এক
কেউ বলে বন তেজপাতা কেউ আবার লুটকি নামে ডাকে আবার কোথাও ডাকে দাঁতরাঙা। সরু ডালে উজ্জ্বল বেগুনি রঙ নিয়ে বিস্ফারিত চোখের মতো বাতাসে দুলে এই দাঁতরাঙা। বুক সমান উঁচু ছড়ানো গাছে কালচে সবুজ পাতা নিয়ে পাহাড়ে বা উঁচু জমিতেই জন্মে। পাতা বা ফুল দাঁতের পাটিতে চিবাতে গেলেই ঝকঝকে দাঁত নিমিষেই রাঙা হয়ে উঠে বলেই হয়তো এই নামটিই সকলের মুখে মুখে ফেরে।
তাওয়াকুচা বা রাংটিয়া বিটে হাঁটতে হাঁটতে যে সকল পাহাড়ি ফুলের প্রেমে পড়ে গেছি দাঁতরাঙা তাদেরই একজন। বৃষ্টিস্নাত সকালের রোাদে ঝলকে ঝলকে উঠছিল এই উজ্জ্বল বেগুনি দাঁতরাঙা। এই গাছগুলো আবার যেখানে বেড়ে উঠে সেখানে চা জন্মবার সম্ভবনা রয়েছে প্রচুর। শহীদুজ্জামান হাঁটতে হাঁটতে জানালেন।
শহীদ পাখি বৃক্ষ ও ফুলের এনসাইক্লোপিডিয়া। নক করলেই থোকা থোকা তথ্য বের হয়ে আসে। দাঁতরাঙা টি ইনডিকেটর ট্রি নামেও পরিচিত। নতুন কোনো ফসল জন্মানোর জন্য আগাম প্রাকৃতিক জরিপের কাজটি দাঁতরাঙাই করে থাকে। এখন প্রয়োজন শুধু প্রকৃতির গুপ্ত সংবাদটি ব্যক্ত করবার কাজে হাত লাগানো।
শেরপুরের উত্তর জনপদ এই তাওয়াকুচা। যদিও পুরাতন বইপত্রে টাওকুচা এই বানানেই হাজির। আদিবাসী আচিক মান্দি ও কোচদের বসত এই এলাকা জুড়ে। কালে কালে আদি নাম পাল্টে গেছে কখনো উচ্চারণে কখনো প্রশাসনিকতার কলমের দোষে। পাল্টে গেছে গ্রাম। বসতি। জীবন ও জীবিকা।
এই যেমন বিশাল গাজুনি গারো গ্রাম গত শতকের নব্বই দশকের শুরুতে পাল্টে গেলো ‘গজনি অবকাশ’ নামে। হারিয়ে গেলে গাজুনি গ্রাম। উচ্ছেদ হলো আচিক মান্দির সামষ্টিক মালিকানার জমি ও জঙ্গল। যদিও উচ্ছেদ দেশভাগ পূর্ব থেকেই কোনো-না-কোনোভাবে জারি ছিলই সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের তাপে চাপে ভাপে। একটি বধিষ্ণু গ্রাম সমূলে উচ্ছেদ করে গজনি অবকাশ এখন নাগরিকের পিকনিক স্পট।
এই উত্তর পূর্ব ও পশ্চিম দিকের জনপদ — ঝিনাইগাতি,নালিতাবাড়ি ও শ্রীবর্দী উপজেলা — গারো পাহাড়ের পাদদেশ। মধুটিলা, রাংটিয়া ও বালিজুরির প্রায় ২০ হাজার একর বনভূমি বন বিভাগের অন্তর্ভুক্ত।
তাওয়াকুচা রাংটিয়া রেঞ্জের আওতাধীন বিট।কাংশা ইউনিয়নের একটি গ্রাম। আচিক মান্দির পরিবারের সংখ্যা গোটা পচিশের বেশি নয়। যদিও এই ইউনিয়নের গুরুচরণ দুধনই গাজুনি ছোট গাজুনি গান্ধীগাঁও জোকাকুড়ায় এক সময় কোচ ও আচিক মান্দিরাই ছিল সংখ্যাধিক। সামাজিক সাংস্কৃতিক নেতৃত্বের হাল গারো বা কোচদের হাতেই ছিল।
