অম্বলিকা গুহ — ভারতের কলকাতাভিত্তিক একজন স্বাধীন গবেষক। ২০১৮ সালে প্রকাশিত অম্বলিকা গুহের Colonial Modernities: Midwifery in Bengal, C.1860–1947 বইটি মূলত দেখাতে চেয়েছে, বাংলায় ১৮৬০ সাল থেলে ১৯৪৭ সালের ভেতর ধাত্রীবৃত্তি কীভাবে প্রচলিত দাইদের থেকে সরে গিয়ে পেশাদার ধাত্রী ও চিকিৎসকদের আধিপত্যপূর্ণ এলাকায় পরিণত হয়েছিল। একই সাথে মানবশিশু জন্মদানের মতো একটি প্রাকৃতিক বিষয়কে কিভাবে ঔপনিবেশিক শাসন একটি চিকিৎসার বিষয়ে পরিণত করেছিল, আর এই পরিণত করার পেছনে সেই সময়ের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি ভদ্রলোকদের তৎপরতা, যার অন্যতম ছিল সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনে লেখালেখি, তারই সামাজিক ইতিহাসকে তুলে ধরেছে এই বই। অম্বলিকার বইটি ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করবেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক শিবলী নোমান।
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গবিরোধী উত্তেজনায় জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে ভদ্রলোকদের গভীরতর যুক্ততার সাথে সাথে শিক্ষিত নারীরাও তাদের নিজেদের বিষয়গুলোকে সামনে নিয়ে আসতে শুরু করে। শতাব্দীর পরিবর্তনের সময়ে নারীদের প্রশ্নগুলো শিক্ষা সংস্কার ও বাল্যবিবাহের মতো কতিপয় সামাজিক চর্চা দূরীকরণের ভেতর ঘনীভূত হচ্ছিলো। বঙ্গ মহিলা সমাজ (১৮৭৯) ও সখি সমিতির (১৮৮৬) মতো অভিজাত পরিবারের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নারীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত মহিলা সমিতিগুলো শিক্ষা ও বিধবা নারীদের চাকরির বিষয়টিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো; একই সাথে বিজ্ঞান ও পরিচ্ছন্নতা এবং লৈঙ্গিক সম্পর্কের কতিপয় দিক সম্পর্কে আলোচনাও চালাচ্ছিলো।১০৯
১৯২০ এর দশকে গান্ধীযুগের আগে অধিকারবাহী সত্তা হিসেবে নারীদের রাজনৈতিক দাবিগুলো জাতীয় পর্যায়ে সংযুক্ত হয় নি, আর এর সংযুক্তি এ যাবৎকাল পর্যন্ত নারীদের প্রশ্নের বিবেচ্য বিষয়গুলোকে নির্ধারণ করা পিতৃতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী প্যারাডাইম থেকে বড় ধরনের বিভক্তিকে নির্দেশ করে।১১০ বাংলায় ১৯২১ থেকে ১৯৩৬ সালে নারীদের আন্দোলন নিয়ে বারবারা সাউদার্ডের বিস্তারিত অধ্যয়ন থেকে দেখা যায় যে, এসময় ভারতীয় নারী সমাজ ও বেঙ্গলি উইমেন’স এডুকেশন লীগ যথাক্রমে নারীদের ভোটাধিকার ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থায় নারীদের অন্তর্ভুক্তির জন্য লড়াই করেছিল। বাঙালি নারী অ্যাক্টিভিস্টরা নারীদের ভোটাধিকারকে একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক বিষয় হিসেবে নয় বরং নারীদের পক্ষে সামাজিক ও শিক্ষামূলক সংস্কারকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার একটি উপযুক্ত রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেছিল।১১১ নারীদের প্রশ্নের সমাধান এসময় নারীদের সংস্কারে নয় বরং কতিপয় সামাজিক চর্চার মূলোৎপাটনে শায়িত ছিল; এর ভেতর সবচেয়ে আলোচিত আবেদন ছিল বাল্যবিবাহ প্রথার সংস্কার, যার ফলাফল হিসেবে ১৯২৯ সালে সারদা আইন পাশ হয়।১১২
