অম্বলিকা গুহ — ভারতের কলকাতাভিত্তিক একজন স্বাধীন গবেষক। ২০১৮ সালে প্রকাশিত অম্বলিকা গুহের Colonial Modernities: Midwifery in Bengal, C.1860–1947 বইটি মূলত দেখাতে চেয়েছে, বাংলায় ১৮৬০ সাল থেলে ১৯৪৭ সালের ভেতর ধাত্রীবৃত্তি কীভাবে প্রচলিত দাইদের থেকে সরে গিয়ে পেশাদার ধাত্রী ও চিকিৎসকদের আধিপত্যপূর্ণ এলাকায় পরিণত হয়েছিল। একই সাথে মানবশিশু জন্মদানের মতো একটি প্রাকৃতিক বিষয়কে কিভাবে ঔপনিবেশিক শাসন একটি চিকিৎসার বিষয়ে পরিণত করেছিল, আর এই পরিণত করার পেছনে সেই সময়ের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি ভদ্রলোকদের তৎপরতা, যার অন্যতম ছিল সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনে লেখালেখি, তারই সামাজিক ইতিহাসকে তুলে ধরেছে এই বই। অম্বলিকার বইটি ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করবেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক শিবলী নোমান।
ধাত্রীবৃত্তি শিশু পালনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল যেখানে শিশুকে খাওয়ানো ও শিশুরোগ থেকে শুরু করে শিশুকে নৈতিকভাবে লালনপালনের মতো বিস্তৃত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত। তাই শিশু পালনের ক্ষেত্রেও একটি সমানভাবে আলোকিত ও পরিশুদ্ধ প্রক্রিয়া প্রয়োজন। ১৮৫৭ সালে শিব চন্দর দেব শিশু পালন শিরোনামে শৈশবকালীন শারীরবৃত্তিক চিকিৎসা বিষয়ে একটি গ্রন্থ লিখেন যা রচিত হয়েছিল ডক্টর অ্যান্ড্রু কম্বের ট্রিটিজ অন দ্য ফিজিওলজিক্যাল অ্যান্ড মোরাল ম্যানেজমেন্ট অব ইনফ্যান্সি শীর্ষক গ্রন্থের ভিত্তিতে।৮৬ ১৮৬৮ সালে প্রকাশিত গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে শিশুকে নৈতিকতার সাথে বড় করে তোলার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। স্বামী ও স্ত্রীর ভেতর সংলাপের আদলে শিশু পালন শিরোনামে প্রবন্ধের একটি সিরিজ বামাবোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল, এর উদ্দেশ্য ছিল নারী পাঠকদের তুলনামূলক বেশি বোধগম্যতা নিশ্চিত করা। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে প্রিন্ট জগতে ছড়িয়ে পড়া এমন নির্দেশনামূলক প্যামফ্লেটসমূহে মাতৃত্ব ও শিশুপালনবিষয়ক ভিক্টোরিয়ান ভাবনাগুলোর প্রতিধ্বনি থাকতো। মেরেডিথ বোর্থউইক দেখিয়েছেন, মাতৃদুগ্ধদানের ক্ষেত্রে ‘নির্দিষ্ট’ সময়ে নিয়ন্ত্রিত পরিমাণে দুগ্ধদানের যে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ডিসকোর্স তা ছিল গার্হস্থ্যের ‘ঘড়ির কাঁটার মতো কাজ করার’ ভিক্টোরিয়ান ভাবনার স্পষ্ট অনুকরণ, যাকে ভদ্রলোকরা উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে যথেষ্টভাবেই আত্মীকৃত করেছিল।৮৭ এসময় শিশুদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা সম্পর্কে অবগত থাকা এবং ছোট ছোট রোগবালাইয়ের ঔষধ ও চিকিৎসা সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান দ্বারা নিজেদের সমৃদ্ধ করাকে নারীদের কাছ থেকে প্রত্যাশা করা হচ্ছিলো।৮৮
