খৈ, খৈতান আর হেমামালিনী

বিন্নির মাঝে মাঝে তখন এত জিদ লাগত, নাম আর পায়নি বাবা, তার নামটা কেন বিন্নি রাখতে হবে! স্কুলে স্যারেরা-আপাদের কেউ কেউ বলত, এইযে বিন্নি ধানের খৈ! সহপাঠীরাও ছাড়ত না। ছড়া কাটত। ‘‘শালি ধানের চিঁড়ে দেব/ বিন্নিধানের খৈ।’’ তার নামই হয়ে গিয়েছিল খৈ। বিন্নিও কিছু বলত না। মেনে নিয়েছিল। না মেনে উপায় কী। তারপরও খেয়াল করেছিল, লিয়াকত তাকে কখনো এমন নামে ডাকত না।

 

কত বছর পর জে. এফ. কেনেডি বিমানবন্দরের অপেক্ষমান কক্ষে বিন্নির সঙ্গে লিয়াকতের দেখা। বিন্নিই প্রথম চিনতে পারে। লিয়াকতের তেমন কোনো বদল হয়নি। তেমনই ম্লান মুখ, কেমন একটা ঢুলুঢুলু চোখের লোক, মুখে সেই বিষণ্ণ কিশোরের ছায়া, হুবহু আগের মতোই আছে। আর আছে সেই আগের মতো খাড়াখাড়া চুল। সিঁথিহীন। এখনও সজারুর মতোই লাগছে। মাথা ভরা কালো চুল। একটা চুলও পাকেনি। নাকি কলপ দেয়? বয়স তো তারই সমান। প্রায় সাতচল্লিশ। নিজের মাথায় চুলও তেমন কমেনি, তবু এখন কদিন পর পর পিঠছাপানো চুলের ফাঁকে ফাঁকে দুয়েকটা রুপালি তারে বয়স বেজে ওঠে।

 

বছর পাঁচেক আগে হঠাৎ করে দেশে ফিরে শুনে, স্কুলে পুনর্মিলনী হবে। আর সেটা আরো হবে, তার দেশে আসাকেই কেন্দ্র করে। বিন্নি তখন প্রথম শুনেছিল লিয়াকতও আমেরিকায় থাকে। কিন্তু কেউ তার কোনো খোঁজ দিতে পারে নি। লিয়াকত এসেছিল ওপি-ওয়ানে। মানে তারও ছয়-সাত বছর আগে। বিন্নি তখনও বুয়েটে। পরে স্থপতি হয়ে বুয়েটে চাকরিও পেয়েছিল। তারপর পিএইচডির সুযোগ হয়ে যায়। চলে আসে মার্কিনদেশে। আর ফেরা হয়নি। ফিরে আসার ইচ্ছাও ছিল। দেশে তখন আগুন-সন্ত্রাস। বাসে বাসে আগুন, পেট্রোল বোমা। সরকার বলে, বিরোধীরাই করছে। বিরোধীরা বলে, সরকারই এসব নাটক সাজাচ্ছে। ঢাকায় ফোন করলে ভাইয়া ঠাট্টা করে বলত, এখন সময় কঠিন, কিন্তু জীবন সহজ।
— মানে কী? জানতে চাইল বিন্নি।
— মানে হলো, এইযে বাসা থেকে বেরুলে অফিসে যাওয়ার পথে যেকোনো বিপদ ঘটে যেতে পারে। বেরুনো মানুষটা আর ঘরে নাও ফিরতে পারে। তাই খুব অল্প কিছু কাজের ভেতর দিনগুলি সাঁটানো। একদম প্রয়োজন ছাড়া বাড়তি কোনো কিছুর জন্য কোথাও যাওয়ার নেই। যানজটহীন রাস্তা। সাঁই করে যাওয়া আসা করা যাচ্ছে অফিসে। স্বাভাবিক সময়ে যাতে দেড় ঘণ্টা লাগে এই পনেরো মিনিটের পথ। এখন জীবনে ফালতু আড়ম্বর, ব্যস্ততা নেই, ফলে দিনযাপন সহজ। কিন্তু সময়টা কঠিন।