উনিশ শতকের শেষার্ধ থেকে প্রসারমান প্রিন্ট সংস্কৃতি শিক্ষিত নারীদের জন্য নতুন ডিসকার্সিভ এলাকা উন্মোচিত করে দিচ্ছিলো।
উনিশ শতকের শেষার্ধ থেকে প্রসারমান প্রিন্ট সংস্কৃতি শিক্ষিত নারীদের জন্য নতুন ডিসকার্সিভ এলাকা উন্মোচিত করে দিচ্ছিলো। উনিশ শতকের শেষ দিকে নারীদের ম্যাগাজিনে কৃষ্ণভাবিনী দাস, স্বর্ণকুমারী দেবীর মতো অসংখ্য নারী লেখকের রচনাসমূহের মুক্তিপরায়ণ ক্ষমতা প্রায়শই পুরুষনিয়ন্ত্রিত বুদ্ধিবৃত্তিক ডিসকোর্সকে ছাপিয়ে যাচ্ছিলো।১১৩ উদাহরণস্বরূপ কৃষ্ণভাবিনীর লেখাগুলোর কথা বলা যায় যেখানে উচ্চশিক্ষার দাবিকে ব্যক্তিগত ও সামাজিক অগ্রগামিতা এবং ‘অর্থনৈতিক দৃঢ়তা’ ও বৃহত্তর সামাজিক শক্তির সাথে সচেতনভাবে যুক্ত করা হয়েছিল।১১৪
যাই হোক, বাল্যবিবাহ ও নারীশিক্ষা নারীদের সামাজিক ও শিক্ষাগত সংস্কারের সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক দুইটি দাবি হিসেবে অবস্থান বজায় রেখেছিল এবং উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে আলোচনা ও বিতর্কে বর্তমান ছিল। ১৮৬৩ সালে কৈলাশবাসিনী দেবী তাঁর হিন্দু মহিলাগণের হীনাবস্থা শীর্ষক রচনায় কম বয়সে মাতৃত্ব এবং এর ফলে মা ও শিশুর স্বাস্থ্যকে দুর্বল করে দেয়া প্রভাবসমূহে আলোকপাতের মাধ্যমে বাল্যবিবাহের বিপদ তুলে ধরতে গিয়ে বলেন :
বাল্যবিবাহ রোধ না করা পর্যন্ত আমাদের দেশে কখনো সুখ ও সমৃদ্ধি আসবে না, দাম্পত্যে সমন্বয়ও কখনো প্রতিষ্ঠিত হবে না এবং বৈধব্যের যন্ত্রণাদায়ক পীড়া থেকে কন্যাশিশুরা রক্ষা পাবে না; বাঙালিদের পিছিয়ে থাকার অন্যতম প্রধান কারণ হলো বাল্যবিবাহের উত্থান…এমন অনেক ঘটনা আছে যেখানে বারো বা তেরো বছরের বালিকারা গার্হস্থ্য বিষয়াদিতে প্রবেশ করেছে আর এর ফলে নিজেদেরকে কঠিন বিপদে ফেলে দিয়েছে। কেউ কেউ নবজাতকের সাথে পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়…কেউ কেউ এই দুর্ভাগ্য এড়িয়ে গেলেও নিজের শিশুকে হারায়…নতুন মাকে জন্মদান পরবর্তী রোগের সংস্পর্শে এসে নিদারুণ ভোগান্তি পোহাতে হতে পারে; অথবা মা-বাবার দুর্দশা বাড়িয়ে শিশু হতে পারে খুবই দুর্বল ও ক্ষীণকায়।১১৫
শতাব্দীর পরিবর্তনের সময় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নারীরা ধাত্রীবৃত্তি চর্চার অসুরক্ষিত প্রকৃতি নিয়ে ভদ্রলোকদের সচেতনতাগুলোকে যথেষ্টভাবে আত্মীকৃত করে; একই সাথে আত্মীকৃত করে মা ও শিশুকে অশিক্ষিত দাইদের যত্নের হাতে ছেড়ে দেয়ার সম্ভাব্য বিপদগুলোকে। অন্তঃপুর-এর মতো জার্নালগুলোতে নারীদের লেখায় এসব সচেতনতা ফুটে উঠতো এবং জন্মদানের চর্চার আধুনিকায়নের প্রয়োজনীয়তা ব্যক্ত করা হতো।১১৬ তবে এসব লেখা দ্বারা মধ্যবিত্ত নারীদের সিংহভাগ শিশুজন্মদানের সময় চিকিৎসাজনিত উপস্থিতির ক্ষেত্রে আসলে কী চাচ্ছিলো সে বিষয়ে ভুল বোঝা ঠিক হবে না। মনীষা লাল আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, সাধারণ মধ্যবিত্ত নারীরা তখনও স্থানীয় দাইদেরকে কাজ দিতে পছন্দ করতো যাদেরকে সহজে ও কম খরচে পাওয়া যায়।১১৭
