গীতা দাস একজন সাহিত্যিক, কলামিস্ট এবং মানবাধিকার কর্মী। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত পত্রপত্রিকায় তার কলাম, প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও ছোটগল্প নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে। সহজিয়ার জন্য ধারাবাহিকভাবে লিখবেন বাংলাদেশের সংখ্যালঘুর কথাসাহিত্য প্রসঙ্গে। আজ প্রকাশিত হলো কিস্তি ৯।
ত্রিপুরা নৃগোষ্ঠীর কথাসাহিত্যে নিখোঁজ প্রভাংশু ত্রিপুরা
ত্রিপুরা নৃগোষ্ঠীর মধ্যে কথাসাহিত্যে বই প্রকাশ করার সূচকে প্রভাংশু ত্রিপুরাই প্রথম কথাসাহিত্যিক। তাঁর লিখিত ছোটগল্প ও উপন্যাসের বই উদ্ধার করা না গেলেও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা থেকে সংগৃহীত তাঁর ছোটগল্পের পর্যালোচনা করা হলো। (গল্পগুলোর উৎস সম্পর্কিত তথ্য ইতোপূর্বে অষ্টম কিস্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে।)
এখানে আলোচিত তাঁর প্রথম ছোটগল্পটির নাম ককবরক ভাষায় ‘খগ্রী’ (বাংলায় খগ্রী অর্থ মুরগী)। নিজের ভাষার অস্তিত্ব রক্ষার্থেই যেন বাংলা ভাষার গল্পের শিরোনাম ত্রিপুরা ভাষায়; এ যেন নীরবে নিজের ভাষার অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার প্রয়াস। গরিবের সুন্দরী মেয়ে তালবিতি এক কার্বারীর ছেলের প্রেমকে প্রত্যাখ্যান করে। পরে তার বাবা তাকে দিনমজুর হাদুক রায়ের সঙ্গে বিয়ে দেয়। এ দিনমজুর যাত্রা দেখার বিলাসিতা পূরণ করতে কার্বারীর ছেলের হাঁস চুরি করে। পরিণামে তাকে কার্বারীর ছেলের হাতে প্রাণ দিতে হয়। গল্পটির শুরু তালবিতির পালিত খগ্রী বিক্রি করে হাদুক রায়ের যাত্রা দেখার প্রচেষ্টা দিয়ে। আর গল্পের শেষ হয় মৃত স্বামীর পাশে বসা তালবিতির পায়ের কাছে খগ্রী দুটোর লুটিয়ে পড়ার মাধ্যমে। লেখক এ গল্পে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন ত্রিপুরা গ্রামের চিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি সংখ্যালঘু ত্রিপুরা নৃগোষ্ঠীর মধ্যেও লঘুতর হাদুক রায় আর তালবিতির হতদরিদ্র সংসারের করুণাবস্থা মমতার সাথে চিত্রিত করেছেন।
‘বাজি’ গল্পে রত্না নামে এক নারীর দুইবার বিয়ের পর দুই স্বামীই মারা যাওয়ায় সমাজ তাকে অপয়া হিসেবে চিহ্নিত করেছে। হকিরায় নামে এক লম্পট বিবাহবহির্ভূতভাবে বাজি ধরে রত্নাকে উপভোগ করতে না পেরে ঝাড়-ফুঁক করে রত্নাকে বশীভূত করার জন্য চৈ কুমার নামে এক বৃদ্ধ বৈদ্যের শরণাপন্ন হয়। বৃদ্ধ বৈদ্য অন্যের ক্ষতি না করার জন্য শক্ত নৈতিক অবস্থান নেয়। হকিরায় নিজের ব্যর্থতার প্রতিশোধ নিতে এই বৃদ্ধের সাথে রত্নার বিয়ের জন্য বৃদ্ধকে উদ্ধুদ্ধ করে এবং ঘটনার ধারাবাহিকতায় রত্না ও বৃদ্ধের বিয়েও সম্পন্ন হয়। রত্নাকে বিয়ে করে বৃদ্ধ যে শারিরীকভাবে যৌন ক্ষমতার অধিকারী তা প্রমাণ করার চিত্রও লেখক এঁকেছেন। কিন্তু অপয়া বলে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধারণা থেকে ত্রিপুরা সমাজকে মুক্ত রাখার প্রয়াস নিলেও অবশেষে রত্নার সতীদাহের ব্রত নিয়ে নিজেকে স্বামীর চিতায় আত্মহুতি দেয়ার বর্ণনায় লেখক যেন প্রগতির উলটো পথেই হেঁটেছেন। তবে হকিরায় নিজের যৌনক্ষুধা মিটাতে না পারলেও অবশেষে রত্নার আত্মহুতিতে তাঁর বোধোদয়ের কথা বলা হয়েছে এ গল্পে।
