বাংলাদেশে সংখ্যালঘুর কথাসাহিত্য ।। কিস্তি : ১০

গীতা দাস একজন সাহিত্যিক, কলামিস্ট এবং মানবাধিকার কর্মী। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত পত্রপত্রিকায় তার কলাম, প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও ছোটগল্প নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে। সহজিয়ার জন্য ধারাবাহিকভাবে লিখবেন বাংলাদেশের সংখ্যালঘুর কথাসাহিত্য প্রসঙ্গে। আজ প্রকাশিত হলো কিস্তি ১০

   ত্রিপুরা নৃগোষ্ঠীর কথাসাহিত্যে অসম্পূর্ণ বরেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ও অসংগঠিত শোভা ত্রিপুরা

বরেন্দ্র লাল ত্রিপুরা  

সোনালী ঊষা ধূসর গোধূলী ত্রিপুরা নৃগোষ্ঠীর বাংলা ভাষায় রচিত দ্বিতীয় ও আপাত ফলাফলে শেষ উপন্যাস। বরেন্দ্র লাল ত্রিপুরার পর বিগত দুই যুগেও আর কোনো উপন্যাস রচিত হয়নি এবং প্রভাংশু ত্রিপুরারউত্তরের মেঘ উপন্যাসের কপির কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি বিধায় এটাই ত্রিপুরা নৃগোষ্ঠীর বাংলা ভাষায় রচিত একমাত্র প্রাপ্ত উপন্যাস হিসেবে আলোচনা করা হচ্ছে।

 

লেখক বরেন্দ্র লাল ত্রিপুরা নিজেই উপন্যাসটির কাহিনি সংক্ষেপ বইয়ের ফ্ল্যাপে লিখে দিয়েছেন যা এখানে সংযোজন করছি।

কৈশোর পেরিয়ে সদ্য যৌবনে পদার্পণকারী পাহাড়ী যুবক প্লাবন। আর বন্যা প্রকৃতির নিতুল হাতে গড়া, চটুল ঝরণার মত চঞ্চলা পাহাড়ী ললনা। বিভিন্ন ঘটনাক্রম ও পরিচয়ের সূত্রে তাদের মধ্যে গড়ে উঠে মিষ্টি ও চমৎকার কৌশোর প্রেম। পরবর্তীতে প্লট ডেভেলপমেন্টের সাথে সাথে উপন্যাসে উঠে এসেছে পার্বত্য চট্টগ্রামের নৈসর্গিক সৌন্দর্য, সেখানকার আদিবাসীদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট, অধিকারের দাবি, ভালবাসার সুখ, ভালবাসার দুঃখ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া একজন ছাত্রের জীবনের বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত এবং সংকট উত্তরণের দৃপ্ত প্রয়াস। সর্বোপরি একটি এন্টিক্লাইমেক্স উপন্যাসের রসোপাদান।

কাহিনি ও বইয়ের ফ্ল্যাপে লেখকের পরিচিতি পড়ে বইটিকে একটি আত্মজৈবনিক উপন্যাস বলা যায়। লেখকের রাঙামাটিতে কলেজ জীবন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পর্যন্ত এর কাহিনির পরিসর। উপন্যাসটি লেখাও হয়েছে লেখকের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত অবস্থায়। কৈশোর উত্তীর্ণ বয়সের ভাবাবেগে ভরপুর কিছু ঘটনার সমারোহ। প্রেমিকার বিরহে তাকে ‘হারামজাদী’ গালি দিতেও সংকোচ নেই। তখনকার সময়ে প্রেম প্রকাশের মাধ্যম, প্রেমের আদান-প্রদান হতো পাতার পর পাতা চিঠি লিখে। এ উপন্যাসে তা বহুল পরিমাণে ব্যবহৃত হয়েছে।

 

ত্রিপুরা নৃগোষ্ঠী ও ত্রিপুরা রাজ্যের কথা বিভিন্নভাবে বইটিতে এসেছে। যেমন :

  • “বিয়ে করেছেন ইন্ডিয়ার ত্রিপুরা রাজ্যের একটা মেয়েকে।” (ত্রিপুরা, ১৯৯৭, ৫)
  • “প্লাবনের হাতে একটা বই ছিল “ত্রিপুরার ইতিহাস”।” (ত্রিপুরা, ১৯৯৭, ১১)
  • “তুমি কি প্রশান্ত দা’র নাম শুনেছ? না। ওনি হচ্ছেন ত্রিপুরাদের মধ্যে প্রথম আমেরিকা ফেরত এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার।”(ত্রিপুরা, ১৯৯৭, ৭৭)

