আলাপটা শুরু করা যাক বাংলাদেশের পঞ্চাশের দশকেরই একজন গুরুত্বপূর্ণ কথাসাহিত্যিকের অভিযোগ ও আক্ষেপের সূত্র ধরে। তিনি হাসান আজিজুল হক। তাঁর সুপরিচিত প্রবন্ধগ্রন্থ কথাসাহিত্যের কথকতায় আক্ষেপটি এমন — সাতচল্লিশ-পরবর্তী কথাসাহিত্য বিশেষত উপন্যাস তার পূর্ববর্তী ঐতিহ্য ও বিবর্তনের সঙ্গে প্রায় কোনো যোগাযোগ না রেখে ‘অতিসরলীকৃত বক্তৃতার শিথিল ভাষায় লেখা আকারহীন’ অবস্থায় উপনীত হয়েছিল। তিনি ঐতিহ্য বলতে পূর্ববর্তী দেড়-দুশো বছরের বাংলা গদ্যের ঐতিহ্য ও পরম্পরাকেই বুঝিয়েছেন।
এক হিসেবে ঠিকই আছে। একজন সাধারণ পাঠকের কাছেও — বঙ্কিমচন্দ্রকে না হয় দূরবর্তী ধরা গেল — অব্যবহিত পূর্ববর্তী রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র-তারাশঙ্কর-মানিক এঁদের কথাসাহিত্য পড়ার পর পঞ্চাশের দশকের আবুল মনসুর আহমদ-আবু ইসহাক-আবুল ফজল-সরদার জয়েনউদ্দীন-শামসুদ্দীন আবুল কালামদের গল্প-উপন্যাস পড়লে ঠিক জমে উঠলো বলে মনে হয় না। কিন্তু কেন? বলে রাখা ভালো, হাসান আজিজুল হকের সেই আক্ষেপের জবাব বা অভিযোগের খণ্ডন নির্মাণ করা এই আলাপের উদ্দেশ্য নয়। বরং তার কথার সূত্র ধরে ওই সময়ের কথাসাহিত্যের পটভূমিগত কার্যকারণ দেখাটাই এই আলাপের লক্ষ্য।
সংকটটা কেবল বিষয়ের নয় বরং আরও বেশি বিষয়ীর। তবে বিষয়-বিষয়ী কোনোটিই নিরপেক্ষ বিষয় নয়। হাসান তাঁর ওই প্রবন্ধে অবশ্য এই জনাঞ্চলের নিকট অতীতের আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথাও খানিকটা বলে দিয়েছেন। চল্লিশের দশকের সেই বিশ্বযুদ্ধ-মন্বন্তর-সাম্প্রদায়িকতা-বাঙালির মুসলিম মধ্যবিত্ত হয়ে ওঠা-দেশভাগ-দেশভাগ পরবর্তী বাস্তবতা ইত্যাদি ইত্যাদি। হাসানের আরও একটি আক্ষেপ, ‘দেশবিভাগের পর যে হৃদয়বিদারক মানব-বিপর্যয় ঘটেছে তা নিয়ে কোনো ঔপন্যাসিকই লিখলেন না।’ প্রশ্ন — কেন লিখবেন? হ্যাঁ, হাসান নিজে লিখেছেন; তাঁকে লিখতে হয়েছে। তিনি প্রধানত তাঁর ছোটগল্পে সেই বিপর্যয়ের নানামাত্রিক রূপের কথা বলেছেন।
আরও অনেক পরে (২০০৬) যখন উপন্যাস লিখলেন — ‘আগুনপাখি’ — তখনও সেই বিপর্যয়েরই চমৎকার শিল্পরূপ দিলেন। হাসানের লেখার সেই শক্তি আছে। তিনি পেরেছেন। আরও একটি কথা — তিনি সেই বিপর্যয়ের প্রত্যক্ষ শিকার। তাঁকে দেশ ছাড়তে হয়েছে। হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ এঁদের গল্পেও সেই বিপর্যযের কথা আছে। কিন্তু হাসানের মতে, যে সামূহিক বিপর্যয় ঘটেছিল সেই রাজনৈতিক বাস্তবতায়, তা ওই সময়ের উপন্যাসে আসেনি। প্রকৃত অর্থে, এমন সামূহিক বিপর্যয় উপন্যাসের আধারেই ধারণ করবার মতো বিষয়। কিন্তু বাংলাদেশের উপন্যাসে প্রত্যাশামাফিক তা ঘটেনি।
