বীজ উপন্যাসে প্রকাশিত হয়েছে এক তরুণীর তীব্র সংবেদনা; পর্যবেক্ষণশীল চোখ দিয়ে সে দেখেছে নিজের ভেতর ও বাহির। মনিরুল ইসলামের লেখা এই উপন্যাস আপনাকে নিয়ে যাবে সমকালীন জীবনের অন্দরমহলে।
২৫
চারদিন পর আজ গোসল করলাম। চুলগুলো একদম জট পাকিয়ে যাচ্ছিল। কেমন একটা বিশ্রী গন্ধও পাচ্ছিলাম। এরমধ্যে দাদি আবার তেলটেল দিয়ে একাকার অবস্থা করে রেখেছে। নিজেকে কেমন বিধ্বস্ত লাগছিলো। মনে হচ্ছে, অনেকদিন পর আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। নগ্ন। গলাটা যেখানে ঠিক শেষ হয়েছে সেখানে দুদিক থেকে দুটি হাড় এসে জোড়া লেগেছে। কার কাছ থেকে যেন শুনেছিলাম পোস্টমর্টেম করার সময় প্রথমেই এই হাড়টা ছেনি আর হাতুড়ি দিয়ে কেটে ফেলে। পরে নাকি অনায়াসেই বুকটা আলাদা করা যায়। নিচে নামতে থাকলে পেট। সেখানে শুধু চামড়া। এই কথা শুনে দীর্ঘদিন আমি ঘুমাতে পারিনি। চোখ বন্ধ করলেই হাতুড়ি আর ছেনির টাং টাং আওয়াজ শুনতাম। তনুর জায়গায় আমি হলে আমার এই অংশটা টাং টাং শব্দে ইতোমধ্যেই কেটে ফেলা হতো। তারপর সহজেই বেরিয়ে আসতো হার্টটা।
মুখটাও কেমন তেলতেলে হয়ে আছে। কালো হয়ে গেছি। নিজের নগ্নতার কি কোনো আলাদা মূল্য আছে? নাই। নিজের কাছে মানুষ সবসময়ই নগ্ন। আসলে ঢেকে রাখার প্রক্রিয়াটাই নগ্নতার মূল্য তৈরি করে। নারীকে ঢেকে রাখে পুরুষ। ঢেকে রাখে। নিয়ন্ত্রণ করে। ঢেকে রাখার মাধ্যমেই মূল্য সৃষ্টি করে। নারী মূলত পুরুষেরই নির্মাণ করা সামগ্রী। আমার কথা নয়। ইমরানের কথা। আসলেই তো, এই শরীরটা নিয়েই কত কিছু! অথচ কী এর মূল্য! কিছুই না। মাংসের দলা। এই স্তন জোড়া চর্বির দলা ছাড়া আর কী! নারীরা একেকজন একেকটা বিভ্রম মাত্র। পুরুষের নির্মাণ করা বিভ্রম। অথচ এর মাশুল গুণতে হয় নারীদেরই। অনেকদিন আগে মাওলানা রুমির বরাত দিয়ে বিভাস বলেছিল, Women is the light of God । শুনতে ভালোই লাগে। কিন্তু কীভাবে? কীভাবে লাইট অব গড? আমি বুঝতে পারিনি। নিজের মধ্যে আমি ঈশ্বরের জ্যোতি অনুসন্ধান করলাম। পেলাম না।
দাঁড়ালেই মাথাটা চক্কর দেয়। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেই খারাপ লাগে। আজ একটু খালি পায়ে হাঁটাহাঁটিও করলাম। খুব ঠান্ডা লাগল মেঝে। মনে হল, কতদিন মাটি পাড়াই না। এক-দুই মাস হলে কথা ছিলো। কয়েক বছর হবে। কী সাংঘাতিক! মাটির সঙ্গে আমাদের লক্ষ লক্ষ বছরের সম্পর্ক। মাটি পাড়ানো আর প্লাস্টিক বা সিমেন্ট পাড়ানো এক বিষয় হতে পারে না। মাটি হলো জীবনের আধার। আর এরা মানুষের কারসাজিতে বিকৃত পদার্থ। মনে হলো, মাটিতে হাঁটলে আমি হয়ত দ্রুতই ভালো যাবো। কিন্তু মাটি কোথায় পাওয়া যাবে?
