মুজিব ইরমের কবিতা

স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন নব্বই দশকের কবি মুজিব ইরম। দেশজ ঐতিহ্য, বিষয়, ভাববস্তু ও কলাকৌশলের সাধনায় তিনি পৌঁছে গেছেন দৃষ্টিগ্রাহ্য অবস্থানে। সহজিয়ার পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো মুজিব ইরমের একগুচ্ছ কবিতা।

শব্দভাব

কেটেছে ভঙ্গিমা করি কতোটা না কাল!

ভেজালে ভেজালে গেলো জীবন যৈবন। এতো ভঙ্গি, এতোটা ছলনা, তবু এসে ভঙ্গি করি দাঁড়ায় জীবন। আমি তার কটাক্ষ বুঝি না। আমি তার ইশারা বুঝি না!

তুমিও ভঙ্গিমা করি ধরে রেখো হাত। আমি যেনো রঙ্গেঢঙ্গে সময় কাটাই। আমি যেনো রাধাবনে জীবন কানাই। তুমিও ডাকিও ঘোর বৃন্দাবনে রাই। আমি যেনো ভঙ্গি করি বাঁশুরি বাজাই। আমি যেনো কান্না রাগে শব্দ শব্দ গাই।

কেটেছে ভঙ্গিমা করি কতোটা না কাল! শব্দরঙ্গে হৈলা বুঝি ইরম বেহাল!

 

গাছ

আমায় তুমি নিয়ে যেও সেই হাওরে, যে হাওরের মধ্যিখানে গাছ দাঁড়িয়ে থাকে, আর কিছু নয় নাম না-জানা একটি মাত্র গাছ, খুব একাকী, ফুল ধরে না ফল ধরে না, ঝাকড়া মাথায়, সগৌরবে, সব ঋতুতে দাঁড়িয়ে থাকে একা, বর্ষা এলে জলের হাওর সাগর হয়ে ওঠে, সেই সাগরে গাছটি শুধু ডাল উঁচিয়ে থাকে, জলের মাঝে ভাসতে থাকে যেনো সবুজ টিলা, যেনো বা সে জলের রাখাল, জল পাহারায় জলের আদি পিতা, জল পালালে ফসল ভরা মাঠে, গাছটি তবু লম্বা মাথা ছড়িয়ে পড়ে থাকে, ফসল কাটা হলে সেই একাকী গাছ শূন্য মাঠের মাঝে সকাল বিকাল হাওয়ার সাথে কান্না ফেরি করে, শীতে-বর্ষায় খরায়-বন্যায় দিনের পরে দিন দাঁড়িয়ে থাকে একা, তেরসা সবুজ পাতা আগলে ধরে বুকে, কী অচেনা সুখে, কিংবা দুখে ক্ষোভে, তেপান্তরের মাঝে…

আমায় তুমি নিয়ে যেও সেই হাওরে, অচিন গাছের কাছে, আর কিছু নয়, সেই গাছটির সাথে খুব নিরলে খুব গোপনে আমার কিছু কথা আছে।

 

উত্তর পাড়া

এই বার যাবো আমি উত্তর পাড়ায়।

দক্ষিণে পশ্চিমে পুবে কোনো দিকে নয়। উত্তরেই যাবো। উত্তর পাড়ায় তুমি থাকো কি থাকো না, ভাবি না তো আর। আমাকে কেবলি ডাকে উত্তরের পথ। ফাড়ি পথ। কাদামাটি পায়ে মেখে, বাঁশের হাকম পাড়ি দিয়ে, কারো বা উঠান, কারো বা পুকুর পাড়, কারো বা ঘরের বাজু ছুঁয়ে দিয়ে, ধানজমির আইল ঘেঁষে, ভাঙ্গা পথ ভাঙ্গা পুল লাফ দিয়ে, মাড়িয়ে সবুজ ঘাস, পাকুড় গাছের তল, ছায়ায় মায়ায়, জল ভেঙ্গে, শিল্লি দিয়ে, গীত গেয়ে বেসুরো গলায়, বৃষ্টি বাদলা মাথায় নিয়ে, চৈত্র মাসী রোদে, ভাদ্রের তাতানো দিনে, কোনো এক চন্দনির রাতে, কুয়া ভেজা সকাল বেলায়, কার্তিক বিকালে, মাঘের সন্ধ্যায়, মালজোড়া গেয়ে, ধীর লয়ে, এ-বাড়ি ও-বাড়ি দিয়ে, উঁকি মেরে, বাবরি দুলিয়ে, জোড় মন্দিরের পাশ ঘেঁষে, মসজিদের রাস্তায় পুরান কবরে ঘুঘু ডাক শুনে শুনে, যে কোনো ঋতুতে, যে কোনো বেলায়, যাবোই এবার আমি যদি বেঁচে যাই।

