আল্লামা জালালুদ্দিন রুমির বিখ্যাত গদ্য রচনা ফিহি মা ফিহি। ফারসি গদ্যসাহিত্যে মাইল ফলক হিসেবে বিবেচিত হয় তেরো শতকে রচিত এই গদ্য। বইটি ইংরেজিতে Discourse of Rumi নামে পরিচিত। সহজিয়ায় এটি ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করবেন সায়মন আলী।
কেউ একজন বলল, “আমার মনে হচ্ছে, আমি কিছু ভুলে গেছি।”
রুমি প্রত্যুত্তরে বললেন, “সবকিছু ভুলে গেলেও একটি ব্যাপার আছে যেটা কখনোই ভুলে যাওয়া উচিত না। আপনি যদি সবকিছু ভুলে যান কিন্তু সেই ব্যাপারটি মনে রাখেন তাহলে আপনার উদ্বিগ্ন হবার কিছু নেই। কিন্তু আপনি যদি সবকিছু মনে রাখেন, শুধু সেই ব্যাপারটি ভুলে যান; তাহলে আপনি যা-ই করে থাকুন না কেন, আদতে আপনি কিছুই করেন নি।”
এটা অনেকটা এমন — ধরা যাক, রাজা আপনাকে কোন একটা বিশেষ কাজ দিয়ে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় পাঠালেন। আপনি সেখানে গিয়ে হাজারটা কাজ সারলেন। কিন্তু রাজার দেয়া বিশেষ কাজটি সারলেন না। তাহলে ধরে নেয়া হবে আপনি আসলে কোনো কাজই করেন নি। সুতরাং, প্রত্যেকে এ দুনিয়ায় নিজ নিজ নির্দিষ্ট কর্মভার নিয়ে এসেছে, এবং এ নির্দিষ্ট কর্মভারই ব্যক্তিবিশেষের অভীষ্ট লক্ষ্য। যদি প্রত্যেকে নিজ নিজ অর্পিত কাজ না করে তবে তারা আসলে কিছুই করে না।
প্রতিটি জিনিসের মধ্যেই নির্দিষ্ট কাজ আরোপিত রয়েছে। মাটিতে জন্ম নেয়া সকল ঘাস এবং অন্যান্য উদ্ভিদকূলের অঙ্কুরোদগম ও বেড়ে ওঠার জন্যই আকাশ প্রয়োজনীয় আলোক ও বৃষ্টি পাঠিয়ে থাকে। মাটি নিজের মধ্যে গাছের বীজ ধারণ করে এবং সেই বীজকে ফলবান বৃক্ষে পরিণত করে। এই মাটি যদি শ’খানেক বা হাজার খানেক গ্রহণ করে তো তার থেকে অসংখ্য উপহার দেয় যা গুনে শেষ করা যাবে না। পাহাড়গুলো স্বর্ণ-রৌপ্য সহ অনেক আকরিকের খনি সরবরাহ করে। আকাশ, পাতাল, পাহাড়-পর্বত ইত্যাদি সবই নিজ নিজ কর্ম সম্পাদন করে থাকে, শুধু একটি কাজ ছাড়া। সেই বিশেষ কাজটি আমাদের তথা মানুষের উপর ন্যস্ত, আর তা কেবল আমাদের দ্বারাই সম্পন্ন হয়।
আমরা আকাশ, পাতাল, পাহাড়-পর্বতকে
বিশ্বাস স্থাপনের জন্য প্রস্তাব করেছিলাম
তারা সে বিশ্বাস স্থাপনে ভীত হল এবং
সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল।
কিন্তু মানবসম্প্রদায় সেটা বহন করল
নিশ্চয়ই তারা নির্বোধ ও গুণাহগার।
সুতরাং, মানবসম্প্রদায়ের উপর একটি বিশেষ কর্মভার অর্পিত রয়েছে। আর যখন তারা তা পালন করে তখন তাদের সকল পাপাচার ও নির্বুদ্ধিতা বিলীন হয়ে যায়।
আপনি বলতে পারেন, “আমার সম্পাদিত সকল কাজের দিকে তাকিয়ে দেখুন, যদিও আমি সেই বিশেষ কাজটি করি নি।” আপনি সেসকল অন্যান্য কাজ সম্পাদনের জন্য সৃষ্ট হন নি। এটা অনেকটা এরকম, আপনাকে ভারতীয় ইস্পাতের তৈরি একটি অমূল্য তরবারি দেয়া হল, যে তরবারিগুলো শুধু রাজাবাদশাহদের কোষাগারেই সজ্জিত দেখা যায়। আর আপনি সে তরবারিটাকে কসাইয়ের মতো মাংস কাটার জন্য ব্যবহার করছেন। সেটা দিয়ে কোনো গলে যাওয়া মাংস কাটছেন আর বলছেন, “দেখুন, এ তরবারিটা শুধু সাজিয়েই রাখার