বাসাটাকে কেমন একটা হাসপাতাল বানিয়ে ফেলেছি। নিজের কাছেই খারাপ লাগে। আস্তে সাউন্ড দিয়ে রিয়া টিভি দেখছে। হিয়ার জেদাজেদিও বন্ধ। দাদির সঙ্গে ঝগড়াও লাগছে না তাদের। কিন্তু এসব তো জীবনেরই অংশ। তাদেরও উপস্থিতি থাকা চাই। নইলে জীবন অসম্পূর্ণ। বিষয়টা এমন দাঁড়িয়েছে, যেন আমি অসুস্থ হইনি। পুরো বাসাটাই অসুস্থ। হালকা একটু টক দিয়ে ঝোল করে দেশি মাগুর মাছ রান্না করেছে মা। বাবা আলাপ করতেছিল হিরা চাচা আসবে দেশি মুরগি, মুরগির ডিম আরও কী কী নিয়ে। বাবা আজকেও ডাব এনেছে। আজকের ডাবে কচি নারকেল ছিল। আমার খুব পছন্দ। আজ অবশ্য তেমন মজা পেলাম না। মজা নেওয়ার জন্য জিহ্বা এখনও রেডি হয়নি।
পেটের সমস্যাটা আর নেই। তবে দুর্বলতা কাটেনি। গলার স্বরটাও স্বাভাবিক হয়নি। মাথা ব্যথার বদলে মাথাটা এখন ভার হয়ে থাকে। বিভাস এসএমএস করে বাসার ঠিকানাটা চেয়েছে। বললো, আসতে পারে। আজ অথবা কাল। ঘটনা মাকে জানালাম। মা অস্থির হয়ে ওঠলো। বাসায় কী আছে কী নেই হিসাব করতে বসে গেলো। বললাম, আসবে চা-কফি খেয়ে চলে যাবে। ওরা তো আর দাওয়াত খেতে আসছে না। বিস্কুট-টিস্কুট আছে। সামনে দেওয়া যাবে। না, আমার কথা মা’র পছন্দ হচ্ছে না। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো। যা মন চায় করুক। তাকে বলাই ভুল হয়েছে। আসবে কি আসবে না — তার নাই ঠিক। আমাকে জিজ্ঞাসা করতে বলে, যে কবে আসবে? এটা কি জিজ্ঞাসা করা যায়? এই অসুস্থ শরীরে এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে একদম ভালো লাগছিল না।
মানুষ নাকি সব পারে। মাকে কবরে রেখে পেছন চলে আসতে পারে। আস্তে আস্তে ভুলে যেতে পারে যে মায়ের গর্ভ থেকে সে জন্মেছে তাকে।
বিকেলে বিভাসই ফোন করলো। আজকেই আসবে। মাকে বললাম, আজকেই আসবে। শুধু কফি খাবে। আর কিছু খাবে না। তুমি দিলেও খাবে না। শুধু শুধু ঝামেলা করতে যেয়ো না। মা তবু নুডুলস রান্না করলো। সেমাই রান্না করল। শিরিষ পিঠা ভাজল। শিরিষ পিঠা শেরপুর থেকে আগত। পরী চাচি পাঠায়। সিরিঞ্জের ভেতরে সিদ্ধ চালের গুঁড়ার কাই ঢুকিয়ে জিলাপির মত পেঁচিয়ে বানানো হয় এই পিঠা। পরে রোদে শুকাতে হয়। এই হল শিরিষ পিঠা। সিরিঞ্জ পিঠাই হয়তো শিরিষ পিঠা হয়ে গেছে। শেরপুরে সিরিঞ্জকে বলে শিরিষ। বাবা কফির একটা ছোটো জার নিয়ে আসলো। বাসায় যেটা ছিলো সেটা শক্ত হয়ে জমাট বেঁধে গেছে। যাই হোক, হাসপাতাল-হাসপাতাল ভাবটা কিছুটা দূর হলো।
বুঝতেছিলাম অফিস শেষে আসবে। মাকে বললাম, সাতটার মধ্যে আসবে। অনুমান করে বললাম। যদিও ওরা আমাকে কিছু বলেনি। মা জিজ্ঞাসা করল, কয়জন আসবে? তাই তো, কে কে আসবে? এমনও তো হতে পারে বিভাস একাই আসছে। হয়তো এদিকেই কোথাও কাজ পড়েছে। সেই ফাঁকে আমার সঙ্গেও দেখা করে গেল। কিন্তু বিভাস আসলে ইমরানকে রেখে আসবে না। বললাম, দুইজন। সর্বোচ্চ তিনজন। হঠাৎ জেসমিন দি’র কথা মনে হলো। তিনিও আসতে পারেন। মা নিশ্চয়ই এদের মধ্যে আমার পছন্দের ছেলেটাকে খুঁজবে। তাহলে অবশ্য মা’র সিরিয়াস হওয়ার যথেষ্ট যুক্তি আছে। বাবা বেরিয়েছিলো মাগরিব পড়তে। হাতে ফলমূল আর দই নিয়ে ফিরলো। ‘মেমানরা না-খাইলে আমরাই খামু’, কৈফিয়ত দিলো বাবা। সাড়ে ছয়টা নাগাদ আমিও জামা-টামা চেঞ্জ করে নিলাম। সাদার মধ্যে নীলের কাজ করা একটা জামা ছিলো। ওটা পরলাম। রিয়া ইস্ত্রি করে দিলো।
