লেখা থেকে ছবি : পরিতোষ সেনের `জিন্দাবাহার’

পরিতোষ সেন (১৯১৮-২০০৮) চিত্রশিল্পী। ছবিই এঁকেছেন; খ্যাতিমান তো বটেই—দেশে, দেশের বাইরে। চল্লিশের ‘ভারতীয় আধুনিকতাবাদী চিত্রশিল্প-আন্দোলনের’ অন্যতম পথিকৃৎ তিনি। বিশেষ করে উনিশ শতকে ভারতীয় চিত্রশিল্পে যে ‘আধুনিকতার আবছায়া ভাব’ ছিল—তা বিবর্তিত এবং সম্পূর্ণ হয়ে ‘আধুনিকতাবাদী ধারায়’ রূপান্তরিত হলো এই চল্লিশের দশকে এসেই; সেক্ষেত্রে নানাভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন পরিতোষ সেন। এক্ষেত্রে নানান কারণে গুরুত্বপূর্ণ ‘ক্যালকাটা গ্রুপ’, যে গ্রুপের লোকজন এই কাজটা করেছেন : তাঁদের মধ্যেও গুরুত্বপূর্ণ তিনি। চিত্র-কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন পোস্টা-কিউবিস্ট ঘরানাকে। দেশে-বিদেশে—দুই ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন এবং আছেন। আসল কথা হলো এই যে, চিত্রশিল্পী হিসেবে পরিতোষ সেন খ্যাতিমান। কিন্তু লেখক পরিতোষ সেনের হিসেব সম্পূর্ণ ভিন্ন। শিল্প বিষয়ে তাঁর লেখাজোখা বেশ উঁচুমানের; নানান ভাষায় লেখাজোখা ও বই-পত্তর বের হয়েছে। সেসব যে কেউ একটু খোঁজ-খবর নিলেই পেয়ে যাবেন।

 

কিন্তু সেসব লেখা তো আর তাঁর জীবন-বাস্তবতার কথা বলে না। বলে একটা নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে; মানে শিল্প বিষয়ে। পরিতোষ সেন সম্পূর্ণ ভিন্ন মেজাজে, সুকৌশল আর ভিন্ন আমেজ-আবেশ-কায়দায় যে বই লিখেছেন—সেই বইয়ের নাম জিন্দাবাহার। একটা নির্দিষ্ট সময়কাল [১৯৩৭ পূর্ববর্তী] পুরোনো ঢাকায় তাঁর পারিবারিক জীবনযাপনের বিষয় নিয়ে, এবং এই জীবনযাপনের পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে তিনি লিখেছিলেন এই বই। নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ এই বই। যে কেউ এই বই পাঠ করে পেয়ে যেতে পারেন আদি ও অকৃত্রিম ‘দুলালের তালমিছরির’ মতো আদি এবং অকৃত্রিম পুরোনো ঢাকাকে। কারণ ঢাকার সেই আদিরূপ, যে রূপের ভিতরে হিন্দু মুসলমানের সমন্বিত নানান বিষয় ছিল, ছিল সাহেব-সুবা ব্যাপার, হিন্দু-মুসলমানের মিলিত সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের একটা জোরোলো সম্পৃক্তির বিষয় তো ছিলই—সেই ঢাকাকে পরিতোষ সেন তাঁর এই স্মৃতিকথায় উপস্থাপন করেছেন চমৎকারভাবে।

 

কিন্তু এই স্মৃতিকথা মানে পরিতোষ সেনের পুরো জীবনের স্মৃতিকথা নয়। এই স্মৃতিকথা তাঁর জীবনের একটা নির্দিষ্ট সময় ও সময়-বিষয় নিয়ে লিখিত। আর তা দেশভাগের আগে—মানে পুরোনো ঢাকা—তাঁর দেখা ঢাকা। যে সময় তিনি নিছকই বালক কেবল। কারণ, বালকত্ব পার হওয়ার পর তো পরিতোষ সেন আর থাকেননি পুরোনো ঢাকায়। চলে গেছেন ভারতে। সে বিষয়টাও গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ তা তাঁর শিল্পীজীবনের জন্য। বিশেষ করে দেশভাগ-পূর্ব ঢাকার যে আদি চিত্র তা যে কোনো ইতিহাস পুস্তকের চেয়ে বেশি সরবে আর পরিপূর্ণতায় এক খণ্ড ইতিহাসের মিছরিদানা হয়ে উঠেছে এই স্মৃতিকথায়। যে কেউ গালে দিলে মিছিরিদানার মতোই গলে যাবে; স্বাদটা লেগে থাকবে বহু দিন, মুখে।

 

দেশভাগের পর নানান রাজনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে ঢাকার রূপান্তরিত যে রূপ আজ দৃশ্যমান হয়, তা কিন্তু ঢাকার আদি ও অকৃত্রিম রূপ নয়। সেই মুঘল আমলে ঢাকাকে রেখে মুর্শিদাবাদকে রাজধানী করা এবং তারপর ইংরেজদের নানা বাণিজ্যিক তৎপরতায় নানানভাবে ক্ষমতা হারানো ঢাকাকে আসলে এখন আর দেখা যায় না। গগনচুম্বী স্কাইস্ক্র্যাপার আর আধুনিক নানা বিষয় আসলে সেই ‘পুরোনো ঢাকাকে’ খেয়ে ফেলেছে; খেয়ে ফেলেছে মানে পুরোটাই খেয়ে ফেলেছে। ফলে ‘ঢাকাইয়া’ ব্যাপারটা যে সমস্ত বিষয়াদির সাথে সম্পৃক্ত ছিল, তার টিকির নাগাল পাওয়া সম্ভব এখন আর হয় না—তা বহিরাঙ্গে যেমন সত্য, তেমন সত্য অন্তরঙ্গের নানা অনুষঙ্গেও। কারণ এখন ঢাকার আদি ভৌগোলিক সীমানায়ও আর ঢাকার আদি উপাদান খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়; বেশ দুষ্করই বটে। যা দুই এক টুকরো ইমারত টিকে আছে, তা আসলে পুরোনো ঢাকার এক মৃতপ্রায় কঙ্কালেরই রূপান্তরিত রূপ বলা যেতে পারে। কিন্তু এই ঢাকা আর ‘আগের ঢাকার’ মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। সেসব জানার জন্য তো মাধ্যমেরও দরকার হয়।

