আস্তে লেডিজ কোলে বাইচ্চা : মোহাম্মদ আজমের বিষয় সিনেমা

বিষয় সিনেমা ।। তিনটি অনূদিত প্রবন্ধ ।। অনুবাদ : মোহাম্মদ আজম ।। প্রকাশক : চৈতন্য, সিলেট ।। সেপ্টেম্বর ২০২০

শিরোনাম দেখে ভড়কে যাওয়ার কারণ নেই। শ্রীঘরীর নিবাস যেহেতু দেশের এক নির্জন প্রান্তে; ফলে তার ঢাকার স্মৃতি কম। একবার হয়েছে কী, শ্রীঘরী ঢাকার লোকাল বাসে চড়ার পর কোনো এক বাসস্টপে বাস যখন থামলো, তখনই হেল্পার এক যাত্রীকে বাস থেকে নামাতে গিয়ে বলে উঠলো, ‘ওস্তাদ আস্তে, লেডিজ, কোলে বাইচ্চা!’ হুম, যে কোনো বিষয়ে সতর্কতা বেশ জরুরি বিষয়। ‘বাইচ্চা’ শব্দটা নোয়াখালীর আঞ্চলিক শব্দ হিসেবেই পরিচিত। একবার হয়েছে কী, গোপাল হালদারকে কেউ জিজ্ঞেস করেছিল আপনার জন্ম? উত্তরে গোপাল হালদার বলেছিলেন, ‘আমি গোপাল হালদার, নোয়াখালীর গোপাল হালদার।’ মোহাম্মদ আজমের জন্মস্থান নোয়াখালী। মোহাম্মদ আজম, নোয়াখালীর মোহাম্মদ আজম। এসব ফালতু কথা বাদ দিয়ে দিই। কাজের কথায় ফিরি। ঢাকায় এই সময়ে নানান কারণে, বিশেষ করে জ্ঞান-চর্চার হিসেব-নিকেশের বেলায় মোহাম্মদ আজমের নাম বেশ জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে। তা তো যে কোনো ব্যক্তির — যিনি সম্পৃক্ত আছেন একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলের জ্ঞান-র্চচার সাথে — জন্যই নানান কারণে গুরুত্বপূর্ণ। মোহাম্মদ আজম অ্যাকাডেমির লোক। কিন্তু এইসবের বাইরেও তাঁর নানান ক্ষেত্রে বিচরণ। ক্রিয়েটিভ কিংবা সাংগঠনিক জ্ঞান-জগতেও আজমের নানামাত্রিক পদচারণা যে কাউকে ঈর্ষান্বিত করবে। করেও তাই।

 

সম্প্রতি বের হয়েছে মোহাম্মদ আজমের অনূদিত সিনেমা বিষয়ক তিনটি প্রবন্ধের অনুবাদ-সংকলন : বিষয় সিনেমা। এই সংকলনটিতে স্থান পেয়েছে ওয়াল্টার বেনজামিন, স্টুয়ার্ট হল এবং ত্রিন টি. মিন-হা-এর একটি করে আজম কর্তৃক অনূদিত প্রবন্ধ। এই তিনটি প্রবন্ধই মিডিয়া, এবং বিশেষভাবে সিনেমার নানান বিষয় নিয়ে লিখেছিলেন প্রাবন্ধিকরা। ঢাকায় সেই পুরোনো সময় থেকেই গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের লেখা-পত্তর পাঠের একটা সংকট রয়ে গেছে। এই সংকটের পিছনে ভৌগোলিক বিষয় যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি করে সাংস্কৃতিক রাজনীতিও নানান কারণে গুরুত্বপর্ণূ। সেই সংকটের একটা সমাধান-প্রকল্প হিসেবে ‘গনতিতে ধরা’ যেতে পারে এই বইকে। কারণ, যেহেতু হিরো আলম আর অন্যান্য চিহ্ন-সূত্রের মতো বিষয়ের মোকাবিলার মতো একটা বাজে প্রক্রিয়ার মধ্যেই সময় পার করে এই অঞ্চলের সিনেমা-পাগল মানুষজন। কিন্তু সিনেমার যে একটা আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা রয়েছে, এই বিষয় একেবারেই মেনে চলার প্রবণতা চোখে পড়ে না। এই বইয়ের প্রবন্ধগুলো পড়লে সেই বিষয়ে বোধহয় একটু ‘চোখ ফুটে উঠা মাছের বাচ্চার’ মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।

এই বইয়ের প্রবন্ধগুলোর সাথে এই কথাই খাটে। যদিও আজম সাহেব সবই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে উড়িয়ে দেন। বিষয়টা আজমের শক্তির একটা জায়গা। লোকজনও এতে বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।

