অনুবাদ ও রাজনীতির সম্পর্ক দীর্ঘকালের। কিন্তু এই সম্পর্ককে কখনও প্রকাশ্যে মুক্ত আলোচনার বিষয়বস্তু করা হয় না। কারণ এতে রাজনীতির স্বার্থভঙ্গ হয়। দেশ, জাতি ও রাষ্ট্রভেদে এই সম্পর্কের রূপ হয়তো ভিন্ন হতে পারে; কিন্তু সম্পর্ককে অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। এই বঙ্গ এলাকায়ও এ সম্পর্ক চর্চিত হয়েছে কালে কালে। তবে তা চিহ্নিত করার প্রয়াস দুর্লভ বটে! বাংলা ভাষা-সাহিত্য ও অনুবাদের ভেতর যে শত শত বর্ষের সম্পর্ক রয়েছে তা অস্বীকার করার কোন উপায় যেমন নেই; তেমনি এও অমত করার উপায়ান্তর নেই যে, বিদেশি সাহিত্য আমদানির পাশাপাশি রাজনীতি ও জাতিগঠনেও এর প্রভাব ছিল।
বাংলা মধ্যযুগের কাব্য মূলত অনুবাদ নির্ভর সাহিত্য ছিল। আলাওলের পদ্মাবতীর যে রূপ সেও অনুবাদের হাত ধরে চড়াই উতরাই পার হয়ে বাংলায় আসন গেড়ে তবেই বাঙালির নজর কেড়েছিল। এমনকি পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ আমলে বাংলায় শিক্ষার শুরুটাও ছিল অনুবাদের হাত ধরে। আপাতদৃষ্টিতে, একে ভাষা-সাহিত্য ও অনুবাদের সম্পর্ক মনে হলেও, প্রকৃত অর্থে, উপনিবেশকালের অনুবাদ ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই অর্থেই বাংলা ও উপনিবেশের প্রয়োজনে শাসিত জাতিগঠনে অলক্ষ্যে এবং বাংলা ভাষা-সাহিত্যের সমৃদ্ধিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল।
সম্পর্কটিকে বোঝার জন্য শাসকের আসনে নবাব সিরাজের পতন ও ইংরেজ আরোহণের সন্ধিক্ষণকে বিষয় হিসেবে বেছে নেয়া যাক। বাংলা অঞ্চলে জাতিগঠনের ভূমিকায় অনুবাদের অবদান বুঝতে হলে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এর গুরুত্ব সর্বাগ্রে বিবেচ্য। তাঁর বাঙ্গালার ইতিহাস বিখ্যাত একটি গ্রন্থ। দীর্ঘকাল এটি বাংলার ইতিহাস সম্পর্কে জানার একমাত্র গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। প্রকৃত অর্থেই এটি তাঁর অনুবাদ গ্রন্থ। এটি মূলত জন ক্লার্ক মার্শম্যানের আউটলাইন অব দ্য হিস্টরি অব বেঙ্গল (১৮৩৮) অবলম্বনে রচিত হয়েছে। ১৮৬৫ সালে সেরামপুর (বর্তমান শ্রীরামপুর) থেকে প্রকাশিত এর ১৩তম সংস্করণকে এই প্রবন্ধের আলোচনায় মূলপাঠ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। অনুবাদ ও রাজনীতির সম্পর্ক বোঝার জন্য দু’টি গ্রন্থের গুরুত্বপুর্ণ ক্ষুদ্রতম অংশের একটি তুলনামূলক উপস্থাপন প্রস্তুত করা যাক।
১৯১৯ সালে প্রকাশিত দশম সংস্করণে শ্রী ঈশ্বরচন্দ্র শর্ম্মার লিখিত ভূমিকায় কী আছে? বাঙ্গালার ইতিহাস দ্বিতীয় ভাগ এর একটি সংস্করণ কলকাতার সংস্কৃত প্রেস থেকে ১৮৬২ সালে প্রকাশিত হয়। যদিও সবচেয়ে পুরনো সংস্করণটি ১৮৪৭-১৮৪৮-এ প্রকাশিত হয়েছিল বলে জানা যায়। বর্তমান প্রবন্ধে দশম সংস্করণকে মূলপাঠ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। দশম সংস্করণ এর ‘বিজ্ঞাপন’ অংশে ঈশ্বরচন্দ্র শর্ম্মা বলেছেন, “বাঙ্গালার ইতিহাসের দ্বিতীয় ভাগ শ্রীযুত মার্শমন সাহেবের ইঙ্গরেজি গ্রন্থের অবিকল অনুবাদ নহে। কোন কোন অংশ অনাবশ্যক বোধে পরিত্যক্ত হইয়াছে এবং কোন কোন বিষয় আবশ্যক বোধে গ্রন্থান্তর হইতে সঙ্কলনপূর্বক সন্নিবেশিত হইয়াছে।” প্রশ্ন হলো, তিনি কেন পরিমার্জন করলেন?
