মহির মারুফ তরুণ কবি। নাগরিক অভিজ্ঞতার বয়ান হয়ে উঠেছে তাঁর কবিতা। কনফেশনাল কবিতার মতো আত্মপ্রকাশে উন্মুখ এই কবিতাগুলো আত্ম-আবিষ্কারের মাধ্যমও বটে।
যাপিত জীবন
ভগবান আমায় চুল দিয়েছেন, চোখ দিয়েছেন, মুখ দিয়েছেন, দাঁত।
ছুরির মতো সরু হাত দিয়েছেন, টিকালো নাক দিয়েছেন, অজস্র নিঃসঙ্গ রাত।
সারদাপুরের দারোগা বাবু আকাশ দেখে, আমিও দেখি।
ছাতি ফুলিয়ে চাঁদ ওঠে, ছাতি ঝুলিয়ে মেয়েগুলো হেঁটে যায়।
স্কুলের সামনে ফুচকার দোকান, বোম্বাই মরিচের ঘ্রাণ, পাঁপরের কড়মড় শব্দ।
গাড়িগুলো নিঃশব্দে পাড় হয়, রিকশা বাজে টুংটাং করে, লোকাল বাস আওয়াজ তুলে মানুষ পিষে চলে যায়।
সময় পিষে ফেলে স্মৃতি, ডাল ভাঙুনির জাতাকলে চূর্ণ হয় বুটের ডাল।
প্লেটের পাশে শাহি শাহজাহানি সমারোহ।
উৎসবে উৎসব করে একদল লোক, ওইদিন ভিখারির ভাত বাড়ে, আকাশের চাঁদ বাড়ে।
পোলাও চালের ঘ্রাণ শুকে চলে যায় শালিক, আদা-কালোজিরা, চিনি ছাড়া এক কাপ লাল চা।
সিগারেট ফুঁকে ফুঁকে ফুসফুসের সাথে টক-ঝাল-মিষ্টি যোগাযোগ।
হাতে তালি দেয় দর্শক, একা হেঁটে বালক হাতের তালুতে গাঁজা ডলে ডলে গুড়ি করে।
ঢলে ঢলে মাতাল চলে, খাঁ খাঁ রোদ্দুরে বলা নেই কওয়া নেই ঝুম ঝুম করে বৃষ্টি নামে।
মৃত কবি অফিসের ডেস্কে বসে ডেস্কটপে চোখ রাখে।
রাস্তার মানুষ বৃষ্টিকে গালাগাল দিয়ে বেশ্যা বানিয়ে দেয়।
বেশ্যা এক ছিলিম পান পুরে বাবুদের কোলে ঢলে পড়ে।
সূর্য ঢলে পড়ে পশ্চিম আকাশে, প্রেমিকার পাশে বিড়ি ফোঁকে প্রেমিক।
থেমে থেমে ঘড়ির কাঁটা চলে, মাতাল পা রাখে মেপে মেপে মাটির উপর।
উত্তর মেরুর বরফ গলে গলে পায়েশ হয়ে জমে অভিজাতদের পেয়ালায়।
শ্রমিকের মাথার বিনিময়ে কেনা কিসমিস, কাজু বাদাম ভাসে সেখানে।
তারপর নিহিলিস্ট কিছু মানুষ আড়মোড়া দিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে।
ঘুম ভেঙে ঘুষ দিয়ে প্রাতরাশ সারে কিছু সরকারি বড় বাবু।
শুয়োরের খামারে দামড়া শুয়োরগুলো হেলেদুলে হেঁটে চলে।
পাহাড়ি ঢল বেয়ে নামে ঝর্ণা, সম্পর্ক ভাঙার দুঃখে তরুণীর চোখে জমে জল।
ওদিকে জলের অভাবে সেনেগাল-সোমালিয়ার হাসফাস এই সেই।
আরেকটা হাতি মেরে দাঁত নিয়ে পালায় কালোবাজারি, গরুগুলো পাড় হয় বর্ডার।
বাঙালি ভেবে ভুলক্রমে দু-একটা ভারতীয় মারে বিএসএফ।
বিকেল গড়াতেই আটার ভেতরে আলু চেপে ভাজা হয় শিঙারা, সাথে কয়েক টুকরো কাঁচা পিঁয়াজ।
বাজারে পিঁয়াজের দাম আকাশ ছুঁই ছুঁই।
টুকরো টুকরো সাদা মেঘ আকাশে জমে, খন্ড খন্ড কালো মেঘ জমে।
মাটির ব্যাংকে জমে গরিবের টাকা।