 

বিন্নি বলতে গিয়েও বলেনি যে, যুদ্ধের সময়ও জীবন সহজ হয় নাকি বা অবরুদ্ধ সময়ে?
মাঝে মাঝেই তার মনে হানা দিয়েছে তখন, কোন জীবনটা ভালো — মুক্তজীবন না কি বদ্ধজীবন? কাকে বলে মুক্তজীবন, কোনটাই বা বদ্ধজীবন? একটার ভেতরে আরেকটা পোরা নয়তো?

 

বিন্নি ভাইয়ার এসব হেঁয়ালি কিছুটা বুঝতে পারে। কুড়ি বছর ধরে তিনি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে সরকারি চাকরি করে যাচ্ছেন। এর ভেতরে একটা ছেলেকে বিন্নির বদৌলতে আমেরিকা পাঠাতে পেরেছেন। আরাফ ছেলে ভালো, কিন্তু কোনোভাবেই কোনো কায়দা করতে পারছে না। এটা ওটা করেই তার মার্কিনী জীবন কাটছে। মাঝে মাঝে হাত খালি হলে ফুপুর কাছে আগে আসত। পরের দিকে আসাটা কমে গেছে — এটুকুই বদল আর কী! আরাফের মজার একটা কথা মাঝে মাঝে মনে পড়ে, ডলারই কি কলার ধরে আমাদের টেনে ধরে রাখে এদেশে? ডলারের সঙ্গে কলার-এর মিলটায় খুব মজা পেয়েছিল। পরে বিষণ্ণও বোধ করেছিল বিন্নি।

 

নিজের একটা গবেষণা কাজ — একের পর এক সেতু তৈরির কারণে নদীর মৃত্যু হয়, এবং এর ফলে কী প্রভাব পড়ে মানুষের জীবন-জীবিকায়, তাতে স্থাপত্যবিদ্যা, মানুষ ও সমাজ নিয়ে নতুন করে অনেক কিছু টের পেয়েছিল। এই কাজটা করার পরই নিজেকে তার মনে হয়েছিল, এত দিনে কিছু একটা করতে পেরেছে। ইচ্ছা ছিল বই করবে। কিন্তু ওদেশে কোনো প্রকাশকের কাছ থেকে সাড়া পায়নি। কেউ কেউ বলেছে, এ কাজটা একেবারেই উন্নয়নের বিরোধী। এছাড়াও এটা অনেক কিছুর বিরুদ্ধে যায়, বিশেষ করে এ গবেষণাটা ব্যবসা-বাণিজ্যের পাল্টা জিনিস।… এবার নিজের দেশের এক নতুন প্রকাশক রাজি হয়েছে, সেজন্যই দেশে এসেছে সে।

 

লিয়াকত আর থাকতে চাচ্ছে না আমেরিকায়। এবার দেশেই থেকে যাবে। যেটুকু টাকা দেশে পাঠাতে পেরেছিল, তা দিয়ে নিজের গ্রামে গরু আর মুরগির খামার করবে। ছোট একটা মিল্ক ফ্যাক্টরিও করতে পারে। হিসেবে করে দেখেছে, বাকি জীবনটা চলে যাবে। তবে নতুন করে দেশের সঙ্গে,তাও এই বয়সে, খাপ খাওয়াতে পারবে কিনা- এত কিছুর পরও, এ-নিয়ে একটু চিন্তা তো রয়েই যাচ্ছে।

 