জন্যই না, এটাকে এমন আরো শত শত উপায়ে ব্যবহার করা যায়।” অথবা এটা অনেকটা এরকম যে, একটি খাঁটি স্বর্ণের তৈরি পাত্রে শালগম রাঁধছেন, অথচ এক টুকরো সোনা দিয়ে ওরকম শত শত পাত্র পাওয়া যেতে পারে। অথবা বলা যায়, আপনি একটুকরো লাউ ঝুলিয়ে রাখার জন্য খুব দামি দেখে একটি দামেসিন ছুরি নিয়েছেন আর বলছেন, “আমি এটির সদ্ব্যবহার করছি। আমি এর দ্বারা এক টুকরো লাউ ঝুলিয়ে দিয়েছি যাতে ছুরিটি অব্যবহারের ফলে নষ্ট না হয়।” সেটা কেমন নির্বুদ্ধিতার পরিচয় হতো বলুন তো? লাউয়ের টুকরো ঝুলিয়ে রাখার কাজ একটি কাঠের অথবা ধাতব পেরেকের মাধ্যমে খুব সুন্দরভাবে করা যেত, যে পেরেকের মূল্য খুব বড়জোর কয়েক পয়সা হবে। সুতরাং সে কাজের জন্য একশ পাউন্ডের মতো দামি একটি ছুরি ব্যবহার করতে হবে কেন? একজন কবি বলেছেন-
স্বর্গ-মর্ত্যের চেয়েও তোর মূল্য ভারি,
এরচেয়ে বেশি কী আর বলতে পারি?
যখন তুই জানিস না তোর মূল্য নিজেরই।
আল্লাহ বললেন, “আমি তোমাদের কিনে নিবো… তোমাদের মুহূর্তগুলো, তোমার শ্বাস-প্রশ্বাস, তোমাদের সমুদয় সম্পত্তি, তোমাদের জীবনগুলো… সব কিনে নিবো। তোমরা সেগুলোকে আমার পথে ব্যয় কর। সেগুলোকে আমার মুখাপেক্ষী করে দাও এবং বিনিময়ে আমি সেগুলোর মূল্যায়ন করবো ঐশ্বরিক স্বাধীনতা, অনুগ্রহ আর প্রজ্ঞার দ্বারা। আমার দৃষ্টিতে এটিই তোমাদের প্রকৃত মূল্য।” কিন্তু যদি আমরা আমাদের জীবন শুধু আমাদের জন্যই রাখি আর আমাদের প্রয়োজনেই ব্যয় করি তবে আমার সেই ঐশ্বরিক রতন হারাতে পারি যা কেবল আমাদের জন্যই নির্ধারিত ছিল। ঠিক ঐ লোকগুলোর মতোই যারা এক টুকরো লাউ ঝুলিয়ে রাখার জন্য একশ পাউন্ডের মতো দামি একটি ছুরিকে হাতুড়ি দিয়ে দেয়ালে পেরেকের মতো গেঁথে দিয়েছিল এবং এরকম নির্বুদ্ধিতার মাধ্যমে তারা নিজেদের দামি ছুরির মতো মূল্যবান ভাগ্যটাকে পেরেকের মতো নগণ্য মূল্যে নামিয়ে আনল।
তবু আপনি অজুহাত দাঁড় করাতে পারেন এই বলে, “কিন্তু আমি তো এরচেয়েও অনেক বড় বড় কাজে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছি। আমাকে আইন, দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসাশাস্ত্র ও অন্যান্য আরো অনেক কিছু অধ্যয়ন করতে হয়।”
দিনরাত আপনি শুধু আপনার শরীরকে পরিপুষ্ট করতে ব্যস্ত থাকেন। এখন আপনার শরীরটা যদি হয় একটি ঘোড়ার মতো তবে তার ভেতরের জগতটা হল তার আস্তাবল।
বেশ, তবে ভেবে দেখুন তো, আপনি একমাত্র নিজের জন্য ছাড়া আর কার জন্যই বা এই শাস্ত্রসমূহ অধ্যয়ন করে থাকেন? যদি শাস্ত্রটি আইন হয় তবে আপনি তা অধ্যয়ন করেন যাতে কেউ আপনার আহার্য চুরি করতে না পারে, আপনার পরিধেয় বস্ত্র কেড়ে নিতে না পারে, আপনাকে কেউ মেরে ফেলতে না পারে; সোজা কথায় আপনি আইনশাস্ত্রে পড়াশোনা করেন আপনার নিজের নিরাপত্তার জন্য। জ্যোতির্বিজ্ঞানের কথা বললে বলতে হয় — আপনি সেটা পড়ে থাকেন পৃথিবীসহ অন্যান্য গ্রহসমূহের গতিবিধি, সে গ্রহগুলোর ওজনের তারতম্য পৃথিবীর উপর কেমন প্রভাব ফেলে, তাদের কোনটি পৃথিবীর জন্য ক্ষতিকর কোনটি মঙ্গলজনক