আল্লামা জালালুদ্দিন রুমির বিখ্যাত গদ্য রচনা ফিহি মা ফিহি। ফারসি গদ্যসাহিত্যে মাইল ফলক হিসেবে বিবেচিত হয় তেরো শতকে রচিত এই গদ্য। বইটি ইংরেজিতে Discourse of Rumi নামে পরিচিত। সহজিয়ায় এটি ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করবেন সায়মন আলী।
রুমির আকস্মিক আগমনে আমির অবাক হয়ে গেলেন। বললেন, “হুজুর আপনি কত মহানুভব! আমি কখনোই আশা করি নি যে, আপনি আমাকে এভাবে সম্মানিত করবেন। আমি কোনো দিন এমন সম্মানের অধিকারী হতে পারবো এ চিন্তাও আমার মাথায় ছিল না কখনো। বরং আমারই উচিত ছিল রাতদিন আপনার সেবক ও পরিচারকের দলের সাথে মিলে আপনাকে সেবা করার জন্য অপেক্ষা করা, কারণ এটা আমাদের অধিকার। অবশ্য আমি সে অধিকারেরও যোগ্য নই। আহা! আপনার মতো মহানের আগমন! আপনার অসীম দয়া!”
রুমি বললেন, “আমার আগমনের নেপথ্যে রয়েছে আপনার আধ্যাত্মিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা। আপনার পদমর্যাদা যত উন্নত ও যত মহত্তর হবে, আপনি ততই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবেন এবং জাগতিক বড় বড় বিষয়ে নিজেকে জড়িয়ে ফেলবেন; আর ততই আধ্যাত্মিকতার সাথে আপনার সংশ্লিষ্টতা কমে যাবে। আপনি যা কিছু অর্জন করেছেন তাতে আপনি সন্তুষ্ট নন, কারণ আপনি মনে করেন আপনার অনেক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবু আপনার সকল জাগতিক অর্জন যেহেতু আপনার স্বর্গীয় অর্জনকে ম্লান করে দেয় নি, তাই আমি মন থেকে আপনার সাথে দেখা করতে চাচ্ছিলাম। আর একারণেই আমি আপনাকে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মান জানাতে এসেছি।“
তিনিই তপস্বী যিনি ভবিষ্যত প্রত্যক্ষ করতে পারেন আর বাকি দুনিয়াবাসী শুধু সময়ের বর্তমানটাই দেখে।
রূপও বিশাল গুরুত্ব বহন করে। না; বরং বলা যায়, গুরুত্বের চেয়ে বেশি কিছু বহন করে; কারণ এটি সত্যিকারের অস্তিত্ব। এটি ঠিক শরীরের মতো — শরীর যেমন হৃদয় ছাড়া অচল, ঠিক তেমনি ত্বক ছাড়াও অচল। আপনি যদি খোসা ছাড়া একটি বীজ বপন করেন তবে এটি কোনোভাবেই বেড়ে উঠবে না, কিন্তু আপনি যদি খোসাসহ একটি বীজকে মাটিতে পুঁতে দেন তাহলে এটির অঙ্কুরোদ্গম ঘটবে এবং এক সময় একটি বিশাল বৃক্ষে পরিণত হবে। সুতরাং রূপ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, এবং এটি ছাড়া আমরা আমাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হবো, আমাদের উদ্দেশ্য হাসিল হবে না। আর হ্যাঁ, যাঁরা সত্যতা জানেন এবং সত্যই যাদের ধ্যান, তাঁদের চোখে এই রূপ হচ্ছে একটি ধ্রুব সত্য।
একদা এক দরবেশ রাজার নিকট উপস্থিত হলেন।
রাজা তাকে সম্বোধন করলেন, “হে দীন…”
দরবেশ বললেন, “দীন আমি নই বৎস, আপনি।”
রাজা জানতে চাইলেন, “পুরো বিশ্ব যেখানে আমার দখলে সেখানে আপনি আমার দীনতা কোথায় দেখলেন?”