পাহাড়ে নিরাপত্তার বিশেষ ব্যবস্থা, খ্রীষ্টান ও হিন্দু ত্রিপুরাদের মধ্যে সহিংসতা, পার্বত্য চট্টগ্রামের দরিদ্রতা, সামরিক বাহিনীর অত্যাচার, বাঙালিদের অর্থনৈতিক শোষণ, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের দাবীসমূহের কথা উল্লেখ করার মাধ্যমে লেখক পার্বত্য চট্টগ্রামের সংখ্যালঘুর জীবনালেখ্য প্রতিফলনের চেষ্টা করেছেন। যেমন,

  • “অজানা এক আশংকায় তাঁর ভ্রু কুঁচকে উঠল। ভাবলেন, “নিশ্চয় কোন গন্ডগোল হয়েছে সনাতন আর খ্রীষ্টান ত্রিপুরাদের মধ্যে।” (ত্রিপুরা, ১৯৯৭, ৩৫)
  • “আবার অনেকের সরলতার সুযোগের সদ্ব্যবহার করে তাদের ঠকিয়ে জায়গা জমি হটিয়ে নিচ্ছে সমতলবাসী চতুর মানুষেরা।” (ত্রিপুরা, ১৯৯৭, ৫৫)
  • “পথে কিছুক্ষণ পরপরই গাড়িতে ব্যাগ খুলে দেখাতে হয় নিরাপত্তা বাহিনীর লোকদের। … নিজেকেই কাপড়-চোপড় ওল্টিয়ে দেখাতে হয়। সে বুঝতে পারে এটা তাঁর মৌলিক গণতান্ত্রিক নাগরিক অধিকারের লংঘন। কিন্তু তাঁর প্রতিবাদ করার বা কিছু বলার উপায় নেই। এ বাঘের চামড়া পরিহিত লোকদের দৌরাত্ম তাঁর ভালভাবেই জানা আছে।” (ত্রিপুরা, ১৯৯৭, ৭৮)
  • “প্লাবনের বাবা অসুস্থ স্ত্রীকে ডা: দেখানোর জন্য বাজারে যাওয়ার কারণে পারেনি যথাসময়ে বাঁশ ও বেত গাছ দিয়ে আসতে। এজন্য ক্যাম্পে তলব করা হয় তাকে। আদেশ ভঙ্গের অপরাধে তাকে বেত্রাঘাত করে নির্দেশ দেওয়া হয় পরদিনই যেন দ্বিগুণ গাছ বাঁশ নিয়ে ক্যাম্পে হাজির হয়।” (ত্রিপুরা, ১৯৯৭, ৭৮)

 

অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার বহি:প্রকাশ পাই বন্ধু ইকবাল ও বিলকিস চরিত্র সৃষ্টিতে; আজানের ধ্বনি উল্লেখে এবং সচেতনভাবে সংখ্যালঘু ছেলেদের জন্য সংরক্ষিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের কথাও বর্ণিত হয়েছে।

 