বিন্নি যখন, আপনি মানে তুই লিয়াকত না? বলে বিস্ময়ে হাঁ হয়ে ছিল তখন লিয়াকত হাতে একটা কবিতার বই নাড়াচাড়া করছিল। হ্যাঁ, মনে পড়ে, লিয়াকতকে সবাই কবি বলত। দেওয়াল পত্রিকায় বের হওয়া তার কয়েকটা ছড়া তখন অনেকের মুখে মুখে ফিরত। ‘‘আমেরিকা রাশিয়া/ বড় ভালোবাসিয়া/ গরিবের বিশ্ব/ লুটে করে নিঃস্ব।’’ বা ‘‘খুঁজছো যা/ পাবে না তা/ থামাও এ সন্ধান/ তুমি তো মানুষ/ নও তো ফানুস/ তুমি যে/ অমৃতেরই সন্তান।’’ বড় আপা তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় পড়ত। আপাকে সমরেশ বসুর ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’ পড়তে দেখে মানে জানতে চেয়েছিল। বড় আপা যেসব কথা বলে, সেটাকেই আসলে ছড়া বানায়। আর প্রথম ছড়াটার ভাব নিজের বাবার কী একটা কথায় — আমেরিকা-রাশিয়ার লোকদেখানো লোকভুলানো টানাটানির কথা শুনে, পাওয়া। খুব নাম হয়েছিল লিয়াকতের। তারপর কলেজ পাস করেই ওপি-ওয়ানে আমেরিকায় আসা। বিন্নিকে হাসতে হাসতে সে বলে, একটা প্রবাদ আছে, জানিস তো- যারে নিন্দলাম/ তারেই পিন্দলাম। বিন্নিও মুখে হাত দিয়ে হেসে ওঠে।

 

লিয়াকত বলছিল, তুই তো আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে শার্প স্টুডেন্ট ছিলি। অল্পের জন্য বোর্ড স্ট্যান্ড করতে পারিস নি। কিন্তু তোর জায়গাটায় তুই কিন্তু ঠিকই যেতে পারলি। তবে অদ্ভুত বিষয় কী জানিস!
— কী?
— যে আমি ক্লাস সেভেনের পর আর কিছু লিখিনি কখনো, বহু বহু বছর। আমেরিকাই আমাকে কবি করে দিল। কীভাবে কবিতা লিখতে হয় জানি না। হঠাৎ একদিন থেকে শুরু হলো। তারপর প্রতিদিন রাতে ফিরে নোট বুকটা টেনে নিয়ে যা মনে আসে তা লিখে গেছি। নেশার মতো। মনে হচ্ছিল, বাংলায় লিখে লিখে বাংলাদেশে ফিরে এসেছি। ভাষাটাই আমার আরেক দেশ হয়ে উঠেছিল। প্রতিদিন মনে হচ্ছিল, দেশে ফিরে এসেছি। কবিতা যেন একটা উড়োজাহাজের মতো আমাকে প্রতিদিন দেশে পৌঁছে দিচ্ছে। এই করে করে কুড়িটা নোটবুক ভরে গেছে। ঢাকা থেকে গত তিন বছর তিনটা বই বের করেছি। সেখানে আমার নাম কিন্তু আনোয়ার শরিফ। লিয়াকত আনোয়ার না। শরিফ কিন্তু আমার ডাক নাম ছিল। তোরা অনেকেই জানিস না। ঢাকার পত্রিকায় কিছু কবিতাও ছাপা হয়েছে। বলতে কি জানিস, দেশে ফিরছি এইটুকু সম্বল নিয়ে। ওই খামার করব, ফ্যাক্টরি করব — সেসবের চেয়েও এই তিনটা কবিতার বই-ই আমার বাংলাদেশে ফেরার আসল প্লেনের টিকিট। আমার আসল ডানা।
লিয়াকত একটা বইকে উল্টো করে পাখির ডানার মতো টেনে দেখিয়ে একটু হাসল।

 