যদিও এই অধ্যায় প্রধানত হিন্দু ভদ্রলোকদের পশ্চিমের ভাবনা দ্বারা শিশুজন্মজনিত চর্চার ধারণার পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করে, তবুও এটি উল্লেখ করা জরুরি যে গর্ভধারণ ও শিশুপালন বিষয়ক চর্চাগুলোর আধুনিকায়নের ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মুসলিমরাও আন্তরিক আগ্রহ দেখিয়েছিল। উনিশ শতকের শেষে মুসলিম নারী ও পুরুষ দ্বারা লিখিত নির্দেশিকাসমূহে এই ধারাটি স্পষ্ট হয়ে উঠে। সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো ঔপনিবেশিক নৃতাত্ত্বিক ও ইতিহাসবিদদের পুরনো ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে যেখানে বলা হয় ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে মুসলিমরা অর্থনৈতিকভাবে অবদমিত থাকায় পশ্চিমা আধুনিকতা ও প্রগতি থেকে নিজেদের সরিয়ে রেখেছিল।৮৯ সোনিয়া নিশাত আমিন বলেন উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলায় মূলত সরকারি চাকরিতে থাকা বাঙালি মুসলমানদের একটি অংশের ভেতর আধুনিক সচেতনতা উপস্থিত ছিল। নারীদের সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন অন্তর্ভুক্ত থাকা তাদের সংস্কারমূলক এজেন্ডার পেছনে দুইটি কামনা কাজ করছিল, নিজেদেরকে ঔপনিবেশিক শাসক ও তাদের চেয়ে এগিয়ে থাকা হিন্দু সমাজের কাছে প্রমাণ করা। যদিও কিছুদিন পর বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনসহ অন্যান্য মুসলিম উদার সংস্কারকদের লেখনিতে মাতৃত্ব ও শিশুপালনবিষয়ক হিন্দু ভদ্রলোকদের ডিসকোর্স জায়গা করে নেয়। নারীশিক্ষার বিস্তার ও পশ্চিমা ধারার শিশুযত্ন প্রক্রিয়াকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে বেগম রোকেয়া গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।৯০ তারপরও ঠিক কী পরিমাণ মধ্যবিত্ত শ্রেণির মুসলিম নারী শিশুযত্নের পশ্চিমা ধারাকে গ্রহণ করেছিলেন তা আমিনের অধ্যয়নে পরিষ্কার নয়। তৃতীয় অধ্যায় দেখাবে নিচু শ্রেণির মুসলিম নারীরা পর্দাপ্রথার ফাঁদেই আটকে ছিল যাকে ঔপনিবেশিক জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তারা তাদের (নারীদের) স্বাস্থ্য এবং শিশু ও মাতৃমৃত্যুর সংখ্যায় বিরূপ প্রভাব ফেলার জন্য তাৎপর্যপূর্ণ বলে ধারণা করতেন।
এসময় পশ্চিমা চিকিৎসা ভাবনাগুলো ধীরে ধীরে আরো বেশি গ্রহণযোগ্য হতে থাকে সেই সব ক্ষেত্রে যেগুলো একসময় সাংস্কৃতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত ও ধাত্রীবৃত্তির নারীদের দ্বারা প্রহরারত এলাকা ছিল। এর ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি অংশের দৈনন্দিন জীবনের সামাজিক-সাংস্কৃতিক পর্যায়ে পশ্চিমা চিকিৎসা জ্ঞানকে খাপ খাওয়ানোর প্রবণতা বুঝতে পারা যায়।
