ভারতবর্ষ কৃষিপ্রধান দেশ ছিল। এমনকি আজও তা-ই। তবে সেকালে একালের ন্যায় স্কুলকলেজ, অফিস-আদালত, ব্যাংক-বিমা এসব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ছিল না। সিংহভাগ মানুষই কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। রোদ-ঝড়বৃষ্টিসহ প্রাকৃতিক দুঃসহ দুর্যোগ উপেক্ষা করে এঁরা মাঠে শ্রম দিতো। এই দৈহিক শ্রমের যোগানদারকেই বলা হতো কৃষক। তখন জমিদারের কাল। জমিদাররা সত্যিসত্যি কাল ছিল। কৃষকের নিজস্বতা বলতে কিছু ছিল না। গরুবাছুর, হাঁসমুরগি, ক্ষেতের ফসল, গাছের ফলফলাদিসহ সবকিছু বেচাবিক্রি করেও খাজনা পরিশোধ করতে পারতো না। মহাজনের কাছ থেকে উচ্চহারে সুদসহ ধারকর্য নিয়ে আবার চাষে নামতে হতো। কখনোসখনো ফলা-ফসল ঘরে তুলতে পারতো না। বাকি আদায়ের নামে মাঠের ফসল মাঠ থেকেই ক্রোক করে নিয়ে যেতো। সময়ে-অসময়ে নামেবেনামে খাজনা বাড়াতো। জমিতে শ্রম দিলেও জমির মালিক ছিল না কৃষক। যখন খুশি কেড়ে নিতো। যাকে খুশি তাকে দিতো। মূলত বেশি দর দাতার হাতেই জমি হস্তান্তর করতো।
২
সবার অন্ন সংস্থানের দায়দায়িত্ব ছিল কৃষকের ওপর। জমিদারের দৌহিত্রের বিয়ে, ভ্রাতুষ্পুত্রের অন্নপ্রাশনসহ শয়শরিকের চৌদ্দগোষ্ঠির নামে খাজনা আদায় হতো। জমিদারবংশের বাইরেও যারা জমিদারের কাছাকাছি থাকতেন, খাজনা আদায় সংক্রান্ত নানাবিধ দায়দায়িত্ব পালন করতেন যেমন নায়েব, গোমস্তা, পাইকপিয়াদা, বরকন্দাজ, মুহুরি, পুরোহিত, জমাদার-তহশিলদার ইত্যাকার কত কী নামে খাজনা আদায় করতো। পানির জন্য কূপ খনন অথবা ঘরের চাল-খুঁটি এমনকি শোবার চৌকি বানানোর জন্য গাছ কাটতে পারতো না। নিজস্ব পয়সায় কোঠা বাড়ি বানাতে পারতো না। বানালেই মামলা ঠুকে দিতো। স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি নানাবিধ আইনকানুনের মারপ্যাঁচে অক্টোপাসের ন্যায় কৃষককে বেঁধে ফেলতো। তাছাড়া কৃষকের মামলা চালাবার সামর্থ্য কোথায়!
স্ট্যাম্পের দাম, উকিলের ফি, সাক্ষীর খোরাকি, পারিতোষিক, আমিনের খরচ, আদালতের পাইকপিয়াদা-আমলা ইত্যাদি তো আছেই। বঙ্কিমচন্দ্র লিখছেন — ‘আইন-সে এক তামাসা মাত্র — বড় মানুষেই খরচ করিয়া, সে তামাসা দেখিয়া থাকে।’
৩
কৃষক নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র (১৮৩৮-১৮৯৪) ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। সেখানে কৃষকের এসব দুঃখ-দুর্দশার কথা তুলে ধরেছেন। ‘হাসিম শেখ আর পরাণমণ্ডল’ প্রতীকের মধ্য দিয়ে কৃষকের প্রকৃত অবস্থা উপস্থাপন করেছেন। জমিদারের নির্মম-নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত রূপ দেখিয়েছেন। কৃষকের দুর্দশার জন্য চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে (১৭৯৩) দায়ি করেছেন। প্রবন্ধটির ভেতরে ঢুকলে মনে হয় কৃষকের প্রতি সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমের কত দরদ! কিন্তু আসলে কি তাই? পরবর্তীসময়ে তিনি মত পাল্টিয়েছেন। প্রবন্ধ পুর্নমুদ্রণ করেননি। কারণ হিসেবে বঙ্কিম বলছেন — ‘জমীদারের আর সেরূপ অত্যাচার নাই। নূতন আইনে তাঁহাদের ক্ষমতাও কমিয়া গিয়াছে। কৃষকদিগের অবস্থারও অনেক উন্নতি হইয়াছে। অনেক স্থলে এখন দেখা যায়, প্রজাই অত্যাচারী, জমীদার দুর্বল। এই সকল কারণে আমি এতদিন এ প্রবন্ধ পুনমুদ্রিত করি নাই।’ বিস্ময় লাগে, আড়াই দশক আগেও যে বঙ্কিম কৃষকের দুঃখদুর্দশা নিয়ে এতটা ব্যথিত ছিলেন, সেই বঙ্কিম কৃষককে উল্টো অত্যাচারী বলতে চান।