উপন্যাসটির সাহিত্যিক মূল্যের চেয়েও লেখকের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। তবে, ১৯৯৭ সালে প্রথম উপন্যাস প্রকাশ করে পদযাত্রা শুরু করলেও কথাসাহিত্যে ওখানেই থেমে রয়েছেন বরেন্দ্র লাল ত্রিপুরা। তাঁর প্রথম উপন্যাস সোনালী ঊষা ধূসর গোধূলী এর ফ্ল্যাপে লিখেছিলেন অপ্রকাশিতব্য আরও দুটো উপন্যাস রয়েছে। দুই যুগ পরেও অপ্রকাশিতব্যই বলতে হচ্ছে। এ স্থবিরতার কারণ হিসেবে বরেন্দ্র লাল ত্রিপুরা বলেন যে, তিনি নানাবিধ কারণে কথাসাহিত্যচর্চা স্থগিত রেখেছেন। যেমন, প্রকাশকরা বই প্রকাশ করাকে আর্থিক বা ব্যবসায়িক দিক দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করতেন বলে বই প্রকাশের যাবতীয় খরচ চাইতেন। এই কারণে কথাসাহিত্য রচনায় উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন। তাছাড়া কথাসাহিত্য সৃষ্টি সময় ও শ্রম্য সাধ্য, অথচ প্রকাশের সম্ভাবনা ক্ষীণ হওয়াতে কথাসাহিত্যে আত্মনিয়োগের আগ্রহ স্বাভাবিক কারণেই ম্রিয়মাণ হয়ে গেছে। তবে তিনি বাংলা ও ককবরক ভাষায় কবিতা ও ছড়া লেখা এবং বই প্রকাশ অব্যাহত রেখেছেন। এদিক থেকে বলা যায়, কথাসাহিত্যে বরেন্দ্র লাল ত্রিপুরা অসম্পূর্ণ রয়ে গেছেন। মানসিক পরিপক্ক সময়ে তিনি কথাসাহিত্য রচনা করলে বাংলা ও ককবরক ভাষায় ত্রিপুরা নৃগোষ্ঠীর কথাসাহিত্যকে পরিপূর্ণতায় ভরিয়ে দিতে পারতেন বলে প্রতীয়মান হয়। সম্ভাবনা ছিল যে, ত্রিপুরা নৃগোষ্ঠী কথাসাহিত্যে পেতো নিজেদের সামগ্রিক জীবন চিত্র। কিন্তু আফসোসের বিষয়, বরেন্দ্র লাল ত্রিপুরা কথাসাহিত্যে অসম্পূর্ণই রয়ে গেলেন।

 

শোভা ত্রিপুরা

শোভা ত্রিপুরা শুধুমাত্র ত্রিপুরা নৃগোষ্ঠী নয়; পার্বত্য চট্টগ্রামের কথাসাহিত্যে নারী হিসেবে তাঁর নামই সর্বপ্রথম বলা হয়। তিনিই একমাত্র নারী যাঁর বাংলায় ছোটগল্পের বই রয়েছে। তাঁর স্বপ্নের ধূসর ছায়া গল্পগ্রন্থটিই ত্রিপুরা নৃগোষ্ঠীর এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত একমাত্র গল্পগ্রন্থ। মোট ১৫ট গল্প নিয়ে এ বই।

 

প্রথম গল্প ‘অনির্দিষ্ট গন্তব্য’ এক সফল শিক্ষকের ব্যর্থ প্রেমিক হিসেবে পাগল হয়ে যাবার কাহিনি। এক ছাত্রীর বয়ানে তা প্রকাশিত।

 

‘ফিরে আসা’ নামে বইয়ের দ্বিতীয় গল্পটি একটি নিবন্ধের মতো। লেখক যুব সমাজকে জেগে উঠতে, জুম জীবনকে ভালবাসতে, জুমিয়া জননীর দুঃখ মোচন করতে, জুম ঘরে অপেক্ষারত দয়িতার জন্য ফিরে আসার আহ্ববান করেছেন ও আকুতি জানিয়েছেন। এ গল্পে জুম্ম জাতি, জুম্ম ভূমি, জুম মা, বোন, পাহাড় ও বনের জন্য লেখকের ভালবাসা প্রায় প্রতিটি লাইনে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়েছে। গল্পটিতে নিবন্ধের মতো কবিতা ও গান ব্যবহার করা হয়েছে। তবে আঙ্গিক বিবেচনা না করে লেখকের আবেগের সম্মান করে বলা যায় জুমিয়াদের জীবনে অত্যাচার, শোষণের ও বঞ্চনার কথা বলতে গিয়ে গল্পে মানুষ নয় — সমগ্র জুম ভূমিই যেন চরিত্রের আকারে রূপ দিয়েছেন। গল্পটিতে লেখকের বুকের গভীরের দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। যেমন, “আমি শিল্পী নই তবু যেন শুনি আমার হৃদয়ের অনুভূতি দিয়ে জুম্ম মায়ের কান্না…” (ত্রিপুরা,২০১৩, ১৭) সখিনা ও মাইনীদের অসহায়ত্বকে এক কাতারে এনে লেখক অসাম্প্রদায়িকতা ও সর্বহারাদের প্রতি একাত্মতার পরিচয় দিয়েছেন। ‘মুছে দাও সখিনার দীর্ঘশ্বাস—। মুছে দাও মাইনীর রোদন ভরা চোখের অশ্রুজল—।’ গল্পটিতে প্রভাংশু ত্রিপুরার নামোল্লেখ করে পাঠককে মনে করিয়ে দিয়েছেন যে তাঁর এ গল্প শুধু গল্পের জন্য নয়, জুমভূমির মানুষের মঙ্গলের জন্য মনের অনুরণন।