পূর্ববর্তী আলোচনাগুলো উনিশ শতকের শেষ দিকে বাংলার সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশের রূপান্তরের উপাদানগুলোতে আলোকপাত করে। এসময় পশ্চিমা চিকিৎসা ভাবনাগুলো ধীরে ধীরে আরো বেশি গ্রহণযোগ্য হতে থাকে সেই সব ক্ষেত্রে যেগুলো একসময় সাংস্কৃতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত ও ধাত্রীবৃত্তির নারীদের দ্বারা প্রহরারত এলাকা ছিল। এর ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি অংশের দৈনন্দিন জীবনের সামাজিক-সাংস্কৃতিক পর্যায়ে পশ্চিমা চিকিৎসা জ্ঞানকে খাপ খাওয়ানোর প্রবণতা বুঝতে পারা যায়। এ ধরনের প্রবণতা থেকেই ১৮৮৩ সালে কাদম্বিনী বসু নামের একজন বাঙালি নারীর কলকাতা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়নের পথ তৈরি হয়, যা ছিল ১৮৮৫ সালে ডাফরিন ফান্ডের মাধ্যমে নারীদের চিকিৎসাবিষয়ক শিক্ষার্জনের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিলাভেরও আগের ঘটনা। তবে কাদম্বিনীকে রক্ষণশীল বাঙালি সমাজের নিন্দার মুখে পড়তে হয়েছিল যারা নারীসমাজকে পুরুষ কর্তৃত্বপূর্ণ পেশাদার জনপরিসরে স্থাপন না করে জেনানার ভেতরে রেখেই স্বাস্থ্যবিজ্ঞানে শিক্ষিত করতে বেশি আগ্রহী ছিল। তবুও বাংলায় নারীদের চিকিৎসাশাস্ত্র শিক্ষার বিষয়ে কাদম্বিনী নতুন চর্চা তৈরি করেছিলেন, আর এটি আরো গতি পেয়েছিল ১৮৮৫ সালে ডাফরিন ফান্ডের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।৯১
অন্তঃপুরে পশ্চিমা চিকিৎসা ভাবনাগুলোর প্রবেশ ঘটলেও উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে জন্মদানের প্রকৃত অবস্থা মূলত অপরিবর্তিতই ছিল। নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য তখনও সরাসরি দাপ্তরিক কর্তৃত্বের বিষয় ছিল। নারীরা তখন পর্যন্ত গর্ভধারণ ও শিশুপালনের বৈজ্ঞানিক ভাবনাগুলোর নিছক গ্রহীতাই ছিল, কিন্তু সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত চিকিৎসা পেশাজীবীদের দ্বারা চিকিৎসাবিষয়ক পরীক্ষার এলাকা থেকে তারা বাইরেই অবস্থান করছিল। ১৮৭১ ও ১৮৮১ সালের আদমশুমারিতে উল্লিখিত শিশু ও মাতৃমৃত্যুর উচ্চহার শিশুজন্মের পরিস্থিতিকে রূপান্তরের ক্ষেত্রে সামান্য সফলতাকেই নির্দেশ করে। ১৮৭০ ও ১৮৮০ এর দশকে দেশীয় দাইদের প্রশিক্ষিত করতে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্ন চেষ্টাগুলো প্রায়শই কোন কাজে আসতো না। সরকার বুঝেছিল যে,
শুধুমাত্র শিশুজন্মের ক্ষেত্রেই পরীক্ষণের পন্থাগুলোকে আটকে রাখলে চলবে না যেখানে সম্ভবত খুব সামান্য পেশাদার জ্ঞানেরই প্রয়োজন হয়, বরং একে ছড়িয়ে দিতে হবে নারীদের বিশেষ বিশেষ রোগনির্ণয় ও চিকিৎসায়…বিশেষত উচ্চশ্রেণির স্থানীয় নারীদের বন্দি ও বিচ্ছিন্ন জীবনই এসব রোগের আক্রমণের জন্য দায়ী এবং তারা পুরুষ চিকিৎসকের অধীনে চিকিৎসা করাতে একেবারেই রাজি নয়, যদিও প্রশিক্ষিত ধাত্রীদের কাছ থেকে তারা খুশিমনেই সাহায্য নিবে।৯২
