পৃথিবীখ্যাত বইয়ের একটি ডিসকোর্স অন কলোনিয়ালিজম (১৯৫৩)। লিখেছেন ফরাসি উপনিবেশ মারতিনিকের লেখক, রাজনীতিবিদ ও তাত্ত্বিক এইমে সিজার। জোয়ান পিংকহামের করা ইংরেজি অনুবাদ থেকে বইটি ধারাবাহিকভাবে বাংলায় অনুবাদ করবেন কবি ও অনুবাদক মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম।
আমরা প্রথমেই খতিয়ে দেখতে পারি কীভাবে উপনিবেশায়ন উপনিবেশককেই অসভ্য করেছে, বর্বর করে তুলেছে প্রকৃত অর্থেই এবং অধঃপতিত করেছে সমূলে। জাগিয়ে দিয়েছে তার ভেতরে বন্দী থাকা সকল পাশবিকতা, লালসা, হিংস্রতা, বর্ণবিদ্বেষ এবং নৈতিক অবনতিকে, এবং এগুলোকে ত্বরান্বিত করেছে। আমাদের অবশ্যই এই সত্য প্রকাশ করতে হবে যে, যখনই ভিয়েতনামে কারো গলা কেটে কিংবা চোখ উপড়ে ফেলে দেয়া হয়, ফ্রান্সে তারা এটাকে নিতান্ত সাধারণভাবে গ্রহণ করে। যখনই একটি ছোট্ট মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়, ফ্রান্সে তারা এটাকে সামান্য ব্যাপার বলে মেনে নেয়। যখনই মাদাগাস্কারে কাউকে পাশবিক নির্যাতন করা হয়, ফ্রান্সে তারা এটাকে মেনে নেয় এবং সায় দেয়, তখনই সভ্যতা গিয়ে দাঁড়ায় মরণের দ্বারপ্রান্তে। শুরু হয়ে যায় এক সার্বজনীন পশ্চাৎপদতা এবং গ্যাংগ্রিনের মত ছড়িয়ে পড়ে সংক্রমণশীল এই পচা ক্ষত। প্রকাশ করতে হবে কত শত চুক্তি তারা ভঙ্গ করেছে, কত মিথ্যা প্রচার করেছে, কত দমনমূলক ব্যবস্থা প্রয়োগ করেছে মানুষের উপর। সাধারণ মানুষকে বন্দী করেছে, তাদেরকে বেঁধে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, দেশপ্রেমিকদের নির্যাতন করেছে নির্মমভাবে, বর্ণবাদী অহংকারকে উৎসাহিত করেছে এবং কত রকমের দাম্ভিকতা প্রদর্শন করেছে ! সবমিলে এর মাধ্যমেই উপনিবেশায়ন ইউরোপের রক্তে ঢেলে দিয়েছে এক বিষাক্ত বিষ । যার কারণে ধীরে ধীরে কিন্ত অনিবার্যভাবে এই মহাদেশ এগিয়ে গিয়েছে চরম অসভ্যতার দিকে।
তারপর কোন এক (অ)শুভ দিনে বুর্জোয়ারা নিজেদের কর্মের আত্মঘাতী কুফলের ধাক্কায় জেগে ওঠে দেখে গেস্টাপো’র লোকেরা (হিটলারের গোপন বাহিনী) অনেক তৎপর, জেলগুলো দেখতে দেখতেই ভরে যাচ্ছে, নির্যাতনকারীরা নতুন নতুন পদ্ধতিতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
লোকজন অনেক অবাক হলো। তারা ঘৃণা দেখাতে লাগলো। তারা বলতে লাগলো, আশ্চর্য বিষয় এটি! আগে কখনো দেখিনি! কিন্তু চিন্তা করার কারণ নেই—এটা নাৎসিবাদ, শীঘ্রই শেষ হয়ে যাবে! তারা নির্বাক নিষ্ক্রিয় বসে থাকে, তবে মনে মনে ইতিবাচক আশা পুষতে থাকে । নিজেদের কাছ থেকে এই সত্যটি লুকিয়ে রাখে যে, এটা ছিল বর্বরতা, চরম বর্বরতা, বৃহৎ এক বর্বরতা যেটি প্রতিদিন ঘটে যাওয়া সকল ধরনের বর্বরতাকে হার মানায়, নিজের ভেতরে ধারণ করে ফেলে, গিলে খায়। হ্যাঁ, এটা ছিল নাৎসিবাদ, নাৎসিবাদের লুকানো সত্যতা। নিজেরা এই নাৎসিবাদের শিকার হওয়ার আগে তারা ছিল এর দোসর, সহযোগী। যতদিন পর্যন্ত এই নাৎসিবাদ তাদের উপরে প্রয়োগ করা হয়নি, প্রয়োগ করা হয়েছে কেবল অইউরোপীয়দের উপরে,ততদিন পর্যন্ত তারা এটাকে মেনে নিয়েছে, সমর্থন দিয়েছে, দেখে ও না দেখার ভাণ করেছে, আইনতঃ বৈধতা দিয়ে আসছে। কাজেই তারাই নাৎসিবাদের জন্মদাতা, লালনকারী এবং এটার জন্য একমাত্র দায়ী । কিন্তু এই নাৎসিবাদ সমস্ত পশ্চিমা খ্রিস্টান জগতকে চরম রক্তক্ষয়ী আঘাত না দেয়া পর্যন্ত, তাদের কাছে এটা ছিল কেবল একটি ফাটল যা দিয়ে ধীরে ধীরে উপচে পড়তে পারে সামান্য কিছু (পানি/পুঁজ)।
