয় — সোশাল মিডিয়ার কল্যাণে। দর্শক এখন চাইলেই যেকোনো ব্যাপারে তার মতামত কমেন্ট করে জানিয়ে দিতে পারে। ‘পাবলিক পালস’ বলে একটা কথা আছে যা বুঝতে নির্মাতাকে এখন আর কালঘাম ছোটাতে হয় না। কেউ চাইলেই জনগণের চাহিদা ধরতে পারে। তবে জনপ্রিয় সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ‘অগভীর, ভোগবাদী, গণ উত্তেজনাকর বা দূষিত’ বলে যে অভিযোগ আনা হয় তার সত্যতা কতখানি তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাকালে ভাবনার উদ্রেক করে বৈকি।
বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া হচ্ছে ফেসবুক। এদেশে ফেসবুক ব্যবহারে এখনো কোন নির্দিষ্ট বয়সসীমা বা বিধিনিষেধ জারি নেই বলে স্বেচ্ছাচারিতার চিত্র একটু ভালো করে চোখ বুলালেই ধরতে পারা যায়। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয় থেকে শুরু করে বৃহৎ কোনো গোলযোগ সবকিছু নিয়েই কৌতুক করা, খেলো করে দেখানো কিংবা ফেসবুক পোস্ট বা কমেন্ট করার মাধ্যমে নৈরাজ্য সৃষ্টি করার মনোভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে তরুণ সমাজে। বর্তমানে এটি পপ কালচারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য নির্ধারিত হয়েছে। ফেসবুক সৃষ্টি হয়েছে ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’ খেলার রঙ্গমঞ্চে। যেহেতু ফেসবুক বিশাল জনগোষ্ঠীর মনোভাবকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম তাই পপ কালচারের নিয়ত্তা হয়ে গেছে ‘মিম (Meme Culture) কালচার’।
বিনোদন জগতের নির্মাতারাও বাণিজ্যিক লাভের উদ্দেশ্যে সোশাল মিডিয়ায় জনপ্রিয় মুখদের নাটক, সিনেমা এমনকি সংগীত জগতে সুযোগ সৃষ্টি করে দিচ্ছে। কিছুদিন আগে টিকটকে ব্যাপকভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করা ‘অপু ভাই’ কে সিনেমায় অভিনয় করানোর গুঞ্জন শোনা গেছে। যা ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মধ্যে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। এক্ষেত্রে দোষের কিছু নেই যদি কোনো প্রতিভা তার সঠিক স্থানে পৌঁছে যাওয়ার সুযোগ পায়। তবে নিশ্চিত করতে হবে গ্রেসামের সূত্র ‘Bad money drives out the good’ প্রতিষ্ঠিত হতে কেউ উৎসাহ প্রদান না করে। যেন শুধু জনপ্রিয়তার দোহাই দিয়ে প্রতিভাবান মানুষদের প্রতি অমনোযোগী থাকা না হয়।
কিছুদিন আগেও কোনো সুরকার যদি অনুমতি ব্যতীত অন্য কারো সুর বসিয়ে দিতো, তবে সেই ব্যক্তি কপিরাইট আইনে মামলা করতে পারতো। এক সময়ের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী বেবি নাজনীনের একটি গানের সুর বলিউডের ‘টুইস্ট’ নামের একটি গানে হুবহু নকল করার কারণে সুরকারের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান যুগে গান ‘কভার’ করার নাম দিয়ে প্রকৃত গানের চরম বিকৃতিও যেন হালের ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। নেগেটিভ পাবলিসিটিই যেন শিল্প-সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার অন্যতম হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।
কোনো গান হিট হতে না হতেই সোশ্যাল মিডিয়ার অতি পরিচিত মুখ ‘হিরো আলম’কে গানের কভার করতে দেখা যায়। হোক তা বাংলা কিংবা আরবি অথবা সিংহলি ভাষার গান। আর এই গান কয়েকদিন জুড়েই ফেসবুকে ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কৌতুক আকারে। হিরো আলমের এই ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা, ফ্যান-ফলোয়ার এর একটি বৃহৎ সংখ্যাই তার গান অথবা অভিনয়কে কৌতুক করতে তার ফলোয়ার লিস্টে থাকে। এটি শুধু হিরো আলম নয়,বেশিরভাগ সেলিব্রিটির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। দর্শকগোষ্ঠীর একটা বিরাট অংশ যে কতটা অসুস্থ মানসিকতা ধারণ করে আছে তা পাবলিক কমেন্ট পড়লেই বোঝা যায়।
আমরা কাউকে মজা করার উদ্দেশ্য নিয়ে তাকে জনপ্রিয় করে তুলছি কিন্তু আদতে সেখানে আমাদের কোনো লাভ হচ্ছে না। বরং ক্ষতি হচ্ছে সেইসব প্রতিভার যারা এইসব অসুস্থ কৌতুকের ভিড়ে লাইমলাইটে আসতে পারছে না।
আমাদের এই কৌতুক করার অহেতুক প্রবণতা, সোশাল মিডিয়া জুড়ে বিদ্বেষ ছড়ানোর মানসিকতা পপুলার কালচারের অংশ হয়ে গেছে। আর এই সংস্কৃতি কতটা ভয়ংকরভাবে আমাদের মেধা ও মননকে নিয়ন্ত্রণ করছে সে ব্যাপারেও আমাদের মনযোগ নেই। জনপ্রিয় সংস্কৃতির এই দিকটি কতদিন স্থায়ী হবে জানিনা তবে নেতিবাচক মনোভাবকে উৎসাহ দেওয়ার মূল্য অনেকদিন ধরে পোহাতে হবে তা বলাই বাহুল্য।
তাই সোশাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের স্বেচ্ছাচারিতা, শঠতা এবং আগ্রাসী মনোভাব স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থেকে শুরু করে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে ভূমিকা রাখছে কিনা তা ভেবে দেখবার এবং প্রয়োজনবোধে আইন প্রণয়ন করার সময় এসে গেছে বলে আমি মনে করি।