এই সময়কালে, পুন্নার মহারাণী মিস এলিজাবেথ বেইলবি নামের একজন চিকিৎসা মিশনারিকে অনুরোধ করেছিলেন যেন যথাযথ চিকিৎসা সেবার মাধ্যমে ভারতের অসুস্থ নারীদের রক্ষা করার জন্য রাণী ভিক্টোরিয়ার কাছে অনুরোধ করা হয়। মিস বেইলবির আলোচনার প্রেক্ষিতে ভারতের নারীদের কাছে চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দিতে কিছু করার জন্য রাণী লেডি ডাফরিনকে পরামর্শ দেন, এসময় তিনি তার স্বামী, ভাইসরয় হিসেবে নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত লর্ড ডাফরিনের সাথে ভারতে পা রাখার জন্য তৈরি ছিলেন। এই পরামর্শকে কিছুটা রঞ্জিত করা হয়েছিল “গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সুবিধা”-র সাথে যা এমন উদ্যোগ থেকে ঔপনিবেশিক সরকার লাভ করতো এবং “কল্যাণমূলক আলো হিসেবে একে প্রতিষ্ঠা করতো।’’৯৩ এছাড়া ব্রিটেনে নারী চিকিৎসকদের প্রাচুর্য ও ব্রিটিশ পুরুষ কর্তৃত্বাধীন চিকিৎসা ব্যবস্থা কর্তৃক নারী চিকিৎসকদের পেশাদার সুযোগের একরোখা প্রতিরোধের কারণে ভারতে নারী চিকিৎসকদের কাজ করতে অনুমতি দেয়া রাণীর জন্য ছিল সুবিধাজনক, আর ভারতেও তখন পর্যন্ত নারীদের চিকিৎসা বিষয়ে শিক্ষালাভ ছিল প্রাথমিক পর্যায়ে।৯৪ লেডি ডাফরিনের উদ্যোগ থেকে ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর সাপ্লায়িং ফিমেইল মেডিকেল এইড টু দ্য উইমেন অব ইন্ডিয়া, যা পরিচিতি পেয়েছিল কাউন্টেস অব ডাফরিন ফান্ড নামে।
ঔপনিবেশিক পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত কিন্তু সরাসরি এর নিয়ন্ত্রণে না থাকা৯৫ ডাফরিন ফান্ডই ছিল নারী চিকিৎসক, নার্স ও ধাত্রীদের প্রশিক্ষণ প্রদান এবং নারীদের হাসপাতাল, ঔষধালয় ও প্রশিক্ষিত ধাত্রীর মাধ্যমে জেনানায় থাকা পর্দানশীন নারীদের কাছে চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দেয়ার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের প্রথম পর্যায়। অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা ও ধনী স্থানীয় অভিজাতদের উদ্যমের কারণে ফান্ড প্রাথমিক সফলতা পেলেও বাংলায় শিশুজন্মের চিকিৎসায়ন প্রক্রিয়া ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে এর প্রভাব ছিল উদ্যম হানিকর। এর কারণ ছিল দ্বিস্তরী; প্রথমত, ধাত্রীবৃত্তির পশ্চিমা পদ্ধতি শেখার ক্ষেত্রে স্থানীয় দাইদের স্থির বিরোধিতা৯৬ এবং দ্বিতীয়ত, বাংলায় জেনানা হাসপাতালগুলোর অজনপ্রিয়তা।৯৭ ১৯০১ সালে লেডি কার্জন কর্তৃক ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল স্কলারশিপ ফান্ড-এর মাধ্যমে দাইদেরকে পুনরায় প্রশিক্ষিত করার মতো পরবর্তী প্রচেষ্টাগুলো দাইদের স্থির অসম্মতির মুখে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। তবুও পরের অংশে দেখা যাবে যে ভাবনার জগতেই বেশির ভাগ অর্জন সাধিত হয়েছিল। নারীদেরকে শিক্ষিত করা এবং জেনানায় পশ্চিমা বৈজ্ঞানিক ও চিকিৎসা ভাবনাগুলো ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে উনিশ শতকের শেষ দিকে বাংলার প্রসারমান প্রিন্ট সংস্কৃতি শিক্ষিত ভদ্রমহিলাদেরকে তাদের সামাজিক ও জীববৈজ্ঞানিক সত্তার সাথে যুক্ত জটিল সামাজিক বিষয়াদি সম্পর্কে নিজেদের ধারণা প্রকাশে পরিচালিত করে। এর মাধ্যমে নারীদের নিম্নগামী সামাজিক ও জীববৈজ্ঞানিক অবস্থা নিয়ে বিংশ শতকে হতে যাওয়া প্রভাবপূর্ণ ভবিষ্যৎ বিতর্কগুলোর মঞ্চ তৈরি হয় যা পরবর্তী দশকগুলোর নারীবাদী এজেন্ডাসমূহকে আকার প্রদান করে।
