ইসমত চুগতাইয়ের গল্প

ছবি : বদরী নারায়ণ

ইসমত চুগতাই (১৯১৫-১৯৯১) ভারতীয় ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, চিত্রনাট্যকার। বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ উর্দু কথাকারদের একজন। নারীজীবন, প্রেম, যৌনতা, শ্রেণি-সংঘর্ষ তাঁর গল্পের বিষয়। কথাশিল্পে নিজের সময়কে তুলে ধরতে সিদ্ধহস্ত। যুক্ত ছিলেন প্রগতি লেখক সংঘের সঙ্গে, বিশ্বাস ছিল তাঁর বাস্তববাদে। মূল উর্দু থেকে ‘যৌবন’ গল্পটি  অনুবাদ করেছেন অনু্বাদক সফিকুন্নবী সামাদী

যৌবন

যখন অসাধ্য সাধন হয়ে যায়, খোদা খোদা করে যৌবন-জ্বর চড়তে শুরু করে… শিরায় শিরায় বাহিত আগুনের নদী জেগে ওঠে। আনাড়ি চলন, নেশায় নিমজ্জিত, যৌবনে মত্ত। কিন্তু তার সাথে সাথে সকল পাজামা এত ছোট হয়ে যায় যে, কোমরের দিক দিয়ে বিঘত বিঘত বাড়িয়েও পায়ের দিক দিয়ে উঁচু হয়ে যায়। তবে এর ভাল চিকিৎসা আছে, কাঁধ একটু সামনে ঝুঁকিয়ে দিয়ে হাঁটু একটু বাঁকা করে দিতে  হয়। হ্যাঁ, চলন খানিকটা ক্যাঙ্গারুর সঙ্গে মিলবে।

চুল কথা শোনে না, গোছা খসে পড়ে। চুল বাতাসে উড়ে যায় আর সিঁথি? সিঁথি তো গায়েব। সাত দিন পর মা সরষের তেল মাখিয়ে ঝুঁটি বেঁধে না দিলে জীবন অসহ্য হয়ে যায়। মুখ ক্যাঙ্গারুর কপালের মত চাঁচাছোলা মনে হলেও চুলের হাত থেকে তো  জীবন  বাঁচে। যেন কেউ মাথা মুড়িয়ে চুলের জাল থেকে মুক্তি দিয়েছে। কি জানি মেমসাহেবেরা ফোলা ফোলা চুল গর্দানের ওপর ছেড়ে কেমন করে বেঁচে থাকে। আর পা? পা তো নয় যেন লতা, কী দ্রুত বেড়ে চলেছে। এই গতিতে বাড়তে থাকলে তো ছাদ ছুঁয়ে ফেলবে। বুড়ো আঙুল যেন কচ্ছপের মাথা।

আরো অনেক কথা একা একা বসে থাকলে জন্নুকে কষ্ট দেয়। আয়নায় নাক দেখলে বমি আসতে থাকে তার, নাক তো নয় হতশ্রী এক খুঁটা। শজ্জুর যখন বিয়ে হয় ইয়া বড় নথ পরেছিল সে। কী সুন্দর নাক ওর! একেবারে পুতুলের মতো। আর জন্নুর এই খুঁটার মতো নাক দেখে তো নথও লজ্জা পেয়ে যাবে। যদি ওর বিয়ে হয় তবে!

‘ঠাঠা পড়ুক এমন নাকের ওপর।’ সে ভাবে।

এবার ঈদে শবরাতী ভাই এসেছে। কেমন এক দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

সে কেমন করে এমন নাক দেখবে কোথাও। জন্নু তাড়াতাড়ি কিছু মোছার অছিলায় ওড়না দিয়ে নাক লুকিয়ে ফেলে। শবরাতী ভাই লজ্জা পেয়ে যায়। হয়তো ভেবেছে, ক্ষেপে যাবে ও!

সে যদি সুলোচনা হত, অথবা মাধুরী, কিংবা অন্তত কজ্জন। আল্লাহ মিয়ার কী ক্ষতি হয়ে যেত? কোনো অভাব তো পড়ে যেত না তাঁর তহবিলে। যদি সে একটু ফর্সাই হত আর ফাঁকিবাজ কারিগর যদি একটু মনোযোগ দিয়ে তাকে সুন্দর বানাত তবে কি তার হাত পচে যেত?