প্রত্যুত্তরে দরবেশ বললেন, “আপনি যেকোনো বিষয়ের প্রকৃত রূপটি না দেখে তার বিপরীত রূপটি দেখেন। এই দুনিয়া ও তার আগে-পরে সবকিছু আমার নখদর্পণে। আমি গোটা মহাবিশ্বকে আমার মুঠিবদ্ধ করতে পারি। আপনি তো এক টুকরো রাজত্ব আর কিঞ্চিৎ ক্ষমতা পেয়ে নিজের দীনতা ঢাকতে চাইছেন। আর এখানেই আপনার দীনতা।”
আপনি যেখানেই তাকান না কেন সেদিকেই মহান আল্লাহর স্বরূপ দেখতে পাবেন। এই স্বরূপ অসীম এবং অনন্তকাল ধরে প্রবহমান। প্রকৃত আধ্যাত্মিক সাধকগণ এই স্বরূপের সাক্ষাত পাবার জন্য নিজেদেরকে উজাড় করে দেন এবং এর বিনিময়ে কিছুই প্রত্যাশা করেন না। বাদবাকি মানবসম্প্রদায় গবাদি পশুর মতো।
যদিও তারা গবাদি পশুর মতো, তথাপি তারা অনুগ্রহ পাবার যোগ্য। আল্লাহ চাইলে তাদেরকে সে অবস্থায় স্থিতিশীল রাখতে পারেন। আর তিনি যদি ইচ্ছা করেন তবে তিনি তাদেরকে স্থিতিশীলতা থেকে নিজের ঐশ্বরিক কলমে স্থান দিতে পারেন। অর্থাৎ, শুরুতে তিনি নর-নারীর রূপ দান করেন। তারপর তাদেরকে তিনি তার ঐশ্বরিক কলম থেকে নির্জীব দুনিয়াতে প্রেরণ করেন। তারপরে সেই নির্জীব দুনিয়া থেকে উদ্ভিদকূলে রূপ দিতে পারেন; রূপান্তর করতে পারেন সেই উদ্ভিদ থেকে প্রাণীতে, সেই প্রাণী থেকে মানবে, মানব থেকে ফেরেস্তা.. এভাবে অনন্তকাল পর্যন্ত। তিনি এসকল রূপের প্রকাশ ঘটান যাতে আপনারা বুঝতে পারেন তাঁর কলমের সংখ্যা অনেক এবং সেগুলোর প্রত্যেকটি পরেরটি থেকে মহত্তর।
কোনো কিছু পাবার জন্য যতক্ষণ না আমাদের ভেতরে প্রবল আকাঙ্ক্ষা, তীব্র আসক্তি, মর্মপীড়া তৈরি হচ্ছে ততক্ষণ আমাদের সেটা পাবার জন্য চেষ্টা করা উচিত নয়।
আল্লাহ বর্তমান জগতকে একটি পর্যায়রূপে প্রকাশ ঘটিয়েছেন যাতে আপনারা পরবর্তী আরো অন্যান্য পর্যায়সমূহকে গ্রহণ করতে পারেন। আপনারা যাতে বলতে না পারেন যে, “এ জগতটাই চূড়ান্ত।” — সেজন্য তিনি সে পর্যায়সমূহ অপ্রকাশিত রেখেছেন। কারুশিল্পের ওস্তাদগণ তাদের কারুকার্য আর দক্ষতা তাঁদের শিষ্যদের সামনে এমনভাবে তুলে ধরেন যাতে তাঁদের শিষ্যদের মনে ওস্তাদের দক্ষতার প্রতি একটি বিশ্বাস তৈরি হয়। এর ফলে যে কারুকার্য শিষ্যরা দেখে নি সে কারুকার্যের ব্যাপারে ওস্তাদ যদি কথা বলেন তবে তারা তা মনোযোগ দিয়ে শুনবে এবং সে কারুকার্যের ব্যাপারে বিশ্বাস করবে। একজন রাজা তার প্রজাগণকে আচকান দিয়ে সম্মানিত করেন আর অকাতরে দয়াদাক্ষিণ্য দেখান। কারণ, তারা রাজার কাছ থেকে অন্য কিছু উপহার হিসেবে পাবার আশায় চেয়ে থাকে; বিশেষত তারা আশান্বিত থাকে যে, পরবর্তী কালে হয়তো তারা থলিভর্তি স্বর্ণমুদ্রা পাবে। তিনি সে জিনিসগুলো এজন্যই দান করেন যাতে লোকেরা বলতে না পারে, “এটাই শেষ। রাজা আমাদের আর অন্য কিছু কৃপা করবেন না। সুতরাং যা পেয়েছো তাতেই সন্তুষ্ট থাকো।” যদি রাজা কখনো জানতে পারেন যে লোকেরা সেরকমই কিছু বলছে আর তাঁর দেয়া উপহারগুলোকে নিছক দান হিসেবে নিচ্ছে তবে তিনি কোনদিনও তার প্রজাগণকে আর কিছুই দেবেন না।