অবশ্যই হিটলার এবং হিটলারবাদিতাকে সবিস্তারে তলিয়ে দেখাটা খুব জরুরি। তাহলেই বেরিয়ে আসবে বিংশ শতাব্দীর (অ)মানবিক (অ)সুন্দর খ্রিস্টান এক বুর্জোয়া চেহারা। যদিও সে মানতে নারাজ যে, তার ভেতরেই বাস করে এক হিটলার, সে নিজেই হচ্ছে হিটলারের আধার, হিটলার হচ্ছে তার নিজস্ব শয়তান। তলিয়ে দেখলে সামনে আসে, এই বুর্জোয়া চেহারা যখন হিটলারের বিরুদ্ধে কথা বলে, তখনই সে নিজের সামনে হয়ে পড়ে নড়বড়ে। হিটলারকে সে মন থেকে ক্ষমা করতে পারে না তার মূল কারণ কেবল হিটলারের অপরাধ (হত্যা) নয়, বরং কারণ হচ্ছে গণহত্যা, মানবজাতির বিরুদ্ধে কৃত অপরাধ। এটা জঘন্য অপরাধ কেবলই মানব জাতির অপমান করার জন্যও নয়; আরো বেশি জঘন্য হয়েছে সাদা মানুষের বিরুদ্ধে করা অপরাধ হওয়ার জন্য; সাদা মানুষকে অপমানের জন্য, এবং সবচেয়ে বড় সত্য হচ্ছে, হিটলার ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক নির্যাতন-পদ্ধতিগুলো ইউরোপে সাদা মানুষের উপর প্রয়োগ করেছে — যা ছিল অভূতপূর্ব। কারণ তখন পর্যন্ত এই নির্যাতন-পদ্ধতিগুলো আলজেরিয়ার আরব, ভারতের কুলি-সম্প্রদায়, এবং আফ্রিকার কালোদের জন্যই নির্ধারিত ছিল।
এটাই হচ্ছে এই ছদ্মবেশী মানবতাবাদের বিরুদ্ধে আমার এক দবড় অভিযোগ। এটা (ছদ্মবেশী মানবতাবাদ) মানুষের অধিকারকে পদদলিত করেছে ইতিহাসের দীর্ঘ সময় ধরে। আজ অবধি তার দেয়া মানবাধিকারের ধারণাগুলো সংকীর্ণ, মাজাভাঙা, অসম্পূর্ণ, পক্ষপাতদুষ্ট এবং সর্বোপরি নোংরা বর্ণবিদ্বেষী।
আমি হিটলার সম্পর্কে অনেক কিছু বলেছি। এটা দরকার ছিল। হিটলারের কারণেই বিষয়টিকে ব্যাপক পরিসরে দেখা সম্ভব হয়েছে। আমরা বুঝতে পেরেছি যে, এই সময়ে এসে পুঁজিবাদি সমাজ সার্বজনীন কোন অধিকারের ধারণা দিতে ব্যর্থ হয়েছে যেমন সে ব্যর্থ হয়েছে ব্যক্তিগত নীতিশিক্ষার কোন পদ্ধতি দাঁড় করতে। কেউ পছন্দ করুক বা না-ই করুক, অন্ধদের লীলাভূমি ইউরোপের (ইউরোপ বলতে আমি আদিন্যু, শ্যুমান, বিদাউসহ কয়েকজনের আবাসভূমি বুঝিয়েছি) শেষ সীমানায় দাঁড়িয়ে আছে কোন এক হিটলার। যে পুঁজিবাদ নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে চায়, নিজের সময়কে মাড়িয়ে উঠতে চায়, তার শেষ সীমানায় দাঁড়িয়ে আছে এক হিটলার। এই পোশাকী মানবতাবাদ এবং দার্শনিক আত্মত্যাগের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকে সেই হিটলার।
কোন জাতিই নির্দোষভাবে, নিষ্পাপ পথে উপনিবেশায়ন করে না, কোন জাতিই শাস্তিমুক্ত অবস্থায় কাউকে উপনিবেশিত করে না, যে জাতি উপনিবেশায়ন করে আর যে সভ্যতা উপনিবেশায়নকে, এই বলপ্রয়োগকে বৈধতা দান করে, সেই সভ্যতা অবশ্যই বিকারগ্রস্ত।
এ পর্যায়ে এসে আমি একজনের একটি মন্তব্য উল্লেখ না করে পারছি না। সেটি হলো, “সাম্য নয় বরং আমরা আধিপত্য চাই। বিদেশি চামড়ার একটি দেশকে অবশ্যই আবার হতে হবে ভূমিদাস, কৃষিশ্রমিক কিংবা শিল্প-শ্রমিকের দেশ। মানুষের মাঝে অসমতা দূরীকরণের প্রশ্ন এটি নয়। আসলে এটি করতে হবে অসমতা বাড়ানোর জন্য এবং বাড়ন্ত অসমতাকেই আইনে পরিণত করার জন্য।