কিছুক্ষণ আগেই বলা হলো, হাসানকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল। বর্ধমানের যবগ্রাম থেকে শৈশব-কৈশোরের সকল স্মৃতি-বিস্মৃতিসহ তাঁকে চিরতরে পূর্বপাকিস্তানে পাড়ি জমাতে হয়েছিল। কিন্তু ময়মনসিংহের আবুল মনসুর আহমদ কিংবা চট্টগ্রামের আবুল ফজলকে দেশ ছাড়তে হয়নি; তাঁরা মানুষকে দেশ ছাড়তে দেখেছেন। এ-দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য বিস্তর।
মোঘল আমলের কয়েকটি স্ট্রাকচার বাদ দিলে ধুলিময় ঘোড়াগাড়িসর্বস্ব শহর ঢাকায় মোগলাই ঐতিহ্য তখন অনেকটা গল্পের মতোই। তাই পঞ্চাশের দশকের কথাসাহিত্যিকরা শহর নিয়ে গল্প-উপন্যাস লিখতে পারেন নাই।
অন্য দিকে শওকত ওসমান, রশীদ করীম কিংবা আবু রুশ্দেরও দেশ-বদল ঘটেছে। কিন্তু ‘দেশছাড়া’ আর ‘দেশবদলের’ মাত্রাগত ব্যবধানও অনেক। ফলে হাসানের আক্ষেপ সংগত। দেশভাগ — এটি তো কেবল একটি বিষয়। কিন্তু পঞ্চাশের দশকের গল্প-উপন্যাস জমে না ওঠার কারণ সম্ভবত আরও জটিলর এবং গভীরতম। এর একটা দিক হতে পারে বাস্তবতার স্বরূপগত ভিন্নতা; বাস্তবতা-অতিক্রমণের সময়গত ব্যবধান। উনিশ শতকের সীমাবদ্ধতার অভিযোগ সত্ত্বেও যে রেনেসাঁস সেখান থেকে শুরু করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-চাকরি, ১৮৫৭-র বিদ্রোহ, শতাব্দীর শেষার্ধে জাতীয়তাবাদ, হিন্দু-মুসলমান সংকট, বঙ্গভঙ্গ-বঙ্গভঙ্গরদ, অসহযোগ আন্দোলন এবং অতঃপর ভারতের স্বাধীনতা পর্যন্ত বাস্তবতার দৈর্ঘ্য আর চল্লিশের দশক থেকে নিজেকে নতুন পরিচয়ে চিনতে পারা ও চেনানো শুরু করার বাস্তবতার দৈর্ঘ্যরে ব্যবধান সহজেই বোঝা যায়।
একে বলা যেতে পারে — অন্তর্বাস্তবতা ও বহির্বাস্তবতার বোঝাবুঝির সংকট। এই বিতর্ক পুরোনো। বাংলা গদ্যসাহিত্যে এই বিতর্কের সূত্রপাত ধরা যায় প্যারীচাঁদ মিত্র রচিত আলালের ঘরের দুলালের (১৮৫৮) কাল থেকে। অনেকে আলালের ঘরের দুলালকে সার্থক উপন্যাস বলতে চান না। এর কারণ — তাতে বহির্বাস্তবতার প্রাবল্য। এরই বিপরীতে রচিত হয় ‘প্রথম সার্থক উপন্যাস’ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দুর্গেশনন্দিনী (১৮৬৫)। এরপর উপন্যাস-শিল্প এগিয়েছে অনেকদূর। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়, কোন বাস্তবতা গুরুত্বপূর্ণ, কোন সংকট সাহিত্যে আবশ্যিক, অন্তর নাকি বাহির? এই সংকটের মুখোমুখি হতে হয় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তকে মধুসূদনের কবিতার সামনে দাঁড়িয়েও।
দেবেশ রায় তাঁর উপন্যাস নিয়েতে এইরূপ কার্যকারণেরই ব্যবচ্ছেদ করেছেন। তাই বোঝা যায়, এই সংকটের শুরু কেবল বাংলাদেশের পঞ্চাশের দশকের কথাসাহিত্য থেকে নয়। কাছাকাছি সময়ের কাজী নজরুল ইসলাম বা জসীমউদ্দীনের কথাসাহিত্য পড়তে গেলেও তো একই সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। হাসান-কথিত দুশো বছরের ঐতিহ্যিক পরম্পরার ক্ষেত্রে (একে কি ঔপনিবেশিক পরম্পরাও বলা যায়?) উল্লম্ফনতা থাকলেও সংকটের এইরূপ পরম্পরা দেখা দেয় কলকাতা শহরকেন্দ্রিক অন্তর্বাস্তবতাদীর্ণ কথাসাহিত্য পাঠ-পরবর্তী বাংলাদেশের কথাসাহিত্য পাঠের ক্ষেত্রে।