 

‘ধুসর পাহাড়ে সবুজ তারুণ্য’ এক নারীর অপেক্ষার গল্প। শান্তা নামে চব্বিশোর্ধ এক নারীর জুম ভূমি মুক্ত করার সংগ্রাম থেকে তাঁর প্রেমিকের ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা। তবে প্রেমিক শান্তিচুক্তির পরও অশান্ত পাহাড়ের বন জঙ্গল থেকে ফিরে আসবে কি না তা অনিশ্চিত। পাহাড়ে আগ্রাসনের সমাপ্তির ইঙ্গিত দিলেও ওখানে সংখ্যালঘুর জীবনের যে আশংকা তা লেখক গোপন করেননি। এমন পরিস্থিতিতে এ গল্পে পাহাড়ে শান্তি ফিরিয়ে আনতে প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার এত প্রশস্তি ও ভূয়সী প্রশংসা না করে শুধুমাত্র তাঁর অবদান উল্লেখ করলে কিছুটা হলেও ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্যের সাথে প্রযোজ্য হতো।

 

‘সেদিন ছিল সোনাঝরা রোদ’ গল্পটিকে স্মৃতিচারণমূলক রচনা বলা যায়। গল্পের বইয়ে সংকলিত হয়েছে বলেই এটি গল্প। লেখকের সারাদিন নিজের মেয়েসহ একদল শিল্পীর সাথে সুটিংএ দীঘিনালা ভ্রমণে কাটানোর সময় টুকরো টুকরো স্মৃতি ও নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা। লেখাটির মধ্যে পাহাড়ের অস্বস্তিকর জীবনচিত্রও তুলে ধরেছেন “এরই মধ্যে তো বিগত বছরের কত শ্বাসরুদ্ধকর লোমহর্ষক ঘটনা ঘটে গেল মহালছড়িতে, রাজনৈতিক সামাজিক কতো বিপর্যয়। ইতোমধ্যে বিভিন্ন ঘটনায় সাহিত্য হয়ে যায় স্তব্ধ। কবিতারা হয়ে যায় ম্লানকেশ। মানুষের হৃদয়ের মধ্যে একটা হা-হুতাশ ভয় এবং আতঙ্ক ছিল এতদিন।” (ত্রিপুরা, ২০১৩,২৫)।  লেখাটির শেষে তিনি অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে বলেছেন, “আসলে অনুভব করলাম সাংস্কৃতিক বিপ্লব প্রয়োজন, না হয় সমাজ জাগবে না চেতনা থাকবে ঘুমিয়ে।” (ত্রিপুরা, ২০১৩, ২৮)।  এটা যেন কোন নিবন্ধের সুপারিশের প্রতিধ্বনি, ছোটগল্পের নয়।

 

