সাহিত্যে গবেষণা ।। পর্ব ৪

মুহাম্মদ শফিকুল ইসলাম কবি, গবেষক এবং ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক। মূলত ইংরেজিতে লিখে থাকেন। বিশ্বখ্যাত বিভিন্ন গবেষণা-পত্রিকায় তাঁর প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সহজিয়ার জন্য তিনি লিখবেন গবেষণা বিষয়ক ধারাবাহিক গদ্য। আজ প্রকাশিত হলো লেখাটির চতুর্থ পর্ব

 

গবেষকের গুণাবলি

একজন গবেষকের আলাদা করে গুণ থাকার দরকার নেই। তবে তাকে কিছু বিষয় আলাদা করে রপ্ত করতে হবে অথবা কিছু কাজ অন্যদের থেকে ভিন্নভাবে করতে হবে। যেমন ধরুন আপনি যখন গবেষণার কাজটি শুরু করেছেন, তখন নিজেকে গুছিয়ে নিতে হবে। কোনোভাবেই আগের মতো করে সময় কাটাতে পারবেন না। মানসিকভাবেও প্রস্তুতি নিতে হবে। যেমন কীভাবে আপনি অন্যান্য অনেক কাজ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে বেশির ভাগ মনোযোগ গবেষণা আর পড়াশোনার প্রতি দিতে পারবেন। যাহোক আমি এখানে কিছু গুণের কথা উল্লেখ করতে চাই যা পুরোটা আমার ভাবনা থেকে। এর বাইরেও নিশ্চয়ই অনেক আছে, থাকবে। খুব গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি তুলে ধরতে চাই।

 

১। নিয়মানুবর্তিতা/সময়ানুবর্তিতা : গবেষণার কাজটি সময় ও নিয়মের সঙ্গে খুব জোরালোভাবে সম্পৃক্ত। আপনি আগে যেমন বিচ্ছিন্ন চিন্তা করতেন, বিচ্ছিন্নভাবে লিখতেন, গবেষণা শুরু করার পর তা করা যাবে না। আপনার চিন্তা ও কাজ যে বিষয় নিয়ে গবেষণা করছেন সে বিষয়ের মধ্যে স্থির করতে হবে। যে টেক্সট নির্বাচন করেছেন তা ভালোভাবে পড়তে হবে। প্রয়োজনে কয়েকবার পড়তে হবে। তারপর সেখান থেকে যে বিষয়টি নিয়ে কাজ করবেন বলে স্থির করেছেন তা নিয়ে ভাবতে হবে। সময় দিতে হবে। অর্থাৎ সময়কে আপনার অনুকূলে নিয়ে আসতে হবে। সময় আপনার কথা শুনবে, আপনি সময়ের কথা শুনবেন না। নিয়ম করে পড়াশোনা করতে হবে। আপনি পড়ছেন, নোট করছেন, ভাবছেন, লিখছেন এবং এ সবকিছুই করছেন নিয়ম করে, নিয়মিত। পদ্ধতি ও কাজ কীভাবে এগিয়ে নিবেন এ বিষয়ে পরে বিস্তারিত বলব।

 

২। স্থিরতা : গবেষণার কাজে অস্থির হলে চলবে না। আপনার ব্রেইন ও মন ঠান্ডা রাখতে হবে। যেমন ধরুন কোনো বিষয় পড়তে গিয়ে আপনি কিছু একটা বুঝতে পারছেন না বা কিছু বিষয় জটিল মনে হচ্ছে। এমতাবস্থায় একটু সময় নিন বা কারো সাথে শেয়ার করুন। কথা বলুন। কিন্তু অস্থির হয়ে কাজ করা থেকে বিরত হওয়া যাবে না। আবার আপনার লেখা মনমত হচ্ছে না বলে আপনার কাছে মনে হচ্ছে বা প্রকাশ করতে পারছেন না। সেক্ষেত্রে অস্থিরতা আসতে পারে। কিন্তু এমতাবস্থায়ও আপনাকে মানসিকভাবে স্থির থাকতে হবে। মনকে হালকা রাখার চেষ্টা করতে হবে যাতে কাজটি এগিয়ে নিতে পারেন। অন্যথায় গবেষণা ব্যাহত হবার সম্ভাবনা থাকবে।