সুইস ব্যাংকের হিসাবে গরমিল হয় বুর্জোয়া বাবুদের।
গেটিসবার্গের জাতিবিদ্বেষের বিপক্ষে লিঙ্কনের রোমান্টিসিজম মনে পড়ে যায়।
মনে পড়ে যায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের দুই একটি গানের কলি।
আমের মুকুল থেকে আমের ঘ্রাণ আসে, উঠোনে শুকোতে দেয়া আমসত্ত্ব চলে যায় কর্পোরেট প্যাকেটে।
পকেটে দুমড়ে মুচড়ে আত্মহত্যা করে সিগারেট।
মেঠোপথগুলো এসে মিশে হাইওয়েতে।
হাই তুলে বুঝতে পারি রাতের ঘুম ভালো হয় নি।
আকাশটা এখনো কালো হয় নি।
পকেটে হাত পুরে, ঠোঁটে সিগারেট ধরে প্রেমিকার বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে আসি।
এভাবে হেঁটে চলে মানুষ।
গরুগুলো গোধূলি বিকেলে বাড়ি ফেরে।
বাজারে ওঠে মাগুর মাছ, কৈ, রূপচাঁদা, শিং।
ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রেখে শিৎকার করে ওঠে প্রেমিক যুগল।
খিস্তি ছাড়ে রিকশাওয়ালা, পথচারী।
আহ! ভগবান আমায় কান দিয়েছেন।
বলা নেই, কওয়া নেই পেচ্ছাপ করতে বসে যায় মধ্যবয়সী এক বুড়ো।
চোখ দিয়ে বালিকার বুক মাপে অচেনা পুরুষ।
কৌতুহলী চোখে দিগম্বর শরীর দেখে দুজন দুজনার।
দু টাকা পেয়ে মিথ্যে দোয়ার ভান্ডার খুলে বসে থুরথুরে বুড়ি।
আহ! ভগবান আমাকে চোখ দিয়েছেন।
নাক দিয়েছেন ভগবান।
অন্ধকার শুকে শুকে কুকুরের মতো বেঁচে আছি।
শহুরে সিসামাখা আকাশে একা নক্ষত্রের মতো টিকে আছি।
নক্ষত্রও হারিয়ে যায়।
আমি বেচে আছি।
এই কি অনেক নয়?
প্রাত্যহিক বাস্তবতা
আমি সম্পর্কের ব্যাপারে কতটা স্পর্শকাতর ছিলাম-
ভেবে ভয় পাই।
পাতলা কাচের মতো প্রতিটি সম্পর্ক।
এদের শক্ত মুঠিতে ধরলে ভেঙে যায়,
হালকা আঘাতে চৌচির হয়ে যায়,
অবহেলায় ধূলো জমে,
মুছতে গেলে হাত ফসকে হারিয়ে যায় অবয়ব।
কত বন্ধু, আত্মীয়, প্রেমিকা, পরিচিতজন দিনের আলোর মতো এসে
সন্ধ্যার আঁধারে হারিয়ে গেছে।
জোছনার মতো জ্বলে উঠে অমাবস্যার মতো মিলিয়ে গেছে।
যাদের সাথে প্রতিদিন সকালে চা খেতাম —
আজ তাদের নাম মনে রাখতে পারি না।
যাদের অতি আবেগে জড়িয়ে ধরতাম —
এখন তাদের দূরবর্তী অস্তিত্বে নাকে এসে জানান দেয় উৎকট ঘামের গন্ধ।
যাদের ভালোবেসে চুমু খেয়েছি —
তাদের মুখগহ্বর এখন ছাইদানি মনে হয়।
প্রাত্যহিক জীবনের পরিচিত মুখগুলো বদলে যেতে থাকে।
স্বপ্নের মতো সম্পর্কগুলো মিলিয়ে যায় দিনের আলোয়।
কিছু ক্ষত শুকিয়ে যায়। দাগও মিলিয়ে যায়।
কিছু ক্ষত শুকিয়ে যায়। থেকে যায় দাগ।
ভুলে যাওয়া মানুষগুলো মৃত মানুষের থেকেও নিম্নপর্যায়ের।
অতি প্রিয়জন মরে গেলে
তার মৃত্যুকে নিয়ে অবসরে দুঃখবিলাস করা যায়।
