হিমেল বরকত কবিতা পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি মোস্তফা হামেদীর সাক্ষাৎকার

হিমেল বরকত কবিতা পুরস্কার পেয়েছেন কবি মোস্তফা হামেদী। সহজিয়ার পক্ষ থেকে নেয়া এই সাক্ষাৎকারে তিনি কথা বলেছেন কবিতা, নিজের লেখালেখি ও বাংলাদেশের কবিতা প্রসঙ্গে।

সহজিয়া : কবিতা লেখার প্রতি কীভাবে ও কেন আগ্রহী হয়ে উঠলেন?

মোস্তফা হামেদী : এইটা সম্ভবত একটা প্রাকৃতিক নির্বাচন। আমার চৌদ্দ পুরুষের মধ্যে কবিতা ব্যাপারটা ছিল না। বেশ বৈষয়িক একটা পরিমণ্ডলের মধ্যে কবিতা লেখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাটা আশ্চর্যজনকই। খোদাতালা আমাকে বেশি বিস্মিত হওয়ার, মুগ্ধ হওয়ার আনন্দ দিয়ে জগতে পাঠাইছেন। সেইটা প্রকাশ করার সুবিধা করে দিছে বাংলা ভাষা। দুনিয়ার মহৎ সব কবিরা এই ভাষাটাকে কবিতা লেখার উপযোগী করে গড়ে তুলছেন। আমি সেই আসামান্য পাখির সামান্য একটা পালক মাত্র।  একটা আনপড় সমাজে বাংলা পাঠ্যবই ছাড়া কবিতার মতো জিনিসের দেখা পাওয়া আমার জন্য সহজ ছিল না। ফলে এই সামাজিক দানটুকু স্বীকার না করলেই নয়।

 

সহজিয়া : কবিতা নিয়ে আপনার ভাবনা কী?

মোস্তফা হামেদী :  আমি আসলে দেখি। পড়ি। বিরাজ করি। ভাবি। মুগ্ধ হই। বিস্মিত হই। লিখতে বসি।

 

সহজিয়া : কবিতা সম্পর্কে সাধারণ অভিযোগ হলো : এ সময়ের কবিতা দুর্বোধ্য। কেন এই অভিযোগ তোলা হয়ে থাকে; সাহিত্যের অন্য কোনো রীতি সম্পর্কে এরকম অভিযোগ শোনা যায় না তো… আদতে কোন সময়ের কবিতা সুবোধ্য ছিল?

মোস্তফা হামেদী : এই অভিযোগের একটা কারণ আমি আন্দাজ করি, সেটা হইলো আমাদের স্মৃতি ও যৌথ ইচ্ছা/কল্পনা এবং জনসমাজে ভাষা বিকাশের যে স্তরে আছে তার বাইরে কবিতা লেখা হইছে বেশি। সেটা কেন হইলো? মূলত বিদেশি সাহিত্য পাঠের কারণে। বিদেশি মনকে নিজেদের মন ভাবার কারণে। ফলে পাঠকের সাথে এক ধরনের বিচ্ছেদ তৈয়ার হইছে। সেইটা দুর্বোধ্যতা নামে বাজারে প্রচলিত। আরেক রকমের দুর্বোধ্যতা আছে। কবিতা লেখা ও পড়ার জন্য যে দরকারি প্রস্তুতিটুকু লাগে, সেটা ছাড়াই লোকে যখন কবিতা বিচার করতে বসে, তখন এমন আলপটকা মন্তব্য পাওয়া যায়। সাহিত্যের অন্য রীতি খোলাসা করে। আর কবিতা আড়াল করে। ফলে কসরতটা এখানে একটু বেশিই করতে হয়। তুলনাটা এ কারণে চলে না।

কবিতার সুবোধ্য কাল ছিল বালকের ছড়া পড়ার কাল। কারণ সে ছিল অপার আনন্দের কাল। আনন্দিত হওয়ার মন নিয়ে কবিতা পড়লে কবিতা সহজ বস্তু।

 

সহজিয়া : অনেকে মনে করেন, ভাষা ও শৈলীর নিরীক্ষা করতে গিয়ে দুর্বোধ্যতাকে ইচ্ছে করেই আরোপ করা হয়ে থাকে। সহজতা বা সহজ বোধ্য প্রকাশ কবিতার জন্য ক্ষতিকর কিছু?