জেনে রাখো, এই বার ঠিক ঠিক যাবো আমি উত্তর পাড়ায়। তোমার বাড়িতে। ঘরবন্দি দিনগুলি শেষ হলে পর।

 

বিপদকালীন কবিতা

কুমড়া ঝাড়ের হলুদ হলুদ ফুল, তুমি ফোটো আমার মনে…সবুজ সবুজ ধনিয়া ক্ষেতে সাদা সাদা ফুল, তুমি ফোটো আমার মনে…নামুক নামুক ঝিঙে ঝাড়ে কনে দেখা আলো, শেষ বিকেলের রোদ, ফুটুক ফুটুক উঠান জুড়ে হলুদ হলুদ ফুল, আমার মনটা ভালো হোক…ফুটুক ফুটুক হইলফা গাছে মন কাঁপানো ফুল, আমার মনটা ভালো হোক…এই ঘোর নিদানে পড়ছে মনে লাই সরিষার ফুল, কী আচানক জিরা ফুলে, চানা ফুলে উঠছে ভরে পড়শি নদীর কূল…শিম ঝাড়ের ওই লাল গোলাপি ফুল, শিম ঝাড়ের ওই সাদা সাদা ফুল, তুমি ফোটো সন্তর্পনে, আমার মনে মনে…নীল তিসি ফুল, রাঙা শাকের ক্ষেত, তোমায় পড়ছে মনে খুব…ঢেড়স ফুলের রঙ, বেগুন ফুলের ঢঙ, তোমায় পড়ছে মনে খুব…আনাজ ক্ষেতে, পেঁয়াজ ক্ষেতে মন ভোলানো ফুল, তুমি চোখের মাঝে ফোটো, তুমি মনের মাঝে ফোটো…এই ঘোর বিপদে মানুষগুলোর মনটা ভালো হোক, এই ঘোর বিপদে মানুষগুলোর মনে শান্তি হোক।

ও আমার শৈশবের ওই আনাজপাতি ফুল, তুমি মনের মাঝে ফোটো, এই মিনতি রাখো, রোগেশোকে একটু না হয় শুশ্রূষার রঙ মাখো।

আগের লেখামাল্যবানের আলো ও অন্ধকার
পরের লেখাসাহিত্যে গবেষণা ।। পর্ব ৫
মুজিব ইরম
মুজিব ইরম নব্বই দশকের বিখ্যাত কবি ও কথাসাহিত্যিক। পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে। মুজিব ইরমের কিছু বই : মুজিব ইরম ভনে শোনে কাব্যবান ১৯৯৬, ইরমকথা ১৯৯৯, ইরমকথার পরের কথা ২০০১, ইতা আমি লিখে রাখি ২০০৫, উত্তরবিরহচরিত ২০০৬, সাং নালিহুরী ২০০৭, শ্রী ২০০৮, আদিপুস্তক ২০১০, লালবই ২০১১, নির্ণয় ন জানি ২০১২; শিশুসাহিত্য : এক যে ছিলো শীত ও অন্যান্য গপ ১৯৯৯। উপন্যাস/আউটবই: বারকি ২০০৩, মায়াপির ২০০৪, বাগিচাবাজার ২০০৫।

1 COMMENT

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here