যাই হোক, নারীদের লেখাগুলোতে তাদের বিদ্যমান স্বাস্থ্যাবস্থার সংস্কার খোঁজার ক্ষেত্রে মধ্যপন্থি হওয়া থেকে নিম্নগামী স্বাস্থ্যাবস্থাকে অন্যান্য সামাজিক বিরূপতার সাথে যুক্ত করা হতো যেগুলোকে বাংলার দমনমূলক পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো বাঁচিয়ে রেখেছিল। ১৯০১ ও ১৯০৩ সালে অন্তঃপুর-এ প্রকাশিত দুইটি প্রবন্ধে নারী লেখকদের এই ভিন্নমুখী অবস্থান স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।
প্রথম প্রবন্ধটি হলো অন্তঃপুর-এর সম্পাদক হেমন্তকুমারী চৌধুরীর লেখা ভারত মহিলার স্বাস্থ্য; এতে গৃহকর্ত্রীদের স্বাস্থ্যের শোচনীয় অবস্থায় আলোকপাত করা হয় এবং এই অবস্থাকে নারীশিক্ষার পাঠ্যক্রমে অপরিহার্য অংশ হিসেবে স্বাস্থ্যশিক্ষাকে যুক্ত করার শক্তিশালী প্রেক্ষাপট প্রদান করে। ‘গার্হস্থ্যবিদ্যা, শিশুপালন ও রন্ধন’-এর সাথে সাথে স্বাস্থ্যশিক্ষাকে স্থান দেয়ারও আর্জি জানানো হয়। শোকাভিভূত হয়ে তিনি বলেন :
সাম্প্রতিক সময়ে, নারীশিক্ষা অত্যন্ত গতিশীল হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এবং প্রতি বছর বিদ্যালয় থেকে পাশ করে বের হওয়ার পর কতিপয় নারী বিখ্যাত হচ্ছে। কিন্তু তাদের স্বাস্থ্যাবস্থা অনুসন্ধান করলে কী দেখা যায়? তাদের অধিকাংশই চোখে কম দেখা, মানসিক রোগ ও অন্যান্য অসুখে ভোগে। স্বাস্থ্যসংক্রান্ত নিয়মগুলো না মানা এর প্রধান কারণ। বর্তমান সময়ে আমাদের মনোযোগ বাইরের পৃথিবীর দিকে। মিউনিসিপালটির নজরদারিতে রাস্তাসমূহকে পরিষ্কার রাখার বিষয়ে প্রায়শই প্রতিবাদী আন্দোলন হয়। কিন্তু অন্তঃপুরের নারীদের অবস্থা নিয়ে ভাবার মতো সময় কারো আছে বলে মনে হয় না। অন্তঃপুরে জন্মানো ও বেড়ে উঠা এবং মৃত্যু পর্যন্ত এর সাথে অবিচ্ছেদ্য ও স্থায়ী বন্ধন থাকা কেউ কি কখনো সেখানে নারীদের অবস্থায় আলোকপাত করেছে? গার্হস্থ্যের গৃহকর্ত্রীদের খারাপ স্বাস্থ্য দেখা হতাশাজনক, যাদের উপর পরিবার, সমাজ ও জাতির শান্তি ও উন্নতি নির্ভর করছে।১১৮
এই প্রবন্ধ পরিবার, সমাজ ও জাতির উন্নয়নে নারীদের স্বাস্থ্যের কেন্দ্রীয়তায় আলোকপাত করে। আধুনিক জাতির রাজনৈতিক সংজ্ঞায়ন যেহেতু তখনও হয় নি, তাই এখানে জাতি দ্বারা সমাজকে নির্দেশ করা একটি সাংস্কৃতিক বোধ হিসেবে একে ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে; এক্ষেত্রে স্বরূপা গুপ্ত বলেন, এখানে জাতি একটি ‘ছাতাসদৃশ ধারণা’ যা পরিবার, জাত, বর্ণ ও ধর্মকে এক করে এবং এটি প্রাক-আধুনিক যুগে বাঙালি পরিচিতি ও জাতিত্ব তৈরির একটি শক্তিশালী ধারণামূলক ধারা।১১৯ গৃহ পরিচালনা তথা গার্হস্থ্য কর্মাদি ও স্বামী ও সন্তানের প্রতি দায়িত্ব পালনের জন্য নারীকে তৈরি করতে ভালো শারীরিক স্বাস্থ্যের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে লেখক এখানে গৃহ, সমাজ ও জাতীয় ক্ষেত্রে একজন আদর্শ নারীর ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত, সেই পিতৃতান্ত্রিক অবস্থানকেই গ্রহণ করেছেন। নারীদের শারীরিক অসুস্থতাপূর্ণ জীবনের আলোকপাত করে তিনি বাঙালি সমাজে নারীদের হীনাবস্থার দিকে ইঙ্গিত করলেও বেশ স্পষ্টভাবেই পিতৃতন্ত্রের সরাসরি সমালোচনা থেকে দূরে থেকেছেন।
