সুলোচনা মননধর ধিতাল — নেপালি কবি ও লেখক। সম্প্রতি দ্যা কাঠমান্ডু পোস্ট পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তার একটি সাক্ষাৎকার। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন শ্রীজু বজ্রাচার্য। এ সাক্ষাৎকারে সুলোচনা কথা বলেছেন লেখার প্রেরণা, অনুবাদ ও ভাষা বিষয়ে। সহজিয়ার পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটির সারভাগ অনুবাদ করেছেন শাহরিয়ার তপন।
সুলোচনা মননধর ধিতাল জন্মেছেন ১৯৫৫ সালে। জন্ম গ্রহণের আট মাসের মধ্যে মারা যান বাবা। বিধবা মায়ের তিন সন্তানের একজন ছিলেন তিনি। অভাব-দারিদ্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটেছে অত্যন্ত ছোটবেলায়। মায়ের হাসিমুখ দেখেছেন বলে মনে পড়ে না তার। সুলোচনার লক্ষ্য ছিল মাকে সুখী করা আর ভালো মেয়ে হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলা। ষাটের দশকে অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাওয়াটাই ছিল নেপালি প্রথা। সুলোচনা তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বরং ভর্তি হয়েছিলেন স্কুলে।
স্কুলে পড়ালেখা শেষে সুলোচনা যোগ দিয়েছিলেন শিক্ষকতায় এবং এই সূত্রে পেয়েছিলেন সাধারণ জনগণের তীব্র ভালোবাসা। তিনি বলেন, ‘স্কুলের আধিকাংশ শিক্ষার্থী আসত পোদ সম্প্রদায় থেকে। যাদের বিবেচনা করা হতো ‘পিছিয়ে পড়া জাত’ হিসেবে। শিক্ষকরা নিয়মিত ক্লাস নিতেন না। এই ছিল একটিা ঘটনা যা আমাকে শিক্ষকতা শুরু করতে প্রভাবিত করেছিল।’ কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলেছেন, ‘আমি যখন এই গোষ্ঠীগুলোতে পড়াচ্ছিলাম তখন আমি স্বাধীনতা ও সাহস অনুভব করেছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল পৃথিবীকে একটি ভালো অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমি আমার ভূমিকা পালন করছি।’
তরুণ বয়সে সুলোচনা ছিলেন বিপ্লবী। বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেছেন। সরকারি শোষণের বিরুদ্ধে অংশ নেয়ায় ধ্বংস করা হয়েছিল তার লেখা; যা তিনি আর উদ্ধার করতে পারেন নি। লেখালেখি থেকে দূরে ছিলেন বহু বছর। কিন্তু প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে ফিরেছিলেন লেখালেখিতে। রাত্রি তার একটি কবিতা-সংকলনের নাম। বইটি পাঠক-লেখকের দৃষ্টি কেড়েছে।
আপনার এই পথপরিক্রমায় প্রেরণা কী ছিল?