৪
বঙ্কিমচন্দ্র ছাড়াও উচ্চবর্গীয় অনেকেই কৃষকের ন্যায় প্রান্তজনের ব্যথায় অনুরূপভাবে ব্যথিত হয়েছেন। বেশ কিছু গদ্যপদ্য অথবা প্রবন্ধনিবন্ধও লিখেছেন। এই কাতারে রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩), দীনবন্ধু মিত্র (১৮৩০-১৮৭৩), রমেশচন্দ্র (১৮৪৮-১৯০৯), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) এবং প্রমথ চৌধুরীর (১৮৬৮-১৯৪৬) নাম উল্লেখ করা যায়। এঁরা সবাই ছিলেন উচুঁ তলার বাসিন্দা।
প্রমথ চৌধুরী জমিদার নন্দন ছিলেন। পূর্ববাংলায় জন্ম হলেও বেড়ে উঠেছেন কৃষ্ণনগরে। দেশবিদেশের নামিদামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করেছেন। বিলেত থেকে ব্যারিস্টার হয়ে এসেছিলেন। তার পুরো জীবনটাই কেটেছে জমিদারি আবহে। ভালোবেসে ঠাকুর পরিবারের মেয়ে ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীকে (১৮৭৩-১৯৬০) স্ত্রী হিসেবে ঘরে তুলেছিলেন (১৮৯৯)। তাঁর আত্মীয়স্বজন, পরিবার-পরিজন, জ্ঞাতিগোষ্ঠীর অনেকেই জমিদার ছিলেন। এই সাহিত্যিক বেশকিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখে সাহিত্যে স্মরণীয় হয়ে আছেন।
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মের দিকে তাকালে মনে হয়, জমিদারি নিয়ে তিনি কিছুটা শঙ্কায় ছিলেন। না হলে কেন লিখবেন, ‘যার জন্যে এতো জোড়াতাড়া সে ততকাল পর্যন্ত টিকবে কি না সন্দেহ।’
বিদেশে বিভাষায় পড়ালেখা করলেও স্বদেশী স্বসমাজকে তিনি দারুণভাবে পছন্দ করতেন। জাগিয়ে তুলতে চাইতেন নিজের সমাজটিকে। মাতৃভাষাকেও কম ভালোবাসতেন না। বাংলাভাষার পক্ষে তাঁর জোড়ালো অবস্থান। সাহিত্য-সংস্কৃতি বিশেষত কাব্যসাহিত্য সম্পর্কে তাঁর চিন্তাভাবনা মুগ্ধ করে। প্রান্তজন নিয়েও ভাবতেন তিনি বিশেষত কৃষকসমাজ । অন্তত ‘রায়তের কথা’ নিবন্ধটি পড়লে তা-ই মনে হয়। নিবন্ধটিতে তিনি কৃষকের বিপুল ব্যথাবেদনার কথা তুলে ধরলেও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে (১৭৯৩) সমর্থন জানিয়েছেন। সমর্থন জানিয়েছেন জমিদারগোষ্ঠীকে। তাঁকে অকপটে লিখতে দেখি :
বাংলার জমিদার সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে কোনোরূপ কুসংস্কার আমার নেই, এবং থাকতে পারেনা। আমার মন স্বতই এঁদের প্রতি অনুকূল, কেননা আমার আত্মীয়স্বজন জ্ঞাতিকুটুম্ব সবাই জমিদারÑকেউ বড়ো, কেউ ছোট, কেউ মাঝারি। আমি জন্মাবধি এই জমিদারের আবহাওয়াতেই বাস করে আসছি। সুতরাং সে সম্প্রদায় আমার যতটা অন্তরঙ্গ, অপর কোনো সম্প্রদায় নয়। জমিদারের ওপর বঙ্কিমচন্দ্র যে আক্রমণ করেছিলেন, সে আক্রমণ করতে আমি অপারগ, কেননা আমি জানি যে সে আক্রমণ অন্যায়।’ (রায়তের কথা)
৫