‘‘ এই বক্তব্য একটি সুস্পষ্ট নির্মম হঠকারিতার পরিচয় দেয়। আমাদেরকে সরাসরি নামিয়ে দেয় এক ভয়াল বর্বরতার অন্ধকার কূপে। চলুন আরেকটু নেমে দেখি। এই কথাগুলি কে বলছে? আমার বলতেই লজ্জা লাগছে যে, এই বক্তব্যের বক্তা আর কেউ নন, রেনান। এটা কি কাকতালীয়!? রেনান হচ্ছেন একজন খ্যাতনামা পশ্চিমা মানববাদী, একজন ভাববাদী দার্শনিক । বক্তব্যটি তার রচিত La Reforme Intellectualle et Morale ( বুদ্ধিবৃত্তিক এবং নৈতিক স্বাধীনতা ) নামক বই থেকে নেয়া হয়েছে। বইটি যুদ্ধপরবর্তী ফ্রান্সে লেখা হয়, যে যুদ্ধে ফ্রান্স আবার পেশীশক্তির বিরুদ্ধে ন্যায়-যুদ্ধকে প্রতিনিধিত্ব করেছে। কাজেই বইটি বুর্জোয়া’র (শ্রেণি ও মতাদর্শ) নৈতিক জগত সম্পর্কে আমাদেরকে অনেক কিছুই জানিয়ে দেয়।
এই নিচু জাতি বা অপজাতিকে পুনর্গঠন করাই হচ্ছে উন্নত জাতির ধর্ম। মানবজাতির জন্য স্বর্গীয় নীতিমালা এটি। আমাদের সাথে থাকলে নিতান্ত সাধারণ মানুষ হয়ে ওঠে একজন প্রায় অভিজাত মানুষ, তার শক্ত হাত তরবারির জন্য উপযুক্ত হয়ে যায়, করে না আর কোন তুচ্ছ কাজ। কাজ করা থেকে যুদ্ধ করাকেই সে অধিক পছন্দ করে । এভাবেই সে ফিরিয়ে যায় তার প্রথম (উন্নত) অবস্থানে। Regere imperio populos মানে হচ্ছে যাবতীয় শক্তি দিয়ে জাতি শাসন করাই আমাদের পেশা। তাই নিজের সমস্ত শক্তি ঢেলে দিয়ে চীনের মত দেশগুলি দখল করে নাও, কারণ বিদেশী শাসনের জন্য তারা ছটফট করছে, চিৎকার করে কান্না করছে। দুঃসাহসী জলদস্যু যারা ইউরোপীয় সমাজকে বিরক্ত করে তাদেরকে ধর্মযোদ্ধার মন্ত্র দিয়ে বাইরে ছেড়ে দেয়া উচিত। ফ্রাঙ্কস, লোম্বারড, কিংবা নরমান জাতির মত। তখন এই মানুষগুলি তার যথার্থ কাজ পেয়ে যাবে। চীনা সম্প্রদায়কে প্রকৃতিই একটি শ্রমিক সম্প্রদায় হিসেবে তৈরি করেছে। তাদের হাতে আছে অসামান্য শ্রম-দক্ষতা কিন্তু ভেতরে আত্ম-সম্মানবোধ বলতে কিছু নেই। তাদেরকে ন্যায়সংগতভাবে শাসন করতেই হবে, প্রচুর খাজনা আদায় করতে হবে। এই রকম একটি উন্নত সরকার ব্যবস্থা এবং বিজেতা সম্প্রদায়ের সংস্পর্শ পাওয়ার কারণেই তারা হয়ে উঠবে অতি পরিতৃপ্ত। নিগ্রোরা কাদামাটি গায়ে চাষা-ভূষা এক সম্প্রদায়। তাদেরকে দয়া-করুণা-মানবতা দিয়ে শাসন করো। তাহলে প্রতিষ্ঠিত হবে একটি ইউরোপীয় জাতি, একটি শাসক ও সৈন্যের জাতি, এবং তাই হওয়া উচিত। যদি তুমি এখানের উন্নত সম্প্রদায়কে চীনা কিংবা নিগ্রোদের মত কঠিন শাস্তি দিয়ে শ্রমিক বানাতে চাও তাহলে হিতে বিপরীত হবে, তারা বিদ্রোহ করে বসবে। ইউরোপের প্রত্যেক বিদ্রোহী কম-বেশি একেকজন সৈন্য, যে মহান কাজ করতে চায় কিন্তু সেই সুযোগ সে পায় নি। তাই একজন সৈন্য হিসেবে কায়িক-শ্রমের কাজ তার স্বভাবের পরিপন্থি। চীনা শ্রমিক যে জীবন পেলে মহাখুশি, সেই কাজ করতে গেলে আমাদের লোকেরা বিদ্রোহ করে। কারণ চীনারা কোনভাবেই সৈনিক জাতি নয়। কাজেই যে কাজের জন্য যে মানুষ উপযুক্ত, তার তাই করা উচিত, তাহলে সবার ভালো হবে।
এই কথাগুলি কে বলেছে? হিটলার? রোজেনবার্গ? না। কথাগুলি রেনানের।
চলুন, আরেকটু দেখা যাক। ইনি হচ্ছেন একঘেঁয়ে রাজনীতিবিদ। কে তার প্রতিবাদ করবে? কেউ পারবে না।
আমি যতটুকু জানি যখন ইন্দোচীনার সাবেক গভর্নর জেনারেল এম. আলবার্ট সারাউত একোলি কলোনিয়ালে (একটি পাবলিক স্কুল) দাঁড়িয়ে ছাত্রদের সামনে কথা বলেন, তখন তিনি তাদেরকে এই শিক্ষা দেন যে, ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক প্রকল্পকে বাধা দেয়া এক চরম বোকামি। নিজের দখলে থাকা ভূমির অধিকার কিংবা অন্য কোন অধিকারের বলে তীব্র বিচ্ছিন্ন থাকলে সে এলাকার প্রাকৃতিক সম্পদ আজীবন অব্যবহৃত থাকবে, অচলাবস্থায় পড়ে থাকবে কিছু অযোগ্য লোকের হাতে।