এখন এই বিস্তীর্ণ বন সরকারের। তবু বেদখল হয়ে গেছে প্রচুর জমি রাজনৈতিকতার খাসিলতে। খুঁটির জোর না থাকলে কি আর জল জমি জঙ্গল নিজের নামে করা যায়? বিআরএসে কারো নাম উঠে গেছে। দিনে দুপুরে সামষ্টিক সম্পদ ব্যক্তি মালিকানায় রূপান্তর ঘটে গেছে। দখলের পরিমাণও কম নয় — রাংটিয়া রেঞ্জে ১৪৬৬ একর বালিজুড়ি রেঞ্জে ৪৭৭.৩৪ আর মধুটিয়ায় ৬১২ একর বনভূমি ভূমিখেকোদের পকেটে।
দখল উচ্ছেদ যে হয় না তা নয়। হচ্ছে। তবু আছে পাহাড় কাটা। নতুন নতুন বাড়ি — জোড়া গরু মার্কার ঢেউটিনে উঠছে দুচালা চৌচালা ঘর। তাওয়াকুচার বনের গভীরে সারি সারি উপশৈলসমূহের কোনোটা-না-কোনোটার কোমরের চারদিকে গভীর খাঁজ কেটে রাস্তা তৈরি করেছে যেন দ্রুত নিজের মাছের প্রজেক্টে আসতে পারে ভোঁ ভোঁ করে মটর বাইক চালিয়ে। কোথাও পাহাড়ের বুক চিরে সোজা রাস্তা করা। মাছের খামার যেহেতু সেহেতু একটা সহজ ট্রানজিট না থাকলে প্রোডাশন কস্ট বেশি হয়ে যাবে বলেই এমন করে পাহাড় কেটে কেটে রাস্তা তৈরি।
বৃষ্টির দাপটে আজ হোক বা কয়েক বছর পাহাড়ের কোমর পেঁচিয়ে যে খাঁজকাটা করা হয়েছে তা জলের চাপে ভেঙে পড়বেই। জলের ধারা পাহাড়কাটা গায়ে শুকিয়ে যাওয়া চোখের জলের দাগ লেগে আছে। এখানে উপশৈল ন্যাড়া। ট্র্যাকিঙে সুবিধা। কোনো বৃক্ষই আরোহীকে আটকে দেয় না। পায়ে পায়ে বন আগাছা। ইচ্ছে করে এখানেই এই সবুজ প্রান্তরে একটি বৃক্ষ হই। আকাশ ছুঁয়ে সবুজ গায়ে মেখে এই উপশৈলে দাঁড়িয়ে থাকি কোনো না কোনো আগন্তুকের ফিরে আসার প্রতীক্ষায়।
ভূমি আদিবাসীর কাছে আধ্যাত্মিকতার প্রতীক। পবিত্রতার প্রতীক যে সমূহের সম্পদ তা তারা বিক্রি করে দেবে দেনার দায়ে বা পেটের দায়ে পড়ে তা মানতে মন চায় না।
দুই
ছোট ছোট পাহাড়ের মাঝখানে প্রশস্ত প্রান্তর। একটি কৃত্রিম জলাধার। ব্যক্তি মালিকানাধীন। মালিক জানালেন তাঁর ক্রয়কৃত সম্পত্তি এই প্রান্তর। মাছের খামার করেছে — বোয়াল রুই মৃগেল তেলাপিয়ার। জমি বিক্রেতা গারো। বললেন গোটা ত্রিশেক গারো প্রথমে যাদের কাছে বিক্রি করেছেন তাদের থেকে তিনি ক্রয় করেই এই চাষাবাদ। মাটির মান্দি ঘর ভেঙে কৃত্রিম জলাধার নির্মাণ। গভীরতা পনেরো বিশ ফুটের বেশি নয়। চারদিকে সরকারি বন ও পাহাড় সমুহ। মাঝখানে ব্যক্তির সম্পদ।
কে জানে কী হয়েছিল? যে আচিক মান্দির জীবন জল জমি জঙ্গলকে আবর্তিত করে সে কোন দহনে দগ্ধ হয়ে হাত বদল করলেন বংশ পরম্পরা এই বসত ও জমি। এখন জলের নীচে। কোথায় আছে এই পরিবারগুলো? জলাধারের পাশে একটি ভাঙা টিলার উপর বসে বসে ভাবছিলাম শিকড়বিহীন আচিক মান্দিদের কথা।