সে চোখ বন্ধ করে অনেক ফেরেশতাকে খটখট আওয়াজে মানুষের শরীর বানাতে দেখে। আহা যদি তাকে বানানোর সময় ফেরেশতাদের বগলে ফোঁড়া না হত। বাবার যখন ফোঁড়া হয়েছিল তখন দেড় মাস খাটের উপর পড়ে ছিল, হাঁসিয়াটা পর্যন্ত নাড়েনি।

তার মনোযোগ মায়ের দিকে যায়। কি জানি কতক্ষণ টালির ঘরের বিছানায় শরীর এলিয়ে দিতে পারে। গত কয়েক মাস ধরে তার পেট অত্যন্ত ভয়ানক গতিতে বেড়ে চলেছে। সে খুব ভাল করেই জানে, এই পেট ফুলে যাওয়াটা  নির্দোষ কিছু নয়। যখনই মায়ের ওপর এমন বিপত্তি আসে, একজন বোন অথবা ভাই রাতভর ট্যাঁ ট্যাঁ করতে এবং তার কোলের ওপর বসে কাঁদতে হাজির হয়ে যায়।

মাছিগুলো দুপুর বেলাতে খুব জ্বালায়। এক কান থেকে উড়িয়ে দিলে অন্য কানে এসে মরে । সেখান থেকে তাড়ালে নাকে এসে ভ্যান ভ্যান করে। এখান থেকে সরালে চোখের কোণে এসে ঢুকে পড়ে। দু মুহূর্তও হয়নি, দোপাট্টার ফাঁক দিয়ে হল্লা করে বসে আর মা ওদিকে চিৎকার করে বলে, ‘মউত পড়ুক তোর ঘুমে, ওঠে, শবরাতীকে রুটি দে।’

গর্দানের ময়লা ডলতে ডলতে সে শিঁকার দিকে যায়। বাইরে পাথরের ওপর শবরাতী ভাই লাল চেকের গামছা কাঁচছে। ছপ ছপ করে ময়লা পানির ফোটা লাফিয়ে এসে তার আধ-খোলা চোখে আর এলোমেলো চুলে পড়ছে। জন্নু রুটি রেখে কাছেই হাঁটুর ওপর থুতনি রেখে বসে মনযোগ দিয়ে তাকে দেখতে থাকে। বুকে কত পশম। জবজবে ঘামে ডোবা। ‘ভয় লাগেনা?’ — জন্নু ভাবতে থাকে, ‘খুব চুলকায় নিশ্চয়ই!’ তার পেটানো বাহু  এবং উরুর পেশী কাপড় কাঁচার প্রতিটি ঝোঁকে নেচে ওঠে।

জন্নু বুঝতে পারে বুকের ঘামে ডুবে থাকা ঘন পশমকে কেন ভয় পায় না আর বাঁশের মতো আঙুলগুলো কীভাবে এত ফুর্তিবাজ হয়।

শবরাতী ভাই বেড়ার ওপর গামছা ছড়িয়ে দিয়ে রুটির বড় বড় টুকরো তরকারিতে ডুবিয়ে গিলতে থাকে।

‘পানি’ শুকনো রুটি বড় গ্রাস গলায় আটকে গেলে সে বলে। জন্নু ভয় পেয়ে তাকে লোটা এগিয়ে দেয়।

‘তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও — বাসন মেজে এখানেই রেখে দিও। আমার কুটা কাটতে হবে।’ সে গম্ভীরভাবে হুকুম জারি করতে করতে ওঠে।

‘আমি কেটে দেব কুটা।’ শবরাতী রুটির শেষটুকু খেতে খেতে বলে।

‘তুমি ক্ষেতে যাবে।’ সে যেতে উদ্যত হয়।

‘ক্ষেতেও যাব।’ সে দম্ভের সাথে একটা লম্বা ঢেঁকুর তুলে বলে।

‘উঁহুঁ, থাক।’ সে যেতে থাকে।

‘বলছি তো, তুমি কুটা কাটতে পারবে না। খামাখা ব্যথা-ট্যাথা পাবে।’ শবরাতী আদুরে ধমক দেয়।