এবং কে প্রতিবাদে ফুঁসে উঠবে যখন মান্যবর বার্ড আমাদেরকে আশ্বস্ত করে বলেন, পৃথিবীর সম্পদ যদি এভাবেই অব্যবহৃত বিভক্ত পড়ে থাকে অনাদিকাল তাহলে এতে মহান প্রভুর মহাপরিকল্পনা কিংবা সামগ্রিক মানুষের ন্যায্য দাবিদাওয়া কিছুই বাস্তবায়িত হবে না। আর উপনিবেশায়ন ছাড়া এই অবস্থার কোন পরিবর্তন সম্ভব নয়।
তারই (বার্ড’র) আরেকজন বন্ধুবর সম্মানিত মুলার ঘোষণা করেন, “মানবসমাজ অসভ্য জাতিদের অযোগ্যতা, অবহেলা কিংবা অলসতাকে কখনো মেনে নেবে না, নিতে পারে না কারণ তারা মহান প্রভুর দেয়া সম্পদকে অলস ফেলে রেখেছে আজীবন ধরে, তারা এই সম্পদকে সবার জন্য ব্যবহার করছে না।”
কেউ প্রতিবাদ করেনি। কেউ না। বিখ্যাত লেখক, পণ্ডিত, প্রচারক, ন্যায়যোদ্ধা বা ধর্মযোদ্ধা কিংবা ব্যক্তি স্বাধীনতার রক্ষক, কেউ কিছুই বলে নি।
তাই সারাউত, বার্ড, মুলার কিংবা রেনানদের মুখে শুনবেন এটার (উপনিবেশায়ন) বৈধতার কথা। এরকম আরো অনেকেই আছেন যারা মনে করেছিলেন কিংবা এখনো মনে করেন, জনগণের কল্যাণের খাতিরে অইউরোপীয়দের নিকট থেকে সম্পদ ছিনিয়ে নেয়াটা বৈধ। এতে উন্নত সভ্য এবং সমৃদ্ধশালী জাতি অনেক উপকার পাবে। তখনই আসলে তাদের মুখ দিয়ে হিটলার কথা বলছিল!
এখন আমার বক্তব্য কী? আমার বক্তব্য হচ্ছে, কোন জাতিই নির্দোষভাবে, নিষ্পাপ পথে উপনিবেশায়ন করে না, কোন জাতিই শাস্তিমুক্ত অবস্থায় কাউকে উপনিবেশিত করে না, যে জাতি উপনিবেশায়ন করে আর যে সভ্যতা উপনিবেশায়নকে, এই বলপ্রয়োগকে বৈধতা দান করে, সেই সভ্যতা অবশ্যই বিকারগ্রস্ত। যে সভ্যতা নৈতিকতায় অসুস্থ, যে বেপরোয়াভাবে একের পর এক কুফল বয়ে আনে, অপলাপের পর অপলাপ চালিয়ে যেতে থাকে, সে আসলে তার নিজের জন্য একজন ‘হিটলার’ ডেকে আনে। আমার কাছে, এই হিটলারই হচ্ছে তার শাস্তি।
উপনিবেশায়নকে বলা হচ্ছে বর্বরতাকে সভ্য করার অভিযানের সুরক্ষিত দুর্গ। কারণ এই বর্বরতা থেকে যেকোন সময় জন্ম নিতে পারে সভ্যতার চূড়ান্ত বিনাশ। আমি ইতোঃপূর্বে ঔপনিবেশিক অভিযানের ইতিহাস থেকে কিছু ঘটনা তুলে এনেছি সবিস্তারে। দুর্ভাগ্যবশত সবাই এটাকে ইতিবাচকভঙ্গিতে গ্রহণ করে নি। মনে হয় যেন এক অন্ধকার ঘর থেকে আমি টেনে তুলছি বহুদিনের পুরাতন কঙ্কাল। আলজেরিয়ার একজন বিজেতা কর্নেল দি মটেইনাকের একটি বক্তব্য তুলে ধরা এখানে যুক্তিযুক্ত। সে বলেছিল, “আমার ভেতরে জমে থাকা কিছু চিন্তা মাঝে মাঝে আমাকে ঘিরে ধরে, এই চিন্তাধারাকে চিরতরে তাড়ানোর জন্য আমি কয়েকেটি মাথা কেটে ফেলে দেই, আর্টিচোক (এক প্রকার সবজি ) গাছের মাথা নয়, মানুষের মাথা।’’ এখন কাউন্ট দি হ্যারিসনের কথা একটু শুনি, তিনি বলেছেন, “এটা সত্যি কথা। আমরা বন্দীদের জোড়ায় জোড়ায় কান কেটে আনি এবং স্তূপাকারে জমিয়ে রাখি হোক তারা বন্ধুবর কিংবা শত্রুসম।’’ আমি কি এই জায়গায় সেইন্ট আমুদের বর্বরোচিত বিশ্বাসভরা বক্তব্য ভুলতে পারি? তিনি বলেছিলেন, “আমরা ধ্বংস-যজ্ঞ চালাই, আমরা বাড়িঘর, গাছপালা পুড়িয়ে দেই, লুটপাট করি এবং ধ্বংস করে দেই।’’ আমি কি মার্শাল বুগিয়াদকে তার নগ্ন তত্ত্ব এবং পূর্বসূরিদের অনুসরণ করে একটি পদ্ধতি দাঁড় করানো থেকে বিরত রাখতে পারি? তিনি বলেন, “আমাদেরকে অবশ্যই ফ্রাঙ্ক এবং গোথদের মত আফ্রিকাতে একটি বিশাল আক্রমণ চালাতে হবে।’’ পরিশেষে আমি কি জেনারেল গেরার্ডের মহান কর্মটি ভুলে যাবো? এম্বিকে শহরের বন্দী ও ধ্বংসের কথা ভুলে গিয়ে নীরব থাকবো? সত্যি বলতে কি, এই শহরটি জীবনে স্বপ্নেও দেখেনি যে একদিন তাকে দাঁড়াতে হবে আত্মরক্ষার মুখোমুখি। জেনারেল বলেন, “বন্দুকধারীদের বলা হয়েছিল কেবল পুরুষদের হত্যা করতে কিন্তু তারা কেউ নিজেদেরকে থামাতে পারে নি বরং রক্তের গন্ধের নেশায় পড়ে তারা সকল নারী ও শিশুকে হত্যা করেছে, কাউকে ছাড় দেয় নি। শেষ বিকেলের আলোয় হালকা কুয়াশার মত ভাসছিল, এটা ছিল পাঁচহাজার মানুষের বুকের তাজা রক্ত, শহরের আত্মাগুলো যেন বাষ্পের মত হাওয়া গেল সেই পড়ন্ত বিকেলের আলোয়।”
এই কথা, এই কাজগুলি কি সত্য না মিথ্যা? যখন সে দূর থেকে আনামীদের রক্তপাত দেখে, তার পাশবিক শরীরে দেখা দেয় এক ধর্ষকামী উল্লাস, এক নামহীন আনন্দ, যা তাকে কাঁপুনি দেয় সজোরে। এগুলো সত্য নাকি মিথ্যা? কেউ যেহেতু অস্বীকার করতে পারে না। তাই এগুলো সত্য। যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে কেবল পাশবিকতার মাত্রা কমানোর জন্যই, অনেকেই বলে থাকে যে, লাশেরা কিছুই প্রমাণ করে না। আমি বলতে চাই, এই যে আমি কয়েকটি ভয়ানক কসাইগিরির কথা তুলে ধরলাম এ থেকে আমি কোন ধরনের অসুস্থ আনন্দ নিতে চাই না। বরং আমি মনে করি, এই বিচ্ছিন্ন মাথা, কাটা কানের স্তূপ, পোড়া বাড়িঘর, হিংস্র আক্রমণ, তাজা রক্তের ধারা, তরবারির আঘাতে বাষ্পের মত মিলিয়ে শহরের গল্প—এগুলো কখনো মুছে ফেলা যাবে না। তাই আমি আবারো বলছি, এগুলো প্রমাণ করে দেয় যে, উপনিবেশায়ন সবচেয়ে সভ্য দাবিদার জাতিকে অমানুষ বানিয়ে ফেলে। প্রমাণ করে যে, ঔপনিবেশিক কর্মকাণ্ড, অভিযান ও বিজয়—যা স্থানীয়দের প্রতি প্রবল ঘৃণার উপর নির্মিত এবং স্থাপিত—চূড়ান্ত বিচারে উপনিবেশকেই ক্ষতি করে ব্যাপক। কারণ এই কুকর্মে নিজের বিবেকের সায় নিতে গিয়ে সে স্থানীয়দেরকে পশু ভাবা শুরু করে, এবং তাদের সাথে সেভাবে আচরণ করে বলেই এক সময় সে নিজেই নেমে যায় পশুর কাতারে। হয়ে যায় মস্ত বড় এক জানোয়ার। এটাই হচ্ছে উপনিবেশায়নের কুফল, যেটি একটি আত্মঘাতী অস্ত্র। এটাই আমি দেখাতে চাচ্ছি।
অবিচার মনে হচ্ছে? আসলে তা না। কারণ সেই সময় এগুলো ছিল অহংকারের বিষয়, গর্বের কারণ। তাই তারা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা না বলে সোজাসাপটা বলে ফেলতো। আমি এখন শেষবারের মত আরো একটি উদ্ধৃতি দিবো। এটা কার্ল সিগের থেকে। তিনি লিখেছিলেন Essai sur la Colonisation (Essays on the colonization, Paris, 1907) মানে হচ্ছে উপনিবেশায়ন বিষয়ে প্রবন্ধ। তিনি বলেন, “এই নতুন দেশগুলি (উপনিবেশিত দেশ) অনেক বিচ্ছিন্ন বিধ্বংসী কাজের সুযোগ করে দেয়, যেগুলি আবার নাগরিক সভ্যতার দেশগুলিতে করা যাবে না, কারণ এগুলি কিছু সামাজিক রীতিনীতির পরিপন্থি, উন্নত এবং পরিপাটি জীবন-ধারণার ঘোর বিরোধী। উপনিবেশিত দেশে এ কাজগুলি এগিয়ে নেয়ার বেশি স্বাধীনতা পাওয়া যায়, যা দিয়ে ওই দেশগুলির নিজের মূল্য নির্ধারিত হয়ে থাকে। তাই বলতে গেলে অনেকাংশ ক্ষেত্রেই এই উপনিবেশিত দেশগুলি আধুনিক সমাজের (ইউরোপের) জন্য কলুর বলদ হিসেবে কাজ করে। কলুর বলদ হওয়াই যদি তাদের একমাত্র মূল্য হয়ে থাকে, এটাই তাদের জন্য বড় পাওনা।’’ বাস্তবিকই এগুলো হচ্ছে এমন পাপ যেগুলো কেউ কখনো মাফ করতে পারবে না, কারো এই ক্ষমতা নেই। কেউ কোনদিন এগুলোর কাফফারা আদায় করা যাবে না।