ইত্যাদি বিবিধ বিষয়ে জ্ঞানার্জন করার জন্য। আর খেয়াল করে দেখুন, এ বিষয়ে অর্জিত সকল জ্ঞানই আপনার পরিপার্শ্বের সাথে সম্পৃক্ত যা আপনার নিজের ভালোমন্দের সাথে সংশ্লিষ্ট। চিকিৎসাশাস্ত্রের কথা বলছেন? দেখুন, তা সম্পূর্ণই আপনার স্বাস্থ্য সম্পর্কিত এবং তা শুধু আপনার পরিসেবার জন্যই রচিত। আপনি যদি বিষয়গুলোকে ভালো হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন তবে তার মূলে রয়েছে একান্তই আপনার নিজের জন্য চিন্তা। এ সকল বড় বড় কাজ আপনারই শাখা-প্রশাখা মাত্র।
যদি এই বিষয়গুলি বিপুল সংখ্যক অলৌকিক ব্যাপার আর জ্ঞানের অসীমতা দ্বারা পরিপূর্ণ থাকতো তবে আপনি একবার চিন্তা করুন কোন জগতে আপনি জীবন অতিবাহিত করছেন এবং কারা রয়েছে এর মূলে? যদি আপনার শাখা-প্রশাখাগুলো আইন, চিকিৎসা, জ্যোতির্বিজ্ঞান দ্বারা বিস্তৃত থাকে তবে আপনি চিন্তা করুন আপনার মধ্যে কোনটি প্রকাশ পাচ্ছে আর কারাই বা এর উৎস? কোন আধ্যাত্মিক আইন আর ওষুধের বলে আপনার ভাগ্য ও ভবিষ্যত প্রভাবিত অথবা কোন ইতিহাসগুলো আপনার হৃদয়ের হাহাকারকে চিত্রিত করে?
আত্মার প্রশান্তির জন্য ঘুম আর আহার ছাড়াও আরেকটি বিষয় আছে, যার কথা আপনি ভুলে গেছেন। দিনরাত আপনি শুধু আপনার শরীরকে পরিপুষ্ট করতে ব্যস্ত থাকেন। এখন আপনার শরীরটা যদি হয় একটি ঘোড়ার মতো তবে তার ভেতরের জগতটা হল তার আস্তাবল। ঘোড়াটি যে খাবার খেয়ে অভ্যস্ত তা শুধু ঘোড়ার জন্যই, তার আরোহীর জন্য না। আপনিই সেই আরোহী এবং আপনার নিজস্ব আহার-নিদ্রার পাশাপাশি নিজস্ব বিনোদন রয়েছে। কিন্তু যেহেতু ঘোড়াটির একটি বিশাল প্রভাব আপনার উপর রয়েছে সেহেতু আপনি সেই ঘোড়ার আস্তাবলের চেয়ে পিছিয়ে আছেন। সেই চিরায়ত জগতের কোন রাজা বা রাজপুত্রদের মধ্যে আপনাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আপনার অন্তর হয়তো সেখানে বিদ্যমান কিন্তু যেহেতু আপনার শরীর তা ধারন করে সেহেতু আপনি এর শাসন মানতে এবং এর বন্দি থাকতে বাধ্য।
গল্পে যেমনটা বর্ণিত আছে তা হল, মজনু একবার তার প্রিয়তমা লাইলির সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিল। যতক্ষণ সে সচেতন ছিল ততক্ষণ সে তার উটটিকে সঠিক গন্তব্যেই চালিয়ে নিচ্ছিল। কিন্তু যখনই সে লাইলির চিন্তায় পুরোপুরি ডুবে গেল আর তার উটটি সম্পর্কে বেমালুম উদাসীন হয়ে পড়ল, উটটি তখন নিজের মতো করে সেই গ্রামের উদ্দেশ্যে চলতে থাকলো — যে গ্রামে এর শাবকগুলো রাখা আছে। চেতন হওয়া মাত্র মজনু দেখল যে, সে তার যাত্রাপথে দুইদিনে যতটুকু দূরত্ব অতিক্রম করতো ঠিক ততটুকু দূরত্বের সমান পথ পিছনে ফিরে গেছে। তিন মাস সে এই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করল, তার গন্তব্যের কাছাকাছি না আসতেই সে ফিরে যাচ্ছিল। অবশেষে সে তার উটটির উপর সমস্ত রাগ ঝেড়ে বলল, “এই উটটিই যত নষ্টের গোড়া।” তারপর সে পায়দলে যাত্রা শুরু করল আর গাইতে লাগল —
আমার উটের ইচ্ছা পেছনে যাবার
আমি যেতে চাই সামনে —
আমাদের লক্ষ্য যখন এপার-ওপার
তো আমরা একমত হই ক্যামনে?