শবরাতীর কী? সে আসবার আগে জন্নু কি কুটা কাটে নি? এমন কী ব্যথা পাবার আছে? পুকুর পাড়ে গিয়ে রূপা আর চন্দনকে আদর করে দুচারটে গুঁতো দিয়ে তাদেরকে চুপচাপ এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে নিজে আঁটি খুলে কুটা কেটে স্তুপ দিতে থাকে।

‘সরো, আমি কুটা কেটে দিচ্ছি।’ শবরাতী আবার ঢেঁকুর তুলে ছোলার তরকারির স্বাদ নিতে শুরু করে।

সে হাঁসিয়া সামলে নিয়ে বসে থাকে যেন শুনতেই পায়নি।

‘একবার বললে শুনতে পাওনা… দাও এদিকে হাঁসিয়া।’ হাঁসিয়া কেড়ে নিতে চেষ্টা করে।

‘না।’ কুটা কাটতে শুরু করে দেয়।

‘তাহলে নাও এখন।’ সে বাঁশের মত মোটা মোটা আঙুল হাইশার নিচে বিছিয়ে দিয়ে বলে, ‘নাও কুটা কাটো এবার, মারো কোপ।’

‘সরাবে নাকি আমি সত্যি সত্যি দেব কোপ?’ সে হাঁসিয়া তুলে বলে, যেন সত্যি সত্যি কোপ দিয়ে বসবে।

‘মারো, তোমার বুকে সাহস থাকলে মেরে দেখাও।’

আর সত্যি সত্যি যদি কোপ মেরে বসত, কচ কচ করে সবগুলো আঙুল কেটে যেত। এসব কী, গায়ের জোর নাকি?

‘এখন কোপ দিচ্ছ না কেন।’ শবরাতী চোখ নামিয়ে নেয়… তার গোঁফওয়ালা মোটা ঠোঁট বিস্তৃত হয়। হাঁসিয়া ছিনিয়ে নেয়।

জন্নু লজ্জিত হয়। কি জানি শবরাতী ভাইয়ের শক্ত এবং রুক্ষ হাতের এই সময় কী হয়ে যায়… কী আশ্চর্য ছোট আর নরম মনে হয়।

জন্নু বুঝতে পারে বুকের ঘামে ডুবে থাকা ঘন পশমকে কেন ভয় পায় না আর বাঁশের মতো আঙুলগুলো কীভাবে এত ফুর্তিবাজ হয়।

জন্নু পারলে নিজের শরীরের মাংস এই ভুখা কুত্তাদের খাইয়ে দিত। কিন্তু কত খায় তার এই রত্তি রত্তি ভাই-বোনেরা। এই মোটা মোটা রুটি, পোড়া হোক বা আধা-সেদ্ধ, মুহূর্তে হজম করে ফেলে। এমন দিন কি কখনো হবে যেদিন ওকে রুটি বানাতে হবে না! রাতভর মা আটা পিষতে থাকে। এই বদসুরত মহিলা আর কীইবা করতে পারে। বছরে ৩৬৫ দিন কোনো না কোনো বাচ্চা পেটে নিয়ে, কোলে নিয়ে দুধ খাওয়াতে খাওয়াতে কাটে। মা তো নয়, এক ভাণ্ডার, শেষ হয় না। কত কীট সে নর্দমায় লড়াই করবার এবং ময়লা ছাড়াবার জন্য পয়দা করেছে, এখনও বাকি আছে অনেক‌।