বিন্নির মনে হলো, ঠিকই লিয়াকতের আসলেই তেমন কোনো বদল হয়নি, সেই উদাসীন বিষণ্ণতা এখনও স্কুলে পড়া সেই ছেলেটার মতোই চোখে মুখে লেগে আছে।
— তা তুই একা?
— বিয়ে করেছিলাম। এক আফ্রিকান-আমেরিকান মেয়েকে। তার ঘরে একটা ছেলেও আছে। নার্স। বড় মায়াময় মানুষ। আমিই আসলে ওর সঙ্গে থাকতে পারলাম না। বেশি দিন সংসার করিনি। বছর দশেক। ফ্লোরিডার মেয়ে। অদ্ভুত মেয়ে। যেমন কড়া মেজাজ, আবার তেমনই অপার মায়া। প্রথম দিকে তো ভালোবাসায় জীবন ভরিয়ে দিয়েছিল। মানুষ হিসেবে অনেক বড় মনের, কিছু আমার সত্যিই নিউরেটিক একটা ডিসওর্ডার আছে। ডাক্তাররাও ঠিক ধরতে পারেনি।
-মদটদ খেতি নাকি খুব?
-আরে না! মদ খাওয়ার লোক আমি নাকি! ওটা স্নায়বিক সমস্যা। কবিতাটবিতা লেখা কিছু লোকদের থাকে। জীবনানন্দ তো স্কিজোফ্রেনিক ছিলেন, এখন জানা যাচ্ছে। নইলে কোনো স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে ওই রকম কবিতা লেখা ও ওই রকম চিত্রকল্প, শব্দ-রঙ আর শব্দের প্রবাহ তৈরি করা অসম্ভব, তাই না?

 

বুয়েটের থাকার সময় কবিতা গানগাওয়া থিয়েটার করা অনেক ছেলেমেয়ের সঙ্গেই বিন্নির দারুণ জমেছিল। তবে প্রথম দুবছর নিজের বাছাবাছা কয়েকজন ছাড়া করো সঙ্গে তেমন মিশতই না। এর ভেতরে নিয়াজ হাসান নামে ওদেরই বিভাগের এক ছেলে তো এখন পাকা কবি। খুব নাম। সরকার বদলের ঠেলায় তাকে পাততাড়ি গুটিয়ে লন্ডন চলে আসতে হয়েছে। তখন তার মুখে লেগেই থাকত, ‘‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে/ ভালোবাসে!’’
নিয়াজই একমাত্র তাকে খৈ বলে ডাকত। কোনো একদিন স্কুলের গল্প করতে গিয়ে বলেছিল, বিন্নিকে স্কুলে তার সহপাঠীরা খৈ বলে মজা করে ডাকত। তবে নিয়াজ সবার সমানে ডাকত না। তাদের দুজনের আড্ডার সময় তাকে খৈ বলে ডাকত। মাঝে মাঝে খৈতানও।
— এ আবার কেন?
— তোর সঙ্গে হেমামালিনীর একটা মিল আছে। সেটা কেউ বলেনি?

 

দেশ পত্রিকার সুবর্ণজয়ন্তীসংকলনের তিনটা খণ্ড পড়তে দিয়েছিল নিয়াজ। বলতে গেলে সেটাই প্রথম কলকাতার লেখক-কবিদের লেখার সঙ্গে পরিচয়। সেই নিয়াজই কিনা পরে বলেছিল, কলকাতার সব কিছু আসা বন্ধ করে দেওয়া দরকার। আমাদের পুরো মন মাথা মগজ সব দখল করে ফেলেছে ওরা। পারলে পশ্চিমা সব কিছু।
— এ কেমন কথা!
— এটাই কথা। আমাদের আমাদের সামনে দুটো পশ্চিম। এরাই আমাদের এগোনোর পথে বাধা। একটা হলো পশ্চিমারা-ইউরোপ আমেরিকা। আরেটা হলো পশ্চিমবঙ্গ।
— আজব কথা তো! এখন কী আটকে দেওয়ার দিন আছে নাকি? সামনে তো আরো থাকবে না। আর নিজের যোগ্যতা বাড়ানোর দিকে নজর দে। অন্যেরা কী দখল করল না করল, তা বাদ দিয়ে পাল্টা নিজেকে নিজের দখলে নে।

 