চলুন এবার একটু উপনিবেশিতদের নিয়ে কথা বলি। উপনিবেশায়ন যে কি ক্ষতি করেছে আমি নিজের চোখেই পরিষ্কারভাবে দেখতে পারি। অসম্ভব সুন্দর ইন্ডিয়ান (আমেরিকান) সভ্যতাগুলি ধ্বংস করেছে। এজটেক কিংবা ইনকা সভ্যতাকে ধ্বংস কাহিনি কেউ আমাকে ভুলিয়ে রাখতে পারবে না। ডেটারডিং, রয়াল ডাচ কোম্পানি বা পরিশোধিত তেলের কাহিনি, কোন কিছুর বিনিময়ে এটা সম্ভব নয়।
আমি খুব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, এই সভ্যতাগুলি সাউথ সী আইল্যান্ড, নাইজেরিয়া, নায়াসাল্যাণ্ডে নিকট ভবিষ্যতে নিজেদের ধ্বংসনীতির কারণেই মুখ থুবড়ে পড়ছে। এই অধঃপতনে উপনিবেশিতদের অবদান অনেক কম বলে আমি মনে করি।
নিরাপত্তা? উন্নত সংস্কৃতি? সুশাসন? (এগুলো কোথায়)? যেখানেই উপনিবেশক আর উপনিবেশিতদের মুখোমুখি হতে দেখি, সেখানেই আমি খুঁজে পাই পেশীশক্তি প্রয়োগ, বর্বরতা, নিষ্ঠুরতা,পৈশাচিক নির্যাতন, যুদ্ধ, শিক্ষার নামে উপহাস এবং দ্রুত এক শ্রেণির দক্ষ গোলাম তৈরির কারখানা—যা থেকে উৎপন্ন হবে চাকর, কেরানি, মিস্ত্রি আর অনুবাদক— যাতে করে সফলভাবে এই সভ্যতার ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া যায়।
আমি এই দুপক্ষের (উপনিবেশক আর উপনিবেশিত) যোগাযোগের কথা বলছি। উপনিবেশক আর উপনিবেশিতের মাঝে কেবলই জোরপূর্বক শ্রম, ভীতিপ্রদর্শন, বল-প্রয়োগ, পুলিশগিরি, কর-আরোপ, চুরি, ধর্ষণ, বাধ্যতামূলক কৃষিকাজ, ঘৃণা, অবিশ্বাস, হঠকারিতা, আত্মতৃপ্তি, পাশবিকতা, মগজবিহীন অভিজাত শ্রেণি এবং অধঃপতিত জনতা থাকতে পারে না। এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। কোন মানবিক যোগাযোগ সম্ভবপর নয়। হতে পারে আধিপত্যবাদ ও বশ্যতার সম্পর্ক, যে সম্পর্কের দরুণ উপনিবেশক হয়ে যায় শ্রেণিকক্ষের সর্দার, আর্মি সার্জেন্ট, কারারক্ষী, দাসচালক, আর এদিকে উপনিবেশিত মানুষেরা হয়ে যায় কেবলই উৎপাদন যন্ত্র। তাই আমি এখন একটি সমীকরণ দাঁড় করছি, উপনিবেশায়ন=বস্তুকরণ বা যন্ত্রকরণ।
আমাদের প্রতিটি দিন, প্রতিটি ন্যায়-প্রত্যাখ্যান, পুলিশের প্রতিদিনের নির্যাতন, শ্রমিকের প্রতিটি রক্তমাখা ন্যায্য দাবী, প্রতিটি চাপা ঘটনা, প্রতিটি শাস্তি-অভিযান, পুলিশের প্রতিটি গাড়ি, প্রত্যেক সৈনিক এবং প্রতিটি খাকি পোশাক আমাদেরকে আমাদের অতীত সমাজের গুরুত্ব মনে করিয়ে দেয়।
আমি আমার আশেপাশে অনেক কথাবার্তা শুনে থাকি। তারা প্রগতি, বড় বড় অর্জন, রোগনিরাময়, এমনকি জীবনযাত্রার উন্নতির কথা বলে থাকেন। কিন্তু আমি বলছি সে সমাজের কথা, যাদের অস্তিত্ববোধ কেড়ে নেয়া হয়েছে, সংস্কৃতিকে পায়ের নিচে ফেলে দেয়া হয়েছে, সকল প্রতিষ্ঠানকে ভেঙে ফেলা হয়েছে, জমি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, ধর্মকে গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, অসাধারণ শিল্পকর্মগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছে এবং সকল ধরনের অনন্য সম্ভাবনাকে সমূলে উপড়ে ফেলা হয়েছে। অথচ তারা (ইউরোপীয়)আমার সামনে সংখ্যার সারি বসায়, বাস্তব ঘটনা, লম্বা লম্বা সড়ক, খাল-খনন কিংবা রেললাইন স্থাপনের গল্প ছুঁড়ে মারে। কিন্তু আমি সেই হাজার হাজার