“চাচা, ঢাকা কতদূর? ঐ দেখা যায় সদরঘাট, সামনে নবাবপুর”—ঢাকার ভৌগোলিক-সীমানা সম্পর্কিত এই প্রবাদবাক্য আজ নানান কারণে অকার্যকর। কারণ পূর্বে মূল ঢাকা বলতে যা বোঝানো হতো, তা আর এখন কোনো কারণেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। এমনকি বিরিয়ানির জন্য বিখ্যাত পুরোনো ঢাকাও এখন চাইনিজ রেস্তেরায় ভরপুর; জৌলুস আসলে চাইনিজ রেস্তেরারই, বিরিয়ানির দোকানের নয়।

 

আসলে ওপরে যা বলা হলো তা একটা প্রস্তুতি; যে পাঠক পরিতোষ সেনের জিন্দাবাহার পাঠ করতে বসবেন, তার জন্য। কারণ পরিতোষ সেন এমন এক সময়ের ঢাকা নিয়ে লিখেছেন এই স্মৃতিকথা, যা এখনকার যেকারো কাছেই রূপকথার মতো ঠেকবে। এরও কারণ এই : “সময় দ্রুতই বহিয়া যায়।”; আর “ সকল কিছুই বদলায়, কিছুই না বদলায়া থাকিতে পারে না।” সময়ের এই ধাবমান রেলগাড়ির সাথে সাথে বদলে যাওয়া ঢাকার একটা নির্দিষ্ট সময়কালের নানান বিষয় নিয়ে এই স্মৃতিকথা লিখেছেন পরিতোষ সেন। তার সময়পর্ব আগেই বলা হয়েছে—বিশ এবং ত্রিশের দশকের ঢাকা। যে ঢাকা নানান কারণে গুরুত্ব হারালেও একটা ‘নতুন বিশ্ববিদ্যালয়প্রাপ্ত’ সাবার্বের নানান ক্রিয়া-কর্মের সুবাদে বেশ চাঙ্গা একটা ভাব না আসলেও পরিবর্তনের একটা আভাস তার মধ্যে ছিল। বলতে গেলে এর পুরোনেকালের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির নানা বিষয় তখনো বহাল তবিয়তেই টিকে ছিল। এটাই গুরুত্বপূর্ণ।

 

পুরোনো ঢাকার একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলের বাসিন্দা ছিলেন পরিতোষ সেন। অঞ্চলটা জিন্দাবাহার লেন। সেই অঞ্চলে লেখকের বেড়ে উঠার সময়কার নানান বিষয় এক করেছেন লেখক, এই স্মৃতিকথায়। বর্ণনা করেছেন নানান বিষয়, নানান ঢঙে। বিশেষ করে নানান শ্রেণির মানুষের বসবাস এবং বসবাসের সাথে সম্পর্কিত জীবনাচরণ এবং জীবনযাপনের নানান পদ্ধতি সম্পর্কে। যার ভিতরে রয়েছে দারুণ আবেগ আর অনুভূতি। ছেড়ে যাওয়া ভূমির প্রতি তীব্র এক অনুরাগ তাঁকে পীড়িত করেছিল নানান সময়ে, নিশ্চয়। সেই পীড়নের শিকার তিনি হয়েছিলেন, এবং তার জন্যই তাঁর স্মৃতিকথা তিনি সবিস্তারে—কোনো রাখঢাক না রেখেই—এক অদ্ভুত মায়া আর ভীষণ দরদের সাথে লিখেছেন। নস্টালজিয়া ভীষণভাবে কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে এই লেখার ক্ষেত্রে, তা পাঠকের পাঠাভিজ্ঞতাই বলে দিবে। কারণ এমন মমতা মাখানো নস্টালজিয়াই পারে কেবল এমন সত্যভাষণ-সহযোগে স্মৃতিকথা নির্মাণ করতে।

 

পরিতোষ সেন এই স্মৃতিকথা লেখার সময় গ্রন্থটির যে পর্ব-বিভাজন করেছেন, তা বেশ চটকদার। পাঠককে আগ্রহী করে তোলে বেশ। খাবারের মতো খাবারের সুঘ্রাণের ব্যাপারেও মানুষের আগ্রহ রয়েছে। তেমনি করে এই গ্রন্থের পর্ব-বিভাগ-শিরোনামও তাৎপর্যময়, আকর্ষণীয়। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো এই যে, পরিতোষ সেন এই গ্রন্থে নিজের স্মৃতিকথা লিখেছেন বটে—কেবলই একটি অংশে—বাদবাকি অংশে তিনি নিজ শৈশবে ও কৈশোরে দেখা, তাঁর স্মৃতি-অভিজ্ঞতায় ছিল এমন মানুষ এবং তাদের পারিপার্শ্বিক বিষয়াদি নিয়ে লিখেছেন। অনেকটা প্রায়োগিক সমাজবিদ্যার ছাত্রের মতো। কারণ, সাধারণত, স্মৃতিকথায় লেখকই প্রধান চরিত্র হয়ে অন্যান্য চরিত্রের সাথে কথা-বার্তা এবং কাজকর্মের বর্ণনা দিতে দিতে কাহিনিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যান। কিন্তু পরিতোষ সেন তা করেননি। তিনি এই গ্রন্থে যেন উপলক্ষ মাত্র, অনেকটা নাটকের সূত্রধারের মতো : কেবল কাহিনিটা শুরু করেই দে ছুট্। মূল অনুষ্ঠান শুরুর আগেই তিনি যেন কেটে পড়েন। মূল কথা-বার্তা বলতে থাকেন অন্যান্য চরিত্র, তবে সে কথা তিনিই বলেন বটে, তবে তা কেবল তা তাঁর বলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এছাড়া আর কিছু নয়।

