শেমিজের ফুলগুলি কবিতার বইয়ের জন্য হিমেল বরকত কবিতা পুরস্কার পেয়েছেন কবি মোস্তফা হামেদী। সহজিয়ার পাঠকদের জন্য প্রকাশিত হলো তার একগুচ্ছ কবিতা।
গুলবাহার
ঘাসের ছোট্ট উঠানের ওপর দিয়ে দৌড়ে আসে।
একদল খরগোশ ছানা। পাশ ঘেঁষে বসে।
সেসব ভণিতা আমি বুঝি।
টিনশেডের ওপর চালকুমড়া লতা
পাতার ঝাঁঝর ভেদ করে রোদ ঝাপটে ধরেছে।
আড়াল করে চলেছেন সমস্ত বাসনাকে—
হকারদের বহুরৈখিক স্বর,
বাজারের বিচূর্ণ আওয়াজ
আমরুজ গাছ থেকে উঁকি দেওয়া ছোট শাদা ফল।
জ্বরে নুয়ে পড়া শরীরের কাছে
দেনদরবার করে করে
গেঁথে চলেছেন বুটিকের জামা।
ঝুরা মাটি
সহজ হোক সব
ভাবছে, শাকের জমিতে রোদে পিঠ দিয়ে বসে
ঝুরা মাটির মতো মন আলগা হয়ে আছে—
সংশ্রব থেকে সরে এলে বোঝা যায়
কে কতটা কপট আর কতটা খাঁটি!
কোথাও যাওয়ার আগে,
দূর কোনো অন্বয়ের আগে গায়ে মেখে নেয়
সবজি বাগানের হাওয়া
আর ভাবে— কী কী রোয়া যায় এই ঝুরঝুরা শরীরের ওপর?
ঋতু ফুরিয়ে এলে বীজ হারিয়ে ফেলে সঙ্গমহাসি।
রাত্রিগীতিকা
ঘুমের মাঝে প্রায়ই মোরগ ডেকে ওঠে আর বাগানের অজস্র পতঙ্গের গান
এসব সে নিয়মিতই শোনে
আর স্পষ্ট।
জেগে থেকে থেকে তার অভ্যাস হয়েছে ইতরের ব্যঞ্জনা শোনা!
ঘুম কখনো কখনো আরাধ্য হয়ে ওঠে
তখন পাশ ফিরে পড়ে নেয় রাত্রিগীতিকা
ওষুধের ঝুড়ি থেকে ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে।
এসবই এসেছে পরম্পরায়
নিজেরই শরীর বেয়ে এসে ভিড়েছে নির্ঘুমতার দেশে—
পাট করে রাখে যত শাড়িগুলি
তসবি টিপতে টিপতে দেখে নেয় তারাদের সাজগোজ।
এই মন্দ্রমুহূর্তে সে শুনতে পায়—
বাগানের ফুল ফোটার ধ্বনি,
মাছের শিৎকার,
আর সেইসব কথাকলি যা কোনোদিন ফোটে নি মুখে,
আওড়ায় অনুচ্চ স্বরে পয়ারের লঘু চালে।
সন্ধ্যায়
“আমি লুকিয়ে এসেছি তোমার কাছে
এই ঘন সন্ধ্যায়
লোকে দেখে হাসবে
রমণীরা কি করে কবরখোলায়?”
কথা না হওয়ার এই দিনগুলোয়
একটা ঊর্ধ্বমুখী পাথর ফলকের ভিতর
খোদাই করা নামের দিকে তাকিয়ে
তিনি তিলাওয়াত করেন
তার প্রার্থনার আয়াত
আর বিড়বিড় করে
অস্ফুট কথনে
বলে চলেন—
আমগাছটার কথা,
যে ভিটাটায় নুয়ে আছে বাঁকানো হিজল
অপঠিত বহু পুরানা ফর্দের ভিতর
কীভাবে খুঁজে খুঁজে
তাকে আকার দিয়ে চলেছেন
সেসবই বলে চলেছেন হয়তো বা।
দূর থেকে কিছু কিছু খণ্ডবাক্য—পাতিল উতরে পড়া ভাতের মতো
শোনা যায়।
কুশন
মেয়েরা এলো বহুদিন পর
যেন মজে যাওয়া কোনো পুকুরের ভিতর থেকে আচমকা
কলকলিয়ে পানি উঠে এলো
সেরকম মুখর সংসার—
মনে এলো তার সেই কথাটি,
যে ঘরে নাই নাইওরি
সে ঘরে বাজে না সুখ বাঁশরি
কলতলার চাঁপা গাছটা
গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে।
যেন সেও ফিরে পেলো
পুরানা সই—
ঐ ঝাঁপ দেওয়া তালের আঁটি
উঁকি দেয় হাওয়ায়।
উঠানের কোণে নিকানো দাওয়ায়
মেয়ে আর মায়ে জড়াজড়ি করে শুয়ে
কথার কুশন বোনে—
চাঁদ এসে দাঁড়ায়
গাছ কান নাড়ায়
এক রাতজাগা পাখি
কঁকিয়ে বলে বলে ওঠে—
মেয়েরা কেন বড় হয়?
মেয়েরা কেন চলে যায়?
হারেঙ্গা
হারেঙ্গা গাছের দিকে চেয়ে তিনি দেখে ফেলেন মানুষের ভঙ্গুরতা
মানুষ মূলত একটা সংকলন
বহু কথার—রঙের!
গোশতের ফাঁকে ফাঁকে কেউ রুয়ে দেয়
আয়ু—
ভাঙা হাড় সারাতে যে লোকটা এলো
নিস্পৃহ গগণের তলে
তাকে দেখে মনে হয়—
ভেবেছিল সে—সবই বয়ে চলেছে পূর্ণতার দিকে।
একটা ছোট্ট কাঠের গুড়ি—
আচমকা হোঁচট
তাকে নামিয়ে এনেছে।
শিশুর হাতে গড়িয়ে চলা
সাইকেলের রিংএ
যে ছিটকে এসেছে ভরাট যৌবন থেকে
এক অপাংক্তেয় জীবনে।
বিকালের মরে যাওয়া আলোয়
গড়িয়ে চলেছে জীবন,
সমস্ত বাসনা মুছে ফেলে
কারো খেয়ালের সুরে।