‘সরবত’ গল্পের কাহিনিতে গরীব মা সাম্পারি ছেলে নিয়ে ধনীর বাড়িতে টেলিভিশন দেখতে গিয়ে তা তো দেখতে পারেইনি, উপরন্তু ছেলে ধনীর বাড়ির আরেক শিশুর সরবত খাওয়া দেখে চিরাচরিত শিশুসুলভ চরিত্রের প্রকাশ ঘটিয়ে সরবত খাওয়ার বায়না ধরে। তবে ধনী গৃহিণী যথারীতি সরবতে ছেলেটির লোভী দৃষ্টি লেগেছে মনে করে এক জগ সরবত ফেলে দিলেও সাম্পারির ছেলেকে খেতে দেয় না। পরে মা ছেলেটিকে আমলকি খাওয়ার পর জল খাইয়ে সরবতের স্বাদ দেয়। গরীবের আশ্রয় প্রকৃতি। এ ছিলো গল্পটির মূল বার্তা।
‘হেডম্যান দর্পণ’ গল্পে এক লম্পট হেডম্যানের চরিত্র চিত্রায়ণ করা হয়েছে। যে নিজে তার এলাকায় শোষণ করে সম্পদ বানায়, সালিশে অন্যায়ভাবে রায় দেয় এবং গরীবের এক অসহায় মেয়েকে ভোগ করার জন্য কৌশলে নিজের বাড়িতে কাজ করার জন্য বাধ্য করে। পরে গ্রামের যুবকরা লম্পট হেডম্যানকে শায়েস্তা করে গরীবের মেয়ে যুবতী মাচাংতিকে তার ছোবল থেকে রক্ষা করে।
‘উত্তরাধিকার’ গল্পে চন্দন নারাণ ত্রিপুরা নামে একজন ত্রিপুরা রাজ্য থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় পর্যটনে এসে ঘটনাক্রমে বিয়ে করে বসতি স্থাপন করে। সে পিতা হয়ে এক পুত্রকে তার সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করলে স্ত্রী, বঞ্চিত পুত্র ও জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং গ্রামবাসী এর কারণ জানতে চায়। বৃদ্ধ এর কারণ হিসেবে এ পুত্রের পিতা সে না বলে তার সন্দেহের কথা জনসন্মুখে প্রকাশ করে। কিন্তু স্ত্রী এ সন্দেহের কথা শুনেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। রহস্য আর উদঘাটিত হয় না। গল্পটি শেষ হয়ে হইল না শেষ আমেজে পরিণত হয়।
প্রভাংশু ত্রিপুরার কাছে এ প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন যে, বিভিন্ন প্রবন্ধে, কবিতায় ও উত্তরের মেঘ উপন্যাসে নানাভাবে পাহাড়ে অত্যাচার, নিপীড়ন ও দ্রোহের বিষয়টির তিনি আলোকপাত করেছিলেন।
‘যাত্রাপথে’ গল্পটিতে লেখক খাগড়াছড়ি থেকে চট্টগ্রাম আসা যাওয়ায় সড়ক পথে নিত্যদিনের সমস্যা তুলে ধরেছেন। একটু ঝড় বৃষ্টি হলে যাত্রীদের অসহনীয় দুর্ভোগ শিকারের সুনিপুণ ছবি হাস্যরসের মাধ্যমে এ গল্পে অঙ্কিত হয়েছে। গল্পটিতে জেন্ডার অসংবেদনশীলতাসহ জাতিগত বিদ্বেষ পোষণের ইঙ্গিতও রয়েছে। যেমন— “শিশুর মুখটি হাসি ছড়ানো। সে বলল, তার দেহেও জোঁক বসেছিল। সে নিজেই ওগুলো টেনে ফেলে দিয়েছে। জোঁককে সে ভয় পায় না। অথচ গাড়ীর ভেতর ২৮ জন মহিলা যাত্রী জোঁকের ভয়ে কাতর”। (ত্রিপুরা, এমাং, ২০১৪) অথবা “এক্ষনে ওই ভদ্র মহিলার এমন অসংযত আচরণ দেখে দুর্যোগ আক্রান্ত শত শত যাত্রীগণ বলতে বাধ্য হয়েছিলেন সংযত হোন, সংবরণ করুন। অনেক নারীকে আমি পরনের কাপড় উপরে তুলে নদী পার হতে দেখেছি। কিন্তু আজকের এই ভদ্র মহিলার মতো বেহায়াপনা আমি দেখিনি”। (ত্রিপুরা, এমাং, ২০১৪) আর এতোগুলো মহিলা যাত্রীর মধ্যে এক বাঙালি মহিলাই “তাঁর তলপেটে উরু ও যৌনাঙ্গের সন্ধিস্থলে দু’টো জোঁক কামড় বসিয়ে দিয়েছে।