 

আত্মস্মৃতি লেখার বেলায় নিজেকে দিয়েই শুরু করার একটা রেওয়াজ চালু আছে, মানে নিজের জন্মসন বা জন্ম-কাহিনি এইসব আরকি। কিন্তু পরিতোষ সেন তো তা করলেন না এই গ্রন্থে। তিনি শুরু করলেন ‘দর্জি হাফিজ মিঞা’ নামের অংশ দিয়ে। যেখানে তিনি এমন এক চরিত্র নিয়ে এলেন, যার বর্ণনা এবং পরিতোষ সেন অঙ্কিত চিত্র যে কাউকে একটু চিন্তায় ফেলে দিবে। আরব্য রজনীর সেই সিন্দাবাদের ঘাড়ে চেপে বসা বৃদ্ধের কথাই যেন পরিতোষ সেন আবার আামাদের স্মরণ করিয়ে দিলেন। হাফিজ মিঞাও সেই বৃদ্ধের মতো — শারীরিক দিক থেকে তো বটেই — এমনকি রাগ-টাগ করার বেলায়ও। কিন্তু এর পিছনে হয়তো যুক্তি একটা আছে। পরিতোষ সেন তো শিল্পী। সেই শিল্পীর যে বিকাশ এবং শিল্পী হওয়ার যে ইচ্ছে তা তো তিনি এই ‘হাফিজ মিঞাদের’ মতো সাধারণ—কিন্তু নানান কারণে অসাধারণ ব্যক্তিদের কাছেই পেয়েছিলেন, শৈশব ও কৈশোরে। যদিও তিনি পরে বিশ্বের বড়ো বড়ো আর্ট কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে পড়েছিলেন; তবে শুরুটা কিন্তু হয়েছিল এখান থেকেই। শৈশবের সেই বিমুগ্ধকারী শিল্পীকে হয়তোবা ভুলতে পারেননি পরিতোষ সেন। তাই প্রথমেই হাফিজ মিঞা, ‘দর্জি হাফিজ মিঞা’।

 

বিশেষ করে মাপজোখ বাদেই পোশাক বানানো এবং তা খরিদদারের গায়ের সাথে একেবারেই ফিট্ফাট্ লেগে যাওয়াটা যে শৈশবে এক দারুণ ঘোরের সৃষ্টি করেছিল পরিতোষ সেনের মনে, তা আর বলবার দরকার বোধ করছি না। কারণ পরিতোষ সেনের স্মৃতি এতো টাট্কা; তা ভেবে যে কেউ বিস্মিত হবেন। শৈশবে দেখার বিষয় বৃদ্ধত্বে এসে ধুমধাম করে রসিয়ে-কষিয়ে লিখে ফেলা এবং তাতে দারুণ সাফল্য অর্জন করা—এও এক চমৎকার ব্যাপারই বটে। এইসব স্মৃতি তাঁর শিল্পীজীবনেও বিশেষভাবে কাজে লেগেছিল। জাগরূক ছিল তাঁর চিন্তায়। স্পষ্ট হয় তাঁর আঁকাআঁকিতে। ফলে হাফিজ মিঞা কোনো বেখেয়ালের আগুন্তুক নয় এই স্মৃতিকথায়। হাফিজ মিঞা জরুরি লোক, তাঁর স্মৃতিতে, জীবনে।

 

‘সিন্-পেন্টার জিতেন গোঁসাই’ অংশের জিতেন গোঁসাই পরিতোষ সেনের শিল্পীজীবনে সবচেয়ে প্রভাবক ব্যক্তি হিসেবে সক্রিয় থেকেছে, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। শিল্পের প্রতি তাঁর যে আগ্রহ শৈশবেই সূচিত হয়েছিল—তার পিছনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে জিতেন গোঁসাইয়ের মতো শিল্পীরা। বিশেষ করে শিল্পীর জীবন-যাপনের যে ঢঙ, তা বোধকরি সেই শৈশবেই আয়ত্ত করেছিলেন পরিতোষ সেন, জিতেন গোঁসাইয়ের সহজ-সরল জীবনযাপনের প্রভাব-মাধ্যমে। বিশেষ করে কেবল শিল্পীর জীবনবোধ নয়, একজন সাধারণ মানুষের জীবনবোধ ও জীবনের মূল লক্ষ্য কী হওয়া উচিৎ—তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনাও পরিতোষ সেন দিয়েছেন এই অংশে। এক কথায় জিতেন গোঁসাই সম্পর্কে বলতে গিয়ে পরিতোষ সেন যখন লেখেন, “যে-লোক কর্মের মধ্যে তাঁর জীবনদর্শন খুঁজে পেয়েছেন, তাঁর সঙ্গী কিংবা আড্ডার প্রয়োজন কিসের! একাকিত্বের নিদারুণ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি ও প্রকৃত আনন্দের স্বাদও পেয়েছেন তিনি এরই ভেতর দিয়ে। জীবনের বৃহদংশই কেটেছে প্রবল সক্রিয়তায়, কর্মের প্রবল জোয়ারে।”

 

