ফ্লবেয়ারের চিঠি

গুস্তাফ ফ্লবেয়ার পৃথিবীখ্যাত ঔপন্যাসিক। তাঁর মাদাম বোভারি উপন্যাসটি ক্লাসিক ও বেস্টসেলার বইয়ের একটি। ফ্লবেয়ারের এই চিঠি তাঁর শিল্প ও জীবনবোধের একটি উন্মাদনাময় অভিব্যক্তি। সহজিয়ার জন্য চিঠিটি অনুবাদ করেছেন হাসিব উল ইসলাম

সাহিত্যের মূলধারায় চিঠিপত্র (কিছুটা হলে) উপেক্ষা করা হয়। অবশ্য চিঠিপত্র যে সাহিত্যিকবৃন্দ প্রকাশ করার জন্য লেখেন এরকম না, তবুও কোনো না কোনোভাবে তাঁদের লেখা পত্রালাপ প্রকাশিত হয়। কারণ ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ লেখকরা যখনই কিছু লেখার জন্য কলম ধরেন, তা-ই আমাদের পাঠের উপযুক্ত হয়ে ওঠে। রবার্ট ব্রাউন আর এলিজাবেথ ব্যারেট ব্রাউন একে অপরকে ৫৭৩ টি প্রেমপত্র লিখেছেন। ডি এইচ লরেন্স রচনা করেছেন ৫৫০০ টি পত্র। ধারণা করা হয় এমিলি ডিকিন্সন ১০০০০টি চিঠি লিখেছেন, যার মাত্র দশ শতাংশ টিকে আছে এবং প্রকাশিত হয়েছে। মার্ক টোয়েন কমপক্ষে ১১০০০ পত্র লিখেছেন। মার্সেল প্রাউস্তের পত্রাবলি একুশ খণ্ডে পাওয়া যায় (যদিও সব চিঠি এই একুশ খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি)। ২০৩০ সাল নাগাদ ষোল খণ্ডে লেটারস অভ আর্নেস্ট হেমিংওয়ে সম্পন্ন হওয়ার কথা। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথও প্রায় ৮০০০ চিঠি লিখেছেন। (আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে এসব লেখক চিঠিপত্র লিখতে এতো পছন্দ করতেন, পাঠকরাও এসব পড়তে আগ্রহবোধ করেন, গল্প, কবিতা, উপন্যাস ইত্যাদি রচনার পাশাপাশি এতো চিঠিপত্রও লিখেছেন!)

 

ফ্রান্সের মহোত্তম লেখকদের একজন গুস্তাভ ফ্লবেয়ার (১৮২১—১৮৮০)। ফ্লবেয়ার নিখুঁত ও সুন্দর রচনাশৈলীসম্পন্ন লেখক হিসেবে পরিচিত। তিনি নিখুঁত শব্দবন্ধ, উৎকৃষ্ট বাক্য, এবং নিটোল অনুচ্ছেদ লেখার ঘোরে থাকতেন। ফ্লবেয়ারের লেখা মাদাম বোভারিকে বিশ্বসাহিত্যের মাস্টারপিস হিসেবে গণ্য করা হয় (যদিও অনেকেই মনে করেন দ্য টেম্পটেশন অভ এন্থনি তাঁর সেরা রচনা)। তাঁর প্রকাশিত চিঠিপত্রের সংখ্যা ৩৫০০। তাছাড়াও  আরো অনেক চিঠি হারিয়ে গিয়েছে। চিঠিগুলো তিনি এতো যত্নসহকারে লিখেছিলেন যে, এগুলোকে প্রথম শ্রেণির সাহিত্যকর্মের মর্যাদা দেওয়া হয়। বিশেষ করে কবি লুইসা কোলেতকে লেখা তাঁর প্রেমপত্রসমূহ এবং পরবর্তী সময় জর্জ স্যান্ডের (১৮০৪ —১৮৭৬) সাথে পত্রালাপ। জর্জ স্যান্ড মূলত ফরাসি উপন্যাসিক ও নাট্যকার আমানতাইন দুপিনের ছদ্মনাম। ভদ্রমহিলা শুধু পুরুষের নামই নয়, পোশাকও পরতেন, এবং  পুরুষের মতোন প্রকাশ্যে ধূমপান করতেন। প্রায় এক যুগ ধরে তাঁরা চিঠি চালাচালি করেন। তাঁদের পুরো পত্রালাপ ১৮৮৪ সালে প্রকাশিত হয়  যা এখনো ক্ল্যাসিকের মর্যাদা পায়।

আমি সাধু ছিলাম। আমি ভণ্ড ছিলাম। আমি ছিলাম গাড়োয়ান। এমনকি আমি সম্ভবত প্রাচ্যের এক সম্রাটও ছিলাম।