ভদ্রমহিলাদের সাড়াপ্রদান
উনিশ শতকের শেষ ও বিংশ শতকের প্রথমদিকে নারীদের জনপ্রিয় ম্যাগাজিনগুলোতে নারীদের লেখা পর্যালোচনা করে এসবে নানা ধরনের জটিল ইস্যুর বিভিন্ন ধরনের চিন্তা খুঁজে পাওয়া যায়। এসব ইস্যুর ভেতর ছিল গার্হস্থ্য বিষয়াদি, গর্ভধারণ, শিশুপালন ও নারীদের স্বাস্থ্য, আর এসব বিষয় প্রকাশিত হতো যথাক্রমে গৃহে রমনীর কর্তব্য, সূতিকাগৃহে প্রসূতির শুশ্রুষা, সন্তান পালনান্দ ও ভারত মহিলার স্বাস্থ্য শিরোনামে। বামাবোধিনী পত্রিকা, বঙ্গমহিলা প্রভৃতির মতো সম্পূর্ণভাবেই উদার স্বভাবের বাঙালি পুরুষ সংস্কারকদের দ্বারা পরিচালিত প্রথমদিকের নারীদের ম্যাগাজিনসমূহে গার্হস্থ্য ও দাম্পত্য বিষয়ে নারী লেখকদের ভাবনাকে স্থান দেয়া হতো। তবে এসব লেখা পিতৃতান্ত্রিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুরাগের ভেতর সীমাবদ্ধ ছিল। গোলাম মুরশিদ সামাজিক সংস্কারের প্রতি বাঙালি নারীদের সীমিত প্রকৃতির সাড়াপ্রদানের দিকে আলোকপাত করেছেন। তাঁর মতে এটি ছিল সম্পত্তির অধিকার ও বিবাহ আইনের মতো কিছু অর্থনৈতিক ও আইনি অধিকার বিষয়ে তাদের বোঝাপড়ার সঙ্কটের ফলাফল। মুরশিদ মনে করেন বাঙালি নারীদের কাছে অর্থনৈতিক বা যৌন স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ‘মুক্তি’ বা ‘স্বাধীনতা’ হিসেবে নয় বরং তাদের অধঃপতিত সামাজিক অবস্থান থেকে উন্নতিই ছিল মুক্তির অর্থ।৯৮ হিমানি ব্যানার্জি বলেছেন যে, উনিশ ও বিশ শতকের প্রিন্ট সংস্কৃতিতে নারীদের অংশগ্রহণের প্রকৃতি পিতৃতান্ত্রিক ভাবনার সাথে সহযোগিতা ও একই সময়ে সেসব ভাবনাকে প্রতিহত করার বিপরীতমুখী প্রবণতাপূর্ণ হলেও এই অংশগ্রহণের ফলে “তাদের সামাজিক আত্মনিষ্ঠা ও প্রতিনিধিত্ব তৈরির প্রক্রিয়ায় অবদান রাখা”৯৯ সম্ভব হয়। এই প্রক্রিয়ায় পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নারীরা একই সাথে ‘প্রতিরোধী সত্তা ও সহযোগী’ হিসেবে উঠে আসে।১০০ শিক্ষিত নারীদের লেখনিতে এই সাংঘর্ষিক প্রবণতা প্রচুর পরিমাণে দেখা যায়; যেমন একই সাথে মাতৃত্বকে মহিমান্বিত করার পিতৃতান্ত্রিক অবস্থানকে মহিমান্বিত করা ও বাল্যবিবাহের চর্চার প্রকাশ্য নিন্দা। এক্ষেত্রে বারবারা সাউদার্ড আমাদেরকে মনে করিয়ে দেন যে, জাতীয়তাবাদী আমলে বাঙালি নারীবাদীরা ‘সামাজিক নারীবাদ’-এর সীমানায় অবস্থান করেছিল যেখানে তারা পুরুষের সাথে সমতা দাবি করে নি।১০১ মা ও স্ত্রী হিসেবে নারীর জাতীয়তাবাদী ধারণাকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে নারীদের আদর্শিক দায়বদ্ধতার জন্যও এটি দায়ী ছিল। তাই এটি আশ্চর্য নয় যে এই সময়কালে সবচেয়ে সমালোচক নারীদের দ্বারাও স্ত্রী কিংবা মায়ের ভূমিকায় নারীদের ধারণায়ন করার প্রবণতাটি মূলত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয় নি।