উদ্ধৃত অংশই জানিয়ে দেয় যে, কেমন ছিল জিতেন গোঁসাইয়ের জীবন ও জীবনদর্শন। এবং তা দ্বারা সেই শৈশবেই প্রভাবিত হয়েছিলেন পরিতোষ সেন। এমনকি এই প্রভাব বোধহয় আজীবন জীবনসঙ্গী করে নিয়েছিলেন। না হলে এতোদিন পরে এসে তিনি এর কথাই বলতে যাবেন কেন? আমরা তো তাদের কথাই মনে রাখি : যারা নানান কারণে প্রভাবিত করেছে, সাহায্য-সহযোগিতা করেছে, আনন্দ-বেদনার জন্য দায়ী ছিল আমাদের জীবনে—আদতে এদেরই আমরা শেষ পর্যন্ত মনে রাখি। পরিতোষ সেন এই কারণেই মনে রেখেছেন জিতেন গোঁসাইকে। কারণ শৈশবে যে বিমুগ্ধতা ছড়িয়ে দিতে সমর্থ হয়েছিল জিতেন গোঁসাই, পরিতোষ সেনের ওপর—তা নানান কারণে গুরুত্বপূর্ণ।

 

‘ডেন্টিস্ট আখ্তার মিঞা’ অংশের বর্ণনায় দারুণ হাস্য-রসের যোগান দিয়েছেন পরিতোষ সেন। আপাতদৃষ্টিতে এক ব্যর্থ মানুষের উপাখ্যান হিসেবে পাঠ করলেও বাস্তবে আখ্আর মিঞার গল্প বলার এক দারুণ ক্ষমতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন পরিতোষ সেন। এবং সেই মুগ্ধতার কথা তিনি ভুলে যে যাননি, তা বৃদ্ধ বয়সে লেখা স্মৃতিকথায় স্পষ্ট হয়েছে। বিশেষ করে আখ্তার মিঞার গল্প বলার যে অলৌকিক ক্ষমতা তাই বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছে লেখককে। আখ্তার মিঞার গল্প আপাতদৃষ্টিতে আজগুবি মনে হলেও এক গভীর আকাঙ্ক্ষিত জীবনের প্রতি দুর্মর আকাঙ্ক্ষারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এইসব গল্পের ভিতর দিয়ে। লেখকের জীবনের শৈশবের বড়ো একটা আনন্দ-সময় তিনি কাটিয়েছেন এই আখ্তার মিঞার গাল-গপ্পো শুনে। কিন্তু তার মধ্যে যে অপরিসীম আনন্দ উপভোগ করেছিলেন—তার নিখুঁত বর্ণনা পাওয়া যায় এই স্মৃতিকথায়। মানুষের বেঁচে থাকাটা—তা যেভাবে, যে পরিস্থিতিতেই হোক না কেন—যে আনন্দের ফল্গুধারার মতো হতে পারে তা, পরিতোষ সেন এই অংশে উপস্থাপন করেছেন।

পরের ভাইয়ের দুশ্চরিত্র নিয়ে লেখার সাহসও অনেক লেখকের লেখায় পাওয়া অসম্ভব; সেক্ষেত্রে পরিতোষ সেন এই বিষয়ই লিখে ফেলেন, নিজের ভাইদের নিয়ে! যা সত্যান্বেষীর সত্যভাষণই বটে।

‘প্রসন্নকুমার’ অংশে এক বজ্রকঠিন পিতার সবিস্তার বয়ান নির্মাণ করেছেন লেখক। বিশেষ করে রাশভারি পিতার নানা কর্মকাণ্ডের সবিস্তার কাহিনি বর্ণিত হয়েছে এই অংশে। পেশায় তিনি কবিরাজ; নাম তো পূর্বেই বলা হলো : প্রসন্নকুমার সেন। পরিতোষ সেনের পিতা তিনি। এক দারুণ বনেদিপনার ভাব তাকে যে সর্বদাই ছুঁয়ে যেতো—তা বলতে ভোলেননি পরিতোষ সেন। এ অংশে সাবার্ব-এর এলিট হিসেবে গণ্য হবেন প্রসন্নকুমার সেন। সেই এলিটদের ব্যক্তিগত জীবন ও পারিবারিক জীবনের চমৎকার বর্ণনা রয়েছে। বিশেষ করে এলিটদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বহিঃপ্রকাশে সম্পূর্ণ হয় এই অংশ। এর সাথে সম্পর্কিত হয়েছে জীবনাচরণের আরো নানাবিধ বিষয়।

 

‘আমি’ অংশ এলো বেশ পরে। নিজের অবস্থান জানান দেওয়ার আগে যেন প্রস্তুতিই ছিল পূর্বোক্ত অংশসমূহ। একটা পরিবেশ যেন পরিতোষ সেন নির্মাণ করে নেন। তারপর বলেন নিজের কথা। অন্যকে আর চারপাশকে বাদ দিয়ে যে নিজেকে নির্মাণ করা সম্ভব নয়, তা বেশ ভালো করেই যেন বুঝেছিলেন পরিতোষ সেন। তাই-ই হয়তো বা এইসকল প্রস্তুতি। ‘আমি’ মানে পরিতোষ সেন কীভাবে তাঁর শৈশব ও কৈশোরের কাল পার করছেন তার একটা বয়ান এই অংশে নির্মিত হয়েছে। যেখানে সব আছে, মানে সব—পুরোনো ঢাকার নবাব বাড়ি থেকে শাঁখারির দোকানের বর্ণনা পর্যন্ত। এই অংশের সূচনা হয়েছে নবাববাড়িতে গমনে, আর শেষ হয়েছে বেলতলী গ্রামে। গ্রাম আর সাবার্ব-এর সম্পূর্ণতায় তৎকালীন সমগ্র পূর্ব-বাংলার এক সম্পূর্ণ বয়ান নির্মিত হয়েছে। একদিকে আধা-শহুরে জীবন; বিপরীতে প্রাণ-প্রকৃতিতে ভরপুর নস্টালজিক গ্রাম—এই দুয়ে মিলে ব্যাপারটা পুরা হয়েছে। এই অংশেই শেষ পরিতোষের নিজ-বিষয় সম্পর্কের বয়ান।

 