এই বেলা আসি, বিদ্যাসাগরের অনুবাদের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণে। মজার ব্যাপার হলো, ব্যাপারটি অনুবাদ হলেও কোথাও তিনি মূলানুগ ছিলেন, কোথাও মূলের পরিমার্জন করেছেন। জরুরি তথ্য উপস্থাপন অক্ষুণ্ণ রেখে জাতির যা জানা প্রয়োজন তা অনুবাদ করে লিখলেন। তিনি যখন ‘পরিত্যাগ’ ‘সঙ্কলন’ ইত্যাদি প্রয়োগ করছেন, তখন খুব সচেতনভাবে তথ্য এবং বক্তব্য বাংলায় সংহত রূপে প্রকাশ করেছেন। কখনও ভাব প্রকাশের জন্য বিস্তৃত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি মূলের দৃষ্টিতেই অনুবাদ করেছেন। অর্থাৎ, ইংরেজরা যেভাবে দেখেছে, সেভাবে। দু’জনের রচনা লক্ষ্য করি।
মার্শম্যান লিখেছেন এইরূপে :
Their eyes fell upon Sokut Jung, and though it was almost certain that he would prove no better than Seraj -ood dowlah, yet they resolved to hope for the best. A conspiracy was forthwith formed, …[i]
বিদ্যাসাগর অনুবাদ করেছেন এভাবে :
তাঁহারা আপাতত সকত জঙ্গকেই লক্ষ্য করিলেন। তাঁহারা নিশ্চিত জানিতেন যে তিনি সিরাজ উদ্দৌলা অপেক্ষা ভদ্র নহেন; কিন্তু মনে মনে এই আশা করিয়াছিলেন, যে আপাততঃ এই উপায় দ্বারা উপস্থিত বিপদ হইতে মুক্ত হইয়া, পরে কোন যথার্থ ভদ্র ব্যক্তিকে সিংহাসনে নিবিষ্ট করিতে পারিবেন।
এই বিষয়ের সমুদয় পরামর্শ স্থির হইলে, সকত জঙ্গের সুবাদারির সনদ প্রার্থনায় দিল্লীতে দূতপ্রেরিত হইল।[ii]
‘Conspiracy’ শব্দের বাংলা এখানে তিনি ‘সমুদয় পরামর্শ’ হিসেবে প্রকাশ করেছেন। অর্থাৎ সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে যা করা হয়েছে, তাকে ইতিহাসে ‘সঠিক ছিল’ বলে বৈধতা দেয়া হলো। ইংরেজের পক্ষ থেকে ইতিহাস পরিমার্জিত হলো। কিন্তু ঠিক পরের অনুচ্ছেদে তিনি ব্যবহার করেছেন ‘চক্রান্ত’ শব্দটি। বাক্যটি এরূপ, “সিরাজ উদ্দৌলা, এই চক্রান্তের সন্ধান পাইয়া অবিলম্বে সৈন্য সংগ্রহ করিয়া, সকত জঙ্গের প্রাণ-দণ্ডার্থে পূর্ণিয়া যাত্রা করিলেন।”[iii] অর্থাৎ, সিরাজউদ্দৌলার দৃষ্টিতে নেতৃস্থানীয় আলোচনাটি ‘চক্রান্ত’ ছাড়া কিছুই নয়। স্বাভাবিক অর্থেই, সেটি ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত হওয়ার কথা। অথচ পরবর্তী কিছু অংশ বিদ্যাসাগর মূলানুগ থেকেছেন একেবারে নির্বিকারভাবে। এমনকি অন্ধকূপ হত্যার বিষয় পর্যন্ত। স্পষ্ট করেই মূলানুগত্যে লিখেছেন যে, এই হত্যাযজ্ঞ ঘটেছে সিরাজউদ্দৌলার অজ্ঞাতে। এখানে বিদ্যাসাগর সিরাজউদ্দৌলার ব্রিটিশবিরোধী আক্রমণকে প্রশংসার সুরে উপস্থাপন করতে পারতেন। কিন্তু করেননি। করলে, আজ এই গ্রন্থের বিজ্ঞাপনেই উল্লিখিত ‘অতি দুরাচার নবাব’ এর খেতাব থেকে কিছুটা গ্লানি কমে সাহসের বাহবা পাওয়া সিরাজউদ্দৌলার জন্য সম্ভব ছিল। কিন্তু ব্যাপারটি ঘটেনি। এখানেই বিদ্যাসাগর ব্যর্থ হয়েছেন অনুবাদের মাধ্যমে জাতিগঠনে ভূমিকা রাখতে। এই বার্তা পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছেন যে, সিরাজউদ্দৌলা যেকোন কারণের বশবর্তী হয়েই হোক, শেষ পর্যন্ত তৎকালীন ভাইসরয় এর বিরুদ্ধে গদির লড়াই অব্যাহত রেখেছিলেন, উপনিবেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন।