…আমি আপনার মেয়ের মতো। আমাকে বিপদ থেকে রক্ষা করুন। কী আর করা। আসাম পাতা দু’টো ছিড়ে নিয়ে ভদ্র মহিলার উরুস্থ জোঁক দু’টোকে ছাড়িয়ে এনে পীচ ঢালা রাস্তার উপর ফেলে দিলাম”। (ত্রিপুরা, এমাং, ২০১৪) এ গল্পে লেখক নারী চরিত্র নিয়ে অনেক ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ও হাস্যরসের অবতারণা করেছেন।
‘প্রগতি সমাজ’ গল্পের মূল বিষয়ই হলো যুব সমাজের একতাবদ্ধ হয়ে ত্রিপুরাদের পারিবারিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা করা। কুসুম কুমার নামক এক ত্রিপুরা এক মেয়েকে ধর্ষণ করলে বিয়ে করতে বাধ্য হয়। গরীর শ্বশুর রাঙামাটিতে শহরে গিয়ে তার পড়ার খরচ চালাতে অপারগ হলে স্ত্রীকে ছেড়ে দিয়ে শহরে গিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করে গ্রামের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে। এমনকি বাবার মৃত্যুতে শুধু টাকা দিয়েই দায়িত্ব পালন করে। ত্রিপুরা সংস্কৃতিও চর্চা করে না। “শ্যালিকার পরনে ছিলো ত্রিপুরীদের স্বকীয় পোশাক পরিচ্ছদ। সেটি দেখে প্রতিবেশী এক অধ্যাপিকা পোশাক সম্বন্ধে বেশ তারিফ করেছিলেন। এতে কুসুম কুমারের বউ চানবিতি ঠোঁট উলটে, ভ্রু কুচকে বলেছিলো, ও ধরনের পোশাক আশাক কেবল আদিম মানুষেরাই পরে”। (ত্রিপুরা, সান্তুআ জার্নাল, ২০১৯) তাদের ভাষাও ককবরক নয়। “কুসুম কুমারের পরিবার চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও কুমিল্লা এই তিন আঞ্চলিক ভাষার সংমিশ্রণে খিচুরী বাংলায় কথা বলে”। (ত্রিপুরা, সান্তুআ জার্নাল, ২০১৯) কুসুম কুমারের বিভিন্ন অমানবিক আচরণের প্রতিবাদে যুবসমাজ রুখে দাঁড়ায় — এ সংবাদের মাধ্যমে গল্পটির সমাপ্তি। লেখক যেন লেখনির মাধ্যমে স্বজাতির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে নিয়োজিত।
‘বাংবার’ গল্পের নামটি ককবরক ভাষায়, যার বাংলা অর্থ হলো অশরীরি আত্মা। গল্পের প্রথমে দুই গ্রামের মধ্যে প্রতিযোগিতার চিত্র বর্ণিত হয়েছে। দুই গ্রামের ফসল ফলানো, পারদর্শী তান্ত্রিক বৈদ্য, এমনকি পেশাধারী চোর পর্যন্ত এ প্রতিযোগিতার অংশ। পরবর্তী সময়ে দুই বৈদ্যের কারসাজিই গল্পে মূল প্রতিপাদ্য হয় এবং সবশেষে কুসংস্কারের চিত্র উন্মোচিত হয়।
‘আকাঙ্ক্ষিত পর্বতের ভাষণ’ একটি ঐতিহাসিক গল্প। ১৯৪৭ সালে ১৪ এপ্রিল বৈসু উৎসবের দিন স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্যের সর্বশেষ মহারাজে বীর বিক্রম কিশোর মাণিক্য বাহাদুর মেলাঘরে ছাত্র-শিক্ষক সম্মেলনে যে ভাষণ দিয়েছিলেন তাকে লেখক আকাঙ্ক্ষিত পর্বতের ভাষণ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ভাষণের মাধ্যমেই তিনি মহানুভব, পরাক্রমশালী, স্বপ্নদ্রষ্টা রাজার চরিত্রটি অঙ্কন করেছেন। এ গল্পে লেখকের ত্রিপুরা জাতি, ত্রিপুরা জাতির ইতিহাস, ত্রিপুরা রাজ্যের বিস্তৃতির সাথে যেন নিজের নৈকট্য উপলদ্ধি করেছেন।