আমি যখন আমার শৈশবের কথা ভাবি, আমি ভাবি, অনেক জটিলতা ও যন্ত্রণার মুখোমুখি হতে হয়েছে আমাদের। এমন একটি পরিবারে আমি জন্মেছি যেখানে আমি জেনেছি আনন্দের চেয়ে বেদনা ভালো।
খুব অল্প বয়সে আমার মা তার তিন মেয়ে নিয়ে বিধবা হন। সমাজ আমাদের দিকে অন্যভাবে তাকাতো। পুরুষবিহীন কোনো পরিবারকে কখনোই ভালো চোখে দেখা হতো না। মেয়েদের কখনোই ছেলেদের মতো ভালো ভাবা হতো না। আমার জন্মের মাত্র আট মাস পর যখন আমার বাবা মারা যান, অন্ধকার হয়ে ওঠে আমাদের বাড়ির অংশ। বড় বড় হতে হতে দেখেছি আমার মা সব সময় দুর্ভোগ ও অস্থিরতার মধ্যে দিন পার করছেন। সেই দিনগুলোতে আমি কখনোই তাকে সুখী দেখি নি। শিশু হিসেবে আমরা কখনোই আমাদের মায়ের সামনে কাঁদার সাহস দেখাতাম না; কারণ আমরা কোনো বাড়তি চাপ সৃষ্টি করতে চাই নি। আমরা সব সময় সাহসের সঙ্গে সমস্যা মোকাবিলা করার চেষ্টা করেছি।
আমি সব সময় ভেবেছি কীভাবে আমাকে ভালো কন্যা হতে হবে, যেভাবে পারি মায়ের মুখে হাসি ফোটানো প্রয়োজন। আমার মনে পড়ে না যে, মায়ের কাছ থেকে খুব বেশি কিছু আবদার করতাম। আমি শুধু চেয়েছিলাম তিনি সুখী হোন। আমাদের বাড়ি ছিল বই-খাতাশূন্য। আর আমাদের শৈশব ছিল সুযোগ-সুবিধা ও উপকরণ বঞ্চিত। আমি সৌভাগ্যবান ছিলাম এ কারণে যে, আমি স্কুলে ভর্তি হতে পেরেছিলাম। সম্ভবত আমার জন্য একটা চ্যালেঞ্জিং শৈশব ছিল যেটি আমাকে আমার জীবন দিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ কোনো কিছু করার দিকে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
আশির দশকে আপনি লেখালেখি থেকে কিছুটা বিরতি নিয়েছিলেন। কেন? কী আপনাকে আবারও লেখার দিকে টেনে আনল?
সেই দিনগুলোতে আমি লেখকের চাইতে বেশি পরিমাণে সমাজ পরিবর্তনের অংশীদার হয়ে উঠেছিলাম। সে লক্ষ্যেই আমি লিখতাম। আমরা খুব বিপদজনক একটি সময়ে বাস করছিলাম। সরকারের বিরুদ্ধে যারা কণ্ঠস্বর উঁচু করেছিল তাদের রোধ করা হয়েছিল। নিরাপদে রাখার জন্য আমি আমার বই ও লেখালেখি পাঠিয়ে দিয়েছিলাম আমার বন্ধু অস্তলক্ষ্মী শাক্যর বাড়িতে। বিত্তবান পরিবারে জন্মেছিল সে; আমি ভেবেছিলাম সরকার তার বাড়িতে অভিযান চালাবে না। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সরকার তা করেছিল এবং আমি আমার কবিতাসংগ্রহ পুনরুদ্ধার করতে পারি নি। আমি আমার কবিতার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিলাম কারণ সেগুলো আমাদের রাজনৈতিক নিশানার দিকে জনতাকে উদ্বুদ্ধ করত। সে সময় আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা নারী ও তরুণদের কাছে কবিতা পড়ে সময় ব্যয় করতাম। ওই ক্ষতির অনুভূতি অতিক্রম করতে আমার অনেক সময় লেগেছিল। আমি কবিতা লেখার প্রতি আমার ধাবিত হয়েছিলাম চিন থেকে ফেরার পর; আবাসিক চিকিৎসক প্রোগ্রামের কারণে আমার স্বামীর সঙ্গে আমাকে কয়েক বছর চিনে থাকতে হয়েছিল। চিনে জনাকয়েক পাঠক আমার লেখালেখি নিয়ে সমালোচনামূলক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করল। এ ঘটনা থেকে আমার উপলব্ধি হলো, লেখার এক ধরনের প্রভাব আছে।
কেন লেখালেখি? আমরা কি এ বিষয়ে খানিকটা কথা বলতে পারি, কবিতা কেন শক্তিশালী?