ব্যর্থতার কারণ কী? এখানে খেয়াল করতে হবে যে, বিদ্যাসাগর এমন সময়ে অনুবাদ করেছিলেন, যখন বাংলার সূর্য মলিন। ইংরেজ দ্বারা বাংলার মানুষকে ‘রক্তে মাংসে বাঙ্গালী, কিন্তু মেধায় ও মননে ইংরেজ’ রূপান্তরের বাস্তবায়ন বিশ শতকে শুরু করলেও, ক্ষমতার রাজনীতিতে সর্বস্তরে পৌঁছানোর সকল প্রস্তুতি নিয়ে আদাজল খেয়ে লেগে পড়েছে উনিশ শতকেই। ফলে আঠারো-উনিশ শতকের বাংলার ইতিহাস জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়া দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল। ‘অতি দুরাচার নবাব সিরাজ-উদ্দৌলার’ পতন থেকে শুরু করে বেন্টিঙ্ক পর্যন্ত প্রায় আশি বছরের ইতিহাস-ব্যাপ্তি পাওয়া যায় বিদ্যাসাগরের এই অনুবাদগ্রন্থে।
অনুবাদের রাজনৈতিক বার্তার রূপ বোঝার জন্য উল্লিখিত ইংরেজি অংশ দিয়ে হালের এক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনুবাদককে অনুরোধ করা হয় অনুবাদ করে দেয়ার জন্য। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই, তাঁকে উৎসের তথ্য সম্পর্কে অভিহিত করা হয়নি। তাঁর তাৎক্ষণিক অনুবাদ এমন :
তাঁদের চোখ পড়ল শওকত জং এর উপরে, যদিও নিশ্চিতভাবেই সে সিরাজের চেয়ে ভালো কোন বিকল্প ছিল না, তবু তারা ভালো কিছুর আশা করছিল। সাথে সাথেই শুরু হলো ষড়যন্ত্র …
অনুবাদের মান নয়, খেয়াল করতে হবে ‘resolved to hope’ এর অনুবাদ করতে গিয়ে ‘কী আশা করেছিলেন’ এর কোনও বিস্তৃত অর্থের ব্যাখ্যাপ্রদানকারী বাক্য এখানে নেই। কারণ এই হালের অনুবাদ স্বাধীন বাংলার নাগরিক। অনুবাদের সময় তাঁর জাতিগঠন বা রাজনীতির বার্তা ইত্যাদি ভাবার প্রয়োজন পড়েনি। বিদ্যাসাগর কেন দিয়েছিলেন? কারণ সেকালের সাধারণ মানুষকে এই রাজনীতি বুঝিয়ে দেয়া প্রয়োজন ছিল যে, কেন রাজ্যের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ রাজার বিরুদ্ধে শলা-পরামর্শ করতে দ্বিধা করেনি, যেখানে পরবর্তী কালে আসলে ইংরেজের মদদ প্রত্যক্ষ হয়েছিল। মগজে এটাই দেয়া দরকার ছিল যে, শওকত জংকে তারা ‘অতি দুরাচার নবাব সিরাজ-উদ্দৌলার’ একজন নিরাপদ বিকল্প ভেবেছিল। সাধারণ জনতা তখন মাত্র বিস্তৃত পরিসরে আধুনিক শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে শুরু করেছে। তখনও আম জনতা সামগ্রিকভাবে রাজনীতির সক্রিয় কর্মী হিসেবে নেতৃত্বে আসার কথা নিবিড়ভাবে ভাবতে শুরু করেনি। এবং এই গ্রন্থই তখন ‘অতি দুরাচার নবাব সিরাজ-উদ্দৌলার’ পতনের ইতিহাসকে উপনিবেশের পৃষ্ঠপোষকতায় বঙ্গ এলাকায় বিস্তৃত পরিসরে পৌঁছানোর কাজ করতে পারত, গোপনে নয়।
অনুবাদ ও জাতিগঠন এর প্রসঙ্গে চীনের কমিউনিস্ট আচরণের প্রসঙ্গ এখানে না বললেই নয়। চীনে চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টির শাসনামলে খুব সতর্কতার সঙ্গে শিশু সাহিত্যের উপাদানগুলো নির্বাচন করা হতো। তাঁর কারণ, কমিউনিস্ট সমাজ চায় না যে নতুন প্রজন্ম তাদের প্রশ্ন করুক। ফলে তারা শিশুদের শিক্ষা পাঠ্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সেই বিষয়টিকে নিশ্চিত করে। তাই তারা অনুবাদের মাধ্যমে শিশুসাহিত্যের ভেতরে কমিউনিস্ট উপাদান প্রবাহিত হচ্ছে কিনা সেদিকে প্রখর দৃষ্টি দিতো। অনুবাদের উপর নিয়ন্ত্রণ অনেকটা পাহারাদারের কাজ করতো। এভাবে পরবর্তী প্রজন্ম তারুণ্যের মুখ দেখার আগেই তাদেরকে অঙ্কুরে বিনাশের উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতো কমিউনিস্ট সমাজের নেতারা।