তো এই বই কেন আমরা পড়বো? কী এমন জিনিস-পত্তর নিয়ে এই বই তৈয়ার হয়েছে, যে এই বই আমাদের পড়তেই হবে? হ্যাঁ, তার নানান কারণ কিন্তু আছে। আগেই বলা হলো, এই অঞ্চলে জ্ঞানসম্পৃক্ত বিষয়-আশয় কিংবা বই-পত্তরের একটা বড়ো সংকট রয়েছে। সেই সংকট কাটিয়ে তোলার জন্য এই বই দরকারি। কারণ এই বইয়ে যে সমস্ত প্রবন্ধ সংযোজিত হয়েছে, সেই প্রবন্ধসমূহই এই অঞ্চলে জ্ঞান-জগতের সাথে সম্পৃক্ত অধিকাংশ লোকজন পূর্বে চোখে দেখেননি, চেখে দেখেননি। অন্যের মুখে ঝাল খাওয়ার মতো পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতেই এই অঞ্চলের লোকজনের একটা বিশেষ আরামের ভাব সবসময়ই চোখে পড়ে। সেই ‘আরামের ভাবে’ যেন একটা ধাক্কা দিবে এই বইয়ের প্রবন্ধসমূহ। কেবলই কেলিয়ে পড়ে হা-হা আর হো-হো করে সিনেমা দেখার বিষয়টা এই প্রবন্ধসমূহ পড়লে দূর হবে। আর মিডিয়ার জঙ্গিপনার বিরুদ্ধেও একরকম প্রতিবাদ করার মতো শক্তি খুঁজে পাবে।

 

কিন্তু মিডিয়ার জঙ্গিপনার সূত্রটা কোথায় লুকিয়ে থাকে? হ্যাঁ, এই বিষয়ও এই গ্রন্থের প্রবন্ধসমূহ আমাদের জানান দিবে। মিডিয়া যে নিছক আনন্দ-মাধ্যম নয়, এর সাথে আমাদের চারপাশের নানান বিষয় সম্পৃক্ত থাকে — এই বিষয়টা কিন্তু নানান কারণে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ঠিকঠাক এই বিষয় ধরতে না পারার কারণে বেশ সমস্যাই হয়ে ওঠে। আমরা চিহ্নের মর্মার্থ বাদ দিয়ে কেবল চিহ্নের দৃশ্যমান বিষয়টা নিয়ে মেতে থাকি। এরই ফলে ভিতরে ভিতরে মিডিয়া কিংবা সিনেমার যে বয়ান লুকিয়ে থাকে, তা আমরা টের পাই না। এটাই মূল জিনিস থেকে আমাদের দূরে রাখে। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মতো বিষয়টা এই কারণেই ঠিকঠাক হয়ে উঠতে পারে। এই বিষয় ঠেকা দেওয়ার জন্য আমাদের চিহ্নের ওপর-নিচটা বেশ করে খতিয়ে দেখতে হবে। কিন্তু খতিয়ে দেখতে গেলে ‘দেখার মতো চোখটা’ জরুরি হয়ে পড়ে। এই বইয়ের প্রবন্ধ সেই চোখটা তৈয়ার করবে।

 

পূর্বে যে বিষয়ে কথা বলছিলাম, যে পুরোনো জিনিসের সাথেই আমাদের সম্পর্ক থাকে না। ঠিকঠাক সম্পর্ক তৈয়ার করতে পারি না। নতুন জ্ঞানের বিষয়ে তো কথাই নেই। সে ‘গুড়ে বালিই’ থাকে সবসময়। ফলে আজম যে প্রবন্ধসমূহ অনুবাদ করেছেন, সেই প্রবন্ধ তো অবশ্যই পুরোনো। বিশেষ করে বেঞ্জামিনের প্রবন্ধ তো আজমের তাত্ত্বিক ও আদর্শের জায়গা থেকেও বহু পুরোনো জিনিস। অর্থাৎ নতুন করে যখন বৈশ্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির সাথে সাথে সাংস্কৃতিক নানা বিষয়েরও সৃষ্টি হলো, সেই হিসেবে। ফলে পুরোনো সময় আর সামাজের ভিতর দিয়ে নতুন সময়কে হিসেব করা চলে না। এই বইয়ের প্রবন্ধগুলোর সাথে এই কথাই খাটে। যদিও আজম সাহেব সবই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে উড়িয়ে দেন। বিষয়টা আজমের শক্তির একটা জায়গা। লোকজনও এতে বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। সে যাক্গে। কাজের কথা তবে এইটাই যে, সময়-অসময়ের হিসেবে হলেও আজম তো এই কাজ করেছেন। এটাই গুরুত্বপূর্ণ। তা যতোই পুরোনো হোক না কেন।

 

আরেকটা বিষয় আজম এই বইয়ের প্রবন্ধগুলো অনুবাদের মধ্য দিয়ে বেশ একটা কাজ করেছেন, যাতে করে সিনেমার বিষয়-আশয় ধরাা না ধরার বিষয়টা হয়ে ওঠে। আর তাঁর লেখা ভূমিকাটাও নানান কারণে গুরুত্বপূর্ণ। ধরুন আপনি সিনেমা বিষয়ে ‘একজন আবাল লোক’। তো প্রথমেই যদি এই বই আপনার হাতে গিয়ে পড়ে, তো একটা ‘টাস্কি খাওয়ার’ মতো পরিস্থিতি তৈয়ার হবে। ফলে এই বইয়ের যে ভূমিকা আজম তৈয়ার করেছেন, এতে করেই টাস্কি থেকে মাফ পাবেন পাঠকরা। কারণ এই বইয়ের তিনটি প্রবন্ধই বেশ জটিল, বোঝা-পড়ার জন্য তো বটেই। একইসাথে টীকা সংযোজনের ব্যাপারটা জটিল প্রবন্ধসমূহকে বোঝার জন্য বেশ সরল একটা রাস্তা তৈয়ার করে দিয়েছে।