প্রভাংশু ত্রিপুরা বিভিন্ন গল্পে যুব সমাজের আদর্শিক কার্যকলাপে সুন্দর সমাজ গড়ার স্বপ্ন এঁকেছেন। এ প্রসঙ্গে শোভা ত্রিপুরা এক গল্পে বলেছেন, ‘আমাদের ত্রিপুরাদের মননশীল লেখক প্রভাংশু ত্রিপুরার মতো এমন করে কি তরুণীর চোখে স্বপ্ন এঁকে দিতে পারে না সমাজ।’ [i] প্রভাংশু ত্রিপুরার যুব সমাজের প্রতি গভীর আস্থা ও ভালোবাসা সর্বজনবিদিত এবং শোভা ত্রিপুরার এ বাক্যটির মধ্যেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়।
প্রভাংশু ত্রিপুরাকে নিয়ে অচিরেই অধিকতর গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। এমন একজন জাতীয় ব্যক্তিত্বের লিখিত বই তাঁর জীবদ্দশায়ই বিলুপ্তপ্রায়।
প্রভাংশু ত্রিপুরা তাঁর গল্পে সামাজিক অনাচার, শ্রেণি-বৈষম্য, ধনিক শ্রেণির বজ্জাতি, নিজ জাতি ও সংস্কৃতির প্রতি অবহেলা এবং বিভিন্ন কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সোচ্চার। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠীর দরিদ্রতার অসহায় চিত্রের কথা রয়েছে প্রায় প্রতিটি গল্পে। সম্পদের দিক থেকে যে সংখ্যালঘুত্ব তা সংখ্যালঘুর অন্যন্য বৈশিষ্ট্যকেও যেন হার মানিয়েছে। অবস্থা ও অবস্থানের পরিমাপে তারা সংখ্যালঘুর মধ্যেও লঘুতর। বিভিন্ন গল্প থেকে উদাহরণস্বরূপ:
- ‘তালবিতিরা দরিদ্র। নুন আনতে পানতা ফুরায় এমন সংসার। …তালবিতিরা যত না দরিদ্র, তারচেয়ে আরো বেশী শোচনীয় অবস্থা ছিলো হাদুক রায়ের। এতিম ছেলে। … গৃহস্থের বাড়ীতে পেটেভাতে গরু চরানোর চাকুরী নিয়ে হাদুক রায়ের জীবন ও জীবিকা শুরু হয়।’ (খগ্রী)
- বৃদ্ধ চৈ কুমার একাই বসবাস করেন গ্রামের শেষ প্রান্তের বটগাছ তলার ছোট্ট একটা কুঁড়েঘরে। (বাজি)
- ‘সাম্পারিরা গরীব মানুষ। কষ্টের সংসার। শিশু ছেলের আবদার টেলিভিশন দেখবে। তাই টেলিভিশন দেখতে টেলিভিশন ওয়ালাদের বাড়ীতে আসা। অমন অলুক্ষণেই না আমার ওই বাড়ীতে যেতে হয়েছিল। গৃহকত্রী আমার আগমনের কারণে কি না জানি না চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ লেপিয়ে, টেলিভিশন বন্ধ করে দিয়ে বৈঠক খানায় চলে গেলেন ব্যস! সাম্পারি আর তাঁর ছেলের টেলিভিশন দেখা হলো না। … গৃহকত্রী চেচিয়ে উঠলেন, এ্যাই তোমাদের কি কান্ডজ্ঞান নেই। ঘরে অতিথি। তোমরা নিজেরা উঠে যাবি না কুকুর লেলিয়ে তাড়াতে হবে?’ (সরবত)
- এবার আরও রেগে গিয়ে বললেন, বেয়াদপের দল। জমিদার মশাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটলে কি করতে হয় তাও তোমরা ভুলে গেছো। বের হও বৈঠকখানা থেকে। তোমাদের সমুচিত শাস্তি আমি দেবো।’(উত্তরাধিকার)
- ‘গরীবের সংসার। জমি জিরেট নেই জামাইটা নাকি লম্পট, মদখোর। বউ পালতে পারে না, খাওন দিতে পারে না।’ (হেডম্যান দর্পণ)