বিদ্যাসাগরের কৃতিত্ব এখানেই যে, তাঁকে শাসকের উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখে বঙ্গ জাতির জন্য বোধোদয়ের বার্তা পৌঁছানোর দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। তাঁকে একজন সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করতে হয়েছে। শাসকের রোষানলেও পড়া যাবে না; আবার বৌদ্ধিক বার্তাও দিতে হবে।
আবার, সাহিত্য ও রাজনীতির সম্পর্কে আমেরিকাও কিন্তু এর ব্যতিক্রম নয়। নরমান ক্লেইন, কার্ল স্যান্ডবার্গের মতও লেখকেরা চেয়েছিলেন শিশুরা রাজনীতি সচেতন হয়েই বেড়ে উঠুক। তাঁদের সেই রাজনৈতিক দৃষ্টিসম্বলিত শিশুসাহিত্যের কারণে তাদেরকে কালো তালিকাভুক্তও করা হয়। অর্থাৎ তাঁরা সমকালে প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি। তাঁরা চেয়েছিলেন, শিশুরা প্রার্থনা করে নয়, বরং বৌদ্ধিক প্রশ্ন করে মুক্তির উপায় খুঁজুক। তাঁরা চেয়েছিলেন, শিশুরা মাথা নিচু করে নয়, কর্তৃপক্ষকেও প্রশ্ন করে বাঁচতে শিখুক। এ প্রসঙ্গে ২০১০ সালে প্রকাশিত জুলিয়া মিকেনবার্গ ও ফিলিপ নেল এর সম্পাদনায় টেলস ফর লিটল রেবেল (tales for little rebel) এর কথা অবশ্যই বিবেচনাযোগ্য।
বাংলার ইতিহাস পাঠের মাধ্যমে উপনিবেশায়ন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করে তরুণ সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো ইংরেজ সমাজের জন্য খুব প্রয়োজন ছিল। মার্শম্যানের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানলেই বিষয়টি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে। ১৮৬৫ সালে প্রকাশিত মূল গ্রন্থের ১৩তম সংস্করণ মার্শ ম্যানের আউটলাইন অব দ্য হিস্টোরি অব বেঙ্গল (OUTLINE OF THE HISTORY OF BENGAL) এর শিরোনামের নিচে ছোট ফন্ট ব্যবহার করে লেখা হয়েছে ‘কম্পাইল্ড ফর দ্য ইউজ অব ইয়থস’ (COMPILED FOR THE USE OF YOUTHS)। লক্ষ্য এখানে তরুণ সমাজ। বিদ্যাসাগরের কৃতিত্ব এখানেই যে, তাঁকে শাসকের উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখে বঙ্গ জাতির জন্য বোধোদয়ের বার্তা পৌঁছানোর দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। তাঁকে একজন সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করতে হয়েছে। শাসকের রোষানলেও পড়া যাবে না; আবার বৌদ্ধিক বার্তাও দিতে হবে। রাজনীতিতে সক্রিয় হও, এই সংবাদ বাংলায় কতদূর পৌঁছেছিল তা খুঁজে বের করা আজ দুষ্কর হলেও, একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যা, বিদ্যাসাগরের পরিমার্জিত ইতিহাস বাংলার মানুষ বহুকাল অবশ্যপাঠ্য করে রেখেছিল। কিন্তু এই গ্রন্থের অনুবাদে তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টির প্রখর প্রতিফলন না থাকায় ইংরেজের ‘নজর’ আমরা পেয়েছি; ফলে নবাব সিরাজ আমাদের কাছে অপরাধী।
মার্শ ম্যানের গ্রন্থে আছে ১৮৩৮-এর ভূমিকা। সেখানে কী লেখা আছে একটু জানি। “Before attending to the completion of those works, therefore, he determined to make the experiment of providing a work for the tender capacities of those who were but feeling their way to our language.” লেখক নিজেই লিখেছিলেন। অর্থাৎ তারা চেয়েছিল, তারা যেভাবে ‘উপনিবেশ প্রকল্প’ হিসেবে নবাবের পতন ও উপনিবেশের উত্থানকে দেখেছে, বাংলার মানুষও ব্যাপারটিকে সেভাবেই ‘ইতিবাচক’ দৃষ্টিতেই যেন দেখে। কেবল লক্ষ্য হলেই হবে না, তাকে শেষ সীমা পর্যন্ত পৌঁছানোর ব্যাপারটিকেও নিশ্চিত করার প্রয়োজন আছে। এজন্যই তাদের পক্ষ থেকে প্রয়োজন ছিল বইটির বাংলা অনুবাদ। সেজন্য মূল বইয়ের ইংরেজি ভাষার তুলনামূলক সরলীকরণ জরুরি ছিল।