‘আগুন’ অংশে পরিতোষ সেন যে বর্ণনা দেন, তা তাঁর গ্রাম-জীবনের আনন্দ আর দুঃখের মিলিত বয়ান। যে গ্রামের বাড়িতে পরিতোষ সেন আনন্দ উদযাপনের জন্য গিয়েছিলেন, সেই গ্রাম হতে প্রভূত পরিমাণ দুঃখ নিয়ে ফিরে আসেন সাবার্বে। পিতার মৃত্যুকেই তিনি বর্ণনা করেছেন আগুন হিসেবে। যা পরবর্তী কালে তাঁর পরিবারের ভাঙনের পিছনে নানাভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল। সম্পত্তির ভাগাভাগি, অন্তর্কোন্দল, ভাইদের বখে যাওয়ার মতো নানান কারণের পিছনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল পিতার মৃত্যু। এবং একজন পরিবার-প্রধানের মৃত্যু একটা পরিবারকে কীভাবে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়—তারও সবিস্তার বর্ণনা পরিতোষ সেন দিয়েছেন এই ‘আগুন’ অংশে। তাঁর বড়ো ভাইদের বখে যাওয়ার পিছনে পিতার মৃত্যু বড়ো কারণ হিসেবে বর্ণনা করছেন পরিতোষ সেন। যা তাঁর শৈশবের আনন্দযজ্ঞে আগুনের মতো এসে হানা দিয়ে সব পুড়িয়ে দিয়ে গেছে। সেই দুঃসহ স্মৃতি তিনি আজীবনেও ভুলতে পারেননি, তা তাঁর জীবন-পাঠেই স্পষ্ট হয়। এ বিষয়ে স্মর্তব্য যে, এই বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি প্রকৃতিকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এবং প্রকৃতির সহায়তায় এই অংশ বিশেষ হয়ে উঠেছে।

 

কলকাতায় উনিশ শতকের ‘বাবু সংস্কৃতি’ নিয়ে নানাজন লিখেছেন। সেই ‘বাবুদের’ অবাধ লাম্পট্য, জুয়াবাজি আর নেশার বিবরণ এই সমস্ত লেখাজোখায় পাওয়া যায়। নিজের ভাইদের এই ‘বাবুগিরি’ বিশদভাবে, স্যাটায়ার-সহযোগে পরিবেশন করেছেন পরিতোষ সেন, জিন্দাবাহারের ‘ন’বাবু, সেজোবাবু’ অংশে। পরের ভাইয়ের দুশ্চরিত্র নিয়ে লেখার সাহসও অনেক লেখকের লেখায় পাওয়া অসম্ভব; সেক্ষেত্রে পরিতোষ সেন এই বিষয়ই লিখে ফেলেন, নিজের ভাইদের নিয়ে! যা সত্যান্বেষীর সত্যভাষণই বটে। এই বিষয়ে পরিতোষ সেনের কোনো আক্ষেপ বা সংকোচ চোখে পড়ে না। এই অসংকোচ প্রকাশে পরিতোষ সেন দুরন্ত সাহসী। এবং এই বিষয়—মানে ভাইদের বখে যাওয়া—ঘটে যাওয়ার পিছনে পিতার মৃত্যু যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল, তাও বলতে ভুলে যান না।

‘আগুন’ অংশের যে সূচনা তিনি দেখেছিলেন তার ষোলকলা পূর্ণ যেন ভাইদের এই বাবুগিরিই নির্দেশ করে। লাম্পট্য জুয়াবাজি আর নেশার মধ্যেই যে তারা সীমাবদ্ধ ছিল, ব্যাপারটা তেমনও নয়। বিশেষ করে বিশ ও ত্রিশের দশকের স্বাধীনতা-সংগ্রামে ঢাকাকেন্দ্রিক যুবসমাজের যে অংশগ্রহণ, তার বিরুদ্ধে নিজ ভাইদের ‘মীরজাফরী কর্মকাণ্ডকেও’ বেশ ঘৃণার মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন পরিতোষ সেন। এবং এই ভ্রাতাদ্বয় কর্তৃক মাতার ক্রমাগত অপমান, এবং অন্যান্য ভাইবোনেদের তটস্থ থাকার বিষয়ও বিশেষভাবে ভাবিয়েছে পরিতোষ সেনকে। সে বিষয় যে কতোটা গভীরভাবে তাঁর চিন্তায় রেখাপাত করেছিল—তা তাঁর এই স্মৃতি-জাগরূকতায়ই প্রকাশ পায়। মানসিকভাবে নির্যাতনের শিকার যে কেবল তিনি নন; তাঁর মা এবং অন্যান্য ভাই-বোনও হয়েছিলেন—সে বিষয়েও সত্যভাষণ নির্মাণ করেছেন পরিতোষ সেন।

 

‘হে অর্জুন’ অংশে পরিতোষ সেনের প্রকৃতি ও মানব-চিন্তা একীভূত হয়েছে। দৃশ্যজগৎ আর অদৃশ্যজগৎ এক হয়েছে; এক হয়েছে জীব ও জড় জগৎ। একটা বিরোধের সমাধান করার চেষ্টায়ও চেষ্টিত থেকেছেন তিনি। বিশেষ করে একটা বৃহৎ অর্জুন বৃক্ষের মাধ্যমে মনুষ্য সমাজে বিদ্যমান শ্রেণি ব্যাপারটা যেভাবে তিনি প্রতিকায়িত করেছেন—তা এক কথায় অসাধারণ। এই যে প্রাণিজগতের শৃঙ্খলা, সেটাকেই তিনি ব্যবহার করেছেন মানুষের শ্রেণি-শৃঙ্খলার সাথে। বিশেষ করে এই পরিতোষ সেনের প্রকৃতিভাবনা এবং প্রকৃতি-ব্যবহারের বিষয় নিয়ে চিন্তার মূল্যবান সারাৎসার এই অংশ। তবে এমন প্রকৃতি আর এতো বড়ো অর্জুন বৃক্ষ কেন একটা অঞ্চলের প্রধান শহরে থাকলো, তা পরে আলোচনা হবে। এরও রয়েছে নানান কারণ। বিশেষ করে ‘হিন্টারল্যান্ডের প্রধান সাবার্ব’ বিষয়টা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ।