- চানবিতির বাবা নেহায়েৎ গরীব মানুষ। বাঁশ বেতের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। তিন জোড়া হালের বলদ আছে, হালের বলদগুলোকে দৈনিক কামলা খাটিয়ে যা আয় উপার্জন হয় তাতে কোন রকমে দিন গুজরান করে। জামাইকে পড়ালেখার খরচের যোগান দেবে কি করে? (প্রগতি সমাজ (এক))
আবার, কোনো কোনো গল্পের সারমর্ম বা উপসংহারে একটা নীতিকথা বা শিক্ষণীয় বার্তাও রয়েছে। যেমন:
- ‘সোনার সিংহাসনে বসতে সেনাপতিরা তৎপর। কিন্তু না, বুড়োমন্ত্রী তা হতে দেবেন না। সেনাগণ সিংহাসনে বসলে রাজ্যের অমঙ্গল বৈ কল্যাণ আনবে না।… আর দেখানো হবে “হিংসার পরিণাম” ’ (খগ্রী)
- ‘যে সমাজ সর্বদা তমোগুণে আচ্ছন্ন থাকে, মিথ্যা অহংবোধে যাদের সহমর্মিতা নেই, সমবেদনা নেই, আপন ভোগ বিলাসের ভাগ অন্যকে একরত্রি দিতে যাদের কার্পণ্যতা, তাদের কাছে সমাজের অসহায় মানুষের মানবিক মূল্যবোধ বিবেচিত হয় না।’(সরবত)
- ‘মাথা পঁচে গেলে নাকি দেহের দ্রুত পচন ধরে। আপনি আমাদের মাথা। আপনি এমন কাজ করবেন না যাতে সমাজের পচন ধরে যায়।’ (হেডম্যান দর্পণ)
- ‘ আমার কেন জানি মনে হলো সূর্যদেব বলছেন, “হে প্রাণিকূল ভয় পাবার কিছু নেই। সবই অনিত্য। এখন ঘুমাও। আগামীকাল আবার তোমাদের সাথে মিলিত হবো।”(বাংবার)
ত্রিপুরা জাতীয়তাবোধের পরিচয়কে তুলে ধরা, ত্রিপুরা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে উপস্থাপন করা এবং একজন ত্রিপুরা হিসেবে ত্রিপুরা রাজার ক্ষমতা, শৌর্য-বীর্য নিয়ে গর্ব করার উদাহরণ প্রভাংশু ত্রিপুরার ছোটগল্পে স্পষ্টতই বিরাজমান। প্রায় সব গল্পেই কোনো না কোনোভাবে ত্রিপুরা বিষয়টি স্থান পেয়েছে।
- ‘খগ্রী’ গল্পে হাদুকরায়ের দেখা যাত্রা পালার নাম’ ত্রিপুরেন্দ্র”। যেখানে ত্রিপুরা রাজার সিংহাসন রক্ষার কাহিনি বিবৃত হয়েছে।
- উত্তরাধিকার’ গল্পে চন্দন নারাণ ত্রিপুরা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে পার্বত্য এলাকায় আসে এবং সে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ত্রিপুরা রাজার সৈন্যবাহিনীতে যোগদান করেছিল।
- তিনি ‘প্রগতি সমাজ’ (এক) গল্পে তারিখে ১৫ তালয়ুং, ১৮১২ ত্রিপুরাব্দ ব্যবহার করেছেন।
- ‘আকাঙ্ক্ষিত পর্বতের ভাষণ’ গল্পটিই রচিত হয়েছে ত্রিপুরার রাজার চরিত্র চিত্রায়ণের জন্য।
- ‘বাজি’ গল্পে ত্রিপুরাদের লোক জীবনে দুধ, দই, নারকেল, পান -সুপারি ও সাদা কাপড় কল্যাণ ও মঙ্গলের প্রতীক বলে বিবেচিত হয় এবং এসব দ্রব্য নিয়ে শুভকার্য সম্পাদিত হয় তা উল্লেখ করেছেন।
- ‘বাংবার’ গল্পে আনোক বৈদ্য তাঁর পূর্ব প্রতিজ্ঞানুযায়ী আসলং বৈদ্যের লাশের উপর তার প্রতিশোধ গ্রহণ করে এবং কাফনের কাপড়টি নিয়ে সপরিবারে ত্রিপুরা রাজ্যে পালিয়ে গেছে।