‘পাহাড়ের বুকে একটি সংসার’ গল্পটি জুমচাষী প্রিয় লাল ও লতার অভাবী সংসারের চিত্রায়ণ করলেও এ যেন “অন্ধ অঞ্চলের” সকল প্রান্তিক জুমচাষীদের জীবনালেখ্য। লেখক প্রিয় লালদের এলাকাকে অন্ধ অঞ্চল বলে আখ্যায়িত করেছেন, যেখানে বয়স্কভাতাসহ সরকারি কোন সেবা নেই। জীর্ণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মহালছড়ির সমাজ সেবীরা স্থানান্তর করে নিয়ে গেছে, জুমচাষের ফসল উঠলে প্রিয় লাল ও লতা কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় সাধারণ চাওয়া পূরণ হওয়ার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু জুমের ফসল বেচে ছোট মেয়ের জন্য ফ্রক ও ঔষধ নিয়ে এসে দেখে কোলের বাচ্চাটার জীবন প্রদীপ নিভে গেছে। লেখক যেন কান পেতে জুমবধূ লতার অন্তরের অহংকার, হাহাকার ও আকুলতা শুনেছেন। লতা “বাজারে বাঁশের বোঝা নিয়ে গেলে অনেক শাড়ি পরা পাহাড়ী মেয়েদের দেখে। নিজের বিবর্ণ রিনাই খানা তাঁর বড়ো সুন্দর মনে হয়। তবু এই অরণ্য এই সংসারে এই বিবর্ণ বাঙড়ী নিয়েই তাঁর যেন জীবন শেষ হয়। পৃথিবীর বিবর্তনে ওর মতো হতভাগী গৃহবধূর কিইবা যায় আসে? প্রিয় লাল তাঁর আরাধ্য দেবতা। ককবরক তাঁর মাতৃভাষা। তবু শিক্ষা বিহীন এই জীবন। প্রতিদিন অরণ্যের জীবনে কিছু স্বপ্ন, কিছু দুঃখ জেগে থাকে।” (ত্রিপুরা, ২০১৩, ৩১)। এ গল্পে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠী ত্রিপুরাদের ককবরক ভাষায় সংলাপ ব্যবহার করেছেন, এ ভাষার ও ত্রিপুরা পোশাকের (রিনাই) উল্লেখ করে নিজেদের অস্তিত্বের সগৌরব ঘোষণা দিয়েছেন। তবে লেখাটিতে ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্যের চেয়ে সংবাদপত্রের ফিচারের মিল রয়েছে।

 

‘এখনো তেমনি আছি’ গল্পটিতে কোন নির্দিষ্ট ঘটনা বা চরিত্র নেই। লেখকের শিক্ষকতা জীবনের অভিজ্ঞতা, এ অভিজ্ঞতা কর্মস্থলে যাওয়ার পথের চিত্র, কর্মস্থলে বসবাসের কথা, শিক্ষা বঞ্চিত শিশুদের জন্য ভালোবাসার প্রকাশ চিত্রিত হয়েছে। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ইতিহাসের কথা বলতে ভুলেননি। “তখন ভারতে শরণার্থীর দল। চারদিকে অশান্ত বারুদের গন্ধ—। ভয়ার্ত পাখীর চিৎকার-” (ত্রিপুরা, ২০১৩, ৩৯)

 

‘স্বপ্নের ধূসর ছায়া’ এক প্রেমিকার গতানুগতিক কাহিনি। প্রেমিকের চিত্র প্রদর্শনীতে তার অনুপস্থিতিতে তাঁর স্ত্রীর সাথে পরিচয়। এ চিত্র প্রদর্শনী প্রেমিকাকে অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।

 

‘পাহাড়ী মেয়ে “রাখী”’ যেন নিজ জীবনের কয়েকটি খণ্ড খণ্ড ঘটনার সমারোহ। “এগিয়ে আসে এক তরুণ সাংবাদিক, সাহিত্যিক যার সাথে ভাষা, বৈচিত্র কোন কিছুর মিল নেই।” (ত্রিপুরা, ২০১৩, ৫৩) “ঘর বাঁধল দু’জন বাংলা সাহিত্য প্রেমিক মানুষ। একজন শিক্ষক, অপরজন চালচুলোহীন সাংবাদিক।” (ত্রিপুরা, ২০১৩, ৫৩)

 

‘ফেরারী বসন্ত’ গল্পটি সুখে দুঃখে, আনন্দ বেদনায় দোলায়িত নিজ জীবনের ছায়া। এ গল্পে সোমা যেন শোভা ত্রিপুরা। যিনি অন্য জাতিসত্ত্বার একজনকে বিয়ে করেছেন। “আলাদা সংস্কৃতি, আলাদা ভাষা। আলাদা সমাজ ব্যবস্থা।” (ত্রিপুরা, ২০১৩, ৬৩)

 

‘অব্যক্ত অভিমান’ গল্পটিতে বাংলাদেশের প্রসূতি মৃত্যুর চিরাচরিত অধ্যায়ের পুনরাবৃত্তি মাত্র।

 

