মুহাম্মদ শফিকুল ইসলাম কবি, অনুবাদক, গবেষক এবং ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক। মূলত ইংরেজিতে লিখে থাকেন। বিশ্বখ্যাত বিভিন্ন গবেষণা-পত্রিকায় তাঁর প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সহজিয়ার জন্য তিনি লিখবেন গবেষণা বিষয়ক ধারাবাহিক গদ্য। আজ প্রকাশিত হলো লেখাটির পঞ্চম পর্ব।
গত পর্বে বলেছিলাম আজ গবেষণার জন্য দক্ষতা বিষয়ে কথা বলব, কিন্তু একজন গবেষকের গুণাবলি বিষয়ে আরও কিছু কথা বলা প্রয়োজন বলে মনে করছি। তাই এখন সে বিষয়ে আরও কিছু কথা বলছি। গবেষকের গুণাবলির মধ্যে কৌতূহলী হওয়া গুরুত্বপূর্ণ কাজ। একজন গবেষকের মন কৌতূহলপ্রবণ হতে হবে। যে বিষয় নিয়ে গবেষণা করছেন সে বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করার জন্য তীব্র কৌতূহল থাকতে হবে। নতুন নতুন বিষয় জানার বা আবিষ্কার করার আগ্রহ থাকতে হবে। কৌতূহল বা আগ্রহের জায়গা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কৌতূহলের পাশাপাশি অনুসন্ধান করে যেতে হবে। অনুসন্ধিৎসু মন গবেষণার জন্য সহায়ক শুধু নয়, অত্যন্ত দরকারিও। গবেষণার ক্ষেত্রে কৌতূহল এবং অনুসন্ধিৎসা পাশাপাশি বা সমানতালে চলে। এ দুই গুণের সমন্বয়ে নতুন ভাবনা বা চিন্তার উদ্রেক হয়। আর তা হলেই কেবল সাহিত্যের গবেষণায় নতুন বিশ্লেষণ দাঁড় করানো সম্ভব হয়।
সাহিত্যের গবেষণা ঠিক এরকমই। আমি আগেই বলেছি এটা একটা বৌদ্ধিক চর্চাও। সুতরাং এর জন্য এক ধরনের বিশেষ মানসিক উৎকর্ষের প্রয়োজন রয়েছে বিশেষভাবে মনকে ‘কাল্টিভেট’ করতে হবে। ঈসথেটিক মন ও চিন্তা সাহিত্যের গবেষণার জন্য বিশেষ প্রয়োজন। কৌতূহল ও অনুসন্ধানের জায়গাটাও ঈসথেটিক্স-এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কৌতূহল ও অনুসন্ধিৎসা আপনাকে বসে থাকতে দিবে না। স্বাভাবিকভাবেই আপনি কিছু খুঁজতে থাকবেন এবং নতুন চিন্তা আসার সাথে সাথে তা নিয়ে ভাবতে শুরু করবেন। সব ঠিক থাকলে অবশেষে তা গবেষণায় রূপ নেয়ার সম্ভাবনা থাকে।
একজন গবেষককে ‘ইন্টেলেকচুয়ালি ডিসিপ্লিনড’ হতে হবে। সেটা কেমন? যেমন ধরুন আপনার সামনে বিশেষ কোন প্রাপ্তি অপেক্ষা করছে এবং গবেষণা না করলে বা প্রকাশনা না থাকলে আপনি তা অর্জন করতে পারবেন না। সেক্ষেত্রে তড়িঘড়ি করে কিছু একটা লিখে কোথাও প্রকাশ করলেন। গবেষণা এত সহজ কাজ নয়; কিংবা এরকম তড়িঘড়ি করে করার মত কোন কাজ নয়। এটা একটা মহৎ কাজ। যাহোক বলছিলাম ‘ইন্টেলেকচুয়াল ডিসিপ্লিন’ এর কথা। জ্ঞানের জগত বিশাল, আর সেখানে বিন্দু বিন্দু বিষয়গুলো আলাদা করতে হবে। সেটা করতে গিয়ে মনস্থির করতে হবে কোন একটা বিশেষ ছোট্ট বিষয়ে। গবেষণার বিষয়কে ‘ন্যারো ডাউন’ করতে হবে। এটাতো প্রায়ই বলা হয়ে থাকে, যে বিষয় আপনি সামাল দিতে পারবেন না তার অবতারণা আপনার গবেষণার জন্য ক্ষতিকর।