বিশ শতকের শুরুর দিকে নারীদের লেখনিতে ছড়িয়ে পড়া প্রারম্ভিক নারীবাদী সচেতনতা শতাব্দীর পরিবর্তনের পরে ঘটিত নারীদের প্রশ্নের সূক্ষ্ম স্থানান্তর সম্পর্কে অর্থপূর্ণ অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে ব্রাহ্ম সংস্কারকদের দ্বারা তৈরিকৃত সাংস্কৃতিক বাতাবরণ নারীশিক্ষার সহায়ক হিসেবে প্রতীয়মান হয়; আর ১৮৫৪ সালের উড’স ডেসপ্যাচ বাংলায় নারীদের বিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষাগ্রহণ ছড়িয়ে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৮৮০ এর দশক থেকে ব্রাহ্ম সমাজের বাইরে গঠিত সমদর্শী দল নামক উদার অংশের প্রভাবে নারীদের চিকিৎসা শিক্ষাসহ কলেজ শিক্ষার প্রসার ঘটে। ১৯০০ সালের ভেতর, বম্বে ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির তুলনায় বাংলার মধ্যবিত্ত নারীদের এক বৃহৎ অংশ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন।১০২
বিশ শতকের প্রথম দুই দশকে শিক্ষক ও চিকিৎসক হিসেবে চাকরি পাওয়ার মাধ্যমে নারীদের জনপরিসরে অংশগ্রহণ সহজ হয়।১০৩ বাংলায় নারীদের পেশা হিসেবে চিকিৎসা ও পরে বৈজ্ঞানিক শিক্ষায় আসার বিষয়টি পরবর্তী সময়ের ব্রাহ্ম সমাজের নেতাদের আদর্শ দ্বারা আকার পেয়েছিল। ব্রাহ্ম সংস্কারকগণ নারী ও পুরুষের ভেতর বৃহত্তর সমন্বয় সাধনের জন্যে কাজ করেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ ১৮৭০ এর দশকে ধর্মীয় প্রার্থনা সভাসমূহে নারী ও পুরুষদের একই স্থানে বসতে উৎসাহ প্রদান কিংবা চা-চক্রের মতো সামাজিক জমায়েতে ভদ্রমহিলাদের স্বাগত জানানোর কথা উল্লেখ করা যায়।১০৪ শিবনাথ শাস্ত্রী, মনমোহন ঘোষ ও দ্বারকানাথ গাঙ্গুলির মতো পরবর্তী সময়ের ব্রাহ্ম সমাজ নেতা যারা ১৮৭৮ সালে সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ গঠন করেছিলেন, তাঁরা “শিক্ষায় নারী ও পুরুষদের জন্য দ্বিচারিতার”১০৫ বিরুদ্ধে লড়াই করেন। যেমন, দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি নারীদের জন্যে বিজ্ঞান ও চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়নকে উৎসাহিত করেন এই বলে যে নারীদেরও সেইসব জ্ঞানার্জনের অধিকার আছে যেগুলো শুধু পুরুষদের জন্যই আলাদা করা ছিল।১০৬ ১৯২০ এর দশকের ভেতর শিক্ষিত ভদ্রমহিলাদের ভেতর ‘আত্মোন্নয়ন’-এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়; এছাড়া গান্ধী যখন তাদেরকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়ার সুযোগ দেন তখন বিজ্ঞান শিক্ষাসহ উচ্চশিক্ষার প্রতি ক্রমবর্ধমান দাবি তৈরি হয়, বাংলায় শিক্ষাবিস্তার সংক্রান্ত ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক প্রতিবেদন (১৯১৭-১৮ ও ১৯২১-২২) থেকে এই বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়।১০৭ বাল্যবিবাহ, কম বয়সে গর্ভধারণ, শিশুমৃত্যু ও অপরীক্ষিত নীরব ভোগান্তিসমূহের প্রতি সচেতনতার ফলে নারীদের নিস্তেজ করে দেয়া দুর্দশাপূর্ণ সামাজিক অবস্থানগুলো ক্রিটিক্যাল মূল্যায়নের মুখে পড়ে।১০৮