একদা বুরহান আল দীনকে একজন অভিবাদন জানিয়ে বলেছিল, “আমি আমার বন্ধুদের কাছে আপনার অনেক গুণকীর্তন শুনেছি।” জবাবে বুরহান আল দীন বললেন, “দাঁড়ান। আগে আপনার বন্ধুদের সাথে সাক্ষাৎ করতে চাই আর জানতে চাই যে, তারা যে আমার গুণকীর্তন করে তা কি আমার সম্পর্কে যথেষ্ট জেনে করে, নাকি না জেনে? তারা যদি কেবল আমার মুখের কথা দ্বারা আমাকে চিনে থাকে তবে তারা সত্যিকার অর্থে আমাকে জানে না। কথা স্থায়ী নয়। স্থায়ী নয় তার একেকটি শব্দও কিংবা তার একেকটি অক্ষরও। এই শরীর, এই ওষ্ঠাধর এবং এই মুখও টিকে থাকবে না চিরদিন। এ সমস্ত বিষয় ক্ষণিকের বৈশিষ্ট্য বলতে পারেন। কিন্তু তারা যদি আমারে কাজের দ্বারা চিনে থাকে, আমার অপরিহার্য দিকটি সম্পর্কে জেনে থাকে তবে আমি বুঝবো যে, তারা সত্যি আমার প্রশংসা করতে সক্ষম এবং সে প্রশংসা যথার্থ।”
এটি অনেকটা সেই রাজার গল্পের মতো। এই রাজা তার পুত্রকে একদল পণ্ডিতের কাছে অর্পণ করেছিলেন। রাজপুত্রের মস্তিষ্কের প্রখরতার দিক দিয়ে পিছিয়ে ছিল যেকারণে আর তার মধ্যে প্রচণ্ড রকমের নির্বুদ্ধিতা ছিল। তা সত্ত্বেও যতক্ষণ না পর্যন্ত সে একজন পরিপূর্ণ জ্ঞানী হয়ে উঠছে ততক্ষণ সেই পণ্ডিতদল তাকে জ্যোতিষশাস্ত্র, ভূ-তত্ত্ব ইত্যাদি বিষয়ের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা, কারণ, লক্ষণ সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান দিতে থাকলেন।
একদিন রাজা হাতের মুঠিতে একটি আংটি নিয়ে তার পুত্রটিকে পরীক্ষা করতে চাইলেন।
“এসো, বল দেখি আমার মুঠিতে কী আছে?”
উত্তরে রাজপুত্র বলল, “আপনার মুঠিতে যা আছে তা দেখতে গোল, হলুদ রঙের। সেটাতে কিছু খোদাই করা আছে আর সেটার মাঝখানটা ফাঁপা।”
রাজা জানতে চাইলেন, “তুমি তো জিনিসটির সমস্ত বৈশিষ্ট্য সঠিকভাবে বর্ণনা করলে, এখন বল দেখি জিনিসটি কী?”
“এটি অবশ্যই একটি চালুনি।” রাজপুত্রের সাফ জবাব।
“কী!” রাজা প্রায় আঁতকে উঠলেন আর বললেন, “তুমি একটি ছোট্ট জিনিসের এত পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছ যা শুনে যে কেউ মুগ্ধ হয়ে যাবে, তবু তুমি এতদিনকার অধ্যয়নে যে পাণ্ডিত্য লাভ করেছো তাতে কি তোমার মাথায় এই সামান্য বিষয়টি ঢুকলো না যে, চালুনিকে কখনও মুঠিবদ্ধ করে ধরা যায় না?”