সাহিত্য বাস্তবতা নিয়েই এগোয়। কিন্তু বহির্বাস্তবতার মুখোমুখি না হয়ে অন্তর্বাস্তবতায় যাওয়া সম্ভব কীভাবে? আর জীবনে ও সমাজে যখন বর্হিবাস্তবতাই প্রধান সংকট হিসেবে বর্তমান থাকে, তখন তার মীমাংসাই সাহিত্যস্রষ্টার প্রধান অন্বিষ্ট হয়ে ওঠে। উনিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে কলকাতার মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে ওঠার মুহূর্তে প্যারীচাঁদ তাঁর আলালের ঘরের দুলালে সেই কাজটি করতে চেয়েছিলেন। একই কাজ করতে হয়েছিল বাংলাদেশের লেখকদের সাতচল্লিশ-পরবর্তী নতুন পরিচয়ে পরিচিত হয়ে ওঠা বহির্বাস্তবতার মোকাবিলায়।
অন্যদিকে অন্তর্বাস্তবতার সন্ধানে বঙ্কিমচন্দ্রকে নিতে হয়েছিল ইতিহাসের শরণ, কখনো তা দূর-অতীতের কখনো বা দূরতম অতীতের। আর বিশ শতকের আধুনিকতাবাদীদের রোমন্থন করতে হয়েছিল ফ্রয়েড-মার্কসের মতো পাশ্চাত্য তত্ত্বের জগতে। এক অর্থে বহির্বাস্তবতার দ্বন্দ্ব ও সংকটের মধ্য দিয়েই বাঙালিকে তার দীর্ঘ সময় পার করতে হয়েছে। অন্তর্বাস্তবতা এসেছে বহির্বাস্তবতার পরিপূরক হিসেবে। তাই দেখতে পাই শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে দুই বাস্তবতার যুগ্মীভবন, মনসামঙ্গল-কাব্যে সামন্তশ্রেণি ও বণিক শ্রেণির দ্বন্দ্ব। অর্থাৎ বহির্বাস্তবতার কাঠামোতেই ধরা দেয় অন্তর্বাস্তবতা।
মফস্বল শহর ঢাকার প্রাদেশিক রাজধানী হয়ে ওঠার বাস্তবতার মতোই এর লেখক-সাহিত্যিকদেরও মুখোমুখি হতে হয়েছিল প্রধানত বহির্বাস্তবতারই। মোঘল আমলের কয়েকটি স্ট্রাকচার বাদ দিলে ধুলিময় ঘোড়াগাড়িসর্বস্ব শহর ঢাকায় মোগলাই ঐতিহ্য তখন অনেকটা গল্পের মতোই। তাই পঞ্চাশের দশকের কথাসাহিত্যিকরা শহর নিয়ে গল্প-উপন্যাস লিখতে পারেন নাই। তাদের যেতে হয় — অবশ্যম্ভাবীভাবে যেতে হয় — গ্রামে, ফসলের ক্ষেতে, চেনাজানা সামন্তসমাজ-পটভূমিতে।
শহরের কথা লিখতে অপেক্ষা করতে হয় আরও একটি দশক — ষাটের দশক। সবাই না হলেও, আলাউদ্দিন আল আজাদ কিংবা সৈয়দ শামসুল হকরা ষাটের দশকে এসে শহরের কথা বলতে পারলেন। আর আবু রুশ্দ কিংবা রশীদ করীম যখন শহরের কথা বলেন তা যতোটা ঢাকা, তার চেয়ে বেশি কলকাতা। এই আলাপে দুই বাক্যে আরেকজনের উল্লেখ করা জরুরি; না হলে ভুল বার্তা চলে যেতে পারে — তিনি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ বাংলাদেশের ভূভাগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং তার তিনটি বাংলা উপন্যাসই সাতচল্লিশ পরবর্তীকালে প্রকাশিত — এই দুটি তথ্য ছাড়া তাঁকে ‘বাংলাদেশের ঔপন্যাসিক’ বলার অন্য কোনো কারণ দেখি না। তাঁর ঔপন্যাসিক হয়ে ওঠা এবং সাহিত্যিক পরিচর্যার ইতিবৃত্ত পাঠ না করলেও ওয়ালীউল্লাহ্-র পাঠকমাত্রই আমার আগের বাক্যের অর্থটি ধরতে পারবেন।