যে বিষয় নিয়ে গবেষণা করছেন সেখানে ‘ফোকাসড’ থাকতে হবে। আর তার জন্য আপনাকে ‘ইন্টেলেকচুয়ালি ডিসিপ্লিনড’ হওয়া ছাড়া উপায় নেই। ‘ইন্টেলেকচুয়াল ডিসিপ্লিন’ ব্যাখ্যা করা সম্ভবত একটু কঠিন, কারণ এটা সেলফ ডিফাইন্ড। আমি সহজভাবে যা বুঝি তা হলো একজন গবেষক হিসেবে আপনার অন্তর্জগতকে গুছিয়ে নিতে হবে। বৌদ্ধিক চর্চায় আপনার অবস্থান স্থির, শান্ত ও পরিপাটি হওয়া প্রয়োজন। আপনার চিন্তার জগত স্বচ্ছ হতে হবে। আর উদ্দেশ্য হতে হবে পরিস্কার। এক কথায় আপনাকে ভাবতে হবে আপনি একটি ‘সিরিয়াস’ এবং মানব সমাজের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন, যার জন্য আপনি মানসিকভাবে পুরোপুরি প্রস্তুত। এক্ষেত্রে যুক্তি দিয়ে, কোনভাবেই ইমোশন দিয়ে নয়, আপনার বিশ্লেষণ উপস্থাপন করবেন। মনে রাখবেন গবেষক হিসেবে আপনি ‘র্যাশনাল’, কোনভাবেই ‘ইমোশনাল’ নন।
‘ইম্যাজিনেইশন’ ও ‘ইন্টেলেক্ট’-এর রসয়ান ঘটিয়ে, ‘ইমোশন’ নিয়ন্ত্রণ করে, ‘লজিক’ বা ‘রিজন’ দিয়ে বিশেষ পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে আপনার বক্তব্য বা বিশ্লেষণ উপস্থাপন করাই হচ্ছে গবেষণা।
গবেষণার জন্য আরেকটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো কল্পনা, যেটাকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘ইম্যাজিনেইশন’। আপনার কল্পনা শক্তি যত প্রখর আপনি তত ভালো গবেষক হয়ে উঠতে পারবেন। এখানে একটা বিষয় পরিষ্কার করা দরকার, আর তা হলো, সাধারণত ‘ক্রিয়েটিভ’ লেখালেখির ক্ষেত্রে ‘ইম্যাজিনেইশন-এর বিষয় বেশি আলোচিত হয়। অনেকে মনে করে থাকেন কল্পনা আর ক্রিয়েটিভ লেখালেখি অঙ্গাঅঙ্গীভাবে সম্পর্কযুক্ত। গবেষণার সাথে এর সম্পর্ক নেই। কিন্তু কথাটা ঠিক নয়। আমরা নিশ্চয়ই জানি আইনস্টাইন কী বলেছেন। “ইমাজিনেইশন ইজ মো(র) পাওয়ারফুল দ্যান নলেজ”। এ বক্তব্যটি সাহিত্যচর্চার জন্য যেমন প্রয়োজন, গবেষণার জন্যও ঠিক তেমনি। অর্থাৎ কল্পনা শক্তি আপনাকে ভালো কিছু আবিষ্কার করতে সাহায্য করে থাকে। এখানে বলে রাখছি, পরবর্তী কোন একটি পর্বে ‘ক্রিয়েটিভ রাইটিং’ ও ‘রিসার্চ’ এর সম্পর্ক, পার্থক্য, এবং এ দু’য়ের সমন্বয় বিষয়ে বিস্তারিত লিখব। কারণ এ দুই বিষয়ের সম্পর্ক নিয়ে অনেকের মধ্যে আগ্রহ রয়েছে, এবং বিষয়টি আলোচনার দাবি রাখে।
‘ইম্যাজিনেইশন’ এবং ‘ইন্টেলেক্ট’ এর সংমিশ্রণে নতুন কিছু সৃষ্টি হয়। একটার অনুপস্থিতি আরেকটাকে অচল করে দেয়। কল্পনাশক্তি ছাড়া আপনার ধীশক্তি ম্রিয়মাণ। সাহিত্যচর্চায় কল্পনা কখনো কখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। তারপরও ক্রিয়েটিভ রাইটিং-এ ইম্যাজিনেইশন কন্ট্রোল করা হয়। “spontaneous overflow of powerful feelings”-এর কথা আমরা কে না জানি। তারপরও কবিতা বা গল্প বা উপন্যাসের ক্ষেত্রে কল্পনা নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। তা