 

মনে রাখা জরুরি যে, প্রকৃতির ব্যবহারের মাধ্যমেই ‘সোশ্যাল স্ট্র্যাক্চারকে’ স্পষ্ট করেছেন পরিতোষ সেন। মানুষের সমাজে বিদ্যমান নানা অসঙ্গতি তিনি দেখিয়েছেন প্রকৃতি ব্যবহার করে। প্রকৃতি এখানে নিশ্চুপ, বোবা আর রোমান্টিক আবেগের সারাৎসার নয়; প্রকৃতি এখানে হরবোলা—কথা বলে প্রচুর; নানান বিষয়ে বেশ শক্তি নিয়ে। যেমন ‘আগুন’ অংশে বলেছেন পরিতোষ সেন, দেখা গেছে আগুনের বিধ্বংসি রূপটি।

 

সাধারণ মানুষের প্রতি ভালোবাসা একটা অন্য বিষয়। এই বিষয়ে কোনো তত্ত্ব-টত্ত্ব একেবারেই টেনে আনার দরকারবোধ করছি না। বিশেষ করে জিন্দাবাহারের ‘জমিলার মা’ অংশ পড়ার বেলায়। মনে রাখা জরুরি যে, সাম্প্রদায়িক সংঘাতের আগেই পরিতোষ সেন ঢাকা ছেড়েছেন, ১৯৩৭ সালে। তার আগের নানান কাহিনি নিয়েই লিখিত হয়েছে জিন্দাবাহার। ফলে জমিলার মা ঐ সময়কারই স্মৃতি-মানবী, যাকে পরিতোষ সেন তাঁর লেখায় স্থান দিচ্ছেন। যে কিনা পরিতোষ সেনের পরিবারে কাটিয়ে দিয়েছে প্রায় পঞ্চাশ বছর! এবং পরিতোষ সেনের পিতার আয়ুর্বেদ ডিসপেন্সারির গুরুত্বপূর্ণ মানবীও বটে। কারণ আয়ুর্বেদ ঔষধ তৈরির জন্য সবচেয়ে বেশি শ্রম যে জমিলার মা দিতো—তা লেখক স্পষ্টই জানিয়ে দেন।

 

কিন্তু এই ব্যাপারটার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, পরিতোষ সেনের কাছে, জমিলার মায়ের মাতৃসুলভ আচরণ। আর পরিতোষ সেন, এবং তাঁর অন্যান্য ভাই-বোনদের নানান বিষয়ে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার বিষয়টা। শৈশবের নানা মুখরোচক খাদ্য-খাবারের জোগানের ব্যাপারেও সচেষ্ট থেকেছে এই জমিলার মা-ই। ফলে শৈশব-স্মৃতি উল্লেখের সময় এই ‘ভাঙা কুলোর’ কথা বাদ দেওয়ার শক্তি হয়তো-বা পরিতোষ সেনের হয়নি। কারণ এই যে, নানা কারণে তাঁর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ স্মৃতিতে সক্রিয় জমিলার মা—তা পরিতোষ সেনের স্মৃতিচারণাই বলে দেয়। তবে এ বিষয়ে তাঁর পরিবারের সংকীর্ণতার ব্যাপারেও পরিতোষ সেন রাখঢাক রাখেননি। বিশদ না হলেও সংক্ষেপে সামান্য কয়েক কথায় বলেছেন, কী ব্যবহারটাই না সেন পরিবার করেছিল জমিলার মায়ের সাথে!

 

সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য কি মানুষ ভুলে যায়? আধুনিক হওয়ার পথে এসব মনে হয় মানুষ ডাস্টবিনে ফেলতে ফেলতে সামনে এগোয়। তা না হলে সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য কেন ক্রমাগত হারিয়ে যাচ্ছে? আর হারিয়ে গেলেও তার প্রতি কারো ভ্রূক্ষেপ নেই কেন? এ এক আজব ও জবর প্রশ্ন; কিন্তু কারো মাথাব্যথা নেই এই প্রশ্নে। পরিতোষ সেন তবুও সংরক্ষণ করেছেন তাঁর স্মৃতিকথায় সেই সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য। পুরোনো ঢাকার বাড়ি, গাড়ি, পোশাক, খাবার, উৎসব, বিনোদনসহ নানা বিষয়াদির এক বিশদ বিবরণ এই স্মৃতিকথায় গ্রথিত হয়েছে। তিনি দেখিয়েছেন যে, কীভাবে নির্মিত হয়েছিল এই সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য—অর্থাৎ উৎস ও বিকাশের প্রক্রিয়াটি। ফলে হারিয়ে যাওয়া ‘ঢাকাইয়া’ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক সমৃদ্ধ দলিল হয়ে উঠেছে এই স্মৃতিকথা।

 