তথ্যসূত্র ও টীকা
৮৬ Shib Chunder Deb, Sisupalan, Part II, Calcutta, 1868.
৮৭ Borthwick, Changing Role of Women, Chapter 5. Av‡iv †`Lyb, Branca, Silent Sisterhood, Chapter six.
৮৮ ১৮৬৮ ও ১৮৬৯ সালে বামাবোধিনী পত্রিকা-র সকল সংখ্যায় ‘শিশু পালন’ শিরোনামে প্রবন্ধের একটি সিরিজ প্রকাশিত হয়েছিল। দেখুন, ‘Sisu Palan’ Bamabodhini Patrika, Vol.4, 1868 and Vol.5, 1869.
৮৯ Iqbal Singh Sevea, The Political Philosophy of Muhammad Iqbal: Islam and Nationalism in Late Colonial India, New York: Cambridge University Press, 2012, 69–70.
৯০ Sonia Nishat Amin, The World of Muslim Women in Colonial Bengal, 1876–1939, Leiden, New York and Koln: E.J. Brill, 1996, 93–96.
৯১ Karlekar, ‘Kadambini and the Bhadralok’.
৯২ WBSA, Judicial Department (Medical Branch), File No.63, Progs No:7–9, December 1873.
৯৩ Sean Lang, ‘Saving India Through Its Women’, History Today, Vol.55, No.9, 2009, 46–47.
৯৪ একজন পুরুষ চিকিৎসকের কাছ থেকে জেনানায় থাকা বাঙালি মধ্যবিত্ত নারীদের চিকিৎসা সেবা সন্ধানে ঔদাসীন্য ভিক্টোরিয়ান ব্রিটেনে নারীদের ঔষধের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ও নারী চিকিৎসকদের পেশাদারীকরণে অন্যতম প্রধান প্রণোদনাদায়ী শক্তি হিসেবে সামনে আসে। দেখুন, Antoinette Burton, ‘Contesting the Zenana: The Mission to Make Lady Doctors for India, 1874–1885’, The Journal of British Studies, Vol.35, No.3, 1996, 368–398.
৯৫ Balfour and Young, The Work of Medical Women, 20–21. ডাফরিন ফান্ডের সাধারণ রূপরেখার জন্য দেখুন, Arnold, Colonising the Body, 260–268; Maneesha Lal, ‘The Politics of Gender and Medicine in Colonial India: The Countess of Dufferin Fund, 1885–1888’, Bulletin of the History of Medicine, Vol.68, No.1, Spring 1994, 29–66.
৯৬ Supriya Guha, ‘From Dais to Doctors: The Medicalisation of Childbirth in Colonial India’, in Lakhsmi Lingam, ed. Understanding Women’s Health Issues: A Reader, New Delhi: Kali, 1998, 145–162.
৯৭ Supriya Guha, ‘ “The Best Swadeshi”: Reproductive Health in Bengal, 1840–1940’, in Sarah Hodges, ed. Reproductive Health in India: History, Politics, Controversies, Delhi: Orient Longman, 2006.