তিনিই তপস্বী যিনি ভবিষ্যত প্রত্যক্ষ করতে পারেন আর বাকি দুনিয়াবাসী শুধু সময়ের বর্তমানটাই দেখে। কিন্তু যিনি আল্লাহর পছন্দনীয়, তিনি সত্যিকারের জ্ঞানের অধিকারী বলেই বর্তমান-ভবিষ্যতের কোনটাই দেখেন না। তাঁদের দৃষ্টি আবদ্ধ থাকে আদি তত্ত্বের উপর, যেমন: সমস্ত সৃষ্টির উৎস। তাঁরা যখন গমের বীজ বপন করেন তখন তাঁরা নিশ্চিত থাকেন যে এই গমের বীজ বেড়ে উঠবেই। কারণ তাঁরা একদম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখেছেন। সুতরাং গম হোক আর বার্লি হোক কিংবা হোক সেটা চাল বা অন্য কিছু; শুরুটা দেখার পর শেষটা দেখার জন্য তাঁরা তাঁদের দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখেন না। তাঁরা শুরুটা দেখলেই তাঁদের শেষটা জানা হয়ে যায়। দুনিয়ায় এমন নারী-পুরুষ বিরল।
আঘাত আমাদের যেকোনো উদ্যোগে পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে। কোনো কিছু পাবার জন্য যতক্ষণ না আমাদের ভেতরে প্রবল আকাঙ্ক্ষা, তীব্র আসক্তি, মর্মপীড়া তৈরি হচ্ছে ততক্ষণ আমাদের সেটা পাবার জন্য চেষ্টা করা উচিত নয়। আঘাত ছাড়া যেকোনো ‘প্রাপ্তি’ আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যায়। হোক সেটা ইহলৌকিক সাফল্য অথবা পারলৌকিক মুক্তি। আমাদের লক্ষ্য রাজদণ্ড অধিকারই হোক বা দিগ্বিজয়ী বণিক কিংবা মেধাবী বিজ্ঞানী হোক অথবা শক্তিশালী জ্যোতির্বিদ; আঘাত সহ্য না করে সে লক্ষ্যে পৌঁছানো অসম্ভব। বিবি মরিয়ম ততক্ষণ পর্যন্ত সে গাছের অভিমুখে রওনা হননি যতক্ষণ না পর্যন্ত তাঁর প্রসব বেদনা উঠেছিল। এই বেদনাই তাঁকে গাছটির দিকে নিয়ে গিয়েছিল এবং পরে সেই মৃতপ্রায় গাছটি ফলবান বৃক্ষে পরিণত হয়েছিল।
আমাদের অবস্থা কোরানে বর্ণিত বিবি মরিয়মের গল্পের মতো। আমাদের প্রত্যেকের ভেতর ঈসা (আ) রয়েছেন। কিন্তু যতক্ষণ না পর্যন্ত ভেতরে সেই বেদনা তীব্র হয়ে উঠছে ততক্ষণ পর্যন্ত ঈসার (আ) জন্ম হয় না। যদি প্রসববেদনা কখনোই তীব্র হয়ে না জাগত তবে আমাদের শিশুদের কোনো দিন জন্ম হতো না। তারা যে গুপ্ত পথ ধরে আসতো সেই পথ ধরেই তারা তাদের জন্মের উৎসের দিকে ফিরে যেতো। আর আমাদের জন্মটা হতো অন্তঃসার শূন্য।
তোদের অন্তরাত্মা ক্ষুধায় মরে
আর দেহ মরে অতি ভোজনে
আকণ্ঠ গিলে রুগ্ন হয় নরাধম
আর নরপতিরা ভিক্ষা মাঙে
উপায় পেলাম যখন ঈসা
জন্ম নিয়ে এলো ধরায়,
কিন্তু সকল আশা ছাড়তে হল
আবার তিনি স্বর্গে ফেরায়।
পড়ুন ।। কিস্তি ৪