একটি প্রবন্ধ লেখার পরিকল্পনা থেকে এর প্রকাশিত হওয়ার সময় পর্যন্ত এ বিশাল জার্নির কথা যদি বলি তাহলে এর জন্য অসীম ধৈর্যের প্রয়োজন আছে বলে সবাই একমত হবেন।

৩। অধ্যবসায় : এ গুণটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন গবেষককে অধ্যবসায়ী হতেই হবে। আপনি এক পৃষ্ঠা লেখার আগে শত পৃষ্ঠা পড়ার চিন্তা করুন। এক্ষেত্রে বেঞ্জামিনের একটি কথা মনে পড়ছে। যদিও তিনি কথাটি বলেছেন ক্রিয়িটিভ রাইটিং-এর ব্যাপারে। কিন্তু এখানেও তা প্রযোজ্য বলে আমি মনে করি। তিনি বলেছেন “একটি বই লেখার আগে, একটি পুরো লাইব্রেরি পড়ে শেষ করো।” তিনি লেখা ও পড়ার সমন্বয় কীভাবে করতে হবে বা লেখালেখির জন্য পড়া কত গুরুত্বপূর্ণ তা বলার চেষ্টা করেছেন। আমিও তা বিশ্বাস করি। একটি প্রবন্ধ লেখার জন্য অনেক বই বা প্রবন্ধ পড়তে হবে। প্রাসঙ্গিক বই বা প্রবন্ধ খুঁজতে হবে এবং সংগ্রহ করতে হবে। আর সেগুলো পড়ে পড়ে আপনাকে সমৃদ্ধশালী করতে হবে। অর্থাৎ অধ্যবসায়ী হওয়া ছাড়া আপনি গবেষক হওয়ার চিন্তাও করতে পারবেন না।

 

৪। পরিশ্রম : কঠোর পরিশ্রম করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। পরিশ্রম করার অর্থই হলো প্রচুর সময় ব্যয় করতে হবে এবং পড়তে হবে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আপনি কতটা সময় পড়ার জন্য, কতটা সময় লেখার জন্য ব্যয় করবেন তা ঠিক করে নিতে হবে। এক্ষেত্রে একটা কথা না বললেই নয়, আর তা হলো আপনার প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব বা অন্যান্য কর্তব্য পালন করার পর এ সময় বের করার চেষ্টা করতে হবে। আমি সম্ভবত আগেও বলেছিলাম কীভাবে অন্যান্য কাজ করেও গবেষণার কাজটিও এগিয়ে নেয়া যায়। আবারও বলছি, গবেষণার জন্য সদিচ্ছা, সময়ের সঠিক ব্যবহার আর পরিশ্রমের বিকল্প নেই।

 

৫। ধৈর্যশীলতা : ইংরেজিতে একটা কথা আছে “পেইশন্স ইজ বিটার, বাট ইটস ফ্রুট ইজ সুইট।” ধৈর্য না থাকলে গবেষক হওয়া কঠিন হবে। ধৈর্যের ব্যাপারটি বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। যেমন, একটি প্রবন্ধ লেখার পরিকল্পনা থেকে এর প্রকাশিত হওয়ার সময় পর্যন্ত এ বিশাল জার্নির কথা যদি বলি তাহলে এর জন্য অসীম ধৈর্যের প্রয়োজন আছে বলে সবাই একমত হবেন। লেখার প্রক্রিয়া ও প্রকাশনা নিয়ে যেহেতু বিস্তারিত বলার আছে, আমি সে বিষয় এখনই বলতে চাচ্ছি না। তবে সংক্ষেপে বলি, আপনি একটি মানসম্মত প্রবন্ধ লিখতে কত সময় লাগতে পারে তা অনুমান করতে পারছেন। এখানে টেক্সট পড়া, থিওরি পড়া, ক্রিটিক্যাল প্রবন্ধ পড়া, রেফারেন্স বই পড়া — এসবই সঠিকভাবে করা সম্ভব, যদি আপনি ধৈর্যশীল হতে পারেন। আর প্রচুর সময় ব্যয় করার জন্য প্রস্তুত থাকেন। তাছাড়া একটি মানসম্মত আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশ করতে গেলে আপনাকে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হবে রিভিউ ফিডব্যাক পেতে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাবমিশন থেকে শুরু করে পাবলিকেশন পর্যন্ত দুই থেকে তিন বছর সময় লেগে যায়। কোন শর্টকাট পন্থার ব্যবস্থা নেই। তবে ভাবুন গবেষক হতে হলে আপনাকে কত ধৈর্যশীল হতে হবে। তাছাড়া অন্যান্য বিষয় তো আছেই। যেমন, আপনার প্রবন্ধ সাবমিট করছেন আর রিজেক্টেড হচ্ছেন — এমতাবস্থায় ধৈর্যহারা  হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, ধৈর্যহারা হয়ে গেলে আপনার সামনের চলার পথ আরো কণ্টকাকীর্ণ হবে। সুতরাং ধৈর্যশীল হওয়ার চেষ্টা অব্যাহত থাকতে হবে।