সেই নিয়াজও লন্ডনে পালালো। নিয়াজের কথা মনে হলেই, ওই খৈ খৈতান আর হেমামালিনীর কথা মনে হয়। হাসি আসে, তবে তা ম্লান হাসি, সে টের পায়। ‘‘বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে!’’ এই ‘‘মনে আসে’’র সঙ্গে ‘ভালোবাসে’’র মিলটা কত কত দিন চকিতে কোনো চোরা অবসরে হানা দিয়ে গেছে বিন্নির মনে।
লিয়াকত বলছিল, জানিস, তোকে মনে মনে ভালোবাসতাম। কিন্তু সেটা ওই পর্যন্তই। তোর মতো এমন সুন্দর, তারওপর এমন ব্রিলিয়ান্ট মেয়ে! বাপরে! তবে তুই কিন্তু যত বয়স বেড়েছে তত সুন্দর হয়েছিস! ছোটবেলার চেয়েও তোকে এখন আরো বেশি সুন্দর লাগছে।

 

বিন্নিকে নিয়াজও বলেছিল, তুই জানিস, তুই যে রিক্সা থেকে নামবি, সেটা দেখার জন্য কতজন বসে থাকত। ক্লাসে তোর এন্ট্রি মানে তো… বাপরে। তবে যে ভাব নিয়ে চলতি- ফার্স্ট সেকেন্ড ইয়ারে, লোকজন তো ভয়েই তোর ধারে কাছে ঘেঁষত না। মেজর জেনারেলের মেয়ে! জাঁদরেল সুন্দরী! হাঃ হাঃ হাঃ!
— জাঁদরেল না কদবেল! ভাব নিয়ে চলতাম তো কেউ যাতে বিরক্ত না করে। ছোটবেলা থেকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমি কতটা দেখতে ভালো না মন্দ সেটা খুঁজতাম না। আমি নিজেকে বলতাম, নো দাইসেল্ফ। বি ইয়োরসেল্ফ। নিজেকে জানো। আর নিজের মতো হও।- এই দুই ছিল আমার মন্ত্র।
— তা ঠিক। তোকে কোনো দিন বাপের নাম নিতেও শুনিনি।
— কেন তুই তো কপচাতি: দাদার নামে গাধা/ বাপের নামে আধা/ নিজের নামে শাহজাদা।
জিয়াউর রহমান খুনের পর পর মেজর জেনারেল মঞ্জুরকে বিনা বিচারে তক্ষুণ্নি মেরে ফেলা নিয়ে বাসায় রাগে দুঃখে ফেটে পড়েছিলেন বাবা। কাউকে কিছু কোনোদিন বলতে পারেননি। হঠাৎ করে সোফায় বসে পড়ে, হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেছিলেন তিনি।
— বাপি তুমি কাঁদছো কেন?
তখন ক্লাস টুতে পড়ে বিন্নি।
— থাকিস না, এদেশে থাকিস না মা! পালা! পালিয়ে বাঁচ, মা রে!
বলতে বলতে মাছি তাড়ানোর মতো করে হঠাৎ করে যেন ভীষণ দুর্বল আর অশক্ত হয়ে যাওয়া হাতটা নাড়ছিলেন।