প্রকৃতি কিংবা নিসর্গচিত্রের যে বয়ান এই স্মৃতিকথায় নির্মাণ করেন পরিতোষ সেন—তাও এক কথায় অসাধারণ ও গুরুত্বপূর্ণ। যে নিসর্গ নির্মাণ একাধারে রোমান্টিক আবার বাস্তব—মূল কথা, তিনি সেঁধিয়ে দিলেন এই দুটো বিষয়, একই গহ্বরে। ফলে নাগরিক বাস্তবতায় তাঁর যে নিসর্গপ্রীতি এবং নিসর্গ-নির্মাণ প্রক্রিয়া—তা কোনো অলীক বিষয় হয়নি। পরিতোষ সেন এই বিষয় করতে পেরেছিলেন কারণ, সেই বাস্তবতা তখন ছিল বলেই। ‘হে অর্জুন’ অংশ পাঠ করলেই এই বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কারণ নানান অংশে পুরোনো ঢাকার যে প্রকৃতি ও নিসর্গের বর্ণনা পরিতোষ সেন দেন, তা কেউ এখন কল্পনাও করতে পারবে না। আবার এই একই বর্ণনায় তিনি মাঝে-মধ্যেই কথা-বার্তা ছাড়াই চলে যাচ্ছেন গ্রামে। তারও টেকনিক দারুণ। বাস্তবজীবনের মানুষ যেমন পুজোর ছুটিতে যায়, পরিতোষ সেনও পুজোর ছুটিতে স্মৃতিকথায় পুজো করতে গ্রামে চলে যাচ্ছেন। কী যে দারুণ টেকনিক! স্পর্শীও বটে, প্রভাবক হতে পারে কারো কারো জন্যে; যারা জীবনী লিখবেন ভবিষ্যতে—এমন কারো জন্য তো বটেই।

 

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়, হিন্টারল্যান্ডের মূল সাবার্ব হিসেবে ঢাকার যে চরিত্র থাকা দরকার, আদতে পরিতোষ সেনের ঢাকার নিসর্গ ও প্রকৃতির বর্ণনা সেই বিষয়কেই স্পষ্ট করে এবং দৃঢ় ভিত্তি প্রদান করে। মনে রাখা জরুরি যে, নিসর্গ নির্মাণের বেলায় কিন্তু পরিবাহী প্রক্রিয়ারই দ্বারস্থ হয়েছেন পরিতোষ সেন। আবার সেই প্রকৃতি এবং নিসর্গের রয়েছে বিশেষ সঞ্চালন-ক্ষমতা। যা দ্বারা তিনি তাঁর কথাকেই বলেন; মিলিয়ে-টিলিয়ে নেন সবকিছু। মানে একটা সম্পর্ক তৈরি করেন মানুষ ও বহির্জগতের মধ্যে। এটাও একটা চমৎকার বিষয়।

বলা যায় যৌনতা আর নারীর ছড়াছড়ি রয়েছে এই স্মৃতিকথায়। কিন্তু তা কোনোভাবেই পর্নোগ্রাফিক আমেজ তৈরি করে না; তার বদলে একটা সুস্থ যৌন অনুভূতিকেই স্পষ্ট করে।

শরীরময়তা যেন টেনে-হিঁচড়ে এই গ্রন্থ-কিনারে এনে হাজির করেছেন পরিতোষ সেন। বলা যায় যৌনতা আর নারীর ছড়াছড়ি রয়েছে এই স্মৃতিকথায়। কিন্তু তা কোনোভাবেই পর্নোগ্রাফিক আমেজ তৈরি করে না; তার বদলে একটা সুস্থ যৌন অনুভূতিকেই স্পষ্ট করে। মানে এই যৌনতা [পরিতোষ সেনের বর্ণিত] কোনো নেতিবাচকতায় ভরপুর কিংবা বুঁদ হতে কাউকে ধাক্কা দেয় না। একটা স্বাভাবিক যৌনতার বিষয়ে দৃক্পাত করে, ব্যাপারটা যুগপৎভাবে ইন্টারেস্টিং ও দরকারি। এইখানে বর্ণিত যৌনতার বিষয়-আশয় রগরগে আদিম যৌনতার উন্মাদনাও সৃষ্টি করে না। যাকে ‘এথিক্যাল সেক্সুয়াল’ বিষয়-বর্ণনাও বলা যেতে পারে। এই ব্যাপারটা পরিতোষ সেনের চিত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। বিশেষ করে এর জন্য তাঁর শৈশবের নানা অভিজ্ঞতা বিশেষভাবে সক্রিয় থেকেছে।

 

আপাতদৃষ্টিতে পাঁচ-ছ’ বছরের শিশুকে নারীরা ‘পুরুষ’ হিসেবে হয়তোবা বিবেচনা করেননি। এমনকি ‘ন’বাবু ও সেজোবাবু’ অংশে তাঁর আপন ভাইয়ের প্রসঙ্গে তাঁর যে প্রত্যক্ষীকৃত অভিজ্ঞতা, তা কি কেউ সে সময় ভাবতে পেরেছিল? কিন্তু পরিতোষ সেন সেটা মনে রেখেছিলেন গভীরভাবে। এবং তা তিনি তাঁর এই গ্রন্থে উপস্থাপন করেছেন। তেমনি তাঁর চিত্রেও এই বিষয় তিনি সম্পৃক্ত করেছেন। অবশ্য এক্ষেত্রে তিনি ব্যবহার করেছেন উত্তর-ঘনকবাদী চিত্র-কৌশল। কিন্তু এইসব বিষয়ের পিছনে কিন্তু সক্রিয় থেকেছে তাঁর ঢাকা-জীবনের নানান স্মৃতি।

 

এই স্মৃতিকথায় কোনো দার্শনিক বয়ান যে নেই, তা নয়। বিশেষ করে আত্মজীবনী-পাঠের সময় এই বিষয় বারবার এসে ধরা দেয়। জীবনের ক্রমাগত বদলে একজন মানুষের নানা ধরনের শ্রম-এর বিষয় কেমন ছিল, তা। কিন্তু পরিতোষ সেন যে একেবারেই তা বলেননি এ গ্রন্থে—বিষয়টা যে তেমন, তাও নয়। দার্শনিকতা আর সংগ্রামের বিবরণের বাহুল্যদোষে পাঠক কিন্তু জিন্দাবাহার পড়তে গিয়ে একটুও কাহিল হন না। কিংবা ভ্যাঁ করে কেঁদেও দেন না। এরও রয়েছে কারণ। আসলে বাস্তবতাকে—তা যদি খুবই কষ্টেরও হয়—যদি তুলে ধরা যায় হাস্য-রসের ভিতর দিয়ে, তাহলে তা হয়ে ওঠে একেবারেই সোনায় সোহাগার মতো ব্যাপার। পরিতোষ সেন সেটা করতে পেরেছেন।