একটি যথার্থ গ্রহণযোগ্য অনুবাদ সম্পন্ন হওয়ার জন্য বিভিন্ন প্রকার দূরত্ব অতিক্রম করতে হয়। যেমন, ভাষিক দূরত্ব, সামাজিক দূরত্ব, ভৌগোলিক দূরত্ব। অনুবাদক বিদ্যাসাগর কী কী অতিক্রম করেছিলেন? উল্লিখিত গ্রন্থের ক্ষেত্রে, প্রধানত ভাষিক দূরত্ব। সামাজিক ও ভৌগোলিক দূরত্ব অতিক্রম করেছিলেন মূলত মার্শম্যান। মার্শম্যান ১৭৯৯ সালে ৫ বছর বয়সে বাংলায় আসেন পিতার কর্মসূত্রে। ১৮০০ সালে তার পিতামাতা সেরামপুরে (কলকাতার বর্তমান শ্রীরামপুর) যে বোর্ডিং স্কুল খুলেছিলেন, মূলত সেখান থেকেই মার্শম্যানের বাংলা-ইংল্যান্ড এর মধ্যকার সামাজিক দূরত্ব অতিক্রম শুরু হয়। মার্শম্যানের ভূমিকার উপরে উল্লিখিত বক্তব্য অনুসারে, বইয়ের ইংরেজি ভাষাকে তিনি সচেতনভাবেই সরল করেছিলেন। তাহলে দেখুন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্য ভাষিক দূরত্ব অতিক্রমটাও তুলনামূলকভাবে সহজ হয়ে উঠেছিল। অন্তত এই গ্রন্থের ইংরেজি-বাংলা অনুবাদের ক্ষেত্রে। তখন তো আর বর্তমান সময়ের মত ১২ বছরের বাধ্যতামূলক ইংরেজি শিক্ষা নিয়ে অনুবাদে আগ্রহী হওয়ার মতো নিয়ামক ছিল না!
তবে কি বিদ্যাসাগরের অবদান এখানে মলিন হয়ে যাচ্ছে ইংরেজ উপনিবেশায়নের সহায়ক হয়েছে বলে? না। কারণ, এখানে ভুলে গেলে চলবে না যে, যেকোনো উপনিবেশকালে রাজনীতি সচেতন ব্যক্তির যেখানে ‘টিকিয়া থাকাই চরম সার্থকতা’ প্রকৃত বাস্তবতা হয়ে ওঠে, তখন তার সেই ছাদের নিচেই বুদ্ধির বহুমুখী জোগান সমাজকে দিয়ে যেতে হয়। এখানে একটি বিষয় অবশ্যই বিবেচনায় আনতে হবে যে, বিদ্যাসাগর যদি অনুবাদ না করতেন, অন্য কেউ করতো। হয়তো সময়ের ব্যবধান বেড়ে যেতো। কিংবা অনুবাদের মান ভিন্ন রকম হতো। কিন্তু হতো। উপনিবেশ প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রয়োজনেই হতো। দেখতে হবে যে, ইংরেজের ছায়াতলে থেকেই বিদ্যাসাগর সংস্কৃত ও হিন্দি অনুবাদগুলো করেছেন। ইংরেজের সুনজরে থেকেই বাংলা ভাষার ও সাহিত্যের সমৃদ্ধি ঘটিয়েছিলেন। খেয়াল করতে হবে, বাঙ্গালার ইতিহাস গ্রন্থের অনুবাদ প্রকাশের অনতিবিলম্বে বিদ্যাসাগর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের হেডরাইটার ও কোষাধ্যক্ষ পদের দায়িত্ব নেন। অর্থাৎ তিনি আসলে ব্রিটিশের ‘বাংলা কলম’ হিসেবে দায়িত্ব পেলেন। সাপও মরলো, লাঠিও ভাঙলো না। উপনিবেশের রাজনৈতিক প্রয়োজনে বৃহত্তর ভাষা ইংরেজি থেকে ইংরেজের দ্বারা তৈরি করা বাংলার ইতিহাস বৃহৎ ভাষা বাংলায় অনুবাদের মাধ্যমে বাংলার মানুষকে দেয়া হলো।
তবে, একথা স্বীকার করতেই হবে যে, বিদ্যাসাগর বহুভাষাকেন্দ্রিক সাহিত্য অনুবাদের মাধ্যমে বাংলা ভাণ্ডারকে পরিপুষ্ট করতে চেয়েছিলেন। বিদ্যাসাগরের অন্যান্য অনুবাদের উৎস কেমন ছিল জানলেই এবক্তব্য স্পষ্ট হবে। তাঁর অসংখ্য অনুবাদের ভেতর একটি কর্মকে উদাহরণ হিসেবে গ্রহণ করি। তাঁর বেতাল পঞ্চবিংশতি (১৮৪৮) হলো ১৮০৫ সালে লাল্লু লালুর সংস্কৃত থেকে হিন্দি ভাষায় অনূদিত বেতাল পচিসসি এর বাংলা অনুবাদ। রাজা বিক্রমাদিত্য ও বেতাল পিশাচকে নিয়ে রচিত পঁচিশটি গল্প-কিংবদন্তির সংস্কৃত ভাষায় সংকলন বেতাল পঞ্চবিংশতি হলো মূল সাহিত্য। বিশ্বসাহিত্যে বিক্রম-বেতাল (Vikram-Betaal) নামে বহুল পরিচিত এই গ্রন্থ। বিদ্যাসাগর যখন অনুবাদ করলেন, তখন অনুবাদের ভেতর বিরাম চিহ্ন প্রয়োগ করলেন। বলা হয়ে থাকে, সেবারই বিরাম চিহ্নের ‘সফল’ প্রয়োগ হয়েছিল।