প্রভাংশু ত্রিপুরা ছোটগল্প লেখক হিসেবে আঙ্গিক নিয়ে সচেতনভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। যেমন, ‘প্রগতির পথে’ গল্পটি যুব সমাজের একটি ক্লাবের সভার কার্যবিবরণী এবং ‘আকাঙ্ক্ষিত পর্বতের ভাষণ’ একটি বক্তৃতাকে কেন্দ্র করে লিখিত। তাঁর গল্পগুলোতে সৃজনশীল সাহিত্যিক হিসেবে স্বাক্ষর বিরাজমান। বাংলা যে লেখকের দ্বিতীয় ভাষা তা অনুধাবন করা যায় না। তবে প্রভাংশু ত্রিপুরার অগ্রন্থিত ছোটগল্পে পার্বত্য চট্টগ্রামে ত্রিপুরাসহ বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীদের সংখ্যালঘু হিসেবে শোষণের শিকার বা বঞ্চিত হবার চিত্র নেই। গত শতাব্দীর আশির দশকে রচিত কথাসাহিত্যে প্রভাংশু ত্রিপুরার চিন্তা চেতনার বহিঃপ্রকাশ এবং সমসাময়িক পাহাড়ি মানুষের যাপিত জীবন অঙ্কনের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণে লেখকের মনোভাব ও কৌশল পাহাড়ী জনগণের শুভানুধ্যায়ীদের কাছে অজানাই থেকে গেলো। প্রভাংশু ত্রিপুরার কাছে এ প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন যে, বিভিন্ন প্রবন্ধে, কবিতায় ও উত্তরের মেঘ উপন্যাসে নানাভাবে পাহাড়ে অত্যাচার, নিপীড়ন ও দ্রোহের বিষয়টির তিনি আলোকপাত করেছিলেন।
প্রভাংশু ত্রিপুরা নিজের রচিত ছোটগল্প, ছোটগল্পের বই ও উপন্যাস হারিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে বলেন যে, এটি তাঁর জন্য বিষাদময় অনুভূতি। নিজেকে তহবিল শূন্য মনে হয়। বইয়ের অনেক কপি সযত্নেই রেখেছিলেন। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের এক সময়ের রাজনৈতিক অস্থিরতায় নিরাপত্তাজনিত কারণে বইসহ বিভিন্ন সম্পদ স্থানান্তরিত করতে হয়েছিল, লুকিয়ে রাখতে হয়েছিল, নিজেরও আশ্রয় খুঁজতে হয়েছিল এবং তা করতে গিয়ে বিভিন্ন ঘটনার ফলে বিভিন্ন সম্পদের সাথে বইগুলোও রক্ষা করা যায়নি। তিনি মনে করেন, যে কোনো লেখকের বই সংরক্ষণ করার দায়িত্ব লেখকের উপর বর্তায় না; তিনি সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু এ সৃষ্টি সংরক্ষণের দায়িত্ব বিভিন্ন সংগঠনের, সংশ্লিষ্ট সমাজ ও জনগোষ্ঠীর।
প্রভাংশু ত্রিপুরাকে নিয়ে অচিরেই অধিকতর গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। এমন একজন জাতীয় ব্যক্তিত্বের লিখিত বই তাঁর জীবদ্দশায়ই বিলুপ্তপ্রায়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী পুঁথি সংক্রান্ত গবেষণার উদ্দেশ্যে নেপাল গিয়ে তৃতীয়বারে বাংলা ভাষার প্রথম নির্দশন চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয় পুঁথি আবিষ্কার করেন। কাজেই প্রভাংশু ত্রিপুরার বইগুলোর কপি খুঁজে বের করার জন্য ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যসহ চিরুণী অভিযানের মাধ্যমে অনুসন্ধান চালানো ত্রিপুরা নৃগোষ্ঠীর জন্য অতীব আবশ্যক। এ বিষয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন কিংবা কোনো ব্যক্তি এ উদ্যোগ নিতে পারেন।
( চলবে। পরবর্তী কিস্তি – ত্রিপুরা নৃগোষ্ঠী রচিত কথাসাহিত্যে অসম্পূর্ণ বরেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ও অসংগঠিত শোভা ত্রিপুরা)
[i] শোভা ত্রিপুরা, স্বাপ্নের ধূসর ছায়া, (ঢাকা: অঙ্কুর প্রকাশনী, ২০১৩)।
পড়ুন ।। কিস্তি ৮