কৃষকের প্রতি অনুরাগ দেখালেও প্রমথ চৌধুরী স্বসম্প্রদায় থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। আসলেও স্বসম্প্রদায় সেটি সমর্থন করতো না। তার ধারণা অমূলক ছিল না। ‘রায়তের কথা’ নিবন্ধটির জবাবে অনুরূপ শিরোনামে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আরেকটি নিবন্ধ লিখেছিলেন এবং লেখাটি প্রথম চৌধুরীকেই উৎসর্গ করেছিলেন। প্রবন্ধটি কালান্তরের (১৩৪৪) অন্তর্ভুক্ত। রায়তকে জমি ছেড়ে দেওয়া তো দূরের কথা উল্টো রায়তের নেতিবাচক সমালোচনা করতে রবীন্দ্রনাথ এতটুকু দ্বিধা করেননি। রায়ত প্রসঙ্গে তাঁকে লিখতে দেখি, ‘রায়ত খাদক রায়তের ক্ষুধা যে কত সর্বনেশে তার পরিচয় আমার জানা আছে। তারা যে প্রণালীর ভিতর দিয়ে স্ফীত হতে হতে জমিদার হয়ে ওঠে, তার মধ্যে শয়তানের সকল শ্রেণীর অনুচরেরই জটলা দেখতে পাবে। জাল, জালিয়াতি, মিথ্যা-মকদ্দমা, ঘর-জ্বালানো, ফসল-তছরুপ কোনো বিভীষিকায় তাদের সংকোচ নেই।’ (রায়তের কথা, কালান্তর)
জমিদারিতে তাঁর অন্তরের প্রবৃত্তি নেই জানালেও আদতে তিনি জমিদারি ছাড়তে চাননি। তাঁকে লিখতে দেখি, ‘প্রজাকে ছেড়ে দেব? তখন দেখতে দেখতে এক বড় জমিদারের জায়গায় দশ ছোটো জমিদার গজিয়ে উঠবে। রক্তপিপাসায় বড় জোঁকের চেয়ে ছিনে জোঁকের প্রবৃত্তির কোনো পার্থক্য আছে তা বলতে পারি নে।’ মূলত জমিদারি ধরে রাখার পক্ষেই নানাভাবে তাঁকে নানা যুক্তিবাক্য তুলে ধরতে দেখা যায়।
৬
পড়ন্ত জীবনে সোভিয়েত রাশিয়ার ভ্রমণাভিজ্ঞতা (১৯৩০) নিয়ে কবিগুরু লিখেছিলেন রাশিয়ার চিঠি (১৩৩৮)। সেখানকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমবায় ব্যবস্থা, যাপিত জীবন ও জনপদের সামষ্টিক জাগরণ কবিমনকে নিঃসন্দেহে আলোড়িত করেছিল। কবিমনের এই অভিব্যক্তি দেখতে পাই রাশিয়ার চিঠিতে। কিন্তু কোথাও লেনিন (১৮৭০-১৯২৪) অথবা কার্ল মার্কসের (১৮১৮-১৮৮৩) নামটি উচ্চারণ করেননি। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মের দিকে তাকালে মনে হয়, জমিদারি নিয়ে তিনি কিছুটা শঙ্কায় ছিলেন। না হলে কেন লিখবেন, ‘যার জন্যে এতো জোড়াতাড়া সে ততকাল পর্যন্ত টিকবে কি না সন্দেহ।’ মাঝেমধ্যে হয়তোবা জমিদারির ওপর আস্থাও হারিয়ে ফেলতেন, নেমে আসতে চাইতেন জনতার কাতারে। ৩১ অক্টোবর ১৯৩০ সালে পুত্র রথীন্দ্রনাথের (১৮৮৮-১৯৬১) কাছে রবীন্দ্রনাথকে লিখতে দেখি, ‘আমার মন আজ উপরের তলার গদি ছেড়ে নীচে এসে বসেছে। দুঃখ এই যে, ছেলেবেলা থেকে পরোজীবী হয়ে মানুষ হয়েছি।’
৭
প্রান্তপ্রণয় দেখালেও সেই প্রণয়ের ঘনত্ব ও গভীরতা এতো বেশি ছিল না যে, তারা স্বসম্প্রদায় ছেড়ে জনতার কাতারে এসে দাঁড়াবেন। এমনকি কৃষক-শ্রমিকের যাপিত জীবনমান উন্নয়নের জন্য যে প্রাণপাত করেছেন সেই প্রলেতারিয়েত পণ্ডিত মানবেন্দ্রনাথ রায়ও (১৮৮৭-১৯৫৪) নিজেকে নামিয়ে আনতে পারেননি। শোনা যায়, নিজের পাণ্ডিত্য নিয়ে এই নেতা এতোই গর্বিত ছিলেন যে, লেনিনের চেয়েও নিজেকে মৌলিক বিবেচনা করতেন। আবার তলে তলে সাম্রাজ্যবাদী সংগঠন কংগ্রেসের (১৮৮৫) সাথেও সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করতেন। দেখি, আজকাল কিছু কিছু খুদে পণ্ডিত সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করতে চান কিন্তু কাছে আসতে চান না। অনেক দূর থেকেই ইথারে ইথারে ছড়িয়ে দেন টুকরো টুকরো ভালোবাসা। তখন মনে পড়ে ‘বড়র পিরীতি বালির বাঁধ।’