আমি বিশ্বাস করি আমি একজন স্বাধীন লেখক। লেখালেখির কোনো রূপ-রীতির সঙ্গে নিজেকে বেঁধে ফেলি নি। আমি লিখি, কারণ আমি আমার অনুভূতিকে কলমের ডগায় উপস্থাপন করতে পছন্দ করি। আমি ছোটগল্প লিখি, কারণ যে সময় ও পৃথিবীতে আমরা বসবাস করছি তার প্রতিচ্চিত্র ধারণ করতে ছোটগল্প বিরাট মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। আমি প্রবন্ধ লিখতে পছন্দ করি, কারণ রীতির দিক থেকে এটি বেশ মুক্ত, স্বাধীন। আমি ভ্রমণবিবরণ লিখতে পছন্দ করি, কারণ জীবন নিজেই একটা সফর। নানাভাবে সারা জীবনে লেখক বহু রকম গল্প যাপন করে থাকে; তারা চাইলে যেকোনো কিছু নিয়ে তারা লিখতে পারে।
লেখক হওয়ার একমাত্র উপায় হলো লেখা এবং লেখা। একমাত্র দায়বদ্ধতা আপনার দরকার, তা হলো নিজের নির্মাণদক্ষতাকে সমৃদ্ধ করা।
আমি কবিতা পছন্দ করি, কারণ কবিতা অনুভূতি ধারণ করে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, কবিতা মানুষকে যতোটা বোঝানোর ব্যাপার তার চেয়ে বেশি আবেগ ও অনুভূতি প্রকাশের ব্যাপার। ‘সাথী’ কবিতায়, যেটি আমার রাত কবিতার বইয়ে সংকলিত হয়েছে, সেখানে আমি বলার চেষ্টা করেছি, রাত্রি আপনার বন্ধু হতে পারে। আমি এও ভাবি যে, কবিতা কাজ করতে সক্ষম, কেননা অনেকেই কোনো বিষয়কে একইভাবে অনুভব করতে সক্ষম; কবিতায় আমি যা বলছি, যারা আমার কবিতা পড়ছে তারা তার সঙ্গে নিজের অনুভবকে সম্পৃক্ত করতে পারে। কেউ যখন কবিতায় প্রকাশিত উপলব্ধির সঙ্গে নিজের অনুভূতি সম্পৃক্ত করতে পারে তখন কবিতা হয়ে ওঠে অধিক উপলব্ধিযোগ্য ও প্রবেশযোগ্য বিষয়। এভাবেই কবিতা সামনের পথকে আলোকিত করে।
আমরা একটু রাত্রি বিষয়ে কথা বলি। দ্বিতীয়বারের মতো বইটি পুনঃমুদ্রিত হতে যাচ্ছে। কবিতা সংকলনটি আপনার কাছে কী অর্থ বহন করে? কখন কীভাবে আপনি রাত্রি বিষয়ক কবিতা লেখা শুরু করলেন?
আমি রাত্রি সংকলনটি প্রকাশ করেছি ২০১৪ সালে। এই বইটি আমি লিখেছি প্রায় ১৭ বছর ধরে। মেঘরাজ শর্মা নেপাল — যিনি একজন গায়ক, লেখক ও কবি, অথবা মঞ্জুল রাত্রি বিষয়ক একটি কবিতা পড়ে এ বিষয়ে আমাকে আরও কিছু কবিতা লেখার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি বলেন, আমার কবিতায় তিনি যেন নিজের গল্প পড়ছেন। তারপর আমার মাথায় যেসব শব্দ আসত তা-ই লিখে রাখতে আরম্ভ করলাম। রাত্রি বিষয়ক লেখা জারি রাখলাম, এমনকি এই দিনেও। আমি জানি না, আমার ডায়রিতে যা আছে আদৌ তা প্রকাশ করব কিনা। সব সময়ই আমার রাতের বেলায় ঘুমের সমস্যা হয়; আমি তাই রাতের বেলায় রাত্রি বিষয়ক লেখা লিখতে শুরু করি।
এক দিক থেকে রাতের বেলায় ঘুমাতে না পারার ব্যর্থতা অর্থবহও, কারণ এই ব্যর্থতা আমাকে বেঁচে থাকার জন্য আরও কিছু সময় দিয়েছে — ঘুমাতে যাদের সমস্যা হয় না তাদের তুলনায় বাড়তি সময় পেয়েছি আমি। রাতের বেলায় লিখি, কারণ সবাই যখন ঘুমায় তখন নিজের বেপরোয় চিন্তাধারার প্রতিরোধ করা কঠিন। কখনও কখনও আমি দেখেছি যে, রাত্রির অন্ধকারে জীবন সম্পর্কিত ভাবনা মনে হামাগুড়ি দেয়। চিন্তা থেকে পালানোর বদলে আমি এগুলোর আতিথেয়তা করতে আরম্ভ করলাম, উদযাপন করতে আরম্ভ করলাম এবং তাদের সঙ্গে বন্ধুর মতো যোগাযোগ স্থাপন করতে থাকলাম। আর এভাবেই জন্ম পেলো রাত্রি।
সংকলনটি আমার খুব প্রিয়। এর অনুবাদ এবং পর পর দুবার পুনঃমুদ্রণ আমার জন্য অনেক বেশি অর্থবহ; কারণ বইটির অনুবাদ আমাকে আরও অধিক পাঠকের কাছে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে। অনুবাদ করে দিয়ে মুনা বিরাট বড় একটি কাজ করেছে। আমার কবিতার পেছনের আবেগ যথার্থভাবে ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে, যেন সে আমিই, আমার অপর সত্তা। আমি বাজে অনুবাদ দেখেছি, আর জানি তা কী কাজ করতে পারে। কিন্তু মুনার অনুবাদ ভালো অনুবাদের চেয়েও বেশি কিছু।
আমাদের ভাষা আন্দোলনে নেপালির অনুবাদ এবং নেপালি ভাষার লেখালেখি কীভাবে সহায়তা করতে পারে? সংস্কৃতিকে শক্তিশালী করতে অনুবাদের ভূমিকা সম্পর্কে আপনার ভাবনা কী?
সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত বাধা অতিক্রম করতে অনুবাদ সহায়তা করে। সাহিত্যকে তা আরও পাঠযোগ্য করে তোলে। অনুবাদ মূল লেখা সম্পর্কে পাঠককে কৌতূহলী করে তোলে। আমার লেখার অনুবাদ লেখক হিসেবে আমার কাজকে উৎকর্ষমণ্ডিত করতে পেরেছে। আমি যখন আবার লিখতে আরম্ভ করি তখন অনুবাদ আমার লেখাকে প্রাণবান করেছে। আমার লেখা চিনা, জাপানি ও ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
আমার কবিতার গ্রহণযোগ্যতার জন্য একজনের নাম আমি কখনোই ভুলব না, তিনি মঞ্জুশ্রী থাপা। ২০০৩ সালে নেপালি টাইমস পত্রিকার জন্য তিনি আমার অনুভূতিকা থোপাহারু সংকলনের দশটি কবিতা নেপালি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। ওই অনুবাদগুলো প্রকাশিত হবার পর জনসমাজে আমি কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করি।
আর তাই নেপালি ভাষার সাহিত্যকর্ম যখন অন্য ভাষায় অনূদিত হয় তখন সেই সাহিত্য এবং সংস্কৃতির মূল্যবোধ অধিকসংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছায়। আদবাসী ভাষা, যেমন নেপালভাষার মতো ভাষার জন্য অনুবাদ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ; কারণ তরুণ প্রজন্ম এ ভাষা ব্যবহারে আগ্রহী নয়। আমাদের আরও অনুবাদ প্রয়োজন, কারণ অনেক অনেক তরুণ তার সাহিত্য-ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন নয়।
তরুণ লেখকদের প্রতি আপনার পরামর্শ কী?
লেখক হওয়ার একমাত্র উপায় হলো লেখা এবং লেখা। একমাত্র দায়বদ্ধতা আপনার দরকার, তা হলো নিজের নির্মাণদক্ষতাকে সমৃদ্ধ করা। লেখার জন্য ত্যাগ, সময় ও সুযোগ দরকার। আপনি যদি লেখায় সময় বিনিয়োগ না করতে পারেন আপনি কখনোই ভালো করে লিখতে পারবেন না। অধ্যবসায় একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণ যা একজন লেখকের থাকা দরকার। এ প্রক্রিয়াতেই আপনাকে সক্রিয় থাকতে হবে, এমনকি কাজটি যখন ক্লান্তিকরও। আপনি যখন সময়কে যেতে দেবেন তখন আপনার গতিশীলতা নষ্ট হবে। আমার অনেক লেখার প্রকল্প অসমাপ্ত থেকে গেছে; কেননা আমি ত্যাগ স্বীকারে ব্যর্থ হয়েছিলাম। কিন্তু আমি আবার ফিরে যাবো। আমি এখনও একজন উৎসাহী লেখক।
সূত্র : দ্যা কাঠমান্ডু পোস্ট