৯৮ Ghulam Murshid, Reluctant Debutante: Response of Bengali Women to Modernisation, 1849–1905, Rajshahi: Sahitya Samsad, 1985, See Introduction and Chapter 3.
৯০ Himani Bannerji, ‘Fashioning a Self: Educational Proposals for and by Women in Popular Magazines in Colonial Bengal’, Economic and Political Weekly, Vol.26, No.43, 1991, 50.
১০০ Anindita Ghosh, Behind the Veil: Resistance, Women and the Everyday in Colonial South Asia, Delhi: Permanent Black, 2007. ঘোষ এই বিষয়টি তৈরি করেছেন রণজিত গুহের একই ধরনের পূর্ববর্তী আলোচনার উপর ভিত্তি করে, যার সূত্র, ‘The Career of an Anti-God in Heaven and on Earth’, in Asok Mitra, ed. The Truth Unites, Calcutta: Subarnarekha, 1985.
১০১ Barbara Southard, The Women’s Movement and Colonial Politics in Bengal: The Quest for Political Rights, Education and Social Reform Legislation, 1921–1936, New Delhi: Mahohar, 1995, Chapter 3.
১০২ উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৯০২ সালে ভারতে শিক্ষার অগ্রগতি বিষয়ক প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, ঐ বছর ভারতে ১৭৭ জন নারী কলেজ ছাত্রীর ভেতর ৫৫ জন ছিল বাংলা থেকে, যেখানে মাত্র পাঁচজন ছিল মাদ্রাজ থেকে এবং দুইজন ছিল বম্বে ও যুক্ত প্রদেশ থেকে। ১৮৯৭ থেকে ১৯০২ সালের ভেতর, মাদ্রাজের সাতজন, যুক্ত প্রদেশের একজন ও বম্বের একজন ছাত্রীর বিপরীতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৩৭ জন নারী পড়ালেখা শেষ করেন। ‘Progress of Education in India, 1897–1902’, 299, quoted in Karlekar, ‘Kadambini and the Bhadralok,’ 29 and fn34. ১৯০১ সালে কলকাতার আদমশুমারি অনুযায়ী মোট নারী জনসংখ্যার ৯.৭ শতাংশ ছিল শিক্ষিত নারী, যেখানে ১৮৭৬ সালে এটি ছিল ৩.৩৬ শতাংশ। দেখুন, Censuses for Calcutta, Towns and Suburbs, 1876, 1901 as quoted in Borthwick, The Changing Role of Women, fn181.
১০৩ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরই মধ্যবিত্ত নারীরা স্টেনোগ্রাফার, টেলিফোন অপারেটর ও বিভিন্ন দপ্তরের দৈনন্দিন কর্মী হিসেবে চাকরিগুলো গ্রহণ করতে পেরেছিল। দেখুন, Bharati Ray, ‘Women of Bengal: Transformation in Ideas and Ideals, 1900–1947’, Social Scientist, Vol.19, Nos.5–6, 1991, 11.
১০৪ দেখুন, Borthwick, The Changing Role of Women, 259–260.
১০৫ দেখুন, David Kopf, Brahmo Samaj and the Shaping of Modern Mind, Princeton, NJ: Princeton University Press, 1979, 124.
১০৬ Karlekar, ‘Kadambini and the Bhadralok’, 26.
১০৭ Rachana Chakraborty, ‘Women’s Education and Empowerment in Colonial Bengal’, in Hans Hagerdal, ed. Responding to the West: Essays on Colonial Agency and Asian Agency, Amsterdam: Amsterdam University Press, 2009, 96.
১০৮ Hemantakumari Chaudhury, ‘Bharat Mahilar Svasthya (Health of Indian Women)’, Antahpur, Vol.4, No.7, July 1901, 149–151.
পড়ুন ।। কিস্তি ৩
ঔপনিবেশিক আধুনিকতা : বাংলায় ধাত্রীবৃত্তি (১৮৬০-১৯৪৭) ।। কিস্তি : ৩