মানুষের যারা কঙ্গো সাগরে শহিদ হয়েছে, আমি তাদের কথা বলছি যারা এখনো এই সময়ে নিজ হাতে আবিদজানে সমুদ্রবন্দর করছে, আমি লক্ষ লক্ষ মানুষের কথা বলছি যাদেরকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে তাদের খোদা/দেবতা, তাদের জমি, আচার-আচরণ, তাদের জীবনবোধ, তাদের নাচগান আর তাদের নিজস্ব প্রজ্ঞা থেকে। আমি সেই লক্ষ লক্ষ মানুষের কথা বলছি যাদের ভেতরে অতি সুকৌশলে ভয় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে, তাদেরকে হীনম্মন্যতা শেখানো হয়েছে যাতে করে তারা ভয়ে কাঁপতে থাকে, হাঁটু মাটিতে ফেলে কথা বলে, চরম হতাশায় থাকে এবং তাই হীন চাটুকারের মত আচরণ করতে থাকে। অথচ তারা (ইউরোপীয়) আমাকে তুলা, নারিকেল রপ্তানির গল্পে মুগ্ধ করতে চায় কিংবা একরের পর একর জলপাই বা আঙুর চাষের কাহিনি বলতে চায়। কিন্তু আমি বলছি প্রাকৃতিক অর্থনীতির কথা, যা ভেঙে চুরমার করে ফেলা হয়েছে, যা ছিল স্থানীয় মানুষের কাছে আপন, জীবনঘনিষ্ঠ এবং উপযোগী। কথা বলছি কীভাবে ফসল ধ্বংস করা হলো, কীভাবে অপুষ্টিকে স্থায়ীভাবে আমদানি করা হলো, কীভাবে কৃষিভিত্তিক উন্নতিকে হাতেগোনা কিছু দেশের মুনাফার জন্য নির্ধারণ করে ফেলা হলো, কীভাবে পণ্য-ডাকাতি করা হলো এবং কীভাবে কাঁচামাল লুটে নেয়া হলো।
তারা (ইউরোপীয়/স্বদেশী শাসক শ্রেণি) খুব গর্ব করে আমাকে বলে যে, যাবতীয় অপব্যবহার শেষ হয়েছে গেছে। আমিও এই অপব্যবহার নিয়ে কথা বলি। কিন্তু আমি বলছি, পুরাতন আসল অপব্যবহারের উপর নূতন এক ধরনের ঘৃণ্য অপব্যবহারকে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। তারা আমাকে বলে যে, স্থানীয় স্বেচ্ছাচারী শাসকদেরকে যুক্তির ভেতরে আনা হয়েছে, কিন্তু আমি দেখি জনগণের ক্ষতি করতে, পুরাতন আর নতুন স্বেচ্ছাচারী শাসকদের মাঝে ভেতরে রয়েছে এক শক্ত আঁতাত, পরস্পর সেবা ও দুর্নীতিতে একটি শক্ত সম্পর্ক।
তারা আমার কাছে সভ্যতায়ন এর কথা বলে। আমি বলি এটা হচ্ছে শ্রমিকীকরণ এবং অতি রহস্যকরণ।
আমি অইউরোপীয় সভ্যতাগুলির পক্ষে একটি নিয়মতান্ত্রিক অবস্থান নিয়েছি।
আমাদের প্রতিটি দিন, প্রতিটি ন্যায়-প্রত্যাখ্যান, পুলিশের প্রতিদিনের নির্যাতন, শ্রমিকের প্রতিটি রক্তমাখা ন্যায্য দাবী, প্রতিটি চাপা ঘটনা, প্রতিটি শাস্তি-অভিযান, পুলিশের প্রতিটি গাড়ি, প্রত্যেক সৈনিক এবং প্রতিটি খাকি পোশাক আমাদেরকে আমাদের অতীত সমাজের গুরুত্ব মনে করিয়ে দেয়।
তারা ছিল সম্প্রদায়-চালিত সমাজ, কিন্তু এমন সমাজ নয় যেখানে অধিকাংশ কাজ করবে অল্প লোকের মুনাফার জন্য। তাদের সমাজ কেবলই প্রাক-পুঁজিবাদী ছিল তা না, বরং ছিল পুঁজিবাদী বিরোধীও। তাদের সমাজ ছিল সবসময় গণতান্ত্রিক। ছিল সহযোগিতামূলক, ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা। তাই আমি সেই সমাজের পক্ষে একটি নিয়মতান্ত্রিক অবস্থান নিয়েছি, যাকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দিয়েছে সাম্রাজ্যবাদ।
তারা রক্ত-মাংসে বাস্তব ছিল, ছিলনা কোন কল্পনা বা ধারণার নাম। তারা এই চেষ্টাও করে নি কখনো। তাদের ভুলত্রুটি ছিল তবুও তাদেরকে ঘৃণা কিংবা অবহেলা করা যায় না। তারা নিজেদের নিয়েই সন্তুষ্ট ছিল। ‘বিফলতা’ কিংবা ‘অবতার’ শব্দের কোন মানেই ছিল না তাদের কাছে। আশাবাদকে তারা সবসময় ধারণ করে রাখতো।