অমর্ত্য সেন তাকে বিষয়টি বুঝাতে পারতেন না তা নয়, বরং তাঁর কাছে মনে হয়েছে ঐ বিষয়ের একজন গবেষক উক্ত ছাত্রকে আরো ভালভাবে বুঝাতে পারবেন। সুতরাং বিনয়-বিবর্জিত গবেষণা পরিত্যাগ করতে হবে।

৬। বিনয় : একজন গবেষক হিসেবে আপনি যতই সফল হোন না কেন, বিনয় না থাকলে আপনার সমস্ত অর্জনের উপর নেতিবাচক প্রভাব পরার সম্ভাবনা থাকবে। মনে রাখবেন একজন মানুষ হিসেবেও বিনয় আপনার শ্রেষ্ঠ গুণগুলোর মধ্যে একটি। আপনি গবেষক হিসেবে যত পরিপক্ব হবেন, আস্তে আস্তে আপনাকে আরো বিনয়ী হতে হবে। একটি ভালো প্রবন্ধ প্রকাশ করার অর্থ হলো আপনাকে আরো এরকম ভালো ভালো প্রবন্ধ প্রকাশ করতে হবে। সেভাবে যদি অনুপ্রাণিত না হয়ে থাকেন আর যদি আপনার মধ্যে অহংকার বাসা বাঁধে, তবে গবেষণার জন্য তা ক্ষতিকর হবে বলে আমার মনে হয়। অনুবাদক, গবেষক ও অধ্যাপক ল্যান্ডার্স একজন সাহিত্যের অনুবাদকের গুণাবলি আলোচনা করতে গিয়ে বিনয়কে সর্বাগ্রে রেখেছেন। আমার কাছে একজন গবেষককেও যা যা অর্জন করতে হয় তার মধ্যে বিনয় খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। আমার জানা মতে ভালো গবেষকগণ বিনয়ী হয়ে থাকেন।

 

একবার নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের কাছে একজন ছাত্র একটি বিষয় জানতে গিয়েছিলেন। তার প্রশ্নটি করার পর অধ্যাপক সেন বলেন তিনি দু’ভাবে তাকে সহযোগিতা করতে পারেন। এক. তিনি তার প্রশ্নের উত্তরটি জানেন না। আর দুই. তিনি ঐ বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপককে রেফার করতে পারেন, যিনি এ বিষয়ে তাকে আলোকিত করতে পারেন। এখান থেকে একটা শিক্ষা নেয়া যেতে পারে। আর তা হলো বিনয়। অমর্ত্য সেন তাকে বিষয়টি বুঝাতে পারতেন না তা নয়, বরং তাঁর কাছে মনে হয়েছে ঐ বিষয়ের একজন গবেষক উক্ত ছাত্রকে আরো ভালভাবে বুঝাতে পারবেন। সুতরাং বিনয়-বিবর্জিত গবেষণা পরিত্যাগ করতে হবে।

 

গবেষক হিসেবে আরো অনেক গুণ অর্জন করা আবশ্যক। কিন্তু  এখানে যে বিষয়গুলো আলোকপাত করা হলো সেগুলো একজনের মধ্যে থাকলে গবেষণার কাজটি সুন্দরভাবে পরিচালনা করা যাবে বলে আমি বিশ্বাস করি। পরবর্তি পর্বে একজন গবেষককে কোন কোন দক্ষতা অর্জন করতে হবে তা আলোচনা করব।

(চলবে)

 

পড়ুন ।। কিস্তি : ৩

সাহিত্যে গবেষণা ।। পর্ব ৩

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here