কোন একদিন আয়েস করে চোখের জল ফেলা যায়।
অতি প্রিয়জন অপ্রিয় হয়ে গেলে
তার বেঁচে থাকা, তার অস্তিত্ব উপদ্রব বলে মনে হয়।
প্রিয় কোন খাবার পচে গেলে
ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলা ছাড়া আর কোন পথ খোলা থাকে না।
প্রিয় মানুষ অপ্রিয় হয়ে গেলে ঠিক তেমনি,
নাকে রুমাল দিয়ে পাশ কাটিয়ে হেটে চলে যেতে হয়।
যত্রতত্র মল-মূত্রের দিকে চোখ পড়লে যেভাবে চোখ ফিরিয়ে নিতে হয়-
তেমনি তাদের দেখে চোখ ফিরিয়ে , পাশ কাটিয়ে, গা বাঁচিয়ে,
হেঁটে চলে যেতে হয়।
আমি কতটা স্পর্শকাতর ছিলাম ভেবে অবাক হই।
আমি ভাবতাম মানুষ বুঝি ঠোঙা নয়।
আজীবন থেকে যায়।
অথচ ঠুলিপড়া আমাদের এই জীবনে প্রতিনিয়ত মানুষ বদলায়।
স্মৃতিরা বিস্মৃতি হয়ে যায়।
কিছু কিছু থেকে যায়।
রেখে দেই আমরা অতি যতনে। অতি গোপনে।
মানুষ খসে পড়ে নক্ষত্রের মতো।
স্মৃতিরা মাঝে মাঝে দেখা দেয় অমাবস্যার আঁধারে-
জোনাক পোকা হয়ে।
অনুপ্রবেশ
অতঃপর জ্যোৎস্না কেটে প্লেটে প্লেটে পরিবেশন করা হোক।
ঘাসের উপরে ফুটে উঠুক সকল মৃত মুখের ছায়া।
যারা পৃথিবী থেকে চলে গেছে
তারা জানে।
আমরা জানি না।
আমাদের কাঁধের উপর আকাশ ভর করে আছে।
নাকের উপর বসে আছে মাছি।
শার্টের কলার ছিড়ে গেছে, হাতাহাতি হয়েছে একচোট।
একা ঘরে ফেনা মুখে মরে পরে আছে অসভ্য মানুষ।
নোংরা পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয়ে আমি চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিলাম।
আমি আলো দেখে পাপ করেছি।
পাপ করেছি পৃথিবীতে এসে।
আমার সাথে অবিচার হয়েছে।
আমি এই অস্তিত্ব চাই নে।
ইথার কণার মতো অস্তিত্বহীন হতে চেয়েছি।
আমি চাই নি ঈশ্বর আমার উপর খবরদারি করুক।
শয়তান আমার সাথে পাশা খেলুক।
অদৃষ্ট আমাকে পরিহাস করুক।
নিয়তি আমাকে নেংটো করে উদোম প্রহার করুক।
আমি ভূমিষ্ঠ হতে চাই নি।
বিনা অনুমতিতে আমার জননী আমায় ধারণ করেছে।
বিনা অনুমতিতে আমার জনক তার ঔরসে আমায় স্থান দিয়েছে।
একবারের জন্যও আমায় কেউ জিজ্ঞেস করে নি।
এখন যখন চলে যেতে চাচ্ছি —
আমায় মায়া দিয়ে বাধা হচ্ছে।
ধর্ম দিয়ে ভয় দেখানো হচ্ছে।
সাহসের নাম করে শাস্তি দেয়া হচ্ছে।
আমি জীবজগতের কিচ্ছু হতে চাই নি।
আমি কেন মাটি হলাম না?
কেন পানি হলাম না?
কেন বাতাস হলাম না?
কেন আমার অস্তিত্ব থাকতে হলো?
কেন আমি অস্তিত্বহীন, মগজহীন কিছু একটা হলাম না?
কেনই বা আমাকে কিছু একটা হতে হচ্ছে?
আমি তো নষ্ট ভ্রূণ হতে পারতাম।
হস্তমৈথুনে অপচয় হয়ে যাওয়া শুক্রাণু হতে পারতাম।
আমি কেন ভূমিষ্ঠ হলাম?