এই বেবাক জঙ্গল ও জমিই তো কোচ কিংবা গারোদের ছিল একদা। এই মাটি জল আকাশ সকলের সম্পদ। সামষ্টিক মালিকানার ভোগ দখল স্বত্ব। ভূমি আদিবাসীর কাছে আধ্যাত্মিকতার প্রতীক। পবিত্রতার প্রতীক যে সমূহের সম্পদ তা তারা বিক্রি করে দেবে দেনার দায়ে বা পেটের দায়ে পড়ে তা মানতে মন চায় না। অথচ এই ভূমিজ সন্তানরাই এখন প্রান্তিকের প্রান্তিক। গৃহহীন। মাটিশূন্য। শহরবাসী। টবে লাগানো জীবন। এখানে এখনো যারা মাটি কামড়ে পড়ে আছে শুধু বসত ভিটা আশ্রয় করে তারা বাসস্থানের সংস্কার বা বর্ধন পর্যন্ত করতে পারছে না নানা আইনের জটিলতায়।
আমরা যে পুঁজিতান্ত্রিক জীবনধারা যাপন করি সেখানে ব্যক্তিই মুখ্য। সমূহ তার উদ্দেশ্য চরিতার্থ করবার হাতিয়ার মাত্র। সমূহের সাথে মৈত্রিবন্ধন চুক্তির। ব্যবসায়িক মনোভঙ্গি দ্বারা সজ্জিত। তাড়িত।
কখনো আমরা যারা গারো কোচ হদি বানাইদের প্রতিবেশী তাদের জীবনধারা কোনোদিন খতিয়ে দেখিনি। দেখেছি অদ্ভুত ছন্নছাড়া অবনমিত দৃষ্টিভঙ্গির কাঠামোতে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য সামাজিক প্রেমবন্ধন বা ইমোশনাল বন্ডেজকে গভীরভাবে দেখতে পারে না।
অথচ আদিবাসীদের জীবনধারাসমূহের জীবনধারা। ব্যক্তি সেখানে সমগ্রের অংশ। শুধু মানুষ নয় — যে মানুষ পরমা প্রকৃতির অংশ — সেই মহারানীর অংশ হিসেবেই আদিবাসী জীবন প্রবহমান।
আমার নদী আমার আকাশ — এমন বোধের ধারক আদিবাসী না। এই মালিকানা বোধ তার নয় — তার সমাজেরও নয় — যতটুকু সে এই বোধে তাড়িত তা পুঁজির দাপটে। ব্যক্তিমালিকানার জালে জড়িয়ে রেকর্ডভুক্ত হবার তাগিদে। আদিবাসী চিন্তাকাঠামো আমি নদীর আমি আকাশের। আমি তোমার।
আফ্রিকার একটি বৃহৎ এথনিক গ্রুপ আছে। যাদের মূল জীবনভাবনা Ubuntu। সেই যাপনসূত্র সন্ধানে ফিরছেন পরিবেশবাদীরা। সমগ্রের ভাবনার ভেতরই রয়েছে তীব্র সমস্যাপূর্ণ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যেরর মুক্তি। উবুন্টু চিন্তা শৃঙ্খলা ব্যক্তির আরাধনা করে না। সে অপরের সাপেক্ষে ব্যক্তির বিকাশের প্রসারিতের দিকে নজর। “a person is a person through other person”, সে বলছে “I am what I am because of who we all are.” এই জীবনধারার স্রোতস্বিনী নদী রয়েছে আদিবাসী মর্মে। তারই সন্ধান জগৎ ভাবুকেরা ছুটছে সেই প্রান্তিকের প্রান্তিকে যেখানে ভূমিজদের অন্ধকারে রেখে আমরা আধুনিকতার বাত্তিঅলা হয়েছিলাম।