মোস্তফা হামেদী : ভাষা ও শৈলীর নিরীক্ষা ছাড়া কবিতা ব্যাপারটাই টিকবে না। আর কবিতা দুর্বোধ্য হয় কবি ও পাঠক দুই তরফেই। কারণটা কমন। সেটা হইতেছে, কবিতা ব্যাপারটা বুঝতে না পারার অক্ষমতা থেকে।

সহজতাও এক ধরনের কাব্যরীতি। একই রীতিতে সকলে লিখলে একঘেঁয়ে হয়ে যাবে। ফলে কবি যে শৈলীতে লিখবেন, সেটা ধরেই আলাপে যাইতে হবে। একজন বিশেষ কবির কাছে সব ধরনের জিনিস প্রত্যাশা করার দরকার কী। জগৎ বিচিত্র। কবিও বিচিত্র। পাঠকের যেখানে পোষায়, সেখানেই যাওয়া উচিৎ।

আমার মনটা ভূ-বাংলার জলহাওয়ায় গড়া, গ্রামপনায় ভরা। তার থেকে বাইর হইতে চাই না আমি। কারণ এই জায়গাটাকে আরও এক্সপ্লোর করার সুযোগ আছে। দুনিয়ার বড় বড় সাহিত্যে স্থানিকতা একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসাবে হাজির আছে।

 

সহজিয়া : আপনার কবিতায় প্রকৃতি খুব নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থাকে। বিশেষ করে গ্রামীণ নিসর্গ। কেন?

মোস্তফা হামেদী : আমি ব্যক্তিগত অনুভূতি ও দেখার জায়গা থেকে কবিতা লিখি। আমার মনটা ভূ-বাংলার জলহাওয়ায় গড়া, গ্রামপনায় ভরা। তার থেকে বাইর হইতে চাই না আমি। কারণ এই জায়গাটাকে আরও এক্সপ্লোর করার সুযোগ আছে। দুনিয়ার বড় বড় সাহিত্যে স্থানিকতা একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসাবে হাজির আছে। আমাদের কবিতার আরোপিত আছরগুলাকে (যেমন: কলকেতাই, ইউরোপীয়, আরও আরও) মোকাবেলা করতে পারি গ্রামীণ মানুষ ও নিসর্গের জিনিসপত্র দিয়া।

তাছাড়া বাইরে কিছু পরিবর্তন আসছে বটে। ভেতরে ভেতরে পুরা বাংলাদেশই একটা ভিজা মফস্বল। সেই বাংলাদেশের কবি হিসাবে আমি চাই আমার কাজে মফস্বল মফস্বল গন্ধ থাক।

 

সহজিয়া : নিজের কবিতাকে সমালোচকের চোখ দিয়ে দেখেন?

মোস্তফা হামেদী : আমার দুই ধরনের এডিটোরিয়াল বোর্ড আছে। একটা অন্তর্গত। আরেকটা ব্যক্তিগত। প্রথমটায় ছাড় পাইলে সেটা প্রকাশ করি। সেটা ফেসবুক, পত্রিকা বা অন্য কোনো মাধ্যমে। দ্বিতীয়টায় ছাড় পাইলে বইয়ে যাই। বই হওয়ার পরও দ্বিধা কাটে না। সুযোগ পাইলে এডিট করতে চাই। প্রতিনিয়ত নিজেকে মূল্যায়ন-পুনর্মূল্যায়নের ভিতর দিয়ে বাংলা ববিতাকে বুঝতে চাইছি আমি।

 

সহজিয়া : বাংলাদেশের সাম্প্রতিককালের কবিতা সম্পর্কে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

মোস্তফা হামেদী : বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কবিতা জাতীয়তাবাদী ভক্তিতে আক্রান্ত। রাজনৈতিক ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, ক্রিটিকের কবিতাও লেখা হচ্ছে। ব্যক্তিগত অনুভূতির কবিতা সব কালেই ছিল। এখনও আছে। কসমোপলিটান ভাবাদর্শের কবিতাও লেখা হচ্ছে। আমাদের কবিতার ভাষা বেশ বদল হয়েছে বিগত এক দেড় দশকে।

লোকভাষা  ও কাব্যভাষার দূরত্ব বেশ ঘুচে গিয়েছে। কল্পনাঘন, কারুকার‌্যময় কবিতার পাশাপাশি সরাসরি বলতে চাওয়ার প্রবণতা দেখা যায় অনেকের মধ্যে। ন্যাকামো, ফ্যানানো ব্যাপারটা উঠে গেছে। এখন আর তেমন উচ্চ স্বর নাই। মৃদু-মন্দ্র স্বর বিচিত্রভাবে পল্লবিত। পাশাপাশি বড় বড় ব্যাপারও ডিল করতে দেখছি অনেককে। মানুষ, ধর্ম, রাজনীতি, শরণার্থী সমস্যা ইত্যাদি।   

 

সহজিয়া : আপনার প্রিয় কবি কারা? কেন প্রিয়?