আলো দেখে আমি পাপ করেছি।
বিনা অনুমতিতে আমায় টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসা হয়েছে।
হাতে এক প্লেট জ্যোৎস্না।
পকেটে কয়েকটি ঘাসফড়িং।
কানের লতিতে ঝুলছে মহাবিশ্বের উদ্দেশ্যহীনতা।
আহ্নিক গতি, বার্ষিক গতি করে করে —
পৃথিবী হেলে দুলে চলে।
আমি ধীরে ধীরে নষ্ট হই।
কাঁধে আমার ভূমিষ্ট হওয়ার মারাত্মক পাপ।
যার জন্য আমি দায়ী নই।
বিলুপ্তপ্রায়
আমাদের মগজে ঝুল জমেছে।
পিচুটি জমেছে আমাদের চোখে।
আমরা সত্যকে সত্য বলতে ভয় পাচ্ছি।
মিথ্যাকে মিথ্যা বলতেও আতঙ্কিত বোধ করছি।
আমরা হারিয়ে বসেছি আমাদের দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠস্বর।
আমাদের শব্দগুলো আর্তনাদের মতো শোনাচ্ছে।
আমাদের শুক্রাণুগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে।
আমাদের ডিম্বাণুগুলো অপচয় হচ্ছে রজঃস্রাবের সাথে।
আমারা হারিয়ে ফেলছি আমাদের সবটুকু সুখ।
সবটুকু ক্ষমতা।
আমরা হাতড়ে বেড়াচ্ছি আমাদের পরিচয়।
নখের মাঝে জমে আছে আমাদের কাপুরুষোচিত আচরণ।
ক্ষমতার সামনে আমারা মেরুদণ্ডহীন চিংড়িমাছে পরিণত হচ্ছি।
অর্থের ঘ্রাণে আমরা শৃগালের মতো লুটোপুটি খাচ্ছি।
নতজানু হয়ে বসে আছি আমরা।
বেমালুম ভুলে গেছি মানুষ শিরদাঁড়া সোজা করে দাড়াতে পারে।
ভুলে গেছি আমাদের পিঠের মাঝ বরাবর বহ্মপুত্রের মতো নির্বিকার বয়ে গেছে ঋজু মেরুদণ্ড।
ভুলে গেছি আমাদের বাকযন্ত্রের অস্তিত্ব।
ভুলে গেছি আমাদের শরীর কেবল মাংসপিণ্ড নয়।
এর গভীরে রয়েছে বটবৃক্ষের মতো বিস্তৃত কঙ্কাল।
এর চারিদিকে ছড়িয়ে আছে আমাদের কাঠামোগত অস্তিত্ব।
আমারা আমাদের স্বজাতিকে ঈশ্বর ভেবে উপাসনা করছি।
আমারা সমুদ্র ঘোড়ার মতো সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে রঙ বদলাচ্ছি।
আমরা অভিযোজনে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পরেছি-
এখন বোধহয় আর আমরা মানুষ নই।
আদি পুরুষের বর্বরতা জেগে উঠেছে-
আমাদের মজ্জায় মজ্জায়।
ঝুল জমেছে৷ আমাদের মগজে ঝুল জমেছে।
পিচুটি জমেছে আমাদের চোখে।
স্বার্থসর্বস্ব পৃথিবীতে আমরা পরিণত হয়েছি আবর্জনায়।
পৃথিবীর উদরে অপাচ্য হয়ে উঠছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সন্তান।
আলীক স্বপ্নে সবাই ডুব দিয়েছে গহিন বালুচরে।
শাপলা লতায় পা পেচিয়ে মরছে লোভাতুর মানুষ।
আমরা খড়-কুটোকে ফসল ভেবে ঘরে তুলছি।
ফলদার গাছকে আগাছা ভেবে হত্যা করছি।
আমরা পাশবিকতায় অভ্যস্ত হয়ে উঠছি।
পৈশাচিকতা হয়ে উঠছে আমাদের নতুন পরিচয়।
হাজার বছর ধরে শীতনিদ্রার গোলক ধাঁধায় আটকে পড়ে আছে আমাদের মগজ।
ঝুল জমেছে ঝুল,
আমাদের মগজে ঝুল জমেছে।
পিচুটি জমেছে আমাদের চোখে।
প্রলাপ
মদ ফুরায়নি আমার এখনো,
তোমার গল্প ফুরিয়ে গেল?
প্রিয়তমেষু,
এখনো অনেক পথ বাকি।
মূক ও বধির হয়ে বসে থেকে কি লাভ?
তোমার গ্লাসে মদ ঢেলে দেই?
এক চুমুক দিয়ে, অধরোষ্ঠ ভিজিয়ে
নতুন কাউকে খুঁজে নাও নাতিদীর্ঘ গল্প শোনাতে।
তোমার মধ্যবিত্ত আকাঙ্ক্ষা চল্লিশে শেষ হবে।
আমার মদ ফুরাতে ঢের বেলা হবে।
Every poem is insightful and Maroof vai is great!!