তারা সঠিক সময়েই আসলো। বিভাস আর ইমরান। শান্তা আপুর আসার কথা ছিলো। আসতে পারেনি। সবাই কেমন আছে খোঁজ করলাম। মাজহার ভাইয়ের মা কেমন আছে? এসব খবর আমি জানি। তবু জিজ্ঞাসা করলাম। তারাও জবাব দিল। মোজাম্মেলের সঙ্গে আজ দুপুরেই কথা হয়েছে। তবু জিজ্ঞাসা করলাম, মোজাম্মেল কেমন আছে? বিভাস আর ইমরানকে পরিচয় করিয়ে দিলাম। মনেই হল না, চার-পাঁচদিন ধরে দেখা হয় না তাদের সঙ্গে। অসুস্থতা, বিশ্রামে থাকা এইসব নিয়ে কিছুক্ষণ ফর্মাালিটি কথাবার্তা চললো। কথার ফাঁকে ফাঁকেই মা একের পর এক খাবারের আইটেম আনতে শুরু করলেন। শর্ত দিলেন না-খেয়ে ওঠা যাবে না। ইমরানকে খুব চুপচাপ আর ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। যথারীতি বিভাসকে লাগছিল একই রকম। তবে আজ তাকে একটু বেশিই কালো দেখাচ্ছে।
ড্রয়িংরুমে তাদেরকে রেখে আমি রুমে আসলাম। বাবা-মা’র সঙ্গে কথা বলুক। অবশ্য আমার একটু খারাপও লাগছিলো। এমনিই বাথরুমে ঢুকলাম। দেখলাম নিজেকে। ভালোই দেখাচ্ছে। তবে চোখে-মুখে একটা অসুস্থতার ছাপ। কালো লাগছে। বাবা-মা’র কাকে পছন্দ হবে? বিভাসকে নাকি ইমরানকে? দু’জনের যদি দুইজনকে পছন্দ হয়? নিঃসেন্দেহে এটা একটা ইন্টারেস্টিং বিষয়। বিছানার চাদর বদলে দিয়েছে মা। ডিটারজেন্টের গন্ধ এখনো যায়নি। আহ্ কী আরাম! ভালো লাগছে। কেমন উৎসব উৎসব লাগছে। মনে হল, পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছে আমাকে। আর আমি লজ্জা পাচ্ছি।
দাদিকে পরিচয় করিয়ে দিলাম আমি। বললাম, উনি আমাদের স্পেশাল দাদি। রিয়া এবং হিয়া যৌথভাবে দাদির চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী। একসময় বাংলাদেশ এবং জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটদল যেমন ছিলো। এইটুকু রসিকতাতেই হাসিল ঢল বয়ে গেলো। রিয়া-হিয়া দুজনেই লজ্জা পেলো। রিয়া মাওলানা ভাসানীতে পড়ছে, এটা শুনে ইমরান তাকে বিসিএস সম্পর্কিত পরামর্শ দিতে শুরু করল। বাবা-মাকে আমি ইমরানের কথা বললাম। বললাম যে, ওর ৩৬তম বিসিএসের রিটেনে হয়েছে। বাবা বললো, এখন তো রিটেনে হওয়া মানেই চাকরি। এক ফাঁকে তনু হত্যার প্রসঙ্গ চলে এলো। আমি তো ভয়ই পেয়ে গেলাম। না-জানি ইমরান কী বলতে কী বলে ফেলে! বলতে গেলে আমাদের ফ্যামিলি একপ্রকার আওয়ামী পন্থীই। পরিস্থিতি খারাপ দিকে গেল না। বাবা বরং ইমরানের সঙ্গে কী এক প্রসঙ্গে একমত পোষণ করলেন।