বাংলা বেতাল পঞ্চবিংশতি (১৮৪৮) সংস্কৃত থেকে হিন্দি, তারপর হিন্দি থেকে অনুবাদের মাধ্যমে বাংলায় প্রবেশ করেছে। অনুবাদক বিদ্যাসাগর মূলানুগ হয়েছেন কিনা, তা অনুসন্ধান করলেই বেরিয়ে আসবে, বহুভাষা পরিভ্রমণে সাহিত্যের প্রতিসরণ কোন পথে অগ্রসর হয়েছে, যেটি হতে পারে একটি বাংলা সাহিত্যিক অনুবাদ অধ্যয়নের জন্য নতুন তত্ত্বের আবিষ্কার। এ অনুসন্ধানে অগ্রসর হওয়ার জন্য বাংলাভাষী হিন্দি অভিজ্ঞ সংস্কৃত-পারদর্শী গবেষকের প্রতি অনুরোধ রইল। তবে, এই প্রবন্ধে বিদ্যাসাগরের ভাষিক দূরত্ব অতিক্রমের বৈশিষ্ট্যের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
ভাষিক দূরত্ব কী? সহজ কথায়, বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীর ভেতর এক ভাষা থেকে অপর ভাষার ভেতর উৎপত্তিগত যে দূরত্ব, তাই হলো ভাষিক দূরত্ব। ইংরেজিতে লিঙ্গুইস্টিক ডিস্ট্যান্স (Linguistic Distance)। বিদ্যাসাগর কোন কোন ভাষা থেকে অনুবাদ করেছেন, তা যদি বিবেচনায় আনি, তবে বলতে পারি যে, তিনি অনুবাদের জন্য ভাষা-বৃক্ষের নিকটতম ভাষাকে নির্বাচন করেছিলেন। ইংরেজি ছাড়াও তিনি মূলত হিন্দি ও সংস্কৃতকে বেছে নিয়েছিলেন তাঁর অনুবাদ এর উৎস ভাষা হিসেবে।
অনুবাদের জন্য প্রথম পর্যায়ে কেন ভাষা-বৃক্ষের নিকটতম ভাষাই সর্বাগ্রে বিবেচনায় আনা উচিত, তা বোঝার জন্য এবার বাংলার তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম ব্যবহারকারীর চাকমা ভাষাকে গ্রহণ করি। এও বোঝার চেষ্টা করি যে, রাজনৈতিক প্রয়োজনেই সাহিত্য বৃহৎ থেকে বৃহত্তর ভাষার দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
ক্ষণজন্মা কবি সুহৃদ চাকমার বার্গী (১৯৮৭) সর্বাগ্রে উল্লেখ্য। এটি বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত চাকমা সমাজের প্রথম দ্বিভাষিক কাব্যগ্রন্থ। চাকমা–বাংলা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক এই কবি বাংলাকেই কেন বেছে নিলেন প্রথম অনুবাদ হিসেবে? প্রথমত, চাকমা সাহিত্যচর্চা প্রসঙ্গ তিনি রাষ্ট্রকে জানাতে চেয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, বাংলা নিকটতম ভাষা। প্রথমটি, অনুবাদের সঙ্গে জাতিগঠন ও রাজনৈতিক সম্পর্ক। দ্বিতীয়টি, ভাষিক দূরত্বজনিত প্রসঙ্গ। গ্রন্থ প্রকাশের পরের বছরই নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার কারণে তাঁর সুদূরপ্রসারী অবদান আর পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ তাঁর জীবিতকালে তাঁর সাহিত্যের অনুবাদের মাধ্যমে পরবর্তী ধাপ আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটি আর ঘটেনি। এ প্রক্রিয়া বোঝার জন্য অন্য একজন কবির উদাহরণ আবশ্যক।