‘কাঁঠাল চাঁপার বনের বউ’ গল্পে লেখক নিজের জীবনের ব্রত বাস্তবায়নে ‘প্রাইমারী পাশ’ এক পাহাড়ি বধূর মাধ্যমে তার পাড়ার শিশুদের বর্ণমালা শিক্ষার স্বপ্ন দেখেন। বধূটি এ ধরনের দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়ে “কাঁঠাল চাঁপার বনের বউ-এর দু’চোখ ঝকঝক করে উঠল খুশীতে।” (ত্রিপুরা, ২০১৩, ৭১) লেখকের সমাজসেবী অতৃপ্ত মনের অকপট স্বীকারোক্তি এবং সান্ত্বনাও বটে যখন বলেন, “সারাটা জীবন এক প্রচ্ছন্ন অন্ধকারে কি আমার বসবাস ছিল না? সমস্ত পৃথিবী আলোকিত করে আমার জগৎ সংসার ছিলো অন্ধকার—। আজ আসবাব পত্রহীন এই সামান্য বাঁশের মাচা ঘরে কাঁঠাল চাঁপার বনের পরিতৃপ্ত বউ-এড় শুভ্র শান্ত সুখ আমাকে কেমন করে তুললো!” (ত্রিপুরা, ২০১৩, ৭২)। কাঁঠাল চাঁপার বনের বউ বেবী ত্রিপুরা মুর্চ্ছনা মা নামের এ বাস্তব চরিত্রটিকে নিয়ে একটি সার্থক ছোটগল্প লেখা যেত।

 

‘গোধূলীর অস্তরাগ’ গল্পটি লেখকের শিক্ষকতা জীবনের শেষ দিনে দাঁড়িয়ে সার্থকতা, ব্যর্থতা, হতাশা ও সাফল্যের কথকতা।

 

‘জীবন যেখানে যেমন’ গল্পটি নিজের আদর্শ জীবনের ইতিবৃত্ত। স্বামীর বই ছাপানোর টাকা যোগেড় করার ঘটনা। অবশেষে বই ছাপায় এবং পুরস্কার পায়।

 

‘কৃষ্ণচূড়ার ভালবাসা’ এক ছোটবোনের মৃত্যুর করুণালেখ্য। ছোটপিসির মৃত্যুতে ভাইয়ের ছেলের বেদনাবিধুর মনের চিত্রায়ণ; যার কাছে সব কিছুতে শূন্যতা বোধ হয়।

 

‘অচেনা পৃথিবী’ গল্পটি পাহাড়ে একটি ত্রিপুরা পরিবারের সুমনের মা নক্ষত্রবালা ও আরেকটি চাকমা পরিবারের সন্তুর মা নির্বাসীতার জীবন সংগ্রামের ঘটনা। জুমের ফসল ও জঙ্গলের লাকড়ি বেচে অনাহারে অর্ধাহারে সংসার চলে। দুজনেই স্বপ্ন দেখে ছেলেরা লেখাপড়া শিখে দুঃখ ঘুচাবে। তাদের কাছে কাঁকড়া ভর্তা দিয়ে ভাত খাওয়া মানে বিরাট আয়োজন। এ গল্পটিতে  হিংসার খারাপ পরিণাম রূপকথার আবরণে উপস্থাপন করেছেন। এ গল্পে পার্বত্য চট্টগ্রামে সমতলের বাঙালিরা গিয়ে দখলদারিত্বে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর সংখ্যালঘু জীবনের পৃথিবীকে আরও সংগ্রামমুখর করে তোলার ঘটনা সরাসরি বিধৃত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ:

  • “ওদের আগে একটা সুন্দর বাগান ছিল। সেখানে আম কাঁঠালের ঝাড়—। সারা বছর কতো ফল ফলাদি খেয়েও প্রতিবেশিদের দিতো—দু-এক কানি ধানী জমি। সেখানে পাহাড়ে গোলমাল শুরু হল। তখুনি ওরা সেই জায়গা ফেলে চলে গেল অন্য জায়গায় —। সেখানে কোত্থেকে সমতলবাসীরা এসে ওদের জায়গা জমি, বাঁশবন, কাঁঠাল জঙ্গল ইত্যাদি দখল করে নিয়েছে। ওদের চেহারা দেখতে কালো অন্যরকম। ঠিক যেন ডাকাতের মতো চেহারা। চোখে যেন আগুনের ভাটা জ্বলে সবসময়। দেখলে গা ঠা ঠা দিয়ে দিয়ে উঠে।” (ত্রিপুরা, ২০১৩, ৮৭)
  • “মাঝে মাঝে প্রশাসনের নাকের ডগায় গোলমাল হয়। উপজাতীয় বসতভূমিতে সমতল থেকে আসা অউপজাতীয় মানুষেরা ঘর বাঁধতে চায়। তখন ধাওয়া পালটা ধাওয়া চলে।”(ত্রিপুরা, ২০১৩, ৯০)