অবশেষে সেই দিন আসে, রাত বারোটার দিকে মা মহিষের মত চিৎকার করতে থাকে। মহল্লার গণ্যমান্য সকল মহিলা আসে, হাঁড়িতে দুর্গন্ধযুক্ত জিনিস নিয়ে এদিক থেকে ওদিক দৌড়াতে থাকে। বাছুর বাঁধার দড়ির  সাহায্যে মোটা চাদর টালির ঘরের এক কোণে টাঙিয়ে মাকে শুইয়ে দেয়া হয়। বাচ্চারা ফিসফিস করতে শুরু করে আর এখানে আসা প্রায় সব বড় বাচ্চা ধাক্কা খেয়ে পড়তে শুরু করে। বাবা তাদের সাথে অদ্ভুত অদ্ভুত সম্পর্ক স্থাপন করার হুমকি দিয়ে তাদেরকে এক কোণে সরিয়ে দেয় এবং মাকেও অত্যন্ত জটিল গালি দিতে থাকে যার অর্থ জন্নু কোনোভাবেই বুঝতে পারে না। শবরাতী ভাই দুয়েক গালি দিয়ে মহিষের ঘরে চলে যায়। কিন্তু জন্নু মায়ের চিৎকার শুনতে থাকে। তার কলজে কাঁপতে থাকে। মনে হয়, মাকে যেন কেউ কেটে ফেলছে। মহিলারা পর্দার পেছনে মায়ের সাথে না জানি কেমন কেমন অন্যায় আচরণ করছে! জন্নুর মনে হচ্ছে, যেন মায়ের সমস্ত বেদনা সেই বহন করছে। যেন সেই চিৎকার করছে এবং এক অজানা বেদনার ক্লান্তিতে সে সত্যি সত্যি কাঁদতে শুরু করে।

সকালবেলা উঠে যখন কাঁথায় জড়ানো লাল মাংসের একটা টুকরা দেখে তখন সে সত্যিই মীমাংসা করতে পারেনা, কাল রাতে মা যে মুসিবত এবং দুঃখের ভেতর দিয়ে অতিবাহিত করেছে, এটা তার যোগ্য পুরস্কার কিনা। কী জানি, অন্য ময়লার সাথে চিলের খাবার জন্য একেও আস্তাকুঁড়ে ফেলে না দিয়ে মা বুকের সাথে লাগিয়ে রেখেছে কেন!

শীতের মধ্যে মহিষের গোবরের দুর্গন্ধে বেঁচে থাকা নিঃশ্বাসের গন্ধের মধ্যে ছেঁড়া কাঁথার ভেতর যেনতেনভাবে শুয়ে পড়ে সকলে। ফাটা তুলার গাঁঠ এবং পুরনো বিছানার মাঝে টেনে একে অন্যের মধ্যে ঢুকে যেতে শুরু করে যাতে শীত কিছুটা কম লাগে। এই অসহায় অবস্থার মধ্যেও কোনো বাচ্চার সাহস নেই যে উঠে বসে। রসুলন হঙ্গুয়ার ঠ্যাং হ্যাঁচড়ায়, নত্থু মোতীর কোলের ভেতর ঢুকে জ্বালায়। আর কিছু না হোক শবরাতীই টেনে নিয়ে এতই কাতুকুতু দেয় যে দম বেরিয়ে আসে। মা যখন গালাগাল করে কেবল তখনই সে ঘুমায়। রাতের বেলা এমনই বিশৃঙ্খল অবস্থা হয় যে কারো মাথা তো কারো পা। মাঝে মাঝে কারো নিজের শরীরের হুঁশ থাকেনা। পা কোথাও, কথা কোথাও। নিজের শরীর চেনা মুশকিল হয়ে যায়। রাতে কারো লাথি-ঘুষি খেয়ে অথবা এমনিতেই এতগুলো শরীরের দুর্গন্ধে অস্থির হয়ে কোনো বাচ্চা টু শব্দটিও করলে মা ডাইনির মতো চোখ বের করে এমন চিৎকার করে যে ফরিয়াদি ভয় পেয়ে চুপ হয়ে যায় এবং নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে। আর জন্নু তো সবার বড়।

কিন্তু জন্নু খুব ভালভাবেই বুঝে গেছে, বুকে যতই পশম থাকুক আর বগল থেকে যেমন দুর্গন্ধই আসুক মনে একেবারেই ভয় লাগেনা। নর্দমার কীট ময়লার ভেতর আনন্দের সাথে গড়াগড়ি যায়, এ আর এমন কী ব্যাপার!