বাবার সঙ্গে খুব ভাব হয়ে গেলো বিভাসের। দাদার গল্প শুরু করলেন বাবা। বিভাস দেখি মনোযোগ দিয়ে শুনে। ইমরানের সঙ্গে গল্প শুরু করে দিলেন মা। বাসা কোথায়? পরিবারে কয়জন আছে? তার বাবা-মা কেমন আছে ? শেষ কবে বাসায় গিয়েছিলো এইসব। বাবার কথা শেষ হলে কথা বলছে বিভাস। বিভাসের কথা শুনে ভালো না-লাগার কোনো কারণ নেই। বাবা সম্ভবত মুগ্ধ হচ্ছেন। আমি যেন কারো কথাই শুনছিলাম না। আমি ছিলাম ম্যানেজমেন্টে। একমাত্র আমি ছাড়া সবাই যেন পারফর্ম করছিলো। দাদি মাঝে মাঝে এদিকে আসে আর টেবিলে পড়ে থাকা খাবার শেষ করার তাগিদ দেয়। তারাও ভদ্রতা করে এটা-ওটা নেয়।
আমিই কফি বানালাম। নিজের জন্যেও বানালাম একটু। অনেকদিন খাই না। বাসা থেকে তারা বেরাতে পারলো রাত এগারোটায়। রাতে না-খেয়ে মা যেতে দেবে না। দিলোই না। রান্না যা ছিলো তাই দিয়ে খেলো। ইমরান মাগুর মাছ খায় না। কোনো মাছই নাকি খায় না। তার জন্যে মা ডিম ভেজে দিলো। ডিপ-ফ্রিজে গরুর মাংসের তরকারি ছিলো। গরম করে দিলো মা।
আমার একটু খারাপই লাগতে শুরু করলো। তাদেরকে বিদায় দিয়ে এসেই শুয়ে পড়লাম। মাথাটাও হালকা ব্যথা করছিলো। মনে হলো শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙলো ভোরে। ইমরান মেসেজ করেছিলো যে, পৌঁছে গেছি।
একটু দুর্বলতা আছে, এই যা। নয়তো আর কোনো সমস্যা আপাতত ফিল করছি না। আজ বুধবার। আশা করছি, শনিবার থেকে অফিসে যেতে পারবো।
চাকরির যে পরীক্ষাটা দিয়েছিলাম। সেটাতে টিকেছি। জয়েনিং দুই মাস পর। মা খুব খুশি। দুই মাসকে তার মনে হচ্ছে অনেক বেশি সময়। যেন কালকে জয়েন করতে বললেই বেশি খুশি হতো। বাবা জিজ্ঞাসা করলো, সার্কুলারে স্কেল উল্লেখ করা ছিলো কিনা? আমি বললাম, হ্যাঁ। খুশিই হয়েছে সবাই। আমার ক্ষেত্রেই বরং উল্টাটা ঘটেছে। শুরুতে যতটা আকাক্সিক্ষত মনে হয়েছিলো, এখন আর তেমন কিছুই মনে হচ্ছে না। বরং খারাপ লাগছে। কেমন না কেমন হবে, এ-ও একটা চিন্তার বিষয়। এছাড়া এখনকার চাকরিটা আমার কাছে চাকরি মাত্র নয়। এখানে বিভাস আছে। ইমরান আছে। মোজাম্মেল-শান্তা আপু-জেসমিন দি’। মাজহার ভাই। তাদেরকে দেখবো না। কথা হবে না। কেমন একটা খারাপ লাগা কাজ করছে। হয়তো ভয় হচ্ছে। আমি না আবার শোভনের দুনিয়ায় ঢুকে পড়ি।
বিভাসকে জানিয়েছি। অভিনন্দন জানিয়েছে। বলেছি, তোমাদের ছাড়া আমার ভালো লাগবে না। দেখা যাবে, টিকতে পারছি না। বলে, এটা জড়তা। মানুষ নাকি সব পারে। মাকে কবরে রেখে পেছন চলে আসতে পারে। আস্তে আস্তে ভুলে যেতে পারে যে মায়ের গর্ভ থেকে সে জন্মেছে তাকে। অর্থাৎ মানুষ তার উৎসকেও সহজেই ভুলে যেতে পারে। বলে, অবশ্য ভুলে যাওয়াটা দোষের নয়। তার মহান বাণী শুনে আমার খারাপ লাগা কমে না। ও এরকম কেন! কথার নাই কোনো শ্রী। সবসময়ই এত আধ্যাত্মিকতা ঝারতে হবে কেন!
ইমরান শুনে মন খারাপ করে। নিষেধ করে জয়েন করতে। এইসব স্কুলের নাকি অনেক সমস্যা। বললাম, ‘বাসার কাছে। প্রতিদিন জার্নি-টার্নি করতে হবে না। এই জন্যই মূলত জয়েন করতে চাচ্ছি।’ তখন কিছু বলে না। আমাকে সে কোত্থেকে ভরসা দেবে! আমিই বরং তাকে সান্ত¡না দিলাম। বলে, সে-ও চাকরি ছেড়ে দেবে। আমি না-থাকলে ঐ ফালতু অফিসে নাকি দম আটকে মরে যাবে সে।
চলবে
পড়ুন ।। কিস্তি : ২২