 

কিন্তু নিন্দা না করলে সামলোচনা হয় না। প্রথমতই যে বোঝা-পড়ার বিষয়ে আজম এই বইয়ে নিজেও ভূমিকায় কথা বলেছেন, আর প্রাবন্ধিকরা তো বলেছেনই, তাদের কথা বোঝার মতো লোকজন কই পাওয়া যাবে? শ্রীঘরী, মানে আমি, নিজেও তপোবনে দু-চার কলম পড়ে হালকা বিদ্যে করে এই অনুবাদ পড়তে গিয়ে বেশ ঝামেলায় পড়েছি। বিশেষ করে, অনুবাদ স্থির আর সংহত করতে গিয়ে জটিল পরিভাষা এই অবস্থাকে আরো গাঢ় করে ফেলেছে। আসলে পরিভাষার এই সমস্যা অনুবাদের জন্য বেশ ঝামেলারÑতা অনুবাদকের বেলায় যেমন সত্য, তেমনি সত্য পাঠকের বেলায়ও।

 

এছাড়া বেঞ্জামিনের সাথে যার সামান্য জানাশোনা নেই, তাঁর তত্ত্ব ও আদর্শের জায়গাটা সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই, সে এই বইয়ে বেঞ্জামিনের প্রবন্ধ পড়তে গিয়ে নির্ঘাত টাস্কি খাবে। আবার কেউ কেউ যে বেঞ্জামিনের প্রবন্ধ পড়ে হজম করতে পারবে না, ব্যাপারটা তেমনও নয়। আবার এই কথার পিঠেই কথা উঠবে যে, সবার তো এই বিষয় বোঝার দরকার নেই। হুম, দুনিয়ায় সবারই সব করার দরকার নেই। কিন্তু যেহেতু সাংষ্কৃতিক রাজনীতির বিষয়ে বারবার কথা বলা হচ্ছে, সেই বিষয় পুরা করতে হলে সব ধরনের লোকজন সাথে নিয়ে, তাদের বুঝিয়ে-পড়িয়ে সামনের পথ মাপতে হবে। তাই বলতেই হয় যে, এই প্রবন্ধসমূহের আভিধানিক অনুবাদের বিপরীতে একটা সরল অনুবাদ করা কি যেতো না?

 

অর্থাৎ সবাই যদি এই বিষয় না বোঝে, বা বোঝার মতো হিসেবটা তৈয়ার না হয়, তো সেক্ষেত্রে এই প্রবন্ধগুলো প্রায়োগিক অবস্থান থেকে সক্রিয়তা হারায়। অর্থাৎ সিনেমা কিংবা মিডিয়ার কথা-বার্তার রাজনীতিটা ধরতে পারার বিষয়ই। এই প্রবন্ধসমূহে যে বিষয়ে বারবার সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। ফলে নৈতিক দিক থেকে যদি এই বইয়ের প্রায়োগিক ভিত্তিটা ঠিক না থাকে, তো একটা মুশকিল হয়েই যায়। এটাই জরুরি বিষয় এই বইয়ের ক্ষেত্রে। আবার আজম যে আদর্শের কথা বারবার বলেন, এবং যে ভিত্তির ওপরে তাঁর কাজ-কাম জারি রাখেন, সেই ভিত্তির নৈতিক দিক আর আদর্শিক ভিত্তিটাও বেশ খানিকটা খারিজ করে দিবে এই বইয়ের প্রবন্ধগুলো। আর যদি এই বিষয় আজম সাহেব বলে দেন যে, এগুলো নিছকই কাজ, তাহলে তো কথা নেই। কেটে পড়া জরুরি।

 

তবে শেষকথা হলো এই যে, এই বই জরুরি। পূর্বের প্রচলিত তত্ত্ব বা জ্ঞানকাণ্ডের সাথে পরবর্তী তত্ত্ব ও জ্ঞানকাণ্ডের সম্পর্ক ঠিক করে নতুন জ্ঞানকাণ্ডের নির্মাণের বেলায়। এই হিসেবে এই বইয়ের অনূদিত প্রবন্ধগুলোর গুরুত্ব অশেষ। আশা করছি এই ধারার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী প্রচলিত এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ অনুবাদ করে এই ধারার কাজের একটা সম্পূর্ণতা আজম দিবেন। আজমের কাছে এই গরিব জ্ঞানদেশের লোক হিসেবে এই আবদার কেউ কেউ যেমন করতে পারেন, শ্রীঘরীও এমন আবদারই রাখছেন।

 

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here