মোস্তফা হামেদী : আমার প্রিয় কবির তালিকা বেশ বড়। তার থেকে কয়েকজনের নাম নিতে পারি যাদের পড়ে আমি কবিতা ব্যাপারটার ফিল পাই। আমার গড়ে উঠা-বেড়ে উঠা এদের অনেককেই পড়ে। বড়ু চণ্ডীদাস, মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, দ্বিজ কানাই, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জসীমউদ্দীন, জীবনানন্দ দাশ, আহসান হাবীব, আল মাহমুদ, বিনয় মজুমদার, গৌতম বসু, জহির হাসান, হাসান রোবায়েত। অন্য ভাষার দুইজন কবির নাম নিতে পারি এই মুহূর্তে। গার্সিয়া লোরকা আর হুয়ান রামোন হিমেনেথ। এই কবিরা আমার আনন্দের জগতকে স্পর্শ করে। এদের কোনো না কোনো টেক্সট আমাকে নানা সময়ে বিপুলভাবে আন্দোলিত করেছে।

 

সহজিয়া : বাংলাদেশে সাহিত্য পুরস্কারে মানুষের আস্থা উঠে গেছে। এসব নিয়ে ভেবেছেন কখনো? আস্থা নেই কেন? কী মনে হয় আপনার?

মোস্তফা হামেদী : হ্যাঁ, এসব আমাদের বন্ধুদের আড্ডায় প্রায়ই উঠে আসে। আস্থাহীনতার একটা ব্যাপার সাহিত্য সমাজে চাউর আছে। এর কারণ আমার কাছে মনে হয় মূলত দুইটা। এক: পাঠক ও বোদ্ধারা যাকে স্বীকৃতি দেন বা দিচ্ছেন, গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন, তিনি বা তারা পুরস্কার না পেয়ে পুরস্কার পাচ্ছেন গৌণ কেউ। এতে পুরস্কার দাতার স্বীকৃতি আর সমাজের স্বীকৃতির দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে। অনাস্থা তৈরি হচ্ছে। দুই: অনেক পুরস্কার দাতা প্রতিষ্ঠানের নিজেদেরই স্বীকৃতি নাই। ফলে তাদের স্বীকৃতি হাস্যরসের যোগান দিচ্ছে।

এখানে সাহিত্যমূল্যের চেয়ে বয়স, গোষ্ঠী, আদর্শ এসব বড় হয়ে আছে পুরস্কার প্রথায়। সাহিত্যে স্বীকৃতি আর পুরস্কারের দরকার আছে। এটা সমাজের দায়। পুরস্কার প্রদান হোক বা অন্য কোনো ক্ষেত্র হোক,  ঠিক লোক বাছাই করতে জানা সুস্থ সমাজের লক্ষণ।

 

সহজিয়া : আপনার লেখালেখি সম্পর্কিত পরিকল্পনা কী?

মোস্তফা হামেদী: গত দুই তিন বছরে প্রচুর কবিতা লিখছি। সেগুলা নিয়ে কাজ করতেছি। বাইশে একটা কবিতার বই করার পরিকল্পনা আছে। পাণ্ডুলিপি প্রায় চূড়ান্ত। ফাইনাল টাচ দিতে হবে। অন্য কবিতাগুলা বিষয় ও ফর্ম অনুযায়ী সাজাবো। কবিতা বিষয়ক গদ্যের একটা পাণ্ডুলিপি আছে। আরও কিছু গদ্য মাথায় আছে। সেগুলা নামানো হলে গদ্যেরে বইয়ের দিকে যাব। তবে আপাতত মনোযোগ বাইশের কবিতার বইয়ের দিকে রাখতে চাই। কবিতাই লিখতে চাই। টুকটাক কিছু স্মৃতিগদ্য লিখছি। সেসব হয়তো আমার কথাসাহিত্য চর্চার জমিন তৈয়ার করতেছে — কে জানে?

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here