কিন্তু ওই শব্দগুলি (‘বিফলতা’ কিংবা ‘অবতার’) ইউরোপীয়দের জন্য প্রযোজ্য, ইউরোপের বাইরে তাদের কাজকর্ম বুঝানোর জন্য উপযুক্ত শব্দ। আমার এখানে আশার কথা হচ্ছে উপনিবেশায়নের যুগ শেষ হয়েছে, জাতি আজীবন ঘুমিয়ে থাকতে পারে না এবং এত কিছুর পরে সাধারণ মানুষ আজও বেঁচে আছে।
এই কথাগুলি বলে ফেলার পর কিছু মহলের কাছে মনে হচ্ছে আমি ইউরোপের দুশমন এবং প্রাক-ইউরোপ সময়ের দিকে ডেকে ফেরা কোনো এক পয়গম্বর। কিন্তু আমি খুঁজে পাই না, এমন কথা আমি কোথায় বলেছি, কোথায় আমি মানব-চিন্তার ইতিহাসে ইউরোপের গুরুত্বকে অবহেলা করেছি, কোথায় আমি ফিরে যাওয়ার ডাক দিয়েছি এবং কোথায় আমি একরকম প্রত্যাবর্তন দাবী করেছি।
সত্য হচ্ছে, আমি সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বলেছি। মানে, আফ্রিকার সবচেয়ে বড় ঐতিহাসিক দুঃখ এটা নয় যে, সে বাইরের জগতের সাথে অনেক পরে সম্পর্ক স্থাপন করেছে , বরং তার দুঃখের কারণ হচ্ছে যেভাবে এই সম্পর্কটি হয়েছে। দুঃখের কারণ হচ্ছে ইউরোপ প্রচারে তখনই নেমেছিল যখন ইউরোপের মশাল ছিল কিছু অসৎ, মুনাফালোভী ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের হাতে। এটাই ছিল আমাদের মন্দ ভাগ্য যে, আমাদের সাথে ঐ অধঃমুখী ইউরোপের দেখা হয়েছিল ইতিহাসের বাঁকে, যে ইউরোপ সবচেয়ে বেশি লাশের পাহাড় তৈরির জন্য মানব জাতির চোখে ছিল এক মহাঅপরাধী।
উপনিবেশায়ন সম্পর্কে আরেকটি কথা আমি বলেছি যে, স্থানীয় জমিদারদেরকে সহায়তা করেছে ইউরোপ, তাদের সাথে মিলে একটি অপরাধচক্র গড়ে তুলেছে যার মাধ্যমে স্বেচ্ছাচারিতা আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আর ওই কারণেই স্থানীয় জমিদারী প্রথা আরো দীর্ঘ হয়। আমি বলেছি যে, উপনিবেশায়ন পুরাতন অবিচারের সাথে আধুনিক অপব্যবহারকে জুড়ে দিয়েছে, অতীতের বৈষম্যের সাথে যোগ করেছে অতি ঘৃণ্য বর্ণবাদ।
যদি আমার লেখার কারণ বিবেচনায় আমাকে সমালোচনা করা হয়, আমার কথা হচ্ছে উপনিবেশক ইউরোপ মিথ্যুক এবং অসৎ কারণ দৃশ্যমান উন্নয়নের কথা বলে তারা উপনিবেশায়নের কাজকে হালাল করতে চায়। ঔপনিবেশিক সময়ে কিছু বিষয়ে উন্নয়ন দেখা গিয়েছিল যেটা আবার অন্য দেশেও হয়েছিল। আর কেউ বলতে পারে না ইউরোপের দ্বারা উপনিবেশায়ন না হলে উপনিবেশিত দেশগুলো কতটুকু উন্নয়ন করতে পারতো! এশিয়া ও আফ্রিকায় ইউরোপ যে প্রযুক্তি চালু করেছে বা প্রশাসনিক নতুন বিন্ন্যাস করেছে, যাকে এক কথায় বলা যায়, ইউরোপায়ন/ ইউরোপকরণ, এর জন্য ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক দখলবাজির তেমন প্রয়োজন ছিল না। (জাপান হচ্ছে তার জ্বলন্ত প্রমাণ) । কারণ অইউরোপ মহাদেশকে ইউরোপায়ন অন্য ভাবেও করা যেত, এতে সবাইকে ইউরোপের পায়ের নিচে ফেলার দরকার ছিল না কারণ ইউরোপায়নের এই কাজটা তখন চলছিল পুরোদমে। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক দখলবাজির কারণে এই কাজটি বরং থেমে যায় এবং পথভ্রষ্ট হয়।
এর প্রমাণ হচ্ছে বর্তমানে স্থানীয় আফ্রিকা এবং এশিয়ার মানুষ অনেক বিদ্যালয় দাবী করছে এবং উপনিবেশক ইউরোপ তা প্রত্যাখ্যান করছে। আফ্রিকার মানুষ বন্দর চাচ্ছে, সড়ক চাচ্ছে কিন্তু উপনিবেশক ইউরোপ এই ব্যাপারে বড়ই নারাজ, অনিচ্ছুক। যার মানে দাঁড়ায় উপনিবেশিতরা সামনে এগিয়ে যেতে চাচ্ছে কিন্তু যারা উপনিবেশকারী তারা এখন বাধা দিচ্ছে।
পড়ুন ।। প্রথম কিস্তি