চাকমা ভাষায় কবিতা চাকমার রচিত বহুল পরিচিত ও বিখ্যাত কবিতা ‘জ্বলি ন উধিম কিত্তেই’-এর অনুবাদ-পরিক্রমা লক্ষ্যণীয়। কবিতাটি এই শিরোনামের গ্রন্থে প্রথম সংকলিত হয়ে প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে। কবি একে দ্বিভাষিক রূপেই প্রকাশ করেছিলেন। অর্থাৎ এর বঙ্গানুবাদ কবি নিজেই করেছেন। ২০০২ সালে নারী গ্রন্থ প্রবর্তনা থেকে বহুভাষিক (চাকমা, বাংলা, ইংরেজি) হয়ে গ্রন্থাকারে এটি প্রকাশিত হয়। অবশ্য এর আগেই মেঘনা গুহঠাকুরতার করা কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদ আমেনা মহসিন এর Politics of Nationalism: The Case of the Chittagong Hill Tracts (1997) গ্রন্থে সংকলিত হয়। ২০০২ সালের ত্রিভাষিক কাব্যগ্রন্থের নাম-কবিতাটি প্রথম প্রকাশনার পর বাংলাভাষীর কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এ প্রসঙ্গে না বললেই নয় যে, সমকালের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই কবিতা সম্পর্কে জানার জন্য প্রায়ই রাজনীতি সাহিত্য সচেতন শিক্ষার্থীরা চাকমাভাষীর কাছে প্রশ্ন করতো এবং এই কবিতা আলোচনায় উঠে আসতো। কারণ কী?
খুব স্বল্প শব্দে কবি অন্যায় এর স্বরূপ তুলে ধরেছিলেন। কবিতায় ‘চাকমা’ শব্দের উল্লেখ নেই। কিন্তু ভাষা বড় তীব্র! শব্দগুলো বড় তীক্ষ্ণ! চাকমাভাষীদের তো বটেই, বাংলায় এর বিস্তৃতি ছিল বহুদূর। আগ্রহী পাঠক শিরোনাম দিয়ে খুঁজলেই অনলাইন বহু পত্রিকায় এর উল্লেখ পাবেন। এই প্রবন্ধ লেখার সময় অন্তত ১০টি সাইটে এর উল্লেখ পাওয়া গিয়েছে, যেগুলো বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ওয়েবসাইট। এমনকি বাংলা গবেষণাগ্রন্থে পর্যন্ত এটি ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন, বাংলাদেশের ইউনভার্সিটি প্রেস লিমিটেড থেকে ২০১৮ সালে প্রকাশিত সেলিনা হোসেন, হামিদা হোসেন ও আমিনা মহসিন সম্পাদিত একটি জাতির জন্ম যৌন সহিংসতা ও দায়মুক্তি গ্রন্থে এই কবিতা সংকলিত হয়।
সাহিত্যিক অনুবাদ করার জন্য প্রথম পর্যায়ে কম ভাষিক দূরত্বের ভাষা বা সাহিত্য বেছে নেয়াই উত্তম। এই প্রথম পর্যায়ের অনুবাদ অনুবাদকের নৈপুণ্য বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়।
কবিতার সাহিত্যিক বিশ্লেষণ নয়, বর্তমান প্রবন্ধের জন্য অনুবাদের গতিপথ চিহ্নিত করা জরুরি। বাংলায় অনূদিত না হলে এই কবিতা কাদের মধ্যে বেঁচে থাকতো? হয়তো আজ সেটি পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো। প্রয়োজন ছিল দেশের সর্বস্তরে কবিতাটি পৌঁছানো। তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ তো বটেই, এমনকি রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের মানুষ অবধি। কেন? বিশ্বসাহিত্য হয়ে ওঠার জন্য? না। প্রাথমিক পর্যায়ে এর উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক। পার্বত্য অঞ্চলে তৎকালে ও তৎপূর্বে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার তীব্র প্রভাব ও তার প্রতিবাদের স্বরূপ উপলব্ধির জন্য এ কবিতার আর কোন বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে ব্যাপারটি সহজ হওয়ার কারণ কী? ভাষিক দূরত্ব কম বলে প্রক্রিয়াটি দ্রুততর হয়েছে। চাকমা-বাংলার উৎসগত সম্পর্ক হলো অন্য পরিসরের আলোচনা। এখানে সেটি প্রাসঙ্গিক নয়। তবে এটুকু বলা প্রয়োজন যে, যে ইংরেজ বাঙালির ইতিহাস রচনা করে দিয়ে গেছে, সে ইংরেজ চাকমাকে ‘Broken dialect’ বলে পরিচয় করিয়ে দিয়ে গেছে বলে ব্যথিত হওয়ার কোন যৌক্তিকতা নেই। বিশ–একুশ শতকে এসে এটি ডায়ালেক্ট থেকে ভাষায় পরিণত হয়েছে, এই ব্যাপারটি জরুরি, যা অধ্যাপক সৌরভ সিকদারের মত গবেষক কালের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