 

শোভা ত্রিপুরার বইটিতে অনেক কাব্যিক গদ্যের আমেজ এবং অলংকারেরও পরিচয় মাঝে মধ্যে ঝিলিক দিয়ে ওঠেছে। যেমন :

  • “জ্যোৎস্না ছড়ানো উঠোন। পেয়ারা আর লিচু গাছের ওপর গলে গলে পড়ছে চাঁদের আলো…” (ত্রিপুরা, ২০১৩, ১৬)
  • “এ তাঁর কি অপরূপ সহজ সরল সৌন্দর্য পাহাড়ের বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়েছিল এলোমেলো বন।” (ত্রিপুরা, ২০১৩, ১৭)
  • “তেলহীন শুষ্ক চুল দুজনের। মলিন মুখ। ঠিক যেন খরায় শুকিয়ে যাওয়া চেঙ্গী নদ মতো। চেঙ্গী নদ যে অনেক বেদনার স্বাক্ষী।” (ত্রিপুরা, ২০১৩, ৮৯)

 

লোক ঐতিহ্য নিয়ে তাঁর গর্ব ও প্রেম কোথাও কোথাও আরোপিত মনে হলেও তিনি ত্রিপুরা ও চাকমা ছড়া ও গান  বিভিন্ন গল্পে সংযোজন করেছেন। একজন সমাজ সেবক হিসেবে ত্রিপুরা নৃগোষ্ঠীর উন্নয়ন, সাংস্কৃতিক পরিচয়, শিক্ষা নিয়ে লেখক সচেতন ছিলেন, উদগ্রীব ছিলেন। বিভিন্ন ঘটনা ও কাহিনির ফাঁকে ফাঁকে এর পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন :

  • “ত্রিপুরাদের রাজ্য আছে,রাজা আছে ককবরক-এর মত সমৃদ্ধ ভাষা আছে যা আজ হারানো অতীতের গল্প।” (ত্রিপুরা, ২০১৩, ৩০){ বইটিতে গর্ব করে ককবরক ভাষার কথা বহুবার বিভিন্ন গল্পে উল্লেখ করা হয়েছে।}
  • “কতো কিশোরীকে দেখলাম আজো তেমনি শিক্ষা থেকে দূরে, নির্বাসনে —এভাবে উদয়পপুর থেকে কত দূরে আমাদের যাত্রা। কত হোচট খেয়েছি জুমে। ঘুমিয়েছে রাইকাচাক।”(ত্রিপুরা, ২০১৩, ৪০) {উল্লেখ্য যে, রাইকাচাক ত্রিপুরা মহারেজের একজন বীরের নাম, যিনি কুকি বিদ্রোহ দমনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন। }

 

শোভা ত্রিপুরার গদ্য পর্যালোচনায় তাঁর ভাষিক দুর্বলতার পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন, শুধু যৌগিক ও মিশ্র বাক্যে পৃথক ভাবাপন্ন দুই বা তার বেশি বাক্যের সমন্বয় বা সংযোগ বুঝাতে ড্যাস বসলেও শোভা ত্রিপুরা তাঁর লেখায় উল্লিখিত নিয়মের বাইরেও বহুল পরিমাণে ড্যাস (—) ব্যবহার করেছেন। এছাড়াও অনেক ক্ষেত্রে তিনি বাংলা রীতি ব্যবহারের নিয়ম মানেননি। যেমন, একই অনুচ্ছেদে কত এবং কতো লিখেছেন। অন্যদিকে, ত্রিপুরা ভাষার শব্দ ব্যবহারে কখনো বন্ধনীতে বাংলা অর্থ দিয়েছেন, আবার কখনো দেননি। প্রত্যেকটি শব্দ টীকা আকারে থাকলে বাংলা ভাষায় শব্দগুলো অন্তর্ভূক্তিতে সহজতর হতো। শব্দগুলো হলো, যেমন, গাইরিং= পাহাড়িদের জুমঘর, বাঙড়ী= হাতের চুড়ি, রিনাই= ত্রিপুরা নারীদের কোমর থেকে পা পর্যন্ত পরা পোশাকের নাম, রিসা= ওড়না, বাচই= বৌদি, পিসী= আনই, বাতিমা= ওলকচু, যেটা বর্ষাকালে চাষ হয়, মঊরিমি= ঢেঁড়স, ইত্যাদি ।