এই প্রবন্ধের প্রকাশ একজন সাধারণ গৃহবন্দি নারীর কাছে একটি চিত্তাকর্ষক সাড়া আহ্বান করেছিল যিনি নারীদের প্রজনন জীবনের সাথে সম্পর্কিত নানা ধরনের রোগ ব্যাখ্যা করতে জরায়ুর কেন্দ্রীয়তাকে মেনে নিয়েছেন। এটি দেখায় কিভাবে বাঙালি ভদ্রমহিলারা শতাব্দীর পরিবর্তনের সময় নিজেদের স্বল্পভাষিতাকে একপাশে সরিয়ে রেখে তাদের স্বাস্থ্য বিষয়ে জনপরিসরে কথা বলেছিল।১২০
উনিশ শতকে শিশুজন্ম, শিশুর লালন-পালন ও নারীদের সাধারণ স্বাস্থ্যবিষয়ক ইস্যু নিয়ে আধুনিক বৈজ্ঞানিক ভাবনাগুলো বাঙালি সমাজে ধীরে ধীরে নিজেদের অবস্থান তৈরি করে নিচ্ছিলো।
পরের প্রবন্ধটি ১৯০৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল মহিলার স্বাস্থ্য শিরোনামে, এর লেখক ছিলেন একজন নারী যিনি নাম প্রকাশ না করে ‘একজন সাধারণ হিন্দু নারী’ নামে লিখেছিলেন। নারীর শারীরিক, মানসিক ও প্রজনন স্বাস্থ্যের অবনতিকে ব্যাখ্যার জন্য এই প্রবন্ধ যে পথ বেছে নেয় তা ছিল আরো বেশি উদ্ভাসিত। এটি করতে গিয়ে এই প্রবন্ধ পিতৃতান্ত্রিক বাঙালি সমাজের নিয়ন্ত্রিত সীমানাগুলো ছাপিয়ে গিয়েছিল এবং একটি প্রারম্ভিক কিন্তু বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নারীবাদী সচেতনতাকে গ্রহণ করেছিল। উনিশ শতকের শেষ দিকের পুনর্জাগরণবাদী-পিতৃতান্ত্রিক ডিসকোর্সে গ্রহণকৃত ও স্বাভাবিকিকৃত বাল্যবিবাহ ও অল্প বয়সে মাতৃত্বের মতো গভীরভাবে প্রোথিত সামাজিক প্রথাগুলোকে এটি নির্ভীকভাবে জেরা করে। বাঙালি নারীদের স্বাস্থ্যের অবনতির জন্য এটি তিনটি কারণ চিহ্নিত করে, অল্প বয়সে অনেক বেশি গর্ভধারণ, পুরুষদের নৈতিক স্খলন ও নারীদের অলসতা। বাল্যবিবাহকে সরাসরি নিন্দা না করে এখানে অল্প বয়সে যৌন সম্পর্ককে কন্যাবধূর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষমতাবান ক্ষতিকর হিসেবে নিন্দা করা হয়, একই সাথে অল্প বয়সে মাতৃত্বকে এমন সব সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবনতির জন্য দায়ী করা হয় যেগুলোর কারণে নারীদের ভুগতে হয়। এই প্রবন্ধে বলা হয় :
অল্প বয়সী মায়েরা তাদের স্বামীদের সন্তুষ্টও করতে পারে না, আবার তার শিশুকে স্নেহের সাথে বড় করতেও তারা অক্ষম…মধ্যবিত্ত নারীদের ৯০ শতাংশ সঠিক পুষ্টি ও যত্ন পায় না…বধূ একটি সন্তান জন্ম দিতে পারলো কিনা তা নিয়েই স্বামীর পরিবারের সচেতনতা কাজ করে, কিন্তু তার স্বাস্থ্য নিয়ে কেউ ভাবে না। কিছু কিছু নারী জন্মদানের সাথে সাথেই মারা যায়। বাকিরা প্রতি বছর গর্ভধারণ করতে থাকে। এমন নিয়মিত গর্ভধারণ কীভাবে ভালো স্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা দিবে? এখনকার হিন্দু বাড়িগুলোতে ১৬/১৭ বছরের বালিকাদের তিন/চার সন্তানের মা হতে দেখা যায়…আমার প্রিয় বোনেরা, আমরা যদি আমাদের শরীরের যত্ন না নেই, তাহলে কে নিবে?১২১