লক্ষ্য করি, দশ বছর পরে গ্রন্থাকারে ইংরেজি অনুবাদ এই কবিতার বিশ্বসাহিত্য হওয়ার পথ মসৃণ করে দিল। কারণ কবিতাটি যে কোনো শোষিত মানুষের জন্য বাস্তব প্রকাশ হয়ে ওঠে। তিন ধাপে কবিতাটি অনূদিত হয়েছে। চাকমা–বাংলা–ইংরেজি। চাকমা–ইংরেজির ভাষিক দূরত্ব কিন্তু চাকমা–বাংলার ভাষিক দূরত্বের চেয়ে বেশি। একইসঙ্গে এর সামাজিক এবং ভৌগোলিক দূরত্বও কম। ফলে অনুবাদ প্রক্রিয়া সহজতর হয়েছে। অনুবাদক সাজেদ কামাল ইংরেজি অনুবাদ করলেও তিনি এই দেশের পরিসীমার ভেতরের মানুষ। ফলে সকল দূরত্ব এখানে কমে এসেছে।
অধিক ভাষিক দূরত্বের অনুবাদ অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু এ কাজে ভাষিক দক্ষতা অর্জন বা আয়ত্তীকরণের মতো সময়সাপেক্ষ ও জটিল প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। কাজেই একথা বলা মোটেই অসমীচীন হবে না যে, সাহিত্যিক অনুবাদ করার জন্য প্রথম পর্যায়ে কম ভাষিক দূরত্বের ভাষা বা সাহিত্য বেছে নেয়াই উত্তম। এই প্রথম পর্যায়ের অনুবাদ অনুবাদকের নৈপুণ্য বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। কম ভাষিক দূরত্বের ভাষা সাধারণত কাছাকাছিই অবস্থান করে। ফলে সামাজিক দূরত্বও সহজে অতিক্রম করা যায়। এই প্রথম পর্যায়ের অনুবাদ দূরবর্তী ভাষা শিখনের প্রক্রিয়া সহজতর করে তোলে। যদিও নানাবিধ কারণে বলা যাবে না যে ইংরেজি আজ বঙ্গ এলাকায় নতুন কোনো ভাষা। দীর্ঘকাল বাংলা-ইংরেজি পাশাপাশি অবস্থা করছে বলে, অন্য ভাষার তুলনায় ইংরেজি বেশ পরিচিত। ইংরেজি ভাষার ভৌগোলিক দূরত্ব এখানে কমে গেছে দীর্ঘকাল একত্রে অবস্থান করছে বলে। তবে ইংরেজির ক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব অতিক্রমের জন্য আজও ভৌগোলিক দূরত্ব অতিক্রম জরুরি।
সারবার্তা
রাজনীতির প্রয়োজনে সাহিত্য ক্ষুদ্র থেকে তুলনামূলক বৃহৎ বা বৃহৎ থেকে তুলনামূলক ক্ষুদ্র ভাষামুখী হয়। অনুবাদের মাধ্যমে এই প্রয়োজন মেটাতে পারলে সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই সফল হয়। এখানেই রাজনীতি ও অনুবাদের গভীর সম্পর্ক। এই সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করার জন্যই প্রয়োজন একটি সুনির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান। কী, কখন, কেন, কোন উৎস হতে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করা হবে বা বাংলা ভাষা থেকে কী, কখন, কেন এবং কোন ভাষায় অনুবাদ করা হবে এই ব্যাপারে বিচক্ষণ পরিচালনা থাকলে জাতিগঠনে অনুবাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত হতে পারে।
তথ্যসূত্র
[i] John Clerk Marshman, OUTLINE OF THE HISTORY OF BENGAL, Thirteenth edition, Serampur, Calcutta, 1865, page 140-141.
পড়ুন ।। পর্ব ২
সুহৃদ চাকমার বার্গী প্রসঙ্গে এটি সংশোধিত বাক্য – “এটি বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত চাকমা সমাজের প্রথম দ্বিভাষিক কাব্যগ্রন্থ যেটি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিক দূরত্ব অতিক্রম করে সাহিত্যিক ও আনুবাদিক শক্তি বহন করতে পেরেছে।” এ প্রসঙ্গে যুক্তিগুলো কাগজের ছাপায় আরও বিস্তারিত থাকবে বলে আশা করছি।
আমরা তিয়াশা ম্যাডামের সাথে একটু যোগাযোগ করতে চাই।ম্যাডাম যদি আমার কমেন্ট দেখে থাকে যোগাযোগ মাধ্যম দিলে আপনার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকিবো।
tiashbangla@gmail.com