পত্রবিনিময়ের সময়ে ফ্লবেয়ার ও স্যান্ড উভয়ই তাঁদের যৌবনকাল অতিক্রম করেছিলেন। তখন ফ্লবেয়ার ছিলেন চল্লিশ বছর বয়স্ক এক তিরিক্ষি মেজাজের সন্ন্যাসী (তিনি কখনো বিয়েশাদি করেননি)। স্যান্ড ছিলেন তাঁর চেয়ে সতের বছরের বড়। তিনি তখন জীবনের স্থির, অবিচল, শান্ত একটা সময় উপভোগ করছিলেন। তাঁরা স্বাভাবিকভাবেই একে অপরের বন্ধু ছিলেন না এবং প্রায়শই বিভিন্ন বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করতেন। স্যান্ড মনে করতেন, শিল্প হলো মোক্ষ লাভের একটা উপায়; শিল্প হলো প্রেম ও ভাবাদর্শের প্রকাশ। ফ্লবেয়ার কাছে শিল্প ছিল এক ধরনের নিষ্কৃতি বা পলায়ন, এবং সমাজকে সমালোচনা করার পথ।

 

মতান্তর এবং যথেষ্ট পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও, ফ্লবেয়ার স্যান্ডকে অত্যন্ত সম্মান করতেন। পত্রের শুরুতে ‘ডিয়ার মাস্টার’ বলে সম্বোধন করতেন। স্যান্ডের কাছে ফ্লবেয়ার ছিলেন সন্তানতুল্য। তিনি তাঁকে দিয়েছিলেন অকৃত্রিম  সহানুভূতি আর গভীর ও বিস্তৃত জ্ঞান। তাঁরা একে অপরকে বুড়ো হতে, বড় হতে সহযোগিতা করেছিলেন।

 

কিন্তু আত্মা যদি অনন্তকাল ধরে বেঁচে থাকে, বুড়ো হওয়াতে কী আসে যায়? এক বিস্ময়কর চিঠিতে ফ্লবেয়ার জর্জ স্যান্ডকে তাঁর পুনর্জন্মে বিশ্বাসের  কথা বলেছেন। (সম্ভবতঃ  চিঠিটি সেপ্টেম্বর ১৮৬৬ সালে লেখা।) শুধু তা-ই নয়, তিনি আগের জন্মে কি করেছেন তাও একেরপর এক উল্লেখ করেছেন।

 

চিঠি

ডিয়ার মাস্টার

আমি জীবনকে তোমার মতো করে অনুভব করি না যে, একটা জীবনের বোধ অচৈতন্য থেকে শুরু হয়ে নতুন অস্তিত্বের সূচনা করে। আমার মনে হয়, আমি সব সময়ই বেঁচে থেকেছি। আর আমার স্মৃতিরা জানান দেয় যে, আমি ফারাওদের কাছেও ফিরে যেতে পারি।

 

আমি নিজেকে সুস্পষ্টভাবে ইতিহাসের বিভিন্ন যুগে যুগে, নানান পেশায়, নানান ঐশ্বর্যে দেখতে পাইবর্তমানের আমি হচ্ছি আমার হারানো অস্তিত্বসমূহের পরিণতি।

 

আমি নীলনদের মাঝি ছিলাম। পিউনিক যুদ্ধের সময় ছিলাম রোমের বেশ্যালয়ের দালাল দাস ব্যবসায়ী। সাবুরাতে ছিলাম এক গ্রিক (অলংকারশাস্ত্রের) শিক্ষক, যেখানে আমাকে পোকামাকড় গোগ্রাসে গিলে খেয়েছিল। ক্রুসেডের সময় সিরিয়ার বেলাভূমিতে অনেক আঙুর খেয়ে আমি মরে গিয়েছিলাম। আমি ডাকাত ছিলাম।  আমি সাধু ছিলাম। আমি ভণ্ড ছিলাম। আমি ছিলাম গাড়োয়ান। এমনকি আমি সম্ভবত প্রাচ্যের এক সম্রাটও ছিলাম।

 

আমরা যদি আমাদের প্রকৃত বংশবৃত্তান্ত জানতে পারতাম, অনেক কিছুর অর্থই পরিষ্কার হয়ে যেত। যেহেতু মানুষ তৈরির উপাদানগুলি সীমিত, এই উপাদানসমূহের একই সমবায়ে কি আবারো মানুষের সৃষ্টি হওয়া উচিত না? অতএব, বংশগতি হচ্ছে একটি মূলনীতি যা চমৎকারভাবে প্রয়োগ করা হয়…

 

অশেষ প্রীতি শুভেচ্ছা 

ইতি

তোমার  গুস্তাভ ফ্লবেয়ার

1 COMMENT

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here