লেখিকা যেভাবে সাহসিকতার সাথে পুরুষদের নৈতিক স্খলনের বিষয়টি তুলে ধরেছেন সেখানে নারী লেখকের বিষয়নিষ্ঠতা স্পষ্ট। এখানে অল্প বয়সী মায়ের মানসিক যন্ত্রণার দুঃখজনক চিত্র ফুটে উঠেছে যেখানে এই মায়েরা বহুসংখ্যক শিশুর লালন-পালনের চাপে পিষ্ট হয়ে ক্লান্ত ও কৃশকায় হয়ে যায়, আর এর ফলে তাদের স্বামীদের যথাযথ যত্ন ও ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করে। এই স্বামীরা পতিতাদের ঘরে সুখের সন্ধান করে। এই নৈতিক স্খলন নিয়ে আলোচনা করে লেখক বিস্ময়াভিভূত হয়ে বলেন :
নৈতিক চরিত্র হারিয়ে বহুসংখ্যক অল্পবয়সী পুরুষ কেন এখন নতুন নতুন রোগের শিকার হয়ে তাদের জীবন হারাচ্ছে?…বেঁচে থাকলেও এদের অনেকেই আপত্তিকর রোগে যন্ত্রণাপ্রাপ্ত হচ্ছে যা তাদের স্ত্রীদের ও ভবিষ্যত জাতির জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলছে। কেন কেউ এমন ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে চিন্তা করছে না?১২২
এভাবে এই প্রবন্ধ পিতৃতন্ত্রের এক শক্তিশালী সমালোচনা তৈরি করে। একই সাথে মুক্তিপ্রাপ্তি ও ক্ষমতায়িতকরণের চর্চা হিসেবে এটি নারীদের নিজেদের শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তবে নারীত্বের অস্তিত্ব সংজ্ঞায়নের একমাত্র বৈধ স্বীকৃতি হিসেবে জননী ও গৃহিণীর সাংস্কৃতিক ধারার প্রতি চলমান আনুগত্যের বিষয়টি নারীবাদের এই প্রারম্ভিক প্রকাশে অপরিবর্তিত ছিল। এ ধরনের সাংস্কৃতিক ধারাগুলো নারীদেরকে তাদেরই ধারণায় প্রগতি ও পুনরুজ্জীবনের জাতীয় এজেন্ডার কেন্দ্রে স্থাপন করেছিল।
উপসংহার
উনিশ শতকে নারীদের জার্নালের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ধাত্রীবৃত্তি সংক্রান্ত পশ্চিমা ভাবনাসমূহের অধিকাংশই (যেমন, পরিচ্ছন্ন সূতিকাঘরের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বিতর্ক অথবা অস্বাভাবিক জন্মগ্রহণ চিহ্নিত করার জন্য ভ্রূণের মাথার আকার ও শ্রোণিচক্রের গঠনের অসামঞ্জস্যতার গুরুত্ব অথবা দাইদের বাতিলকরণ) বিশ শতকের মা ও শিশুর কল্যাণের জাতীয়তাবাদী ডিসকোর্সে কেন্দ্রীয়তা অর্জন করেছিল। তাই বলা যায় যে এই বিষয়ে উনিশ শতকের বিতর্কগুলো বিশ শতকের ডিসকোর্সের জন্য ডিসকার্সিভ ক্ষেত্র তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। শুধুমাত্র প্রেক্ষাপট ও যৌক্তিকতা পরিবর্তিত হয়েছিল। উনিশ শতকের তর্কগুলোর পেছনে যেখানে ছিল যুক্তি এবং আধুনিকায়ন ও আত্মোন্নয়নে ভদ্রলোকদের তাড়না; সেখানে বিশ শতকে এতে ছিল জাতীয়তাবাদী ও রাজনৈতিক সুর এবং মাতৃত্ব ও বাঙালি জাতির ভবিষ্যত নিয়ে প্রচণ্ড আবেগী বিতর্কে পতিত হওয়া।