যে অর্থে শওকত ওসমান হুগলির সন্তান হয়েও পুরোদস্তুর ‘বাংলাদেশের ঔপন্যাসিক’। এবং যে অর্থে বরিশালে জন্ম-নেওয়া জীবনানন্দ দাশ কোনোভাবেই বাংলাদেশের কবি নন — বাংলা কবিতার কবিও হয়তো নন — কবি হয়ে ওঠেন। পঞ্চাশের দশকের কথাসাহিত্যের এই জমে না ওঠার কথা বলতে গিয়ে আহমদ ছফার ‘থিসিস’ (আক্ষরিক অর্থে নয়) বাঙালি মুসলমানের মনের কাছে আরেকবার যেতে হয়।
চিরকালের প্রান্তিক পূর্ববাংলার এই নির্যাতিত মানবগোষ্ঠী পেল একটি আলাদা পরিচয় — বাঙালি মুসলমান; পেল একটি নতুন শহর, পেল মধ্যবিত্ত হয়ে উঠবার সিঁড়ি। নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান হবার পরপরই রাষ্ট্রভাষা নিয়ে সংগ্রাম, এরপর বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি, চুয়ান্নর নির্বাচন এসব হতে হতেই আটান্নতে আইয়ুবের সামরিক শাসন — সবকিছু স্তব্ধ। বহির্বাস্তবতার মোকাবিলা করে অন্তর্বাস্তবতার দিকে পৌঁছানোর বা থিতু হবার ফুসরত মিললো কই?
আরেকটি বিষয় — এসব কথাসাহিত্যে যেগুলোকে চরিত্রায়ণের দুর্বলতা বলে মনে হয়, তার প্রধান কারণ রচয়িতার কণ্ঠস্বর। রচয়িতার বক্তব্য থেকে গেছে, তার কথা এতোাদিন কেউ শুনতে চায়নি, এবার বলার অনেকখানি অনুকূল স্পেস পাওয়া গেল। ফলে চরিত্রের সংলাপে ঢুকে গেছে স্বয়ং রচয়িতার বক্তব্য। তখনও উপন্যাসে ‘রচয়িতার মৃত্যু’ ঘটলো না; মানে মরে যাওয়া সম্ভব হলো না। আর ‘আরোপিত তত্ত্ব, মননবুদ্ধির কূটতর্ক কিংবা দার্শনিক স্থিরতা’ এসব তো আরও পরের কথা।
সাতচল্লিশের পর ভারতে যেভাবে দ্রুত গতিতে বুর্জোয়াতন্ত্রের বিস্তৃতি ঘটেছে, এখানে ঘটেছে সামন্ততন্ত্র আর বুর্জোয়তন্ত্রের দোনামনা। এই দোনামনা এখনও কাটে নাই। ফলে একই ভাষার সাহিত্য হলেও দুই প্রান্তের বাস্তবতার ভিন্নতাই কথাসাহিত্যের স্বরূপকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে দেয়। নাতিদীর্ঘ এই আলাপের পরেও সচেতন পাঠকমাত্রই বলবেন, হাসান আজিজুল হকের মতো করেই বলবেন — পঞ্চাশের দশকের কথাসাহিত্য পাঠ ঠিক জমে উঠে না। জমে না তো বটে। কিন্তু ঘটনা ঘটে গেছে। পঞ্চাশের দশক থেকে আমরা সত্তর বছর পরে চলে এসেছি। কিন্তু জমে নাই এটা যেমন সত্য; কেন জমে নাই সেটা গভীরতর সত্য।
পঞ্চাশের দশকের বাংলাদেশের কথাসাহিত্য কেন জমে উঠলো না
— বিষয় বিবেচনায় লেখাটির পরিসর ছোট লাগলো।আশা করি প্রাবন্ধিক এখানেই ইতি টানবেন না।
ধন্যবাদ। ঠিকই বলেছেন, বিষয়ের গভীরতা অনুযায়ী এটি ছোটো আকারের লেখা। একে এই আলোচনার সূচনামুখ ধরা যেতে পারে।