মা যখন দুপুর বেলা বাচ্চাকে জন্নুর কাছে দিয়ে ধাইয়ের হাতে পেট মালিশ করানোর জন্য কুঠুরির ভেতরে চলে যায় অথবা সখিদের সাথে একান্ত গোপন কথা বলে, সে ভাইকে নিজের কোলে শুইয়ে কি জানি কী ভাবতে থাকে, আর তার ছোট্ট মুখে চুমো খায়। কিন্তু তার গা বমি বমি লাগে, মৃদু মৃদু বাসি দুধের গন্ধ। সে ভাবতে থাকে, ভাই কবে ছয় ফুট লম্বা, চওড়া বাহুওয়ালা জওয়ান হয়ে যাবে। তারপর তার ছোট ছোট গোঁফ এবং বাঁশের মতো মোটা মোটা আঙুল কল্পনা করতে থাকে। সে ভাবতে পারে না, এই গলগলে খামির একসময় কাঠের থাম হয়ে যাবে।

কুয়াতে অর্ধনগ্ন গুণ্ডাদের গোসল করতে দেখে অর্ধমৃত ভাইদের জন্য তার করুণা হয়। তারাও যদি এমন বেড়ে উঠত। এত খায়, তবুও পেট ফুটির মত বেড়ে ওঠে। আর তাও সকালবেলা একদম খালি।

মুহর্রমের সময় শবরাতী ভাই তার বাড়ি চলে যায়। রাতের বেলা বাচ্চারা ধমক খেয়ে আগেই ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু জন্নু পড়ে পড়ে জেগে থাকে, ঘষতে ঘষতে কোনো বাচ্চার সাথে ব্যাকুল হয়ে লেপ্টে যায়।

‘শবরাতী ভাই কবে আসবে মা?’ একদিন সে মাকে জিজ্ঞাসা করে।

‘বৈশাখ মাসে ওর বিয়ে। এখন ও শ্বশুরবাড়িতেই থাকবে।’ মা গম ঝাড়তে ঝাড়তে বলে।

‘আরে!’ ওর কেমন আশ্চর্য লাগে। চাচার বিয়েতে এমন মজা হয়েছে যে বলার মতো নয়। রাতভর গান আর ঢোল। লাল দোপাট্টা কেমন ঠাটের সাথে সে আট দিন পর্যন্ত গায়ে দিয়ে বেড়িয়েছে। শবরাতী ভাই ওকে নিয়ে বেজায় তামাশা করলে সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেঁদেছিল। তারপর সে ভাবতে থাকে, বিয়েতে কোন জামা পরবে। লাল ওড়না তো ঠিক করাই ছিল। কিন্তু বিয়ের তো অনেক দেরী।

কি জানি তার কী হয়েছে। এমনিতে কিছুই নয়, কিন্তু শরীর কেমন এলিয়ে আসে। বাড়ির পেছনের তেঁতুল গাছ না থাকলে ও না খেয়ে মরে যেত। শরীরটা কেমন ভারী ভারী হয়ে থাকে। তার ঝুঁটি ধরে মা ঝাঁকুনি দেয়। কিন্তু সব সময় যেন ঘুম সওয়ার হয়ে থাকে। পানি আনতে গিয়ে কয়েকবার মাথা ঘোরে। আর একবার তো সে পড়েই যায় চৌকাঠের ওপর।

জন্নুর কোমর ঝুঁকে যায়। নিজের পাণ্ডুর চেহারা দেখে তো সে নিজেই ভয় পেয়ে যায়, সে নিশ্চয়ই মরতে বসেছে। কুবড়ী বুড়ি মরার কিছুদিন আগে ধড়াম করে নর্দমায় পড়ে যায়। ব্যাস তারপর হেঁচড়ে হেঁচড়েই ফিরেছে।

‘আরে এই তোর কী হয়েছে ছিনাল?’ তাকে নিস্তেজ দেখে মা জিজ্ঞাসা করে আর তার শরীরে হাত চালিয়ে আন্দাজ করতে চেষ্টা করে। জন্নুর খুব কাতুকুতু লাগে।

‘হারামজাদী! এটা কার?’ মা তার ঝুঁটি ধরে কষে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে।

‘কী?’ জন্নু ভয় পেয়ে বলে।

‘আরে… এইযে…তোর এই পাপ… বাচ্চা জন্ম দিতে চলেছে পোড়ামুখী, হারামখোর।’ মা জন্নুকে বেদম মারে, আড়াই সের ঘি ফেলে দিলেও হয়তো এত মারত না। আর নিজের মাথা কুটতে থাকে।

‘আরে মুর্দাখোর বলবি তো কিছু!’ মা হতাশ হয়ে জন্নুকে আবার পেটাতে শুরু করে। তারপর নাজানি কত সব কথা জিজ্ঞাসা করে। আছেই বা কী?