শেষ করতে গিয়ে বলা যায় যে, উনিশ শতকে শিশুজন্ম, শিশুর লালন-পালন ও নারীদের সাধারণ স্বাস্থ্যবিষয়ক ইস্যু নিয়ে আধুনিক বৈজ্ঞানিক ভাবনাগুলো বাঙালি সমাজে ধীরে ধীরে নিজেদের অবস্থান তৈরি করে নিচ্ছিলো। এসব চর্চা পরিবর্তনের পক্ষে বেশ ধীরগতির ছিল। তারপরও দাইদের নিয়ন্ত্রণ থেকে ধাত্রীবৃত্তিকে মুক্ত করে প্রশিক্ষিত পেশাজীবীদের হাতে তুলে দেয়ার প্রয়োজনীয়তা বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। ১৮৪১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা পাঠ্যক্রমে ধাত্রীবৃত্তির অন্তর্ভুক্তি ছিল সূচনাবিন্দু, যাকে অনুসরণ করে এই ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখা নারী ও পুরুষ অনুশীলনকারীদের উদ্ভব ঘটে। এই অবস্থান থেকে আমরা পরের অধ্যায় শুরু করবো।
টীকা
১০৮ Hemantakumari Chaudhury, ‘Bharat Mahilar Svasthya (Health of Indian Women)’, Antahpur, Vol.4, No.7, July 1901, 149–151.
১০৯ Murshid, Reluctant Debutante, 94–95.
১১০ প্রাগুক্ত
১১১ Southard, The Women’s Movement and Colonial Politics in Bengal, Chapter 3.
১১২ Sinha, Specters of Mother India, 51.
১১৩ নারীর ক্ষমতায়নের কেমন শক্তি শিক্ষার ভেতর ছিল তা নিয়ে বলেছেন মালিনি ভট্টাচার্য, যদিও এই শক্তি ব্যবহৃত হয়েছিল নিছক পরিবার ও গৃহের সংশোধিত চাহিদার জন্য নয়, বরং আত্মোন্নয়ন ও অভিব্যক্তি প্রকাশের ক্ষেত্রেও; নিজেদের সামাজিক অবস্থার নানা ধরনের অসাম্যের কার্যকর সমালোচনার সুযোগ দেয়ার ক্ষেত্রে নারীদের জন্য এটি ছিল এক ধারণাগত হাতিয়ার। বিস্তারিত জানতে দেখুন, Malini Bhattacharya and Abhijit Sen, eds. Talking of Power: Early Writings of Bengali Women from the Mid-19th to the Beginning of the Twentieth Century, Kolkata: Stree, 2003, 3.
১১৪ Banerji, ‘Fashioning a Self’, 55–58.
১১৫ Kailashbasini Devi, ‘The Woeful Plight of Hindu Women’, in Bhattacharya and Sen, ed. Talking of Power, 40.
১১৬ See for instance, Dasi, ‘Sutikagar e prasutir cikitsa’; Chaudhury, ‘Sutikagriha’.
১১৭ Lal, ‘The Politics of Gender and Medicine’. কৈলাশবাসিনী দেবী, সুধা মজুমদারের মতো নারীরা তাদের দাইদেরকে বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক হিসেবে বর্ণনা করেছেন। দেখুন, Chandrika Paul, ‘The Uneasy Alliance: The Work of British and Bengali Medical Professionals, 1870–1935’, Unpublished PhD dissertation, University of Cincinnati, 1997, 182–184.
১১৮ Chaudhury, ‘Bharat Mahilar Svasthya’, 150.
১১৯ Swarupa Gupta, ‘Notions of Nationhood in Bengal: Perspectives on Samaj, 1867–1905’, Modern Asian Studies, Vol.40, No.2, 2006, 273–302.
১২০ Sarojini Devi, ‘Mahilar Svasthya Sambandhe Koyekti Katha (Few Words About Indian Women’s Health)’, Antahpur, Vol.4, No.12, December 1901, 269.
১২১ ‘Mahilar Svasthya (Women’s Health)’, Antahpur, Vol.4, No.3, June–July 1903, 58.
১২২ প্রাগুক্ত
পড়ুন ।। কিস্তি ৪
ঔপনিবেশিক আধুনিকতা : বাংলায় ধাত্রীবৃত্তি (১৮৬০-১৯৪৭) ।। কিস্তি : ৪