জগতে যারা, যেখানে, যেভাবে এবং তাদের মতো করে প্রতিবাদ করে, তারা সবাই এক একজন কবি।

কিছুই বুঝতে পারেনি বিন্নি। যে বাপের ভয়ে তার এত বড় বড় ভাইয়েরা তটস্থ হয়ে থাকত, মেপে মেপে কথা বলতেন যে বাপ, একেবারে পুরো মিলিটারি মেজাজের মানুষ, তাকে সেই প্রথম ও শেষ কাঁদতে দেখেছিল বিন্নি। অবসর নেওয়ার পর তিনি বেশি দিন বাঁচেনওনি।
— চাচা কেমন আছেন?
— বাপি তো মারা গেছেন। আমি তখন কেবল বুয়েটে ভর্তি হয়েছিলাম।
— ও সরি।
— তোর খবর আমরা শুধু এটুকু জানতাম যে তুই আমেরিকায় চলে গেছিস।
— আয়রনি মনে হয়নি শুনে?
— কেন?
— ওইযে ছড়াটা লিখেছিলাম!
— না।
— কেন?
— বাপির কথা মনে হয়েছিল: পালা! এদেশে থাকিস না মা! পালা! পালিয়ে বাঁচ মা রে!
— আসলে কি কেউ পালাতে পারে? তাঁর স্মৃতিরা পিছু ছাড়ে না। পিছু ছাড়ে না কত কত ভুল। কত ব্যর্থতা। আরো কত কী! দিনরাত তাড়িয়ে বেড়ায়। কাউকে কাউকে তো পাগল করে দেয়।
বলে একটু শ্বাস নেয় লিয়াকত।
— আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে কবিতা লেখার পাগলামি।
— আর আমাকে? তোর কী মনে হয়?
— তোকে! তুই জানিস। তুই তো জিনিয়াস। হয়ত কাজের আর গবেষণার ব্যস্ততা।
লিয়াকতকে বলেছিল এবারে কেন দেশে যাচ্ছে। লিয়াকত বলেছিল, তাহলে তো একটু ঝুঁকিরও বিষয়টা।
— কেন?
— নদীতে সেতু দেওয়ার কারণে নদী মরে যাচ্ছে। এই নিয়ে বই। তো ঝুঁকি আছে না?
— কই, সুন্দরবন রক্ষা নিয়ে যেমন আন্দোলন হলো, এসব নিয়ে তো কিছু শুনিনি কোনো দিন। জনগণ তো চায়।
— আসলে কী জন্য চায়, কারা চাওয়াচ্ছে, সেটাও তুই ভালো করে জানিস।
— না ছাপলে কোনো সমস্যা নেই। আমি এটা আরো ভালো করে এডিট করতে বসব হয়ত। আরো এনরিচ করবো। আপডেট দেব।
— এই হাল না-ছাড়া মানুষটাই আসলে তুই। একদম অপ্রতিরোধ্য। দ্যা আনস্টপেবল বিন্নি।
— হাল না-ছাড়া মানুষ আমরা কেউ না। দেশে থাকলে বুঝতে পারতাম, আসলেই হাল না-ছাড়া মানুষ কিনা। জীবনে আসলে ওই লেখাপড়ায় ভালো করার চ্যালেঞ্জ ছাড়া, কোনো চ্যালেঞ্জ কি নিয়েছি বল তো?
কথাটা শুনে লিয়াকত বড় একটা শ্বাস নেয়। আর তত বড় করে একটা শ্বাস ফেলে। চুপ করে থাকে।
— হ্যাঁ নিয়েছিস।
— কী রকম?
— এই যে তোর রিসার্চ!
— মানে?
— রাস্তায় দাঁড়িয়ে মুঠোকরা হাত ছোঁড়া বা বক্তৃতা দেওয়াই তো শুধু না, কত ভাবেই তো চ্যালেঞ্জ করা যায়। তুই সেটা করেছিস। তুই কিন্তু হাল ছেড়ে দিস নি। এই যে দেশে ফেরা, এটাও একটা হাল না-ছাড়ার দৃষ্টান্ত। শুধু নিজের জায়গায় থেকে গিয়েই তো সব লড়াই করতে হয় না। জায়গা ছেড়ে দিয়েও লড়াই করা যায়। ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের মতো। দূর থেকে আঘাত হানা।
বলে লিয়াকত ম্লান হেসে বলে, উপমাটা ভালো হয়নি মনে হয়!
— উপমার ভালো-মন্দে আর কী যায় আসে বল!
— অনেক কিছু যায় আসে।
— তুই কবি মানুষ। তুই ভালো জানিস।
— তুইও কবি।
— তাই নাকি! জীবনে এই প্রথম শুনলাম।

— জগতে যারা, যেখানে, যেভাবে এবং তাদের মতো করে প্রতিবাদ করে, তারা সবাই এক একজন কবি।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here