না হলে উৎকৃষ্ট কিছু হয় না। আর গবেষণার জায়গায় নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি আরও ব্যাপক ও গুরুত্বপূর্ণ। কোন কিছু কল্পনা করেই আপনি কোন ‘আইডিয়া’ বা চিন্তার সূত্রপাত করে থাকেন। গবেষণার জন্য ‘হাইপোথিসিস’ দাঁড় করাতে হয়, আর এর জন্য যা দরকার তা কল্পনা। এর পরেই একজন গবেষক অগ্রসর হতে থাকেন ঐ ‘আইডিয়া’ বা চিন্তা বিশ্লেষণ করার জন্য, বা তা সম্প্রসারণ করার জন্য। কিন্তু এ অবস্থায় আপনার চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজন হয়।
গবেষণার ক্ষেত্রে এ নিয়ন্ত্রণের কাজটি করে থাকে ‘লজিক’ বা ‘রিজন’। আগেই বলেছি, গবেষণায় ‘ইমোশন’-এর কোন জায়গা নেই। আপনাকে ‘লজিক’ বা ‘রিজন’ দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। ‘ইম্যাজিনেইশন’ ও ‘ইন্টেলেক্ট’ এর রসয়ান ঘটিয়ে, ‘ইমোশন’ নিয়ন্ত্রণ করে, ‘লজিক’ বা ‘রিজন’ দিয়ে বিশেষ পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে আপনার বক্তব্য বা বিশ্লেষণ উপস্থাপন করাই হচ্ছে গবেষণা। আর এক্ষেত্রে প্রাইমারি ডেইটা আর সেকেন্ডারি ডেইটা বুঝতে হবে, সঠিকভাবে তা ব্যবহার করতে হবে। প্রাসঙ্গিকভাবে ক্রিটিক্যাল লেখা সাইট করতে হবে। আর থিউরেটিক্যাল ফ্রেইমওয়ার্ক তো আছেই। এসব নিয়ে আলাদা করে বলব। যাহোক, চিন্তা করে দেখুন এত সবের জন্য কি রকম প্রস্তুতি দরকার, কেমন পরিবেশ দরকার, কেমন সংখ্যক রিসোর্স দরকার, সর্বোপরি কী রকম ত্যাগ করার মানসিকতা প্রয়োজন। আবারো বলছি সদিচ্ছা, গবেষণার প্রতি ভালোবাসা, আর পরিশ্রম করার জন্য প্রস্তুত থাকলে ভালো গবেষণা করা অসম্ভব নয়।
গবেষণার এ সংজ্ঞার্থটি আমি চিন্তা করে বের করলাম। তাই এটি দ্বিতীয়বার লিখে এ পর্বটি এখানে শেষ করছি : ‘ইম্যাজিনেইশন’ ও ‘ইন্টেলেক্ট’-এর রসয়ান ঘটিয়ে, ‘ইমোশন’ নিয়ন্ত্রণ করে, ‘লজিক’ বা ‘রিজন’ দিয়ে বিশেষ পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে আপনার বক্তব্য বা বিশ্লেষণ উপস্থাপন করাই হচ্ছে গবেষণা।
(চলবে)
পড়ুন ।। কিস্তি ৪
কোন বিষয়ের ব্যাখ্যায় অতিকথন কিছুটা হলেও বর্জন বাঞ্ছনীয়।
আর ‘ক্রিয়েটিভ রাইটিং’ ও ‘রিসার্চ’ এর সম্পর্ক, পার্থক্য, এবং এ দু’য়ের সমন্বয় বিষয়ে লেখা পড়ার অপেক্ষায়।
পড়ছি; গবেষণা সম্পর্কে সন্দেহ, অজ্ঞাত পিছুটান দূরে সরে যাচ্ছে। সব থেকে মজার ব্যাপার হচ্ছে– জীবনে কোনদিন গবেষণা না করেও, ‘গবেষণা’ নিয়ে মনে মনে একটা গবেষণা করে যাচ্ছি।
আমার গরু হারায় নি। কিন্তু, গরুর চোখ হারিয়েছে। অনুসন্ধান চলেছে ঝকঝকাঝক ট্রেনের মতো; গবাক্ষ কি করে জানালার চৌকাঠে গিয়ে তালেকাঠের গরাদ কিম্বা ইস্পাতের ব্যাকা ব্যাকা ফুল হয়ে গেল! তার রূপ তো গরুর চোখের মতো হবার কথা ছিলো।
গবেষণার গরু আর গবাক্ষের অক্ষি / বাড়া ভাতে খুজে মরি উড়ন্ত মক্ষী।
মূর্খ গবেষক আমি।