 

ধরা যাক ‘ন’বাবু ও সেজো বাবু’ অংশে নিজের আপন ভাইদের দুশ্চরিত্র নিয়ে এভাবে স্যাটায়ার তৈরি করার জন্য কিন্তু শক্তিও লাগে। কেবল গভীর সৎ সাহস থাকলেই বলা যায় এমনসব কথা। এই বিষয় বারে বারে নানা প্রসঙ্গে উঠে এসেছে। বিশেষ করে ব্যক্তি-চরিত্র নির্মাণের বেলায় সেখানে তাদেরকে নিয়ে স্যাটায়ার নির্মিত হয়েছে ঠিকঠাক। কিন্তু অপরপাশে এক ঘনায়মান দুঃখ দাঁড়িয়ে দুঃখের হাঁপর টেনে চলছে। আসলে তাতে লোহা নয়, দুঃখের পুড়ে খাঁটি হওয়ার মতো পরিস্থিতি নির্মিত হচ্ছে। কিন্তু সত্য তো বলা হচ্ছে। কেবল আগুনটাই দেখলেই হবে না; তার শুদ্ধতা নিয়েও ভাবতে হবে।

 

ভাষা কেবলই যে ভাববিনিময়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, ব্যাপারটা তেমন নয়। ভাষা ব্যক্তি ও স্থানের পরিচায়কও হয় বটে। ভাষার ক্ষেত্রে ‘পলিগ্লটস’ ব্যাপারটার ঠিকঠাক উদ্বোধন তখনই সম্ভব হয়, যখন লেখক কোনো লেখায় ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্ক ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। পরিতোষ সেন এই গ্রন্থের ভাষায় এই কাজটা করেছেন দুর্দান্তভাবে। তাঁর ভাষা ব্যবহার স্মৃতিকথার প্রত্যেক ব্যক্তিকে আলাদা আলাদাভাবে চিনতে সাহায্য করে। বোঝা যায় : কী বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছে, এবং কাকেই বা উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে এসব কথা। আবার ভাষার ব্যবহারের ফলেই পুরোনো ঢাকার আদি, অকৃত্রিম এবং মুছে যাওয়া সময় নতুন করে উদ্ভাসিত হয় আমাদের সামনে। এক্ষেত্রে তিনি যেখানে যেমন দরকার, সেখানে তেমনভাবেই ভাষা ব্যবহার করেছেন। যদি কথায় কথায় তিনি ফরাসি বা ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করতেন চরিত্রের মুখে, তাহলে ব্যাপারটা কেমন জগাখিচুড়ি হয়ে উঠতো! কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি সেখানেই সেই ভাষা ব্যবহার করেছেন, যেখানে যে ভাষার দরকার। ফলে পরিতোষ সেনের ভাষা-ব্যবহার দারুণ; এই কারণে যে : চরিত্র ও চরিত্রের প্রকৃত পরিপ্রেক্ষিত প্রকাশে সঠিক ও দরকারি ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করেছেন তিনি, এই স্মৃতিকথায়।

 

আবার প্রকৃতি ব্যবহারের সময় তাঁর এই ভাষা অনেকটা রোমান্টিক হয়ে উঠেছে। কিন্তু তাতে সমস্যা হয়নি। বরং সুবিধাই হয়েছে। আর্ট যে বস্তুজগতের যেকোনো বিষয়ের একটা নকল-উৎপাদন—সেই ব্যাপারটা করতে পারার জন্য হলেও মাঝে মাঝে ভাষায় প্রকৃতি ও প্রকৃতি ব্যবহারের জন্য ‘প্রকৃতিনির্ভর প্রতীক-ভাষা’ ব্যবহার করতে হয়। এই বিষয়টাই পরিতোষ সেন করেছেন, তাঁর প্রকৃতি ব্যবহারের সময় ব্যবহৃত ভাষায়। অর্থাৎ ‘কন্ডাক্টর’ হিসেবেই ‘প্রকৃতিনির্ভর প্রতীক-ভাষা’ ব্যহার করেছেন পরিতোষ সেন। অর্থাৎ মৃত্যু অথবা আনন্দসহ নানা অনুষঙ্গ প্রতীকীভাবে উপস্থাপনের জন্যই এই ‘প্রকৃতিনির্ভর প্রতীক-ভাষা’ ব্যবহার করেছেন তিনি। এই ‘প্রকৃতিনির্ভর প্রতীক-ভাষা’ কিন্তু আবেগের ঢুলুঢুলু চোখে উপস্থাপিত হয়নি। ব্যবহৃত হয়েছে বেশ শক্তপোক্ত আর দৃঢ় কঠিন বিষয় উপস্থাপনের বেলায়।

 

উপর্যুক্ত বিষয়াদি মিলেই এক দারুণ স্মৃতিকথা নির্মাণ করেছেন পরিতোষ সেন : জিন্দাবাহার যে গ্রন্থের নাম। যে স্মৃতিকথা পুরোনো ঢাকা এবং দেশভাগ পূর্ববর্তী বাংলাদেশকে বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ হিন্টারল্যান্ড ও সাবার্ব-এর স্বরূপ উদ্ঘাটনের মাধ্যমে পুরোনো ঢাকাকে চেনা-জানার জন্য। আরো গুরুত্বপূর্ণ ঢাকার আদি ও অকৃত্রিম সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য জানা-বোঝার জন্য।

 

 

2 মন্তব্যসমূহ

  1. ভালো লাগলো পড়ে। লেখককে ধন্যবাদ। গদ্য চমৎকার; ছবির মতো মনে হলো।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here