ঠিক একই ভাবে, যুগে যুগে মহান পণ্ডিতগণ যেকোন বিষয়ের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে বিশদ আকারে ব্যাখ্যা করে এসেছেন। তারা নিখুঁতভাবে এবং পরিপূর্ণভাবে সেসকল বিজ্ঞান সম্পর্কে জানেন যা আত্মার সাথে সম্পর্কিত নয়। কিন্তু যা কিছু তাৎপর্যপূর্ণ সত্য এবং আমাদেরকে যেকোন কিছুর চেয়ে বেশি স্পর্শ করে, যেমন বলা যায় — আমাদের নিজ সত্তা; এটি সম্পর্কে আপনাদের এই দুঁদে পণ্ডিতরা জানেনই না। তাঁরা যেকোন বিষয়ে শুধু বিবৃতি দিতে পারেন আর বলতে পারেন, “এটা সত্য আর ওটা সত্য না। এইটি সঠিক এর ওইটি সঠিক না।” অথচ তারা নিজ সত্তা সম্পর্কে জানেন না যে, সেটি সত্য নাকি ভ্রম; খাঁটি নাকি ত্রুটিপূর্ণ।
এখন হলুদই হোক আর ফাঁপাই হোক, খোদাইকৃতই হোক আর গোলাকারই হোক; এই বৈশিষ্ট্যগুলো ক্ষণিকের। আংটিটিকে আগুনে নিক্ষেপ করলে সেসব ক্ষণিক বৈশিষ্ট্যের কোনটাই টিকে থাকবে না। তখন আংটিটির অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য বেরিয়ে আসবে এবং সেটিই হবে এর বাকি সকল বাহ্যিক রূপের চেয়ে বিশুদ্ধতম রূপ। সুতরাং পণ্ডিতদের জ্ঞানেও এই বিষয়টিই দেখা যায়; আর সব সাময়িক বৈশিষ্ট্য বিলীন হয়ে গেলেও যে বাস্তবতাটি কেবল টিকে থাকে সে অপরিহার্য বাস্তবতার সাথে তাঁদের জ্ঞানের কোন সংযোগ নেই । তাঁরা খুব পাণ্ডিত্য সহকারে কথা বলেন, যেকোন কিছুর বিশদ ব্যাখ্যা করেন কিন্তু পরিশেষে তাঁদের বিবৃতিগুলো “রাজার মুঠিতে যা আছে তা হল চালুনি!”র মতো দাঁড়ায়। জীবনের উদ্দেশ্যে’র মতো মূল বিষয়টি সম্পর্কে তাঁদের কোন জ্ঞানই নেই।
ধরা যাক, আমি একটি পাখি; নাইটিঙ্গেল পাখি। কেউ যদি আমাকে বলে “অন্য সুরে ডাকো তো?” আমি তা করতে পারবো না। আমার স্বরে যেমনটা ধরবে আমি সেভাবেই ডাকবো। আমি অন্য কোন সুরে ডাকতে পারবো না। যাহোক, যারা পাখির ডাক নকল করে তারা নিশ্চয়ই পাখি নয়, বরং তারা পাখির শত্রু এবং তারা পাখির ডাক নকল করার মাধ্যমে পাখি শিকার করে। তারা শিস দেয় আর গান গায় যাতে অন্যরা মনে করে পাখি ডাকছে। লোকে তখন তাদেরকে বারবার শিস দিতে ও পাখির মতো ডাকতে অনুরোধ করে যাতে তারাও তাদের মতো পাখির ডাক অনুকরণ করতে পারে। কিন্তু এই পাখির ডাক যতই সুন্দর হোক না কেন তা নিছকই অনুকরণমাত্র। এটি কখনই সে লোকেদের নিজের কোন বৈশিষ্ট্য নয়। পণ্ডিতেরাও তেমনি। তাঁরা শুধু অন্যের গান গাইতেই সক্ষম কারণ তাঁরা শুধু সে গানগুলো চারপাশের প্রতিটি অনুষঙ্গের অন্তঃস্থল থেকে ছিনিয়ে নিতে এবং ভিন্ন রকমের সুরে পরিবেশন করতেই শিখেছে।
পড়ুন ।। কিস্তি ৩