 

শোভা ত্রিপুরার লেখা গল্পগুলোতে ছোটগল্পের আঙ্গিক রক্ষিত হয়নি, এগুলো ব্যক্তিগত জার্নাল, স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার রূপায়ণ। প্রায় সব গল্পেই শিক্ষানুরাগ, সাহিত্যনুরাগ, ব্যক্তিজীবনের কথার পুনরাবৃত্তিতে পাঠকের বিরক্ত উৎপাদন হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তিনি একজন সমাজ সচেতন ব্যক্তিত্ব ও শিক্ষানুরাগী হিসেবে ছোটগল্পের মোড়কে নিজের চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা, মতামত, সুপারিশসমূহ সংকলিত না করে; ছোটগল্প লেখার প্রচেষ্টা না করে; নিজের মতাদর্শ প্রকাশে দুয়েকটি নিবন্ধ রচনা করলেই যথাযথ হতো বলে প্রতীয়মান হয়।

 

শোভা ত্রিপুরা নিজেও বিষয়টি অনুধাবন করেছিলেন বলেই হয়তো বইটির শুরুতে দু’টি কথা শিরোনামে আত্মমূল্যায়নমূলক কয়েকটি বাক্য লিখেছেন, “প্রায় গল্পগুলো অপরিণত বয়সের লেখা। সেখানে অনেক ভুল ত্রুটি বিদ্যমান। উন্নত মানের রচনা শৈলী এখানে পাওয়া যাবে না। সে আমি জানি। গল্পগুলোতে আছে কিছুটা আত্মকথন, প্রেম-বিরহ, কৈশোরের ভাল লাগা, সামাজিক জীবনের সংঘাত ইত্যাদি। তবু চেষ্টা করেছি অরণ্য জনপদের সুখ-দুঃখের সাথে সমতলবাসীদের সুখ-দুঃখ ও অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটাতে”। (ত্রিপুরা, ২০১৩, ৮)

 

শোভা ত্রিপুরার গদ্য-বুনন আবেগীয় ভাষায় ভরপুর, তবে একটা আদর্শিক জীবন যাপনের আবহ রয়েছে তাঁর মনোজগতে; বিভিন্নভাবে চিত্রকলা, সাহিত্যচর্চার প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ করেছেন। বিশ শতকে মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনে বিলাসিতা বর্জিত যে আদর্শ জীবন যাপনের প্রতি মোহ ছিল তাঁর আত্মকথনমূলক লেখায় তা প্রতিফলিত।

 

শোভা ত্রিপুরা ব্যক্তিজীবনে একজন সার্থক সমাজসেবক। ছোটগল্পের আচ্ছাদনে তাঁর লেখা প্রকৃত অর্থে সমাজকর্মের আবেগীয় প্রতিবেদন। কথাসাহিত্য রচনায় তাঁর সৃজনশীল প্রতিভার সুসংগঠিতভাবে প্রয়োগের অভাব রয়েছে বলে পরিলক্ষিত হয়।

( চলবে। ম্রো কথাসাহিত্য নিয়ে পরবর্তী কিস্তি)

পড়ুন ।। কিস্তি ৯

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুর কথাসাহিত্য ।। কিস্তি : ৯

আগের লেখাপ্রবন্ধসাহিত্যে পূর্বকালের কৃষককথা
পরের লেখাআফগান কবিতা : নারীর কণ্ঠস্বর
গীতা দাস
গীতা দাসের জন্ম নরসিংদী জেলার সদর উপজেলায়। তিনি একজন সাহিত্যিক, কলামিস্ট এবং মানবাধিকার কর্মী হিসেবে বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের সাথে সরাসরি যুক্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই লেখালেখি করছেন। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত পত্রপত্রিকায় তার কলাম, প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও ছোটগল্প নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে। তাছাড়াও অনলাইনে পরিচালিত বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত লিখছেন। সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি সাহিত্য বিষয়ক অনুসন্ধান ও সাহিত্য সমালোচনা তার নিয়মিত আগ্রহের বিষয়।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here