রাতের বেলা বাবার গালি আর মেরে ফেলবার হুমকি শুনে পেটের সাথে হাঁটু শক্ত করে চেপে ধরে উপুড় হয়ে খাটের ওপর পড়ে থাকে সে। কিন্তু অত্যন্ত বিস্মিত হয় যে বাবা তার সাথে সাথে শবরাতী ভাইকেও হাঁসিয়া দিয়ে কেটে ফেলার হুমকি দিচ্ছিল। বৈশাখ মাসে তো তার বিয়ে হবে, জন্নু লাল দোপাট্টা পরে সেখানে… তার গলা ধরে আসে।

9 মন্তব্যসমূহ

  1. স্যার, আপনার অনুবাদে আর কী মন্তব্য করব! পেয়েছি, এতেই সুখ!

  2. দারুণ সুখপাঠ্য অনুবাদ! মান্টোর দেশভাগ বিষয়ক গল্পের অনুবাদ চাই। শুভকামনা স্যার। ????

  3. স্যার, এক নিশ্বাসে পড়ে ফেললাম গল্পটি। বুঝা মুশকিল এটা অনুবাদ না মূল গল্প। আপনার অনুদিত খোয়াহিশেঁ নাটকটি সম্প্রতি পড়লাম। একেবারে অনবদ্য। হিন্দি এবং উর্দু ভাষার সাথে সেতুবন্ধনের দুরূহ কাজটি আপনি অনেকটা নিরবে করে চলেছেন স্যার। আপনার পথ চলা আমাদের গর্ব। শুভকামনা।

  4. স্যার, এক নিশ্বাসে পড়ে ফেললাম গল্পটি। বুঝা মুশকিল এটা অনুবাদ না মূল গল্প। আপনার অনুদিত খোয়াহিশেঁ নাটকটি সম্প্রতি পড়লাম। একেবারে অনবদ্য। হিন্দি এবং উর্দু ভাষার সাথে সেতুবন্ধনের দুরূহ কাজটি আপনি অনেকটা নিরবে করে চলেছেন স্যার। আপনার পথ চলা আমাদের গর্ব। শুভকামনা।

  5. খুব সুন্দর অনুবাদ। বাংলা গল্প পড়ার স্বাদ পেলাম।

  6. আমি অত্যন্ত গর্ব অনুভব করি তিনি আমার শিক্ষক। গল্পটি যেমন চমৎকার আর তেমনি মনোরম অনুবাদ, পাঠ করে আনন্দিত হলাম। আমার শিক্ষক সফিকুন্নবী সামাদী স্যারের প্রতি শ্রদ্ধা।

  7. অসাধারণ অনুবাদ এবং অবশ‍্যই খুব প্রয়োজনীয় কাজ। সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা এই কথাসাত‍্যিকের সাহসী , বাস্তববাদী, বলিষ্ঠ গল্পগুলির সঙ্গে মাতৃভাষার মাধ‍্যমে পরিচিত হতে পারলে আরো সহজে অথচ তীব্রতার সঙ্গে আত্মস্থ করা যায়। বাংলাদেশে এরকম মূল‍্যবান অনুবাদ কর্ম হয়ে থাকে,এবারও হল, অধ‍্যাপক সফিকুন্নবী সামাদি- সামাদিদাকে বাংলাভাষীদের তরফ থেকে কৃতজ্ঞতা ।

  8. খুব ভাল প্রাণবন্ত গতিমান অনুবাদ। আরো অনুবাদ পড়তে চাই।

  9. বুকে কত পশম। জবজবে ঘামে ডোবা। ‘ভয় লাগেনা?’

    বুকের ঘামে ভেজা পশমের সাথে ভয়ের সম্পর্কটা বুঝে উঠতে পারলাম না। একটু পরিষ্কার করে দিলে কৃতজ্ঞ থাকবো।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here